#স্যার
#পর্ব_২৪
লেখনীতে – আফরোজা আক্তার
মাঠের এক কোণায় বসে আছে ফুয়াদ। বিগত দিনে চোখ মুখের অবস্থা খুবই করুণ হয়ে গেছে তার। রিমি ফুয়াদকে একা দেখতে পেয়ে তার পাশে বসে।
রিমিকে এমনিতেও ফুয়াদের ভালো লাগে না। তবুও কেন জানি এই মেয়েটা তার খুব খেয়াল রাখে। অনলাইনে এক্টিভ দেখলেই নক করবে। খোঁজ খবর নেবে। ক্যাম্পাসে এলে তার আশেপাশেই ঘুর ঘুর করবে। রিমির সব কিছু তার কাছে বিরক্ত লাগে। কিন্তু কখনো মুখে কিছু বলেনি পাছে মেয়েটা কষ্ট পায়।
রুশার এইভাবে না করে দেওয়াতে সে খুব কষ্ট পেয়েছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে রুশার সাথে জোর করতে। কিন্তু জোর করা ঘৃণ্য অপরাধ। স্কুল কলেজে থাকাকালীন সময়ে সে নিজেই ধর্ষণের বিরুদ্ধে কতশত মানববন্ধন করেছে। সে এখন কীভাবে এইসব করবে। এসব ভাবার পর মুহুর্তে আল্লাহর দরবারে তওবা করে নেয়।
তবে রুশার ভালোবাসা না পাওয়ার আক্ষেপ কিছুতেই যাচ্ছে না। থার্ড সেমিস্টারের ফাইনাল হয়ে গেল। কিন্তু রুশার ভালোবাসা তার দিকে আর ফিরে এলো না। সেও এখন আর রুশার সাথে তেমন কথা বলে না। দুই দিনে তিন দিনে চোখে চোখ পড়লে হাই হ্যালোতেই তাদের কথা আটকে থাকে। সেবার রুশাকে অডিটোরিয়ামে নিয়ে হেনস্তা না করলেও পারতো। সেটার কথা ভেবেই লজ্জায় একেক সময় রুশার দিকে তাকায় না পর্যন্ত। মেয়েটা ভালো। যথেষ্ট ভালো। যথেষ্ট শব্দটাও তার জন্য কম হয়ে যাবে। অন্যান্য মেয়ে হলে ক্যাম্পাসে তাকে অপমানিত করতে পারতো। বহিষ্কার করাতে পারতো। স্যারদের বলে কঠিন ব্যবস্থা নিতে পারতো। কিন্তু রুশা তা করেনি। আর এখানেই তার নিজের প্রতি নিজের যত লজ্জা যত ঘেন্না।
রিমি তাকিয়ে আছে ফুয়াদের দিকে। কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু সাহস হচ্ছে না। আবার ফুয়াদও আড় চোখে দেখছে রিমিকে। কিন্তু কিছু বলছে না। এভাবেই কেটে যায় প্রায় দশ মিনিট।
ফুয়াদ উঠে যাবে এমন সময় রিমি ফুয়াদকে হাত ধরে। এই প্রথম রিমি কোনো ছেলেকে স্পর্শ করেছে। আর ফুয়াদও বেশ অবাক হয়।
“কী ব্যাপার রিমি? আমার হাত ধরেছো কেন?”
“বসো। কথা বলি কিছুক্ষণ।”
“বিগত দশ মিনিট ধরে তো বসেই ছিলাম। এখন আর ভালো লাগছে না।”
“রেগে যাচ্ছো কেন?”
“ভালো লাগছে না রিমি। বিরক্ত লাগছে এখন।”
“আমি পাশে বসাতেই কি বিরক্ত হচ্ছো?”
“আর ইউ ম্যাড? পাশে বসায় বিরক্ত কেন হবো? আমার এমনিই ভালো লাগছে না কিছু।”
“বসো, তোমায় কিছু কথা বলি।”
ফুয়াদ আবারও বসে পড়ে রিমির পাশে।
“বলো, কী বলবে?”
“রুশাকে ভালোবাসো, তাই না?”
রিমির মুখে রুশাকে ভালোবাসার কথা শুনে অবাক হয়নি ফুয়াদ। সে বুঝেছে যে এই ব্যাপারটা রিমিও জানে। হয়তো এতদিন কিছু বলেনি। তবে এখন বলছে কেন?
“জানোই যখন জিজ্ঞেস করছো কেন?”
চাপা নিঃশ্বাস ফেলে রিমি। অজ্ঞাত কোনো এক কারণে কান্না আসছে তার। তবুও কাঁদছে না সে। বার কয়েক ঢোক গিলে ফুয়াদের দিকে তাকায়।
“রুশা তোমায় ভালোবাসে না। কখনো বাসবেও না। বাসবেও না বললে ভুল হবে। শুধু তুমি কেন, সে তার বাবা এবং দ্বিতীয় একজন পুরুষ ব্যতীত পৃথিবীর তৃতীয় আর কোনো পুরুষকে কখনো ভালোবাসতে পারবে না।”
রিমির কথা শুনে কৌতূহলী চাহনি নিয়ে তাকায় ফুয়াদ।
“হ্যাঁ ফুয়াদ। রুশা কখনো আর কোনো পুরুষকে ভালোবাসতে পারবে না। সে ভালোবাসে এক তার বাবাকে আর দুই তার স্যারকে।”
“স্যার? কোন স্যার।”
“আমরা তখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি। একবার রুশা পরিসংখ্যানে ফেল করে। এরপর তাকে নিয়ে ক্লাসে অনেক হাসাহাসি হয়। রুশার খুব কাছের একজন বন্ধু ছিলো। সে আমারও বন্ধু। ওর নাম রাসিন। রুশার ফেল এর বিষয়টা নিয়ে অনেক হাসি ঠাট্টা করে। এরপর রুশার বাবা-মা তার জন্য হোম টিউটর ঠিক করেন। রুশা তখন খুব হাসি-খুশি এবং প্রাণচঞ্চল কিশোরী ছিলো। জীবনটাকে সে মজার চোখে দেখতো। তার কাছে জীবন মানেউ ছিলো, হৈ-হুল্লোড়, মজা-মাস্তি। কিন্তু তার ওই স্যার তার সব কিছু পালটে দেয়। রুশার অবুঝ মনে স্যারের প্রতি ভালোবাসা ভর করে। তার দুর্বল চিত্তে এক সময় ভর করে ভালোবাসা নেশা। পাগলের মতো ভালোবাসে সে তার স্যারকে। কিন্তু, তার স্যার তাকে বার বার প্রত্যাখ্যান করে। একদিন রুশার পাগলামি কমাতে না পেরে স্যার রুশার মা’কে সব বলে সেদিনই রুশাকে পড়ানো ছেড়ে দেয়। এরপর থেকেই রুশা গুমোট হয়ে যায়৷ রুশা তার জীবনকে একটা গন্ডিতে আবদ্ধ করে নেয়। নিজের চারপাশটা এমন ভাবে তালাবদ্ধ করে দেয় যেন সে একটা জীবন্ত লাশ। সবই চলছে তার শুধু ভেতরে যেই প্রাণটা আছে তা নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে। এরই মাঝে শেষ হয় আমাদের এইচ এস সি এক্সাম। রুশা ভালো রেজাল্ট করে। আমরা এই ভার্সিটিতে এডমিশন নিলাম। নসীব বড় আজব জিনিস। বিগত দুটো বছর এই ক্যাম্পাসে রুশা তার হারানো ভালোবাসার মানুষটাকে খুঁজে পায়।”
এবার ফুয়াদ আরও অবাক হয়। প্রশ্ন করে,
“পায় বলতে?”
“আমিও প্রথমে চিনতাম না। অবশ্য না চেনার কারণ হলো আমি কখনো রুশার স্যারকে দেখিনি। তাই চিনতে পারিনি। রুশার সেই স্যার আর কেউ না। তিনি হচ্ছেন আমাদের ডিপার্টমেন্টের লেকচারার ফায়াজ কারিম।”
অবাকের শীর্ষ চূড়ায় অবস্থান করে ফুয়াদ।
“হোয়াট!”
“হ্যাঁ। ফায়াজ স্যারই রুশার সেই ভালোবাসার মানুষ। প্রথম থেকে আমি কিছুই জানতাম না।রুশা বলেনি। এরপর রুশা আমায় সবটা জানায়। তুমি রুশাকে অডিটোরিয়ামে নিয়ে জোর করেছিলে। প্রপোজ করেছো। রুশা রাজি হয়নি। হবেই বা কী করে ফুয়াদ? রুশা তো তার আবেগ-অনুভূতি, হাসি-কান্না, সব কিছু আগেই তার স্যারকে দিয়ে বসে আছে। যে মনে একজনকে ভালোবেসেছে সে মনে অন্য কাউকে জায়গা কী করে দিতো, বলো তো। তুমি রুশার সাথে যেই আচরণ করেছো তার সবটাই ফায়াজ স্যার জেনেছিলো সেদিন। কিন্তু তিনি কিছু বলেননি। তার কারণ তিনিও বুঝেন কাউকে ভালোবেসে তার কাছ থেকে রিফিউজ হওয়াটা কতটা যন্ত্রণার হয়। যেমন রুশার হয়েছিলো।”
ফুয়াদ কিছুই বলতে পারছে না এই মুহুর্তে। সব কিছু কেমন যেন গোলমেলে লাগছে তার কাছে। রুশা, ফায়াজ স্যার, ভালোবাসা, আরও অনেক কিছু মাথায় সাজাতে তার কষ্ট হচ্ছে। রিমি তার পরিস্থিতি বুঝতে পারে। এরপর ধীর গলায় আরও একবার সবটা জানায় তাকে।
এখনো তার কাছে বিশ্বাস হচ্ছে না পুরোটা। কিন্তু এটাই সত্যি। রিমি কিছুক্ষণ পর বলে,
“আমরা সবাই ভালোবাসার কাঙাল ফুয়াদ। ভালোবাসা এমন একটা অনুভূতি যা আমাদের হাজারো কষ্ট দিলেও আমরা তার পেছনেই ছুটে বেড়াই। রুশার জীবনে সেই ভালোবাসা আবার ফিরে এসেছে। প্রত্যেকটা জিনিসের একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে। তাদের ভালোবাসা নির্দিষ্ট সময় হয়তো এটাই। আর তুমিই হয়তো ভুল সময়ে নিজের ভালোবাসা তার প্রতি দেখিয়েছো। তোমাকেও দোষ দেওয়া যায় না আর রুশারও ভুল নেই এখানে। আজ আসি। সাবধানে থেকো।”
মনে হলো ফুয়াদ রিমির চোখে পানি দেখতে পেয়েছে। রিমিকে পিছু ডাকার আর উপায় ছিলো না। রিমি চলে গেছে।
একের পর এক ফোন বেজে যাচ্ছে। পাঁচ বারের সময় ফোন রিসিভ হয়।
“কোথায় ছিলে রুশা? কয়বার ফোন করলাম।”
“স্যরি, ওই রুমে ছিলাম।”
“এত রাতে ওই রুমে কী?”
“কিছু না। বলুন।”
“কী করছো?”
“এখন বসে আছি।”
“বারান্দায় আসো তো।”
“বারান্দায়! হঠাৎ?”
“আসো৷ তারপর বলছি৷”
ফোন কানে রুশা বারান্দায় যায়। নিচে তাকাতেই বড়সড় ধাক্কা খায়। ফায়াজ নিচে দাঁড়িয়ে আছে। ঘড়িতে এগারোটা বাজে। অথচ মানুষটা এখন তার বাসার সামনে। ইদানীং মনে হচ্ছে তার স্যার একটু একটু করে রোমান্টিক পুরুষ হচ্ছে।
“অবাক হলাম।”
রুশার কথা শুনে ফায়াজ হালকা হেসে বলে,
“অবাক করার জন্যই এলাম।”
“এখানে কোনো কাজ ছিলো?”
“নাহ।”
“আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন?”
“কী মনে হয়?”
“কত কিছুই তো মনে হয়। সব মনে হওয়া কি আর সঠিক হয়, বলেন?”
“তা হয়তো হয় না। আচ্ছা শোন বের হবে?”
“আব্বু মারবে।”
“ফোর্থ সেমিস্টারের স্টুডেন্টকে এখনো মারধর করা হয়? থানায় অভিযোগ জানাতে হবে দেখছি।”
“আমি এখনো তাদের কাছে ছোট।”
“এইজন্যই বলেছিলাম বিয়েটা করে নাও। অন্যকাউকে না, আমায়। শুনলে না তো। বিয়ে করলে এখন তুমি আমার অধীনে থাকতে। ঘুরতেও পারতে আমার সাথে।”
“আপনি কি ঘুরতে বের হয়েছেন?”
“হ্যাঁ। বের হও।”
কিছুক্ষণ রুশা তাকিয়ে থাকে ফায়াজের দিকে।
রিকশায় বসে আছে রুশা আর ফায়াজ। রাতের অন্ধকারে ঢাকা শহরটা কিছুটা হলেও চুপচাপ থাকে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় চারপাশটা সুন্দর লাগে।
রুশা তার মা’কে বলে বাসা থেকে বের হয়েছে। যদিও তার বাবা জানে না। নাসরিন ফায়াজের প্রতি যতই রাগ করে থাকুক না কেন, তিনি জানেন রুশা একমাত্র ফায়াজের কাছেই নিরাপদ। তাই তিনিও বাধা দেননি। তাছাড়া মেয়ে তার এত বছর পর একটু স্বাভাবিক হচ্ছে। এতেই তিনি সন্তুষ্ট। এবার এদের চার হাত এক করে দিতে পারলেই তিনি নিশ্চিন্ত। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে তাদের দু’জনকে দেখছিলেন নাসরিন। ফায়াজ অবশ্য উপরে তাকায়নি। রুশা মা’কে টা টা করে। এখন অপেক্ষা করবে মেয়ের ফিরে না আসা অবধি। ওদিকে আশরাফ ঘুমে বিভোর।
“মা’কে এখনো ছোট বাচ্চাদের মতো টা টা দেও।”
“মাঝেমধ্যে দেই।”
“রিকশায় ঘুরতে কেমন লাগছে?”
“ভালো। তা আজ হঠাৎ ঘুরতে বের হলেন?”
“হঠাৎ মন চাইলো। তাই হঠাৎ বের হলাম।”
“ওহ।”
“তোমার ওই ইচ্ছেটা নিয়ে অনেক ভাবলাম।”
“কোনটা?”
“ওই যে চাঁদনি রাতে সাদা শাড়ি পরে আমার পাশাপাশি হাঁটার ইচ্ছে টা। ভাবলাম সেটা কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়।”
রুশা আর কিছু বলেনি। শুধু মুচকি হেসেছে। ফায়াজ সাহস করেই রুশার হাতটা স্পর্শ করে। পরম যত্নে আঁকড়ে ধরে রুশার নরম হাতখানা। লজ্জা মিশ্রিত চোখে রুশা এক পলক ফায়াজকে দেখে। এর পর পরই রুশা চোখ নামিয়ে নেয়। এই মুহুর্তে রুশাকে নতুন বউ ছাড়া আর কোনো উপাধি দিতে ইচ্ছে করছে না ফায়াজের।
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায়………………….