হঠাৎ বৃষ্টি পর্ব-০৬

0
835

#হঠাৎ_বৃষ্টি
জান্নাতুল নাঈমা
পর্বঃ৬

মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। চারদিকে বৃষ্টির পূর্বাবাস। আকাশ ভেঙ্গে যে কোনো সময়ই বৃষ্টি পড়বে। অনেকে বৃষ্টিতে আশাহত আবার অনেকে খুশি। কেউ বা বৃষ্টিতে ভেজার উল্লাসে মেতে উঠছে। হরেক রকম মানুষের হরেক রকম মনোভাব। এর মাঝেই মেঘ তার একান্ত ব্যক্তিগত ‘বৃষ্টিকণ্যার’ কাছে ছুটছে। তাকে এক পলক দেখার জন্য যে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রিকশাচালককে বিরতিহীন ভাবে তাড়া দিয়ে চলেছে যাওয়ার জন্য। রিকশাচালক হয়তো বেজায় বিরক্ত হচ্ছে কিন্ত কয়টা টাকার জন্য মুখ ফুটে বলতেও পারছে না। পথটা মেঘের কাছে অনেক দীর্ঘ ঠেকছে। শুভ্রতার সাথে দেখা হওয়ার প্রতিটা সময় তার বুকের ভেতর ভীষণ কম্পণ অনুভব করে। উত্তেজনা হয় খুব। কিন্ত অপরদিকের মেয়েটা কি তা বুঝে? কে জানে? হয়তো বুঝেও অবুঝের মতো থাকে। তাও যে মেয়েটাকে তার চাই এ চাই। অবশেষে মেঘের প্রতিক্ষার পরিসমাপ্তি হলো। চলে এলো বৃষ্টিকণ্যার ধারে। চটজলদি রিকশা থেকে নেমে রিকশাচালকের হাতে একশত টাকার নোট দিয়ে বলে,,’পুরোটা রাখেন।’ কথাটা বলে কাল বিলম্ব করলো না ছুটে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো। রিকশাচালক হাতের টাকার দিকে তাকিয়ে হাসে। হয়তো আজ বাসায় একটু বেশী কিছু নিয়ে যেতে পারবে! ছুটে গেলো আপন রাস্তায়।

‘আমি জন্মেছিলা এক বিষণ্ম বর্ষায়
কিন্ত আমার প্রিয় ঋতু বসন্ত।
আমি জন্মেছিলাম এক আষাঢ় সকালে
কিন্ত ভালোবাসি চৈত্রের বিকেল।

মেসে থাকা সিটে হেলান দিয়ে কবি নির্মুলেন্দু গুণের কবিতাটি হেলান দিয়ে বলছে শুভ্রতা। সারাদিন ইংরেজি ইতিহাস, সেক্সপিয়ার পড়তে পড়তে ক্লান্ত সে। তাই আজ নিজের সাবজেক্ট এর বাইরে গিয়ে কিছু করার কথা মাথায় আসছে। তাছাড়াও বাইরে বৃষ্টি আসবে মনে হচ্ছে। শুভ্রতার কাছে কবিতা আবৃত্তি করাটাই শ্রেয় মনে হচ্ছে। কিন্ত তার কাজে ব্যাঘ্রা দেওয়ার জন্য মেঘ হাজির। শুভ্রতাদের মেসটা ঠিক আর পাঁচটা মেসের মতো না। বাসার সাথে এডজাস্ট করা রুম। তিনজন মিলেই থাকে। দরজার ওপাশে ঠকঠক আওয়াজ আসছে। শুভ্রতা ছাড়া আপাদত কেউ নেই। তানিয়া বাইরে সাথে অন্য মেয়েটিও বাইরে। শুভ্রতা ওদের মধ্যে কেউ ভেবে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। দরজা খুলে আবারও নিজের জায়গায় বসে পড়লো। দরজার দিকে তাকালো না কে এসেছে। ওইদিকে মেঘ শুভ্রতার কান্ডে ভড়কে গেলো। মেয়েটা একটিবার চাইলো নাহ! এখন যদি সে না হয় অন্য কেউ বা চোর ডাকাত হতো! তাহলে কি করতো? মেঘ মনে মনে শুভ্রতাকে ভয় দেখানোর ফন্দি আটলো। পা টিপে টিপে শুভ্রতার পাশে এগিয়ে গেলো। শুভ্রতা কবিতাতে মনোনিবেশ করেছে।

‘ভাউউউউউ!’ মেঘ জোরে আওয়াজ করে উঠলো। শুভ্রতা ভয়ে হাত থেকে বইটা ছিটকে পড়ে গেলো। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে মেঘ দাঁড়িয়ে আছে। ভয় কেটে মুখে অবাক স্থান নিলো। মেঘ মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে আছে।
‘আমি নিশ্চয়ই আবার হ্যালুচুলেশন করছি। মাথা আমার গেছে। উঠতে বসতে ওই তার কাটা বদ লোককেই দেখি!’ শুভ্রতার কথায় মেঘের ভ্রু কুঁচকে এলো। এই মেয়ে তাকে কল্পনা করছে। অথচ সে স্ব-শরীরে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘ শুভ্রতার হাতে জোরে একটা চিমটি কেটে বলে,,’এই যে মিস! আমি কল্পনায় না বাস্তবে আপনার সামনে! আর আমি বদ লোক? তারচেয়েও বড় কথা তুমি আমায় কল্পনা করো? কেনো? সামথিং স্পেশাল হুম?’ মেঘ দাঁত কেলিয়ে হাসলো। শুভ্রতা তা দেখে ভ্যাংচি কেটে বলে,,’নাথিং স্পেশাল! হু। আর আপনি এইরকম দাঁত কেলিয়ে কি প্রমাণ করতে চান? আপনি দাঁত ব্রাশ করেন আমরা করি না?’
শুভ্রতার কথায় মেঘের মুখ আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গেলো। এই মেয়েটা সবসময় মুখের উপর কথা বলে দেয়। যার জন্য মেঘের প্রেস্টিজ পাংচার হয়ে যায়! মেঘ মনে মনে ডিসাইড করে নিয়েছে। সে আর দাঁত কেলিয়ে হাসবে নাহ! কোনোদিন না! বৃষ্টিকণ্যা যদি বলে তার দাঁত দেখতে ইচ্ছে করছে তাও হাসবে নাহ হু। শুভ্রতার এতোক্ষণে টনক নড়লো যে মেঘ তার রুমে আছে। বাই এনি চান্স বাড়িওয়ালা বা অন্য কেউ দেখবে সর্বনাশ হয়ে যাবে। শুভ্রতা মেঘকে তাড়া দিয়ে বলে,,’এই বেরুন আপনি! এক্ষুণি বেরুন। কেউ দেখলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। গিয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়ান। যান।’
মেঘেরও মনে হলো এইভাবে একটা মেয়ের বাসায় দাঁড়িয়ে থাকা উচিৎ নাহ। সে কাল বিলম্ব না করে বেরিয়ে গেলো। শুভ্রতা পিছুপিছু বাসায় তালা দিয়ে বেরিয়ে গেলো।
________________

‘আপনি তো আলাদিনের জিনির থেকেও ফাস্ট। যখন তখন যেখানে সেখানে উদয় হন।’ মেঘ আর শুভ্রতা রাস্তা দিয়ে হাটতে হাটতে শুভ্রতা কথাটি বলে।
‘রনে-বনে,জলে-জঙ্গলে যেখানে আমার দেখা চাইবে তোমার ওই আলাদিনের জিনির মতো পৌঁছে যাবো।’ মেঘের কথায় শুভ্রতা জোরে হেসে দিলো। মেঘের এখন দাঁত কেলাতে ইচ্ছে করছে কিন্ত সে কেলাবে না হু।
‘তো আমি তো একটু আগে চাই নি। আপনি উদয় হলেন কেনো?’ শুভ্রতার কথায় মেঘের পা থেমে গেলো। মেঘকে দাঁড়াতে দেখে শুভ্রতাও দাঁড়িয়ে গেলো। মেঘ শুভ্রতার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,,’আমি চেয়েছি তাই।’
মেঘের চোখের ভাষা শুভ্রতার কাছে স্পষ্ট। কিন্ত আপাদত তা প্রশ্রয় দিতে চাইছে না। কথা ঘুরানোর জন্য বলে,,’মেয়ে দেখা শেষ?’
‘হু! আমি চলে এসেছি। ওরা এখনও ওদের বাসায়।’ দুজনে আবার হাটতে শুরু করে।
‘ওহ! আচ্ছা বাসায় কে কে আছে আপনার?’
‘আম্মু,আব্বু আর ছোট বোন মেঘলা। ও এবার ক্লাস টেইনে পড়ে। আব্বু রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। আমাদের মেইন বাসা চট্রগ্রাম। আব্বুর পোস্টিং এর জন্য ঢাকায় থাকা পড়েছিলো। বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছিলাম। এভাবে তো পড়া হয় না। তাই আমি অনার্স থেকে ঢাকায় একাই থাকি । আব্বু রিটায়ার্ড এর পর ওরা চট্রগ্রাম শিফট হয়ে যায়। এই আরকি।’
শুভ্রতা এতোক্ষণ মন দিয়ে মেঘের কথা শুনছিলো। তারপর বলে,,’মিস করেন না ওদের?’
‘হুম করি তো।’
‘জানেন আমিও আমার বাবা-মা ভাইকে অনেক মিস করি। কিন্ত আমি চাইলেও ওদের দেখতে যেতে পারি না,পারব নাহ।’ শুভ্রতা খানিকটা আবেগী হয়ে কথাটা বলে।
‘তোমরা ওই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কোনো স্টেপ নাও না কেনো?’
‘আসলে গ্রামের কেউ চেয়ারম্যানের সাথে ঝামেলায় জড়াতে রাজি নাহ। ওদের অনেক ক্ষমতা।’ মেঘ বুঝলো শুভ্রতার মন খারাপ হচ্ছে তাই কথা ঘুরানোর জন্য বলে,,’এই দেখো আকাশ কিরকম অন্ধকার হয়ে আসছে। যখন তখন বৃষ্টি নামবে। চলো তোমায় বাসায় ফিরিয়ে দিয়ে আসি।’
‘নাহ। আসুক। আমার ভালো লাগছে। বৃষ্টিতে ভিজবো আজ।’ শুভ্রতা মেঘের কথাকে পাত্তা না দিয়ে বলে। কিছুদূর থেকে ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করলো।
_____________________

আকাশ জুড়ে তুমুল বর্ষণ চলছে। মেঘের বৃষ্টিকণ্যার বৃষ্টিতে ভেজার আবদার হয়তো আকাশ মেনে নিয়েছে। নিজের স্বর্বস্ব ঢেলে দিচ্ছে। খোলা মাঠের এক প্রান্তে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে মেঘ। আর একটু দূরে বৃষ্টির তালে তাল মেলাচ্ছে তার মণহরণী তার বৃষ্টিকণ্যা। মেঘ কি করে তার আবদার পেলে। বৃষ্টিতে ভিজলে তার সমস্যা হয় জেনেও সে আজ বৃষ্টিতে ভিজবে। প্রচুর ভিজবে।
‘শুভ্র! অনেক ভিজেছো। ঠান্ডা লাগবে চলো!’ মেঘ খানিকটা চিল্লিয়ে বলে। শুভ্রতার কান অবধি সে কথা যায় না। মেঘের হঠ্যাৎ প্রথম দিনের কথা মনে পড়লো। এইভাবেই ভিজেছিলো শুভ্রতা কিন্ত সেদিন অসহায়ত্ব ছিলো আর আজ উল্লাসে। মেঘ প্রথম দিনের কথাগুলো চোখ বন্ধ করে ভাবতে শুরু করে। হঠ্যাৎ কারো শীতল স্পর্শে ধ্যান ভাঙ্গে। চোখ খুলে দেখে শুভ্রতা তার হাত ধরেছে। মেঘ একবার হাতের দিকে আবার শুভ্রতার মুখের দিকে তাকায়। এই প্রথম শুভ্রতা স্বেচ্ছায় তার হাত ধরেছে। বাইকে কাঁধে হাত দিয়েছিলো। মেঘ শুভ্রতার দেওয়া দ্বিতীয় স্পর্শটা ফিল করতে চাইছে।
‘প্লিজ বৃষ্টি থেমে যাও। স্পর্শটা লেগে থাকুক।’ কিন্ত বৃষ্টি কি শুনার পাত্র? মেঘের মনের কথা সে শুনবে না ভেবে পণ করেছে।
‘আসুন মেঘ। একসাথে ভিজি।’ শুভ্রতা মেঘের একহাত টেনে বলে। মেঘ শুভ্রতার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টিতে চুলগুলো লেপ্টে গেছে। মুখটা খানিক উজ্জ্বল লাগছে,চোখ লাল হয়ে আছে,সেদিনের মতো লাগছে কিন্ত সেদিন সাজ ছিলো আজ একেবারে সাজবিহীন। শুভ্রতা টেনে নিয়ে আবারও ভিজতে লাগলো। আর মেঘের দৃষ্টি শুভ্রতার মুখের চঞ্চলা হাসিতে নিবদ্ধ।

#চলবে?

(ভূল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন। ধন্যবাদ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে