#স্যার
#পর্ব_২৫
লেখনীতে — আফরোজা আক্তার
সময় খুব দ্রুত বয়ে যায়। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে কেউ চলতে পারে না। কিংবা সময়ও কাহারো জন্য অপেক্ষা করে না। সময় তার নিজস্ব গতিতে ছুটে চলে।
এই সময়ই এক সময় দুটো মানুষকে আলাদা করে দিলো, যাদের মধ্যে ভালোবাসা ছিলো প্রবল। যদিও সেই ভালোবাসা ছিলো এক পাক্ষিক।
আবার এই সময়ই দীর্ঘ দুই বছর পর আবার তাদের দেখা করিয়ে দিলো। সময়ের এই উজান ভাটায় মানুষের জীবন প্রবাহিত হতে থাকে কোনো এক অজানা গন্তব্যে।
ফায়াজকে তার অনিশ্চিত ক্যারিয়ারের জন্য ভালোবাসার মানুষ হারাতে হয়েছে। নিজের ক্যারিয়ার গোছাতে গিয়ে যে তাকে খুব ভালোবেসেছে তাকে নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
রুশা, তার অবুঝ মনে ভালোবাসার অনুভূতি ধারণ করে তার স্যারকে আপন ভেবে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করে বার বার রিফিউজ হয়েছে। এক পর্যায়ে পরিস্থিতির সাথে পেরে উঠতে পারেনি আর। তখনই নিজেকে ধীরে ধীরে একটু একটু করে সামলে নিলো সে।
ভাগ্য বড়ই আজব জিনিস। কপালের লিখন যায় না খন্ডন। কপালে যা থাকবে তাই হয়ে যায়। শত চেষ্টা করেও কেউ সেইটা মুছতে পারে না। যার সাথে যার মিলন লিখা হয়ে থাকে শুধু দুই বছর কেন বহু বছর পরেও সে আসবে। আসবেই, আর এটাই সত্য। এটাই বাস্তব।
হাতে হাত রেখে পাশাপাশি হেঁটে চলছে রুশা আর ফায়াজ। রুশার পরনে সাদা রঙের শাড়ি। আর ফায়াজের পরনে সাদা রঙের পাঞ্জাবি। দু’জনকেই অপূর্ব লাগছে। এক কথায় অসাধারণ। রুশার স্বপ্ন সত্যি হলো। কথায় আছে, স্বপ্ন শুধু দেখলেই হয় না। স্বপ্নকে বাস্তবায়নও করতে হয়। আর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে নিজের প্রতি নিজের দৃঢ় আত্মবিশ্বাস রাখা লাগে। এবার সেই স্বপ্ন যা কিছু নিয়েই হোক না কেন। তবে রুশা শুধু স্বপ্ন দেখেছিলো। বাস্তবায়ন করার আগেই সেই স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছিলো তার।
ওইযে বলেছিলাম না, কপালের লিখন যায় না খন্ডন। কপালে যা থাকে, ঘুরেফিরে তাই জীবনে চলে আসে। রুশার ভেঙে যাওয়া স্বপ্নও তার জীবনে চলে এসেছে।
গত তিন দিন আগে পারিবারিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রুশা এবং ফায়াজ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। রুশার বাবা আশরাফ প্রথমে না করেন। তিনি এই ছেলের কাছে কিছুতেই মেয়েকে দিবেন না যার জন্য তার মেয়ে গত দুটো বছর এত কষ্টে ছিলো।
নাসরিন যখন মেয়ের বিয়ের কথা তুলেছেন তখনই তার প্রথম প্রশ্ন ছিলো ছেলে কী করে?
নাসরিন আমতা আমতা করে যেই না ফায়াজের কথা বললেন ওমনি তিনি গর্জে উঠলেন।
“অসম্ভব। এই ছেলে শত লেকচারার হোক। এই ছেলে আমার মেয়েকে বহু কষ্ট দিয়েছে। আমি নেহাৎই শান্ত মানুষ। নয়তো আমার মেয়েকে কাঁদানোর জন্য এই ছেলেকে আমি শুলে চড়াতাম।”
“আহা! তুমি রেগে গেলে কীভাবে হবে, বলো তো?”
“শোন নাসরিন, আমার একটা মাত্র মেয়ে। আমার কী মেয়ে কী হয়ে গেছে। দেখেছো তুমি?”
“দেখেছি। তুমি বাবা আমি মা। তুমি কতক্ষণই বা বাসায় থাকো। আমি তো মেয়েকে সর্বক্ষণই দেখেছি।”
“তাহলে, তুমি কোন যুক্তিতে এই বিয়ের কথা বলো?”
“দেখো, আবেগ দিয়ে আমরা সবাই চিন্তা করতে পারি। কিন্তু বাস্তবতা দিয়ে চিন্তা করলে বোঝা যায় আসলে পরিস্থিতি কতটা কঠিন।”
“মানে?”
“মানে, আগে যা হয়েছে তা হয়েছে। সব ভুলে নতুন করে এগিয়ে যাওয়াটাই উত্তম সিদ্ধান্ত।”
“কী বলতে চাচ্ছো? ক্লিয়ার করে বলো তো।”
“রুশাও চায় এই বিয়েটা হোক।”
“রুশাও চায়? কীভাবে কী?”
“তাছাড়া, রুশার চেয়ে ফায়াজই বেশি করে চাচ্ছে রুশাকে বিয়ে করতে।”
“দু বছর পর আমার মেয়ে কি কোনো সেলিব্রিটি হয়ে গেল নাকি যে সে নিজ থেকে চায় এখন।”
“আশরাফ, কী সব যে বলো না তুমি।”
“ঠিকই তো বললাম।”
“এখন আর এসব ভেবো না। ছেলেটাও যথেষ্ট কর্মিক। ভার্সিটির লেকচারার। পরিবারও ভালো। চেনা পরিচিত। সমস্যা হবে না। সুখ দুঃখ তো আল্লাহর হাতে। তাই না?”
“আমি একবার রুশার সাথে কথা বলতে চাই। আমার গুমোট হয়ে যাওয়া মেয়েটা কি এখনো গুমোট হয়েই আছে? নাকি এখন সে আগের মতোই হাসে।”
“আগের মতো হয়তো আর হবে না। তবে যেটুকু স্বাভাবিক হয়েছে সেইভাবেই যাতে সারাজীবন থাকতে পারে আমরা বাবা-মা এইটুকুন তো করতে পারি।”
“ডাকো রুশাকে। আমি কথা বলি।”
মেয়েকে ডেকে পাশে বসান আশরাফ। মেয়েকে একটার পর একটা প্রশ্ন করতে থাকেন। সব প্রশ্নের শেষে জবাবে রুশা শুধু একটা কথা-ই বলে,
“আমি জীবনকে আরেকটা সুযোগ দিতে চাই আব্বু। জীবন আমায় অনেক কাঁদিয়েছে। এবার জীবনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একটু হাসতে চাই আব্বু। একটু হাসতে চাই এবার।”
আশরাফ মেয়ের একটা কথাতেই মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নেন।
“তুই বড় স্বার্থপর হয়ে গেছিস। তুই এখন আর বাবার কাছে আসিস না।”
“কষ্ট গুলো আমায় স্বার্থপর করে দিয়েছে আব্বু। কিছুই করার ছিলো না।”
“তুই যেভাবে সুখে থাকতে পারিস, ভালো থাকতে পারিস। এতেই আমরা খুশি।”
কিছুক্ষণ পর আশরাফ আবার বলেন,
“হ্যাঁ রে মা। বিয়ের পর তো আরেক ঝামেলা হবে।”
“কেমন ঝামেলা?”
“তখন সবাই হাসাহাসি করবে না! বলবে, জামাই লেকচারার আর বউ তারই স্টুডেন্ট।”
আশরাফ সাহেবের কথায় নাসরিনও হাসেন সাথে রুশাও হাসে। আর রাইসুল, সে তো মহা খুশি। তার আপুর বিয়ে হবে৷ তার একটা ভাইয়া হবে। সে আগেই বলে দিয়েছে — আমি কিন্তু দুলাভাই ডাকবো না, আমি ভাইয়া ডাকবো।
পারিবারিক ভাবেই দু’জনের বিয়ে সম্পন্ন হয়। সবাইকে নিমন্ত্রণ জানানো হয়। ওহ হ্যাঁ, একটা কথা তো বলা-ই হয়নি। ফুয়াদ আস্তে আস্তে রুশার ভালোবাসা থেকে বের হয়ে গেছে। রুশার খুশিতে সেও ভীষণ খুশি। রিমি একটু একটু করে ফুয়াদিকে সামলে নিচ্ছে। নিজের প্রতি রিমির এত উদারতা, এত সহমর্মিতা সব কিছু দেখে ফুয়াদের মন রিমির প্রতি নরম হয়েছে। দু’জনের মধ্যে থাকা বন্ধুত্বের সম্পর্কটা আরও ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। দু’জন দু’জনকে নিয়ে এখন ভাবে। হয়তো সামনে চলার পথে দু’জনের পথটাও এক হবে কোন একদিন।
চাঁদনি রাতে পাশাপাশি হাঁটছে দু’জন। আকাশে আজ বেশ বড় চাঁদ উঠেছে। চারপাশে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ছে। চাঁদটাও যেন আজ তাদের খুশিতে খুশি হয়েছে। মেঠোপথে একাকী হাঁটতে দু’জনেরই ভালো লাগছে। হাঁটতে হাঁটতে ছোট নদীর পাড়ে গিয়ে দু’জনই দাঁড়িয়ে যায়। নদীর পানিতে চাঁদের আলোর রেখা পড়েছে। আকাশে একটা বড় চাঁদ আর নিচে নদীর পানিতে আরেক চাঁদ। অপূর্ব লাগছে চারপাশের পরিস্থিতিটা। রুশার হাতে নিজের হাত দিয়ে হালকা চেপে ধরে ফায়াজ।
“রুশা?”
