#স্যার
#পর্ব_১৩
লেখনীতে — আফরোজা আক্তার
কক্ষ নং ২১৩।
রুশা সবার আড়ালে এখানে এসেছে। মা’য়ের ওপর খুব বেশি না হলেও একটু অভিমান জন্ম নিয়েছে এই মুহুর্তে। শাড়িতে ঠিক মতো পিন দেয়নি বোধ হয়। না হয় খুলে গেল কী করে? রিমিকে খুঁজেছে অনেকক্ষণ। পরে দেখতে পায়, রিমি ফুয়াদের সঙ্গে ডিপার্টমেন্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সেখান থেকে তাকে ডাকা উচিত হবে না। আবার মাঠ থেকে ডিপার্টমেন্টে যেতেও সময় লেগে যাবে। হাতের কাছেই প্রথম ভবন। সেখানেই দ্রুত উঠে যায় সে। সব ক্লাসেই দু’জন, একজন স্টুডেন্ট বসা। কোনো কোনো টায় স্টুডেন্টরা দল পাকিয়ে বসে আছে। খুঁজতে খুঁজতে ২১৩ নং কক্ষটাই তার চোখে পড়েছে।
একদম কাঁধ থেকে খুলে গেছে শাড়িটা। পেছনে হাত দিতে গিয়ে দেখে ইনারটাও হালকা বের হয়েছে। ভাগ্যিস কেউ লক্ষ করেনি তার দিকে। রিমি থাকলেই হতো। মেয়েটা ওইখানে ফুয়াদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিয়েছে।
“ধুর, একে তো গরম। তার ওপর শাড়ি খুলেছে। আম্মু আজকে কী পিন মেরেছে। আম্মুই জানে।”
বক বক করছে আর এদিক সেদিক তাকাচ্ছে কেউ এসে পড়ে কি-না। দরজার চিপার মধ্যে এইভাবে দাঁড়িয়ে শাড়ি ঠিক করা যায়? প্রচন্ড বিরক্ত রুশা। আর কখনো ভার্সিটিতে সে শাড়ি পড়ে আসবে না। এটাই তার শেষ কথা।
হঠাৎ কেউ একজন তার কাঁধে হাত রাখলে সে আৎকে উঠে। এখানে কারো আসার কথা না। কোনো বাজে ছেলে না তো? চট করেই পেছনে তাকায় রুশা। চোখে অন্ধকার দেখছে সে। এ কাকে দেখছে? স্যার যে তার সাথে তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। রুশার ভেতরে আবারও ঝড় উঠেছে। আবারও হাত-পা কাঁপছে। কণ্ঠনালী আবারও শুকিয়ে যাচ্ছে। স্যার জানে কীভাবে সে এখানে?
ফায়াজ চাপা স্বরে বলে,
“কীভাবে শাড়িতে পিন পরেছো যে পিন খুলে যায়। এখনো কি আগের মতোই এমন ছোটাছুটি করো নাকি?”
রুশা তার কথায় বুঝতে পারছে যে সে নিশ্চয়ই খেয়াল করেছে যে শাড়ির পিন খুলে গেছে। রুশা চাইছে না কথা বলতে। ইচ্ছে করছে না কথা বলতে। কেমন যেন তীব্র অভিমান মুহুর্তেই ভর করছে মনে। কিন্তু এই অভিমানের কোনো দাম নেই। সে ভালোবাসে। তবে ভালোবাসলেই যে কথা বলতে হবে তা নয়। রুশা মুখে কাঠিন্য এনে নজর অন্যদিকে নেয়।
ফায়াজ রুশাকে ঘুরিয়ে দিয়ে দাঁড় করায়। স্লিভস টান টান করে ভেতরের ইনার সহ শাড়িতে পিন মারে। পিন মারার সময় ইচ্ছে করেই সে রুশার কাঁধে সরু ধারালো পিনের মাথা দিয়ে খোঁচা দেয়। তার ইনটেনশন রুশাকে ব্যথা দেওয়া ছিলো না। রুশা যাতে তার সাথে কথা বলে সেই ইনটেনশন ছিলো। কিন্তু রুশা পিনের খোঁচা অনুভব করার সঙ্গে সঙ্গে নিজের দাঁত-মুখ এক করে চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলে। ব্যথাটা হজম করে নেয়। তবুও কিছু বলে না।
নারী-পুরুষ একত্রে থাকলে শয়তান ধোঁকা দেয়। এটা সত্যি কথা। ফায়াজের ইচ্ছে করছে রুশাকে জড়িয়ে ধরে দুই বছর আগে করা সকল অন্যায়ের জন্য ক্ষমা চাইতে। ইচ্ছে করছে রুশার এক জোড়া মলিন শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁটে নিজের শীতল ভেজা ঠোঁট ডুবিয়ে দিতে। ইচ্ছে করছে রুশার শাড়ির ভাজে থাকা উন্মুক্ত কোমরে নিজের ঠান্ডা হাত রাখতে। পারফিউমের ঘ্রাণটা তার নাকে আসছে। খুব গাঢ় ভাবেই আসছে। ইচ্ছে করছে রুশার খোলা ঘাড়ে নাক ডোবাতে।
কিন্তু সব ইচ্ছাকে সব সময় বাস্তবে ফলাতে নেই। আর তার পক্ষে তো একেবারেই না। কারণ, রুশা যখন বার বার, বার বার তার সরল মনের ভালোবাসা তুলে ধরেছিলো সে-ও তখন বার বার, বার বার রুশাকে রিফিউজ করে গেছে। তাই, এখন আর তার এইসব ইচ্ছে করা সাজে না। বড্ড বেমানান তার এই ইচ্ছেগুলো।
শাড়ির আঁচল ঠিক করে ছোট্ট একটা ধন্যবাদ বলে রুশা দরজার চিপা থেকে বের হতে নিলে ফায়াজ তার হাতটা ধরে নেয়।
“কিছু কথা আছে আমার। শুনে যাও।”
শান্ত নজরে তাকায় সে স্যারের চক্ষুপাণে।
“আর তো কোনো কথা থাকার কথা না। এখনো কিছু কথা রয়ে গেছে?”
“টন্ট কোরো না আমায়। বিরক্ত লাগে।”
“দয়া করে হাতটা ছাড়ুন। নিউ ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্টের সাথে দরজার চিপায় স্যার। জানা-জানি হলে আমার মান-সম্মানের সাথে সাথে আপনার ক্যারিয়ারে দাগ লাগবে। আপনার কাছে সবার উর্ধ্বে হচ্ছে আপনার ক্যারিয়ার। হাতটা ছাড়ুন।”
“পিঞ্চ করে কথাগুলো বলছো। তাই তো?”
“আমায় সাহায্য করেছেন এর জন্য ধন্যবাদ। এবার হাতটা ছাড়ুন।”
“যদি না ছাড়ি। কী করবে? চেঁচাবে? না-কি লোক জোরো করবে?”
রুশার ভেতরটা গলতে শুরু করছে। দম বন্ধ লাগছে। চোখে হয়তো পানিও চলে আসছে। কিন্ত সে মনে প্রাণে চাইছে যাতে তার চোখে পানি না আসে।
“এই মুহুর্তে যদি আমি দম বন্ধ হয়ে মরে যাই। এর দায় কে নেবে? আপনি নেবেন?”
“মানে?”
“আপনাকে দেখলে এখন আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না। আমার উন্মাদের মতো লাগে। দু’বছর আগে ঘটে যাওয়া প্রতিটা স্মৃতি গভীর ভাবে আমার মনে পড়ে। তখন নিজেকে রাস্তার পাগল কুকুরের চাইতেও খারাপ মনে হয়। এইযে এই মুহুর্তে, আমার নিঃশ্বাসটা মনে হয় আমার কলিজার গোড়ায় আটকে আছে। আমার কষ্ট হচ্ছে। দেখছেন না আমি ঘামছি। আমায় ছেড়ে দিন প্লিজ। প্লিজ আমায় যেতে দিন।”
রুশার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে ফায়াজ। সত্যিই রুশা ঘামছে। কপালে, গলায়, নাকের নিচে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। চোখ জোড়া লাল হয়ে আছে। নিঃশ্বাস পড়ছে ঘন ঘন। ফায়াজ রুশার হাতটা ছেড়ে দেয়। সাথে সাথে রুশা তার চোখ জোড়া আবারও বন্ধ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে।
ফায়াজ প্রশ্ন করে,
“এতটা বদলে গেলে কেন?”
রুশা চলে যাওয়ার আগে উত্তর দেয়,
“ভেঙে যাওয়া মন নিয়ে কখনো একটা মানুষ ভালো থাকতে পারে না। আমিও ভালো নেই। আবার ভালোই আছি। বদলে গেছি কি-না জানি না। তবে ভেতরটা মরে গেছে। আসছি।”
রুশা দৌড়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে যায়। চিন চিনে একটা ব্যথা নিয়ে ফায়াজ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।
রাত প্রায় সোয়া বারোটা।
নিজের ঘরে পায়চারি করছে ফায়াজ। দুপুরে বলা রুশার কথাগুলো মস্তিষ্কে ঘোরাঘুরি করছে। মেয়েটা সত্যিই আর আগের মতো নেই। সে কি তবে নিজের দুঃখ ভুলতে গিয়ে একটা বাচ্চা মেয়ের মনে অনেক বড় আঘাত করে ফেলেছে? যেই আঘাত সহ্য করতে না পেরে মেয়েটা নিজেকেই পাল্টে ফেলেছে। কিন্তু সেই সময়ে তারও যে হাত-পা বাঁধা ছিলো। হুট করে একটা নতুন সম্পর্কে জড়াতে চায়নি সে। তাও উনিশ বছর বয়সের একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে। তাছাড়া সে নিজেই তখন বড় ধরনের এক ধাক্কা খেয়েছে।
দরজায় কড়া পড়ার শব্দে পেছনে তাকায় ফায়াজ। ছোট বোন ফারহানা দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। বোনের সঙ্গে ফায়াজের দারুণ মিল। একা থাকলে এবং কাজ না থাকলে দু’জন ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করে কাটায়। বোনের সব কথা সে জানে তার সব কথা বোন জানে। ফারহানা এবার থার্ড ইয়ার স্টুডেন্ট। বাসায় বাবা-মা, বোন আর সে। চারজনের ছোট একটা পরিবার ফায়াজের। ফারহানাকে দেখে ফায়াজের রুশাকে মনে পড়ছে আবারও। তার এই ছোট পরিবারে ওই ছোট্ট রুশাটা যদি আসতো তবে হেসে খেলেই থাকতো। নিজের ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে এখন।
“কী ব্যাপার লেকচারার ভাই আমার! এত রাতেও পায়চারি? কারণ কী?”
“ঘুমাস নি তুই?”
“ম্যাথ শেষ করলাম মাত্র। বার বার বলেছিলাম, ভাইয়া ম্যাথ নিয়ে পড়বো না। সে-ই জোর করে আমায় ম্যাথে ভর্তি করেছো।”
“সমস্যাগুলো আমায় দেখালেই পারিস।”
“আগে নিজের সমস্যা শেষ করো। পরে আমার ম্যাথের সমস্যা দেখিও।”
“মানে?”
“হয়েছে কী? মুড অফ কেন?”
ফারহানা রুশার কথা জানে আগে থেকেই। তবে কখনো দেখেনি। বোনের কাছে বাকি সব খুলে ভলে ফায়াজ। ফারহানার এবার নিজের ভাইয়ের প্রতি বিরক্ত লাগছে।
“তোমরা পুরুষ মানুষ এমন কেন? যখন সে চেয়েছে তুমি মুনতাহার শোকে কাতর থেকে তাকে রিফিউজ করলা। আর এখন…! দ্বিতীয় কথা আর কি কোনো ভার্সিটি ছিলো না শহরে। ওই মেয়ের এই ভার্সিটিতেই ভর্তি হতে হলো। বেচারি ফেঁসে গেছে।”
“প্রাণবন্ত মেয়েটা আজ একেবারেই নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে।”
“পরিসংখ্যানের ওই সূত্র ছাড়া তোমার মাথায় কিছু আছে বলে আমার তো মনে হয় না। এখন কী করবা? কিছু ঠিক করেছো?”
“বুঝতে পারছি না।”
“এক কাজ করো। এত দ্রুত সব কিছু করতে যেয়ো না। না হয় ওই মেয়ে এতসব ট্রমা নিতে পারবে না। আরও কিছুদিন সময় দাও।”
বোন তার নিজের মতো করে যতটা পেরেছে বলে গেছে। বাকিটা ফায়াজের ওপর নির্ভর করে।
মোবাইল হাতে নিয়ে রুশার ফেসবুক টাইমলাইন ঘুরছে ফায়াজ। তেমন কিছুই নেই টাইমলাইনে। মাঝে মাঝে দুই একটা গান শেয়ার করে। আর প্রোফাইল পিকচারটা চেঞ্জ করা। প্রোফাইল পিকচারটায় ক্লিক করলে দেখতে পায়, মিষ্টি একটা মেয়ে শাড়ি পরে খোঁপায় গাজরা দিয়ে বসে আছে। দৃষ্টি তাহার বহুদূরে। ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসির ভাজে যে সহজেই কান্না লুকিয়ে রেখেছে।
রুশাকে এবং নিজেকে আরও কিছু সময় দিবে সে। হ্যাঁ আরও কিছু সময় দেবে।
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায়………………