#স্যার
#পর্ব_১৭
লেখনীতে — আফরোজা আক্তার
খালামনিকে বলে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করায় রুশা। কিছুক্ষণ চুপ করে ডাইনিং টেবিলে বসে থাকে সে। খারাপ লাগছে ভীষণ তার। পুরো এক বোতল ঠান্ডা পানি একটু একটু খাচ্ছে রুশা।
নাসরিন ডাইনিংরুমে এসে মেয়েকে দেখতে পান। দ্রুত পায়ে গিয়ে মেয়ের পাশে বসে। তিনি কিছু বলার আগেই রুশা তার রক্ত লাল।চোখ নিয়ে তার দিকে তাকায়। আর তিনিও মুহুর্তের মধ্যেই বুঝে যান। ঘটনা যা হবার ঘটে গেছে।
তিনি মেয়েকে বললেন,
“বাসায় চলে যাই। চল।”
রুশার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও সে বললো,
“খালামনি কী ভাববে? শাহীন ভাইয়া আর ভাবী তারা কী ভাববেন?”
“এই বিপদ যে এখানে উপস্থিত হবে তা কে জানতো?”
“বাদ দাও। তুমি যাও। না হয় সন্দেহ করবে সবাই। ইজি থাকো।”
“তোকে দেখে তো মনে হচ্ছে শরীর খারাপ লাগছে তোর।”
“সমস্যা নাই। আমি একটু বসি এখানে। ধীরে ধীরে ভালো লাগবে। যাও তুমি।”
রুশা মা’কে কোনো রকম বুঝিয়ে ভেতরে পাঠিয়ে দেয়। রুশা বরাবরই তার ভাগ্যকে দোষ দেয়। তার ভাগ্যের মতো নাকি এত খারাপ ভাগ্য আর কারো নেই। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। আপন মনে বলে যাচ্ছে সে, আমার কপালে কি শান্তি নেই? মানে কীভাবে একটার পর একটা খারাপ পরিস্থিতিতে আমায় ফালানো যায় সেই ব্যবস্থাই করা হয়। সব খারাপ পরিস্থিতি কি আমার জন্যই নির্ধারণ করা হয়েছে নাকি?
খুব আনন্দের সাথে শাহীন এবং ওয়াজিফার ছেলের জন্মদিন পালন হয়। কেক কাটার পর্ব শেষ হয়। সবার নজর যখন টেবিলে রাখা কেকের দিকে, ফায়াজের নজর তখন রুশার দিকে। রুশা না তাকিয়েও বুঝতে পারছে ফায়াজের চোখ তাকে দেখছে। এই মুহুর্তটা খুবই অস্বস্তিকর। কেউ যদি সামনা-সামনি এইভাবে নজর দিয়ে তাকিয়ে থাকে তাহলে মনে হয় যেন সব কিছুই থেমে যাচ্ছে। বিরক্তিকর একটা মুহুর্ত। কেক কাটার পরে রুশা সেখান থেকে সরে যায়। তার একটাই চাওয়া যতক্ষণ ফায়াজ এখানে আছে ততক্ষণ পর্যন্ত সে লুকিয়ে থাকতে চায়। আর ফায়াজও যেন তাকে না দেখতে পায়। ফ্ল্যাটের পশ্চিম দিকে একটা ছোট বারান্দা আছে। রুশা তার মা আর খালামনিকে বলে সেই বারান্দায় চলে যায়। সবাই ভেতরে খাওয়া দাওয়া আর কথাবার্তায় ব্যস্ত। এখানে আপাতত কেউ আসবে না। রুশা বারান্দার দরজাটা হালকা টেনে চুপচাপ এখানে দাঁড়িয়ে পড়ে। ভাবছে, বাঁচা গেল। এখানে অন্তত একান্তে কিছুটা সময় স্বস্তির নিঃশ্বাসটুকুন ফেলতে পারবো। এমন ভাবে তাকাচ্ছিলো মনে হচ্ছিলো যেন চোখ জোড়া দিয়েই আমায় গিলে খেয়ে নেবে। অতি আশ্চর্যজনক!
ঘাড়টা উঁচু করে কিছুক্ষণ উপরের দিকে তাকিয়ে আছে রুশা। আজ আকাশে অনেকগুলো তারা উঠেছে। কিন্তু চাঁদটা মেঘে ঢেকে আছে। কিছুতেই মেঘ থেকে বের হচ্ছে না। হয়তো চাঁদেরও মন খারাপ। নয়তো সে-ও চায় তার মতো আড়ালে আবডালে থাকতে।
তবে মেঘের আড়ালে থেকেও কিন্তু চাঁদকে অপূর্ব লাগছে। এক ফালি আলো তো ছড়াচ্ছে তার চারপাশে সে। এটাই বা কম কিসে।
নাহ, অনেকক্ষণ হলো এখানে এসেছে সে। এবার ভেতরে গিয়ে পরিস্থিতি দেখা উচিত। রুশা ভেতরে যাবে বলে পেছনে ঘুরতেই একটা হাত তার শাড়ির ভাজে থাকা উন্মুক্ত কোমর আঁকড়ে ধরে। রুশা কেঁপে ওঠে।
“কেহ!”
কাঁপা কন্ঠে বার বার প্রশ্ন করছে সে। কিন্তু অপরপাশ থেকে উত্তর না এসে যেন কোমরটা আরও শক্ত করে ধরে আছে কেউ। রুশা তাকাতেই আৎকে উঠে। অবয়ব দেখেই বুঝে গেছে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি আর কেউ নয়। এ যে ফায়াজ দাঁড়িয়ে আছে। রুশা প্রাণপণে চেষ্টা করছে ফায়াজের হাতটা সরানোর জন্য। কিন্তু পারছে না। চাপা কন্ঠে প্রশ্ন করে,
“কী হচ্ছে? আমায় ছাড়ুন।”
ফায়াজ এক ধাক্কায় রুশাকে আবারও বারান্দায় নিয়ে যায়। দেওয়ালের সাথে মিশিয়ে দেয় রুশাকে।
“তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
“আমার জানা মতে আপনার কোনো কথা নেই আমার সাথে।”
“কী হয়েছে রুশা? এমন করছো কেন?”
“আপনি কোন সাহসে আমার কোমরে হাত রাখেন? কোন অধিকারে রাখেন?”
“হাত রাখতে বুঝি সাহস এবং অধিকার লাগে?”
“আলবাত লাগে। অবশ্যই লাগে। এভাবে হুটহাট আমায় ছোঁবেন না। আমার অস্বস্তি হয়।”
“লাইক সিরিয়াসলি রুশা! তোমার অস্বস্তি হয়?”
“হ্যাঁ।”
“যাকে ভালোবাসো তার ছোঁয়ায় অস্বস্তি লাগে?”
“ভালোবাসা…! আপনার মুখে ভালোবাসা? আমি কি সঠিক শুনছি? এ তো দেখছি ভূতের মুখে রাম নাম। ফায়াজ কারিমের মুখে ভালোবাসার কথা।”
“ফাইযলামি করছো কেন রুশা?”
“না আপনি আমার ভাই, না আপনি আমার হাই, না-ই আপনি আমার বন্ধু। আপনার সাথে ফাইজলামি করার সম্পর্কও আমার নেই। সো এইসব বন্ধ করুন আর আমায় যেতে দিন।”
“দাঁড়াও এখানে। আমার কথা আছে তোমার সাথে?”
“আমি শুনতে ইচ্ছুক নই।”
“কেন, ভালোবাসা কমে গেছে নাকি?”
এতক্ষণ কোনো কথা না লাগলেও ফায়াজের এই কথাটা রুশার গায়ে লাগে। হ্যাঁ, খুব গায়ে লাগে। তার মনে হচ্ছে, ভালোবাসা কমে গেছে নাকি কথাটা দ্বারা ফায়াজ তাকে টন্ট করেছে। বিদ্রুপ করেছে। খুব বিদ্রুপ করেছে। ফায়াজ বোঝে ভালোবাসা কেমন হয়? সে তো ভালোবাসা কী জিনিস বোঝেই না। সে এই কথা কীভাবে বলে? নিজেকে দমিয়ে রাখার অদম্য ইচ্ছাটা রুশা আর ধরে রাখতে পারলো না। সাথে সাথে জবাব দেয়,
“ভালোবাসা মানে বোঝেন আপনি? ভালোবাসা নামক অনুভূতি আছে আপনার মাঝে? কোন যুক্তিতে প্রশ্নটা ছুড়ে মারলেন আমার দিকে? ভালোবাসা কমে গেছে নাকি? আপনার কাছে সব কিছুই মজা লাগে? এই যে মিস্টার ফায়াজ সাহেব, আপনি হবেন আমার স্যার তবে সেটা ভার্সিটিতে। আপনি ছিলেন আমার স্যার, তবে সেটা দু’বছর আগের অতীত। কী জানতে চান, ভালোবাসি কিনা? ভালোবাসা আগের মতো আছে কি-না? তাহলে শুনুন, আপনার এই প্রশ্নের উত্তরে একটা কথাও বলতে বাধ্য নই আমি। বুঝেছেন আপনি? আশা করি বুঝেছেন। এবার আমার পথটা ছাড়ুন।”
ফায়াজ চুপচাপ রুশার কথা শুনছে। রুশার কন্ঠস্বরই বলে দিচ্ছে তার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। চোখে পানি জমেছে। হয়তো পলক পড়লেই গড়িয়ে পড়বে পানিগুলোও। ফায়াজ এখনো ছাড়েনি রুশাকে। রুশা আবারও বলে,
“ভালোবাসলেই যে কথা বলতে হবে কিংবা কথা শুনতে হবে এমন কোনো আইন নিশ্চয়ই জারি করা হয়নি। ভালো তো ভীষণ বেসেছিলাম। কিন্তু বিনিময়ে পেলাম কী? সেই আবেগপ্রবণ, প্রাণচাঞ্চল্য রুশাকে মুহুর্তেই বড় করে দেওয়া হলো। তার কোমল হৃদয়ে ভালোবাসার যেই বীজ বপন করা হয়েছিলো সেই বীজ মাটি খুঁড়ে বের করে দিয়ে সেখানে আস্ত একটা বটগাছ বপন করা হলো। সেদিনের সেই ছোট্ট রুশা মুহুর্তেই বড় হয়ে গেল। ভালোবাসা যে এইভাবে কাউকে বড় করে দেয় আমি জানতাম না। ভালো তো ভীষণ বেসেছিলাম, কিন্তু বিনিময়ে কী পেলাম? রোজ রোজ রিফিউজ। এরপর শেষে আমার মা’য়ের কাছে বিচার দিয়ে মাঝ পথে পড়ানো বন্ধ করে দেওয়া। আরে এতটাই কি বিরক্ত করে ফেলেছিলাম নাকি আমি আপনাকে? আপনি আমায় যেমন দেখতে চেয়েছিলেন আমি এখন তেমনটাই হয়ে গেছি। আশা করি এরপর আমায় আপনি যত দেখবেন ততটাই অবাক হবেন সাথে খুশিও হবেন।”
এবারের কথাগুলো ফায়াজের লেগেছে। হ্যাঁ, রুশার বলা এবারের কথাগুলো ফায়াজের বুকে গিয়ে লেগেছে। রুশা একদম কাট-টু-কাট জবাব দিয়ে দিয়েছে। কোমরে থাকা হাতটা সরিয়ে রুশা সামনে পা বাড়াতে নিলে ফায়াজ বলে,
“ভালোবেসেছিলাম রুশা? ভালোবেসেছিলাম? তার মানে এখন আর সেই ভালোবাসা নেই?”
রুশা তৃতীয় বারের মতো আবারও অবাক হলো। ফায়াজ এখনো এই প্রশ্ন করে। রুশা হালকা হেসে জবাব দেয়,
“আফসোস ফায়াজ সাহেব, আপনি এখনো আমায় এই প্রশ্ন করছেন? আফসোস ফায়াজ সাহেব, আপনি এখনো বুঝেনই না ভালোবাসা কী? আফসোস ফায়াজ সাহেব, যদি দেখাতে সক্ষম হতাম কতটা ভালোবাসি।”
রুশা আর এক সেকেন্ডও সেখানে দাঁড়ায়নি। যদি দেখাতে সক্ষম হতাম কতটা ভালোবাসি– কথাটা ফায়াজের কানে বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দের মতো বেজে ওঠে। বুকের ভেতরটা যেন তার হিম শীতল হয়ে যায়। রুশা কী বলে গেল? মানে তার মনে যেই দ্বিধাটা ছিলো তা এখন আর কাজ করছে না। তবে, রুশা তাকে ভালোবাসে। হ্যাঁ, রুশা তাকে ভালোবাসে। না চাইতেও চোখে পানি জমেছে তার।
ফায়াজ দ্রুত পায়ে ড্রইংরুমের দিকে যায় এই আশায় যে, রুশাকে হয়তো সেখানেই পাওয়া যাবে।
নাসরিন অনেকক্ষণ যাবত মেয়েকে দেখছেন না। পশ্চিম দিকের বারান্দায় দেখে এসেছেন, সেখানে কেউই নেই। পুরো বাসা ভর্তি মেহমান। কোথায় মুখ শুকনো করে বসে আছে মেয়েটা? ভাবতেই নাসরিনের শরীরে কাটা দিচ্ছে।
ওয়াজিফা নাসরিনকে বললো,
“খালামনি, আপনি এখানে বসে আছেন যে, খাবার খাবেন না?”
“এই তো ওয়াজিফা। তোমাকেই খুঁজছিলাম মা।”
“কী হয়েছে খালামনি?”
“ওয়াজিফা, রুশাকে দেখেছো?”
“মায়ের কাছে শুনলাম বারান্দায় গেছে।”
“নেই তো সেখানে মা।”
“তাহলে কোথায় যাবে? আচ্ছা খালামনি, আপনি বসেন এখানে, আমি দেখছি?”
নাসরিনকে বসিয়ে রেখে ওয়াজিফা এই ঘর ওই ঘর খোঁজা শুরু করে। সব ঘর খোঁজা শেষ। এখন বাকি তাহমিনা বেগম মানে তার শাশুড়ি মায়ের ঘরখানা। ওয়াজিফা সেই ঘরে যায়।
“শাহীন, দ্রুত মায়ের ঘরে আসো। রুশা সেখানে সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে?”
ওয়াজিফার কথা শুনে উপস্থিত সবাই যেন থমকে যায়। নাসরিন এদিক সেদিক না তাকিয়ে দৌড়ে যায় তাহমিনা বেগমের ঘরে। ফায়াজ যেন জমে গেছে কথাটা শোনার পর। তাহমিনা বেগম সব ফেলে রেখে তার নিজের ঘরে যান। সবার এক প্রশ্ন একটু আগেও তো ভালো ছিলো মেয়েটা। হঠাৎ কী হলো?
ফায়াজও দ্রুত সেই ঘরের দিকে পা বাড়ায়। ততক্ষণে ফায়াজের মা বোনও সেই ঘরে উপস্থিত হয়। ফায়াজ যেতে যেতে শাহীন রুশাকে খাটে শুইয়ে দেয়। নাসরিন কান্নায় ভেঙে পড়েন। ফোনে আবল তাবল বলছেন নিজের স্বামীকে। পুরো শরীর কাঁপছে তার। তিনি এই ভয়টাই পাচ্ছিলেন। কখন জানি একটা বিপদ হয়। মায়ের মন, আগেই সংকেত দিয়ে রেখেছে।
ফায়াজের মা তাকিয়ে আছেন রুশার দিকে। মনে মনে বলছেন, আহা! কী মায়াভরা চাহনি মেয়েটার! কী অপূর্ব লাগছে! কিছুক্ষণ আগেও দেখলাম হাঁটা-চলা করছে। হঠাৎ কী হলো মেয়েটার?
মা’কে এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফারহানা বলে,
“এইভাবে তাকিয়ে আছো কেন মা?”
“দেখ না, মেয়েটাকে কত মায়াবী লাগছে। ঠোঁট জোড়া দেখ। যেন পুতুলের ঠোঁটের মতো। মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে আছে।”
“মেয়েটা সেন্সলেস হয়ে গেছে মা। আর তুমি তার রুপের বর্ণনা করছো।”
“ঘুমন্ত অবস্থায় যে নারীকে সব থেকে বেশি সুন্দর লাগে, সে নারী সত্যিই সুন্দর।”
“এ্যা।”
“এ্যা নয়, হ্যাঁ। ভাবছি তোর কাকি বলে ফায়াজের জন্য এই মেয়ের সম্বন্ধ চাইবো।”
এইবার ফারহানার চোখ কপালে উঠে যায়। একটা মানুষ অসুস্থ আর তার মা সেই অসুস্থ মানুষটাকে ছেলের বউ হিসেবে কল্পনা করছে।
“মা, তোমার মাথা ঠিকাছে তোমার? কী সব বলছো? হায়রে মা, ভাইয়ার বিয়ের ভূত কবে নামবে তোমার মাথা থেকে? মেয়েটা অসুস্থ আর তুমি তাকে ছেলের বউ বানাবে। ভাগ্যিস কেউ শোনেনি। নয়তো বারোটা বাজাতো।”
মেয়ের কথা শুনে তিনিও একটু চুপ হয়ে যায়। ফায়াজ তাকিয়ে আছে রুশার দিকে। মেয়েটা তার সামনে থেকে চলে গেল। কিন্তু এখানে এসে এইভাবে সেন্সলেস হবে। তা ভাবেনি সে। ব্যথা হচ্ছে। বুকে ব্যথা হচ্ছে তার। চাপা ব্যথা। ইচ্ছে করছে সবাইলে ডিঙিয়ে রুশাকে নিজের বুকে চেপে ধরতে। ইচ্ছে করছে রুশার শরীরে নিজের শরীরের সবটুকু উষ্ণতা ঢেলে দিতে। ইচ্ছে করছে রুশামে অজস্র চুমু দিয়ে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে। মুহুর্তেই ভাবছে, কী হয়েছে রুশার? এইভাবে সেন্সলেস হওয়ার কারণ কী হতে পারে? ওর এই অসুস্থতা আমি নই তো?
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায়…………………..