“হু।”
“তোমার স্বপ্নটা সত্যি করেই দিলাম, বলো।”
“হ্যাঁ। স্বপ্ন আজ সত্যি হলো।”
“তুমি খুশি তো?”
“সব খুশি মুখে ব্যক্ত করা যায় না। কিছু খুশি অনুভবেই ভালো লাগে।”
“সেই অনুভবে আমায় শামিল করা যায় না?”
“তুমি তো শামিল হয়েই আছো। সেই দু’বছর আগে থেকে।”
“সব কিছুর জন্য যদি স্যরি বলি, ক্ষমা করে দেওয়া যাবে আমায়?”
“স্যরি চাইনি তোমার কাছে ফায়াজ। একটু ভালোবাসা চাই শুধু।”
“তবে কথা দাও আমায়। আগের মতো হয়ে যাবে আবার।”
“এখন আর আগের মতো হতে পারবো না। যেমন আছি তেমনটাই মেনে নিতে হবে তোমায়।”
“কেন রুশা? এই রুশাকে দেখলে আমার ভীষণ কষ্ট লাগে।”
“এই রুশাই এক সময় তোমার অভ্যাসে পরিণত হবে।”
“অভ্যাস না আমি চাই বদভ্যাস। আমি চাই রুশা নামক শব্দটা আমার জীবনে অভ্যাস না আমার বদভ্যাস হয়ে থাকুক।”
“তবে থাকুক হয়ে।”
এক হাতে রুশার কাঁধ জড়িয়ে রুশাকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নেয় ফায়াজ। রুশাও পরম নির্ভরতায় নিজের মাথা রাখে ফায়াজের বুকে। যে বুকে শুধুই ভালোবাসা আর নিরাত্তা।
“রুশা, ভালোবাসি বললেই কি ভালোবাসার জানান দেওয়া হয়?”
“নাহ। মুখে ভালোবাসি বলে মনে ছলনা রাখলে সেই ভালোবাসা সম্পূর্ণ শুদ্ধ ভালোবাসা হয় না।”
“তবে আমি তোমায় ভালোবাসি এই কথাটা না বলি। আমি বলতে চাই, আমি তোমারে পেয়েছি, হাজারো কষ্ট সহ্য করে। তুমি থেকে যেয়ো আজীবন শুধু আমারই হয়ে।”
রুশা হালকা হেসে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফায়াজকে। জবাবে বলে,
“তুমি আমার জীবনে পাওয়া সব থেকে মূল্যবান অলংকার, আমি তোমাতেই থাকতে চাই ইহকাল এবং পরকাল।”
দু’জনেই হাসি মুখে আকাশের বুকে থাকা ওই উজ্জ্বল চাঁদটাকে দেখতে থাকে। দু’জনের আত্মা এক হয়েছে। তাদের মনের মিলন ঘটেছে। ভালোবাসা এবং ভালোবাসা শুধুই ভালোবাসা এর থেকেও বেশি কিছু যদি থেকে থাকে তাহলে শুধুই ভরসা আর একে অপরের প্রতি বিশ্বাস প্রয়োজন। এ দুটো জিনিস থাকলে ভালোবাসা নামক অনুভূতিটা সহজেই চলে আসে।
এভাবেই ভালো থাকুক ফায়াজ-রুশা। এভাবেই ভালো থাকুক তাদের ভালোবাসাগুলো। এভাবেই ভালো থাকুক তাদের ভালো মুহুর্তগুলো।
স্যার নামক মানুষটা রুশার জীবনে স্বামী হয়ে এসেছে। স্যার নামক মানুষটা রুশার সব স্বপ্ন সত্যি করবে স্বামী হয়ে। স্যার নামক মানুষটা রুশাকে নিরাপত্তা দিবে স্বামী হয়েই। স্যার নামক মানুষটা রুশার জীবনকে ভালোবাসার সাত রঙে রাঙিয়ে দিবে স্বামী হয়ে।
এভাবেই ভালো থাকুক তাদের ভালোবাসা। শুভ হোক তাদের আগামী দিন গুলো। ফায়াজ-রুশার মতো এভাবেই পূর্ণতা পাক সকল ভালোবাসা। পূর্ণতা পাক সকলের সকল স্বপ্ন।
সমাপ্ত
খুব ভালো লাগলো গল্পটা পড়ে