#স্যার
#পর্ব_২৩
লেখনীতে — আফরোজা আক্তার
পার্কের বেঞ্চে পাশাপাশি বসে আছে ফায়াজ আর রুশা। মাম ওয়াটার বোতল থেকে রুশার হাতে পানি ঢেলে দিচ্ছে ফায়াজ। ফুয়াদের চার আঙুলের ছাপ বসে গেছে রুশার হাতে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব শক্ত করে ধরা হয়েছে হাতটা।
রুশা একদম চুপচাপ বসে আছে ফায়াজের পাশে। ফায়াজ যে সবটা জানে বা বুঝে এটা নিয়ে এখনো সন্দেহে আছে রুশা। সে শুধু চোখের পানি মুছে অডিটোরিয়াম থেকে বের হয়ে সিঁড়ির নিচে আসতেই ফায়াজ তাকে দাঁড় করিয়ে গেইটের বাহিরে দাঁড়াতে বলে। রুশা বাহিরে গিয়ে দাঁড়ালে ৫ মিনিট পর পেছন থেকে ফায়াজ বের হয়। ফায়াজ হাঁটা অবস্থাতেই রুশাকে সোজা হাঁটো — বলে সামনে চলে যায়।
এরপর দু’জন এখানে চলে আসে। ফায়াজ আসার সময় দোকান থেকে পানির বোতল আর ফার্মেসী থেকে একটা অয়েন্টমেন্ট কিনে নেয়।
রুশার হাতে অয়েন্টমেন্ট লাগাতে লাগাতে ফায়াজ বললো,
“ব্যথা বেশি হচ্ছে?”
রুশা শান্ত স্বরে জবাব দেয়,
“নাহ।”
“জোরেই আঘাত করেছে।”
“হ্যাঁ।”
“তোমার কাছ থেকে হয়তো না শব্দটা আশা করেনি সে। তাই রাগ করেই এমন করলো।”
“হয়তো। তবে, যেখানে না শব্দটাই প্রযোজ্য সেখানে হ্যাঁ কখনোই হবে না।”
“তোমায় বার বার জিজ্ঞেস করছিলো, অন্য কাউকে ভালোবাসো কি-না? বললে না কেন?”
“আপনি সব শুনেছেন?”
“হ্যাঁ।”
“তবে ভেতরে গেলেন না কেন?”
“দু’জন মানুষ কথা বলছে। সেখানে আমি কীভাবে যেতাম।”
“জরুরী কিংবা গোপন কথা হচ্ছিলো না। যদি ফুয়াদ আমার হাতে চাপ না দিয়ে গলায় চাপ দিতো। তখনও কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবটা শুনতে?”
রুশার কথাটা শুনে ফায়াজ মুখ তুলে তাকায় রুশার দিকে। ফায়াজের মুখটা ক্রমশ অসহায় হরিণের মতো লাগছে। যেন হরিণ তার প্রাণপ্রিয় হরিণীকে হারানোর ভয়ে কুঁকড়ে আছে৷ রুশা কিছু বলবে কিন্তু তার আগেই ফায়াজ বললো,
“ফুয়াদকে বাধা না দেওয়ার কিছু কারণ আছে। আর কারণ গুলো যুক্তিসম্মত। তবে যদি ফুয়াদের হাত তোমার গলা অবধি যেতো তার আগেই ফুয়াদ তার হাতটা খুইয়ে দিতো।”
“কী করতেন? ফুয়াদের হাতটা কেটে দিতেন। যেমন করে বাহুবালি দ্যা কনক্লিউশন মুভিতে দেবসিনার শরীরে হাত দেওয়ার অপরাধে সেতুপতীর গলাটাই কেটে দিয়েছিলো বাহুবালি।”
রুশার কথা শুনে ফায়াজ হালকা হেসে দেয়। সে হাসতে চায়নি। তবুও সে হেসে দেয়। কারণ, রুশা কথাটাই তেমন বলেছে।
ফায়াজের মুখে হাসি দেখে রুশার নিজেকে হালকা মনে হচ্ছে।
“ক্ষুধা লেগেছে?”
“বাসায় চলে যাবো এখন। বাসায় গিয়ে খাবো।”
“আমার সাথে আজকে খাও। মানে চলো একসাথে লাঞ্চ করি।”
ফায়াজের আবদারটা রুশার কাছে যেন হাতের কাছে চাঁদ পাওয়ার মতো ছিলো। কিন্তু পর মুহুর্তে নিজেকে দমিয়ে নিয়ে বলে,
“আমি বাসায় গিয়েই খাবো।”
“ফুয়াদকে বাধা না দেওয়ার কারণ গুলো শুনবে না?”
“কী কারণ?”
“চলো। খেতে খেতে বলি।”
রুশা আর কিছু বলেনি।
দুপুর আড়াইটা।
রেস্টুরেন্টে সামনা-সামনি বসে আছে রুশা এবং ফায়াজ। খাবার সার্ভ করা হয়েছে। কিন্তু রুশা স্পুন হাতে নিচ্ছে না। ফায়াজ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,
“তপ্ত দুপুরে নিশ্চয়ই ক্ষুধা লেগেছে। খাচ্ছো না কেন?”
রুশা চুপচাপ হয়ে যায়।
“কথা বলবে না?”
“শুনছি।”
“শুনতে বলিনি। খেতে বলেছি। এখানের সেট ম্যানু গুলো খুব মজার হয়। খেয়ে দেখো৷”
ফায়াজের কথায় রুশা খাবার শুরু করে। ফায়াজের উদ্দেশ্য ছিলো রুশাকে কমফোর্ট ফিল করানো। এবং মনে হচ্ছে সে এই ব্যাপারে সাকসেস হয়েছে। প্রশ্ন করে,
“মজা না?”
“হ্যাঁ।”
“এই রেস্টুরেন্টের খাবার এমনিতেও ভালো মানের।”
“আচ্ছা।”
“এবার শোন। খেতে খেতেই বলি। তোমার প্রশ্ন ছিলো, আমি যখন সব শুনেছি কেন কাছে যাইনি। আচ্ছা রুশা, যাওয়াটা কি উচিত ছিলো? বিশ্বাস করবে কি-না জানি না কিন্তু সে যখন তোমার হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে মনে হচ্ছিলো আমার বুকে কেন যেন ছুরি চালাচ্ছে। কিন্তু, আমি তবুও যাইনি। আমি দেখতে চেয়েছিলাম সে কী বলে। নিজস্ব অনুভূতি থেকে অনুভব করতে পারলাম যে সে তোমায় ভালোবাসে৷ কিন্তু তোমার কাছ থেকে না শোনার পরে নিজেকে সামাল দিতে পারেনি। সবাই তো আর রুশা হয় না, যে নিজের ভালোবাসার মানুষটির কাছ থেকে না শুনে নিজেকেই গুটিয়ে নেবে। ফুয়াদ নিজেকে গুটিয়ে নেয়নি। বরং সে প্রতিবাদ করেছে। তুমি নিজেই যেখানে সে বার বার জিজ্ঞেস করার পরেও বলোনি আমার কথা। আমিই বা কী করে যেতাম বলো। ফুয়াদের মাঝে একটা ম্যানলি ভাব আছে। ছেলেটা ভবিষ্যতে আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে। মনের মধ্যে কোথাও আস্থা ছিলো যে সে তোমার তেমন কোনো ক্ষতি করবে না। কারণ ভালোবাসার মানুষগুলোর সাথে আর যাই করা যাক না কেন এদের ক্ষতি করা যায় না। যেমন, আমি তুমি। সে যখন আমায় আমার ক্যারিয়ার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল আমিও পারতাম তার সামনে গিয়ে এখন দাঁড়িয়ে তার স্বামীর সামনে তাকে অনেক কথা বলে আসতে। এতে তার লাভের চেয়ে ক্ষতিই হতো বেশি। পারিনি আম এইসব করতে। পারবোও না। তোমার ভালোবাসাকে বার বার রিফিউজ করার পর আমার সাথে আর যোগাযোগ করোনি। চাইলেই পারতে আমায় খুঁজে বের করে নিজের অপমানের প্রতিশোধ নিতে। আমরা মানুষরা মনে মনে যা চিন্তা করি তা ফলানোর চেষ্টাও করি। তবে এইসব খারাপ উদ্দেশ্য চিন্তাও করি না। আর ফলানোর চেষ্টাও করি না।”
রুশা মন দিয়ে ফায়াজের কথা শুনছে। ফায়াজ পেশায় একজন লেকচারার। লেকচারার হিসেবে উপদেশমূলক কথাবার্তা বলা-ই উচিত। তবে সবার উপদেশ সব সময় ভালো লাগে না। ক্ষেত্র বিশেষে অনেক সময় প্রিয় মানুষটার উপদেশমূলক কথাও শুনতে বেশ ভালো লাগে। রুশার ক্ষেত্রেও তাই হলো।
ফায়াজ বলার এক পর্যায়ে রুশাকে বললো,
“আমি চাইলেই পারি ফুয়াদের সাথে কথা বলতে। কিন্তু বলবো না।”
“আচ্ছা৷”
“তুমি কি ভেজিটেবল পছন্দ করো না?”
“করি।”
“তবে খাচ্ছো না যে?”
“খাচ্ছি।”
“আমার একটা কথার জবাব দিলে না তো।”
“কোন কথা?”
“ভুলে গেছ বুঝি?”
নাহ, সে ভুলে যায়নি। কিন্তু এড়িয়ে যেতে চাইছে। যেই মানুষটা এতদিন দূরে দূরে থেকেছে। সেই মানুষটা এখন এইভাবে কাছে থাকার কথা বলছে। ব্যাপারটা অদ্ভুত হলেও এর অনুভূতিগুলো খুব গাঢ়। রুশা কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু পারছে না। ফায়াজ রুশার মুখের ভঙ্গি দেখেই বুঝে ফেলেছে।
“কিছু বলতে চাও?”
“উহু।”
“মনে হচ্ছে বলতে চাচ্ছো।”
রুশা ভাবে মনের কথা যদি বলা যায়। ক্ষতি কোথায়।
“কোনো এক চাঁদনী রাতে সাদা শাড়ি পরে আপনার পাশাপাশি হাঁটতে চাই। সেদিন আপনিও সাদা পাঞ্জাবি পরবেন।”
রুশার কথা শুনে ফায়াজ হাসে। ফায়াজের হাসি দেখে রুশা বলে,
“কেমন একটা সিনেমেটিক সিচুয়েশন তাই না। যা টিভিতেই মানায়। তবে আমরা চাইলে বাস্তব জীবনেও এমন কিছু সিনেমেটিক সিচুয়েশন তৈরি করতে পারি৷ তাই না?”
ফায়াজ মুচকি হেসে জবাব দেয়,
“হ্যাঁ।”
ফায়াজ খাবার খাচ্ছে আর আড় চোখে রুশাকে দেখছে। রুশা তখন চুপচাপ শান্ত মেয়ের মতো মাথা নিচু করে খাবার খাচ্ছে।
পাশের টেবিলে এক জোড়া বয়স্ক দম্পতি তাদের দেখে বলে ওঠে,
“দু’জনের মধ্যে কেমন ম্যাচুরিটি, তাই না। কোনো ন্যাকামি নেই। কোনো অশ্লীলতা নেই। অথচ কত সুন্দর আর সুখী মনে হচ্ছে তাদের।”
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায়……………….