স্যার পর্ব-১৪

0
1807

#স্যার
#পর্ব_১৪
লেখনীতে — আফরোজা আক্তার

এক সপ্তাহ পর।
খাবার টেবিলে পিনপতন নীরবতা। আশরাফ এক মনে খাচ্ছেন এমনটাও না। নাসরিনও যে খাচ্ছেন তেমনটাও না। তবে রুশা চুপচাপ খাচ্ছে। কোনো সারা-শব্দ ছাড়া সে খাচ্ছে। মূলত আশরাফ মেয়ের আচরণ নিয়ে খুব চিন্তিত। তার এই চিন্তার উদ্ভব ঘটেছে গতকাল থেকে। গতকাল অফিস থেকে এসেই তিনি অত্যন্ত মানসিক চাপে ছিলেন। সেই সাথে নাসরিনও। তাদের দু’জনের নজরই রুশার দিকে। রাইসুল পাশে বসে আছে। কিন্তু রুশা তার সাথেও তেমন কথা বলছে না। ছোট ভাইটার মনটা যে আকুলিবিকুলি করে বোনের সাথে কথা বলার জন্য সেটা রুশা বোঝে না।
গতকাল অফিসে একটা খারাপ খবর শুনেছে আশরাফ। সেই থেকে তিনি স্তব্ধ হয়ে আছেন। বাসায় আসার পর বার কয়েক জোরাজোরি করার পর তিনি নাসরিনকে ঘটনা খুলে বলেন। তার কলিগ করিম সাহেবের মেয়ে গত পরশু রাত সুইসাইড করেছে। এমন ভাবেই নিজেকে শেষ করেছে যে ডক্টর কোনো উপায় বের করতে পারেনি তাকে বাঁচানোর।
সুইসাইডের কারণ জিজ্ঞেস করলে জানা যায়, মেয়েটা নাকি প্রচুর ডিপ্রেশনে ছিলো। নিজের বাবা-মা কারো সাথেই তেমন ভালো কানেকশন ছিলো না। যেমন রুশার সাথে তাদের তেমন কানেকশন নেই। মেয়েটা নাকি সবার কাছ থেকেই দূরে দূরে থাকতো। যেমন রুশা থাকে। আশরাফ আর নাসরিন যেন, কলিগ করিম সাহেবের মেয়ের মধ্যে নিজেদের মেয়ে রুশাকে খুঁজে পাচ্ছেন। সেই থেকেই দু’জন খুব চিন্তায় আছেন মেয়েকে নিয়ে।
আশরাফ সাহেব ভাবছেন তিনি মেয়েকে যতটা সম্ভব চোখে চোখে রাখবেন। নাসরিন ভাবছেন তিনি যতটা পারেন মেয়ের সঙ্গে গল্পে মেতে থাকবেন। রুশা তাদের বয়সকালের প্রথম সন্তান। আল্লাহ না করুক রুশার কিছু হয়ে গেলে তারা দু’জনেই পাগল হয়ে যাবে।
খেতে খেতে রুশার নজর যায় তার বাবা-মায়ের ওপর। তাদের দু’জনকেই কেমন যেন ভীত লাগছে। রুশা খাবার গিলে প্রশ্ন করে,
“কী হয়েছে? এইভাবে তাকিয়ে আছো যে তোমরা?”
মেয়ের প্রশ্ন শুনে একটু ভড়কে যায় আশরাফ এবং নাসরিন। আশরাফ হালকা হেসে জবাব দেয়,
“তুমি অনেকদিন পর তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছো। দেখে খুব ভালো লাগছে মামুনি।”
উত্তরটা নিতান্তই অযুক্তিযুক্ত লাগছে রুশার কাছে। অন্তত তার বাবার কাছ থেকে এমন সব কথা আশা করাও বোকামি। রুশা বলল,
“কী হয়েছে আব্বু? কোনো সমস্যা?”
“নাহ মামুনি। কোনো সমস্যা নেই।”
নাসরিন বলল,
“রুশা, তুই ঠিক আছিস তো মা?”
মায়ের প্রশ্নে একটু অবাক হয় রুশা। হঠাৎ এই প্রশ্ন করলো কেন তার মা?
“আমার কী হবে আম্মু?”
নাসরিনেরও এক পর্যায়ে মনে হতে লাগলো প্রশ্নগুলো অহেতুক। বাবা-মায়ের কাছ থেকে নীরবতা পেয়ে রুশা বলে,
“নিজেকে শেষ করে দেওয়ার পক্ষে আমি নই আব্বু। গতকাল রাতে কিচেন রুমে যাওয়ার সময় তোমার আর আম্মুর কথা শুনেছি আমি। এত চিন্তা কোরো না আমায় নিয়ে। তোমার মেয়ে দগ্ধে দগ্ধে মরবে তবুও নিজেকে শেষ করবে না। কারণ, জীবন তো একটাই আব্বু। আখিরাত বলেও একটা স্থান আছে। সেখানেও জবাব দিতে হবে। আমাদের এই জীবনের ওপর আমাদের কোনো অধিকার নেই। যে জীবন দান করেছেন একমাত্র তারই অধিকার আছে এই জীবন নিয়ে খেলা করার। এইসব আমায় দিয়ে কখনো হবে না আব্বু। যদি হতো আমি সেদিনই শেষ হয়ে যেতাম যেদিন আম্মুর হাতটা আমার গাল অবধি উঠেছিলো। দু’জনকেই বলছি আমি ঠিক আছি। তবে কিছু কথা অস্বীকার করবো না। হ্যাঁ, ভেতরে কষ্ট আছে। এমন অনেক রাত কেটেছে আমার না ঘুমিয়ে। আমি আমার আমিকে অনেক প্রশ্ন করেও উত্তর খুঁজে পাইনি। বাবা হয়ে তুমিও সবটা মায়ের হাতেই তুলে দিয়েছো। একবার এসে প্রশ্ন করোনি যে কী হচ্ছে আমার জীবনে? যা দেখার তোমার স্ত্রী মানে আমার মা দেখেছে। এমন অনেক রাত যায় আমি ঘুমাই না। এমন অনেক বেলা কাটে আমার খেতে ইচ্ছে করে না। আমি অনুভূতি পাই না আব্বু। আমি অনুভব করার শক্তিটাও পাই না আব্বু।”
রুশার চোখে পানি এসে জমাট হয়েছে কিন্তু চোখ বেয়ে পড়ছে না। নাসরিনের গলা ধরে আসছে মেয়ের কথায়। আশরাফের কলিজায় কে যেন ছুড়ি চালাচ্ছে। রুশা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“অপরাধ করেছি একটা। অনেক বড় অপরাধ। অকপটে বলতে লজ্জা করছে না আমার। আমার অপরাধ ছিলো আমি ভালোবেসেছিলাম। আমার ভালোবাসা উপেক্ষা করে যে মানুষটা দুই বছর আগে চলে গেল সেই মানুষটা এখনো আমার মনেই রয়ে গেছে। আমি কেন তাকে ভুলতে পারছি না। এর উত্তর নেই আমার কাছে। আমি খুব যত্ন করে আমার ভালোবাসা লালন করছি আমার এই মনে। আমার এখন মনে হয়, আমি দুই বছর আগেই অনেকেটা বড় হয়ে গিয়েছিলাম। আর এখন আরও বড় হয়েছি। সব কিছুই বুঝি।”
রুশার গলা বন্ধ হয়ে আসছে। কান্নারা এসে ভিড় জমাতে শুরু করেছে গলায়। রুশা সামনে থাকা গ্লাসের পানিগুলো খেয়ে নেয়। এরপর আবারও বলা শুরু করে,
“যেই মানুষটা আমার সরল মনের ভালোবাসা উপেক্ষা করে চলে গেল। আজ দুই বছর পর আমি কিনা সেই ভার্সিটিতেই এডমিশন নিলাম যেখানে মানুষটা পরিসংখ্যানের লেকচারার! লাইক সিরিয়াসলি! এখন বুঝতেছি জীবন আমায় নিয়ে জুয়া খেলছে। দারুণ খেলায় মত্ত্ব সে।”
ফায়াজের অবস্থানের কথা শুনে মাথায় বাজ পড়ে আশরাফ আর নাসরিনের। আশরাফ এখন বুঝতে পারছে সেদিন কেন তার মেয়ে ভার্সিটি বদলানোর কথা বলেছিলো।
“ভয় পেয়ো না। এবার আর তার ক্যারিয়ার এবং তোমাদের মান সম্মানে কোনো আঘাত আসবে না। কারণ, আমি যে ভেতরগত ভাবেই মরে গেছি অনেক আগে।”
গ্লাসে থাকা বাকি পানিটুকুন শেষ করে রুশা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,
“আসছি আমি। আর আব্বু, আমায় নিয়ে এইসব দুঃশ্চিন্তা বন্ধ করো। তোমার মামুনি দিন শেষে তোমাদের সাথেই থাকবে। এটা তোমার মামুনির ওয়াদা।”
রুশা বের হয়ে যায়। আশরাফ এবং নাসরিন বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছেন। তা-ও ভালো, মেয়ে আজ তার ভেতরের কিছু কষ্ট তাদের সাথে শেয়ার করে গেছে। মেয়েটা হয়তো এখন মোটামুটি ভালো থাকতে পারবে। আশরাফ মনে মনে ভাবছেন, একবার কি ফায়াজের সাথে দেখা করবেন তিনি? কথা বলা প্রয়োজন। আবার ভাবছেন, যদি পাত্তা না পান। তখন আরও অপমানজনক ব্যাপার হবে।
ক্যাম্পাসে এসে শান্তি পাচ্ছে না রুশা। মনটা খচখচ করছে তার। কিন্তু কারণ জানা নেই। ইদানীং কলিজার নিচে বড্ড ব্যথা হয়। ডক্টর দেখাবে কি-না ভাবছে। সে বোঝে বাসার পরিবেশটাও ভালো নেই। হয়তো তার জন্যই। বাবা-মা প্রতিনিয়ত তাকে নিয়ে ভয়ে আছেন। তাদের ভয়টাও অগ্রাহ্য করার উপায় নেই। তারা ভাবেন, মেয়ে যদি কিছু করে বসে। রুশা ভাবছে আর মলিন হাসি দিচ্ছে।
ফুয়াদ এসে পাশে বসে তার। মুগ্ধ নয়নে দেখছে সে রুশাকে। রুশার মলিন মুখের এই হাসিটা তার বেশ পছন্দের। যেন সহস্র বছর বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা।
“রুশা, তোমায় একটা প্রশ্ন করি?”
“হ্যাঁ, করো।”
“তোমার এত চুপচাপ থাকার কারণ কী?”
“আমি চুপচাপ থাকতে পছন্দ করি।”
“তোমার একটা ছবি তুলি?”
“নাহ। আমার পছন্দ না।”
ফুয়াদ আর জোর করেনি। বিগত একমাসের উপর হবে তারা এক সাথে ক্লাস করে। মনের কথাটুকু এখনো বলতে পারছে না ফুয়াদ। শুধু এটা ভেবেই যে শোনার পর রুশা বন্ধুত্বটুকু আবার শেষ না করে দেয়। এমন সময় উপস্থিত হয় রিমি। এই রিমিটা সব সময় ভুল সময়ে এসে পড়ে এমনটাই ফুয়াদ ভাবে। কিন্তু কে জানতো, এই রিমিই সঠিক সময়ে এসে উপস্থিত হচ্ছে প্রতি মুহুর্তে।
দূর থেকে পুরো বিষয়টি লক্ষ করে ফায়াজ। এই ফুয়াদ ছেলেটাকে তার পছন্দ হচ্ছে না। কেন পছন্দ হচ্ছে না এর বিশেষ কোনো কারণ নেই। অন্যদের চোখে ফুয়াদ যথেষ্ট ভদ্র একটা ছেলে। ক্লাসেও মনোযোগী। কোনো রকম বেয়াদবিও করে না। তাহলে তার কেন ভালো না? এর কারণ কি তবে রুশা? রুশার আশেপাশে থাকে বলেই কি তার ফুয়াদকে ভালো লাগে না? আচ্ছা, রুশাও কি পছন্দ করে ফুয়াদকে? করতেই পারে। এখানে দোষের কিছু নেই। ফুয়াদ তার ক্লাসমেট। মিলেও ভালো। রুশার সাথে তার বয়সের ফারাকটা অনেক। সেই তুলনায় ফুয়াদ বেশ হ্যান্ডসাম। রুশার পছন্দ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার কেন খারাপ লাগছে?
স্পোর্টস ডে’র কথা মনে পড়ে যায় তার। সেদিন ওই কক্ষে রুশা তাকে যা যা বলল। রুশা কি তাকেই ভালোবাসে এখনো? মাথায় কিছুই আসছে না ফায়াজের। দোটানায় পড়ে গেছে মানুষটা। তার যে রুশাকে মনে ধরেছে। এখন কী করবে সে? কী করে ফেরাবে আগের রুশাকে? কী করলে রুশা আবারও হাসবে আগের মতো করে? এত এত প্রশ্ন, উত্তর কোথায় মিলবে?

পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায়…………………..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে