হঠাৎ বৃষ্টি পর্ব-০৩

0
963

#হঠাৎ_বৃষ্টি
জান্নাতুল নাঈমা
পর্বঃ৩

বাইরে মৃদুমন্ধ হাওয়া বইছে। সময়টা এখন বিকেলের শেষভাগ। কিন্ত তা ঢাকার ব্যস্ত নগরীর দিকে তাকিয়ে বুঝা দায়। এখানে প্রতিনিয়ত মানুষের ভীড়। কেউ জীবনের তাগিদে,কেউ আবার বেড়াতে বেরিয়েছে। হরেক রকমের মানুষ। প্রকৃতি থেকে বেরিয়ে কোলাহল পূর্ণ রাস্তায় হাটা ধরলো দুজন মানব মানবী মেঘ আর শুভ্রতা। দুজনে পাশাপাশি হাটছে কিন্ত দুজনের মাঝেই বিস্তর পার্থক্য। দুজনের মনে কি চলছে সেটা তারা কেউই জানে না। তখন জারুল গাছটা লাগানো শেষ করে শুভ্রতা ফিরে আসতে নেয়। মেঘও তখন দু একটা কথা বলতে বলতে তার সাথে আসে। মূলত শুভ্রতার প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা মেঘকে মুগ্ধ করেছে। যেখানে আমরা প্রতিনিয়ত প্রকৃতিকে ধ্বংস করতে ব্যস্ত। শুভ্রতা অবশ্য এই ব্যাপারে মেঘকে চমৎকার একটা উত্তর দিয়েছিলো।
‘দেখুন মেঘ! মানুষ নিজেদের জীবনের জীবিকার টানেই কিন্ত প্রকৃতি ধ্বংস করে। যেমন ধরুন,আমরা যে জায়গায় থাকি বা বসবাস করি সেখানের গাছপালা কেটেই আমরা ঘর বাড়ি তৈরি করি। আবার যারা বনের গাছ কেটে নষ্ট করে তারাও কিন্ত কাঠ বিক্রি করে নিজের পেট চালায়। তবে এখানে তাদের অন্যায় হচ্ছে তারা নির্বিকারে কেটে নষ্ট করে। তারা লোভী। প্রয়োজন ছাড়াই নষ্ট করে। এইক্ষেত্রে আইনি পদক্ষেপ থাকলেও তা নির্মূল করা সম্ভব হয় নি। এই যে আমরা বাসায় এতো আসবাবপত্র রাখি এগুলো বেশিরভাগই কাঠের। তাহলে কি আমরাও গাছপালা নষ্ট করছি? হ্যাঁ করছি। কিন্ত সেটা আমাদের প্রয়োজনে। এইক্ষেত্রে আমাদের করনীয় বেশী করে গাছ লাগানো। আমি যখন স্কুলে পড়তাম তখন আমার একজন শিক্ষক আমাদের বলেছিলেন তোমাদের জন্মদিনে তোমরা একটা করে গাছ লাগাবে। তোমরা বড় হওয়ার সাথে সাথে গাছটাও বড় হবে। একসময় সেটি তোমাদের প্রয়োজন মেটাবে! তাই আমাদের উচিৎ গাছ লাগানো।’ শুভ্রতার কথাগুলো মেঘ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলো। সে প্রকৃতিকে ভালোবাসে কিন্ত শুভ্রতার মতো করে নাহ। ভালো লাগে দেখতে এইটুকুই কিন্ত তাকে আরো সুন্দর করার মতো কোনো উদ্যোগ নেয় নাহ। মেঘ একমনেই শুভ্রতাকে দেখতে দেখতে হেটে চলছে। সে বারংবার এই মেয়েটাতে মুগ্ধ হয়ে পড়ে।
‘শুভ্র!’ মেঘের কন্ঠে ‘শুভ্র’ ডাকটা শুনে কেমন চমকে উঠলো শুভ্রতা। মেঘের কন্ঠে শুভ্র নামটা যেনো একটু মিষ্টিই ঠেকছে। নামটা ভালো লাগছে নাকি মেঘের কন্ঠটাই মিষ্টি বুঝে উঠতে পারলো না শুভ্রতা। নিজের হাটা থামিয়ে পাশে তাকালো। কিন্ত মেঘ পাশে নেই দেখে পেছন ফিরলো একটু দূরে মেঘ একটা কাঠগোলাপ গাছের চারা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্ত মেঘ এটা নিলো কখন? সে একটুও টের পেলো নাহ? এটা সম্ভব?
শুভ্রতার ভাবনার মাঝে মেঘ শুভ্রতার দিকে চারাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে,,’,শুভ্র নিন!’ শুভ্রতার কেমন জানি অস্বস্তি হচ্ছে। কয়দিনের আলাপের একজন মানুষের থেকে ফুলের চারা নেওয়া কি আদৌ ঠিক হবে? শুভ্রতার অস্বস্তি হয়তো মেঘ বুঝলো। হাত গুটিয়ে বলে,,’সমস্যা নেই নিন। আমি খারাপ কিছু মিন করে আপনাকে এটা দিই নি। আপনাকে যতটুকু বুঝলাম আপনি একেবারে নিখাঁদ একজন প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ। তাই এটা আপনাকে দিচ্ছি আর কিছু নাহ।’ মেঘের কথায় শুভ্রতা স্বস্তির শ্বাস ফেললো। আলতো হাতে চারাটা নিলো। চারাটা খুব বড় নাহ। কিন্ত খুব সুন্দর। শুভ্রতার খুব ভালো লাগলো।
‘আমি চাইলে আপনাকে ফুল দিতে পারতাম শুভ্র! কিন্ত নাহ আমি চারা দিলাম। কারণ,ফুল দিলে একসময় সেটা শুকিয়ে যাবে। ফেলে দিবেন৷ কিন্ত চারাটা আপনি যত্ন করে লাগাবেন। বড় করবেন। ভালোবাসবেন। যেটা আপনাকে আমার কথা মনে করিয়ে দিবে। গাছ বেড়ে উঠার সাথে সাথে আপনার প্রতি আমার ভালোবাসাটাও বেড়ে উঠবে শুভ্র!” শুভ্রতার হাস্যজ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে কথাগুলো বলে মেঘ।

‘কিন্ত এটা কিনলেন কখন? আমি টের ফেলাম না! নাকি আপনি আলাদিনের জিনি ম্যাজিক করে নিয়ে এসেছেন?’ কথাটা বলে শুভ্রতা নিজেই হেসে দিলো। শুভ্রতার সাথে তাল মিলিয়ে মেঘও একগাল হাসলো। এই কয়দিনের মধ্যে শুভ্রতা আজ মেঘের দিকে ভালোভাবে নজর দিলো। বেশ লম্বা মেঘ,বডি আর পাঁচটা সাধারণ মানুষেরই মতো,গায়ের রঙ শ্যামবর্ণ, নাকের ঠিক মাথায় একটা তিল, যেটাতে তার চেহারার সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলে। আর হাসলে একপাশের ট্যারা দাঁত দেখা যায়।
‘না আমি কোনো জিনি নাহ। ম্যাজিকও জানি নাহ। আসলে আপনি তখন সামনের দিকে তাকিয়ে একমনে হাটছিলেন। মাঝে যে ফুলের চারা বিক্রেতা ছিলো খেয়াল করেন নি। আমি সেখান থেকেই নিয়েছিলাম।’
মেঘের কথায় শুভ্রতার ধ্যান ভাঙ্গে। মনে মনে নিজেকে শ’খানেক গালি দিয়ে বলে,,’ছিহঃ শুভ্রতা। তুই এইভাবে একজন ছেলেকে দেখছিলি? লজ্জা নেই তোর? শেইম অন ইউ শুভ্রতা!’ শুভ্রতা মেঘের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি হাসলো। মেঘও হাসলো। তারপর দুজন আবারও ব্যস্ত নগরীতে হাটা দিলো। আঁড়চোখে বারবার দুজনের চোখাচোখি হলো। তবে কি শুরু হবে প্রেমের সুত্রপাত?
____________________

‘আচ্ছা আমি এখন যাই। ভালো থাকবেন?’ একটা বাড়ির সামনে এসে কথাটা বলে শুভ্রতা। মেঘের ইচ্ছে করছে না শুভ্রতাকে যেতে দিতে কিন্ত তাও যেতে তো হবেই। তাই মাথা নাড়িয়ে বলে,,’আচ্ছা।’
‘থ্যাংস।’ শুভ্রতার কথায় মেঘ ভ্রু কুঁচকে বলে,,’ফর হোয়াট?’ শুভ্রতা নিজের হাতের দিকে ইশারা করে। মেঘ গাছের কথা বুঝে হাসে। তারপর বলে,,’মাই প্লেজার।’
‘বায়।’ বলে শুভ্রতা ভেতরে প্রবেশ করে। মেঘ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায় নিজের গন্তব্যে। আজকের দিনটা মেঘের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আজকে তার বৃষ্টিকণ্যার সাথে সে এতটা ভালো সময় কাটিয়েছে। আর ঠিক করেছে এবার থেকে পুরো বাড়ি সে সবুজে ভরিয়ে তুলবে। তাই সোজা ঘর সাজানোর জিনিসপত্রের দোকানে চলে গেলো।
_________________

‘কিরে মা কি খবর তোর?’ ফোনের ওপাশ থেকে মমতা ভরা কন্ঠে শুভ্রতার মা কথাটা বলে। এতোদিন পর নিজের মায়ের গলা শুনে শুভ্রতা আবেগ ধরে রাখতে পারলো নাহ। কেঁদে দিলো।
‘আমি ঠিক আছি আম্মু। তোমরা কেমন আছো? বাবা? বাবা কই? ভাই কই? তোমরা ঠিক আছো তো? ওই চেয়ারম্যান তোমাদের ক্ষতি করে নি তো?’

‘না রে আমরা ঠিক আছি। চেয়ারম্যান কেমন যেনো শান্ত হয়ে গেছে। ওর পোলারেও গ্রামে দেখি নাহ। এই যেনো ঝড়ের পূর্বাবাস। মারে তুই সাবধানে থাকিস। আর গ্রামে ভুলেও আসবি নাহ। তোর আব্বু কিছু ব্যবস্থা করতে পারলে আমরাও গ্রাম ছাইড়া চইলা যামু অন্য কোথাও।’

‘আমার জন্য তোমাদের অনেক কষ্ট তাই না আম্মু?’
‘কি কস এইগুলা। তুই আমাদের কতো আদরের মাইয়া। তুই পড়ালেখা কইরা অনেক বড় হইবি। আমাদের শহরে নিবি। তোর ভাইরে দেইখা রাখবি। তুই তো আমাদের সব। আর গ্রামের কথা তুই মাথা থেকে ঝাইড়া ফালাই দে। আমরা আছি এইদিক সামলানের লাইগা। তুই ভালো থাকিস। মন দিয়া পড়ালেখা কর।’
তারপর মায়ের সাথে আরো অনেক কথা বলে ফোন রাখে শুভ্রতা।
‘আমার সাথে এইরকম কেন হলো। আল্লাহ তুমি যা করো ভালোর জন্যই। শুধু আমার মা-বাবা ভাইকে ভালো রেখো। কিন্ত আমাকে এখন একটা কাজ খুঁজে বের করতে হবে। এইভাবে আর চলবে না। কাল তোহ ক্লাস নেই। কাল থেকেই ট্রাই করবো।’,আপনমনে কথাগুলো বলে শুভ্রতা লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো।
______________________

শুভ্রতাদের ক্লাস শুরু হয় সাড়ে নয়টা থেকে। সে অনুযায়ী মেঘ আজ তাড়াতাড়ি উঠে রেডি হয়ে নিলো। কাল শুভ্রতাকে যে জায়গায় ছেড়েছিলো বাইক নিয়ে সেখানে বেরিয়ে গেলো। কিন্ত শুভ্রতার দেখা ফেলো না। মেঘ সাড়ে দশটা অবধি আশেপাশে বসে রইলো কিন্ত নাহ কারো দেখা নেই। মেঘ এবার বাইক ঘুরিয়ে ভার্সিটিতে গেলো। সেখানেও শুভ্রতার কোনো বন্ধু বান্ধবের দেখা মেলে নি। খোঁজ নিয়ে দেখলো আজ তাদের ক্লাস নেই। মেঘের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। কিন্ত শুভ্রতাকে একপলক না দেখলে শান্তি মিলছে না। আবারও ওই বাসার সামনে গেলো। যাবে কি যাবে না ভেবে বাইক থেকে নেমে গেলো। বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে না জানি শুভ্রতা কি ভাববে। মনে মনে আল্লাহ আল্লাহ করে মেঘ বাসার সামনে যায়। একতলা একটা বাড়ি। মেঘ কলিংবেল বাজায়। তখনই…

#চলবে?

(ভূল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন। ধন্যবাদ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে