#স্যার
#পর্ব_১৯
লেখনীতে — আফরোজা আক্তার
ব্রিজের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে রুশা আর ফায়াজ। আজ অনেকদিন পর রুশা প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে পারছে। মনে হচ্ছে, শরীরে যতটা অসুস্থ ভাব ছিলো সব উধাও হয়ে গেছে।
দু’জন মানুষ। যারা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু চলছে গভীর নিস্তব্ধতা। রুশার চোখ জোড়া দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। আর ফায়াজের দৃষ্টি রুশাকে দেখছে। নিস্তব্ধতা সব সময় ভালো লাগে না। ফায়াজ বলে,
“রুশা, কিছু বলছো না যে?”
ফায়াজের প্রশ্নে হালকা নড়ে ওঠে রুশা।
“কথা খুঁজে পাচ্ছি না। আপনি বলুন। কেন দেখা করতে বলেছিলেন।”
“কিছু কথা বলার আছে।”
“আচ্ছা। শুনছি আমি। আপনি বলুন।”
“তার আগে একটা প্রশ্নের উত্তর দেও তো।”
“আপনি প্রশ্ন করুন। উত্তর জানা থাকলে অবশ্যই দেবো।”
ফায়াজ একটু ইতস্তত বোধ করে। কিন্তু তবুও তাকে এই প্রশ্নটা করতে হবে।
“ফুয়াদ ছেলেটার সাথে তোমার আন্ডারস্ট্যান্ডিং কেমন?”
ফায়াজের কথার ধাচ দেখে রুশা চমকে যায়। এই মুহুর্তে ফায়াজকে দেখে রুশার হাসি পাচ্ছে আবার হাসতে ভালোও লাগছে না। কথায় আছে, নারী মন সন্দেহবাতিক। কিন্তু আজ রুশা বুঝতে পারছে শুধু নারী মন-ই নয়, পুরুষ মনও সন্দেহবাতিক। ফায়াজ এখানে চালাকি করেছে। সে হয়তো ভেবেছে রুশাকে সরাসরি প্রশ্ন করার চাইতে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করাটাই বেশি শ্রেয়। রুশারও কথা ঘোরাতে ভালো লাগে না। তাই সরাসরিই বলে,
“ফুয়াদ আমার ক্লাসমেট। অনলি ক্লাসমেট। আন্ডারস্ট্যান্ডিং শব্দটা ব্যবহার না করে যা সন্দেহ করেছিলেন সেটাই বলতে পারতেন। যে, তার সাথে আমার কী সম্পর্ক অথবা কেন সে আমার সাথে এত কথা বলে। কিংবা আপনার চোখ বার বার আমাদের একত্রেই দেখেছে কেন, আরও কিছু।”
রুশা যে তার চালাকি ধরতে পেরেছে তা বুঝতে পেরে লজ্জিত হয় ফায়াজ। তবুও তার আপত্তি লাগছে না। কারণ সে ভুল কিছু করেনি। সে শুধু জানতে চেয়েছে। এর বেশি কিছু না।
“সবটা যখন বুঝতেই পেরেছো, তবে বলে ফেলো।”
“ওই যে বললাম। শুধু ক্লাসমেট। এর অতিরিক্ত কিছুই না।”
“ফুয়াদ তোমায় পছন্দ করে।”
“করতেই পারে। সে যে আমায় পছন্দ করে সেটা আমিও জানি। তবে সে তো আর এটা জানে না, যে আমার মনে কী চলে।”
“কী চলে তোমার মনে।”
“না বলি।”
পাশ দিয়ে ঝালবুট যাচ্ছিলো। রুশার জন্য নেবে কি-না ভাবছে। খাবে কি-না সেটাও প্রশ্ন।
“ঝালবুট খাবে?”
“নাহ। ইচ্ছে করছে না।”
“ফুচকা খাবে?”
“নাহ।”
“ফুচকা তো তোমার খুব প্রিয়। তাহলে খাও না কেন?”
“কত কিছুই তো আমার প্রিয় ছিলো। সব কিছু কি আর ধরে রাখতে পেরেছি?”
ফায়াজ আবারও দমে যায় রুশার কথায়। মেয়েটা কিছুক্ষণ পর পর এমন একেকটা কথা বলে যা সহ্য করার মতো না। পর মুহুর্তে আবার ভাবনায় আসে থাক, কথাগুলো তার কষ্টের থেকে কম কিছুই।
রুশাকে দেখছে ফায়াজ। রুশাও বুঝতে পারছে পাশে থাকা লোকটার নজর তার দিকেই। কেন যেন সংকোচ হচ্ছে। এভাবে এক নজরে তাকিয়ে থাকাটা রুশা নিতে পারে না। তাও যদি সেই নজর ফায়াজের হয়।
উপরওয়ালার কাছে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে, আমায় নিয়ে আর কত খেলা হবে? আমায় নিয়ে আর কত হাসি ঠাট্টা হবে? আমার ভাবনা গুলোর সাথে আর কত নড়চড় করা হবে? সে যখন আমায় আগুনে ফেলে চলে গেল, তবে তাকে আবারও কেন পাঠানো হলো। আগুন নেভানোর জন্য নাকি সেই আগুনে আরও ঘি ঢেলে আগুনের তাপ বাড়ানোর জন্য। আমার মনে কষ্ট নামের ফোঁড়ায় পাক ধরতে না ধরতেই তার উপর বিষফোঁড়া তৈরির জন্যই কি তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা? আর কত কাঁদতে দেখলে তোমার মন গলবে আল্লাহ।
কিছু কথা রুশার জানা প্রয়োজন। এতে রুশার ভালো হবে কি-না তা জানা নেই তবে সে নিজে মানসিক শান্তি পাবে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে ফায়াজের। কথাগুলোর প্রতি কঠিন জোর দিতে হচ্ছে তাকে। হয়তো এটাই সময়, সব কিছু বলার। গলায় খাকাড়ি দিয়ে ফায়াজ বলতে শুরু করে,
“অভিমান অনেক জমিয়ে রেখেছো নিজের ভেতরে। তাই নিজে ভালো নেই তুমি। রুশা, কিছু কথা ছিলো, যা চাইলেও তখন বলতে পারিনি। আর না পেরেছি তোমার কথা শুনে তোমার সরলতার সুযোগ নিতে। চাইলেই পারতাম রুশা, বিশ্বাস করো চাইলেই পারতাম তোমাকে ব্যবহার করতে। কিন্তু জড়তা কাজ করছিলো ভীষণ এবং সেই সাথে অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে ছিলাম। রুশা, ভালোবাসা অনেকের জীবনে সুখ নিয়ে আসে। আবার অনেকের জীবনে অভিশাপ। ভালোবাসার মানুষ অনেক সময় জীবনে ফেরেশতা হয়ে আসে, আবার অনেক সময় জীবনে ধ্বংসের কারণ হয়ে আসে। আমার জীবনে তোমার আগে অন্য একজন ছিলো।”
বাকি সব কথা উড়িয়ে দিলেও এই কথাটায় আটকে যায় রুশা। অন্য একজন ছিলো! তার মানে এইজন্যই তার স্যার তাকে বার বার রিফিউজ করেছে। ফায়াজকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রুশা বলে ওঠে,
“এটা আপনি দুই বছর পর বলছেন আমায়?”
এবার ফায়াজ একটু বিরক্ত হয়। তার কথার মাঝে কেউ কথা বললে তার অসম্ভব মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। তবুও নিজের মেজাজ কন্ট্রোল করে বলে,
“রুশা, আগে কথা বলার সুযোগ দাও। আমি শেষ করি আগে? এরপর না হয় তুমি বলো।”
ফায়াজের কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে রুশা চুপ হয়ে যায়। ফায়াজ আবারও বলে,
“লাস্ট সেমিস্টারে তার সাথে আমার যোগাযোগ হয়। কাকতালীয় ভাবেই আমাদের যোগাযোগ হয়। এরপর থেকে কথা বলতে বলতে আমাদের সম্পর্কের শুরু। আমি ভীষণ রকম চেয়েছিলাম তাকে। তার মাঝেও কোনো কিছুর কমতি ছিলো না। তবে আমার বিশ্বাসে খুঁত ছিলো। আমায় যে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ করে রেখেছিলো সে। আমি বুঝতেই পারিনি। রুশা, ক্যারিয়ার যদি কারো কাছ থেকে তার ভালোবাসা কেড়ে নেয় তখন বলো তো কেমন কষ্ট লাগে। আমারও লেগেছিলো। যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিলো, ‘সামান্য টিউশনি করে আমার চাহিদা পূরণ করার ক্ষমতা তোমার নেই ফায়াজ। আমি আর আবেগ ধরে রাখতে চাই না। নিজেকে গুছিয়ে নাও।’ ভাবতে পারো রুশা, নিজেকে তখন কতটা কষ্টে দমিয়ে রাখতে হয়েছে আমায়। তবুও টিউশনি করেছি, রাত জেগে পড়াশোনা করেছি, বি সি এস দিয়েছি। কারণ টিচিং প্রফেশন আমার বাবার খুব পছন্দের। যেখানে কোনো দুর্নীতি নেই। তখন রিলেশন, ভালোবাসা, প্রেমিকা, আবেগ আর কিছু চাইনি। শুধু চেয়েছি একটা ক্যারিয়ার। কিন্তু বুঝিনি রুশা, সে ব্যতীত অন্য কেউও থাকতে পারে যে আমায় মনে প্রাণে চাইতে পারে। বুঝিনি, ক্যারিয়ারের নেশায় মত্ত্ব হয়ে কাউকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে দিয়েছি। বুঝিনি, আমার কারণে একটা হাস্যজ্বল প্রাণচঞ্চল কিশোরী খুব সহজেই ভেতর ভেতর আগুনে দগ্ধে শেষ হয়ে গেছে। রুশা, আমি তোমার খোঁজ খবর রাখতাম। তবে শুধুই তোমার পড়াশোনার। আমি বুঝতেই পারিনি নিজেকে এইভাবে শেষ করে দিয়েছো তুমি। তোমায় যখন ভার্সিটিতে দেখেছি কিঞ্চিৎ অবাক হয়েছি। কিন্তু, আগের রুশাকে না পেয়ে আমি মরমে মরে গেছি৷ উপলব্ধি করতে পারার পর থেকে কাছে চাইতাম। কিন্তু তখন এটা হতো পৈশাচিক কর্মকাণ্ডের একটা অংশ। আমি যেমন তোমায় ফিরিয়ে দিয়েছি, তেমন তোমায় জিতে নিতে চেয়েছি রুশা। তেমন তোমায় জিতে নিতে চেয়েছি।”
রুশার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। মুখে শব্দ নেই। কিন্তু চোখে পানির স্রোত বয়ে চলছে। ফায়াজ রুশার মুখের দিকে তাকিয়ে। হাতটা কোনো ক্রমেই তার স্থির থাকছে না। চট করেই সে রুশার গালে হাত দেয়। পরম যত্নে চোখের পানিগুলো মুছে দেয়।
“রুশা, কেঁদো না। আর কত কাঁদবে? যদি বলি, তোমার সমস্ত কান্নাগুলো আমায় দিয়ে দাও। দেবে আমায়? যদি বলি ভেতরে যত আগুন পুষিয়ে রেখেছো, তাতে আমি ভালোবাসার অমৃত ঢেলে দেবো। সেই অধিকার দেবে আমায়?”
রুশা চুপচাপ শুধু শুনছে ফায়াজের কথাগুলো। মুখে কথা আসছে না। শুধু বুকের মধ্যে তোলপাড় করছে। সব ভেঙে চুড়ে যাচ্ছে।
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায়……………..