স্যার পর্ব-১২

0
1904

#স্যার
#পর্ব_১২
লেখনীতে — আফরোজা আক্তার

খাবার টেবিলে নীরবতা। টেবিলে চার জন মানুষ বসা আছে। অথচ কারো মুখে কোনো কথা নেই। দশ বছরের রাইসুলও তেমন কথা বলে না। আসরাফ খাচ্ছেন কম মেয়েকে দেখছেন বেশি। কেমন যেন শীতল হয়ে গেছে তার চঞ্চলা মেয়েটা। বিগত দুই বছর আগে মেয়ের একটা সমস্যা নিয়ে তার সাথে কথা বলেছিলেন তার স্ত্রী নাসরিন। বাবা হয়ে মেয়ের সাথে ওইসব ব্যাপারে কথা বলতেও ইতস্তত লাগে আশরাফের। তাই সব ভার তিনি স্ত্রীকেই দিয়েছিলেন। কিন্তু নাসরিনকে কোনো কষ্ট করতে হয়নি। কেউ একজন চলে যাওয়ার পর থেকেই তার মেয়ে বদলে গেছে। গভীর রাতে নাসরিন তার বুকে মাথা রেখে চোখের পানি ফেলেন। কেন যেন তখন নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়। মনে হয় তিনি পৃথিবীর সব থেকে ব্যর্থ বাবা এবং ব্যর্থ স্বামী।
মেয়ের আড়ালে নাসরিন তার স্বামীকে হালকা খোঁচা মেরে দিয়েছেন। আশরাফ ছোট নিঃশ্বাস ফেলেন। মাথা তুলে মেয়ের দিকে তাকান তিনি। প্লেটে খাবার যেভাবে দেওয়া হয়েছে সেইভাবেই আছে। একটা খাবারও বিগত দশ মিনিটেও পেটে যায়নি রুশার। এইভাবে থাকতে থাকতে তার মেয়ে হয় পাগল হয়ে যাবে নয় মরে যাবে। এটা ভেবেই আশরাফ আর নাসরিনের যত ভয়।
পানি খেয়ে তিনি কথা বলার জন্য প্রস্তুত হোন। আজ-কাল মেয়ের সাথে কথা বলতে গেলে তাকেও প্রস্তুতি নিতে হয়।
“রুশা!”
“জ্বি।”
“পায়ের ব্যথা কেমন হয়েছে মামুনি।”
“একটু একটু আছে। সেড়ে যাবে।”
“মেডিসিন নিচ্ছো তো মামুনি?”
“হ্যাঁ।”
“আগামীকাল তো শুক্রবার। তোমার সাত্তার আংকেলের বাসায় দাওয়াত আছে। তুমি যাবে?”
“নাহ আব্বু। আমার ইচ্ছে নেই যাওয়ার।”
“চলো না মামুনি। গেলে ভালো লাগবে।”
“যেখানে যেতেই ইচ্ছে করছে না। সেখানে গেলে ভালো কীভাবে হবে তা বুঝতে পারছি না আব্বু।”
আশরাফ আর কোনো কথা বলেনি। ইদানীং তিনিও কথা বলা প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন। তবে তা মেয়ের সাথে। মেয়েও চুপচাপ থাকে তাদের সাথে। তারাও চুপচাপ থাকে মেয়ের সাথে। প্রায় পাঁচ মিনিট পর রুশা বলে,
“আব্বু, একটা কথা বলার ছিলো। বলবো?”
খুশিতে আশরাফ এবং নাসরিনের চোখ জ্বলে ওঠে। মেয়ে আজ অনেকদিন পর নিজ থেকে কিছু বলতে চেয়েছে। আশরাফ এক মিনিট অপেক্ষা না করেই বললেন,
“হ্যাঁ, বলো মামুনি।”
“আব্বু, এই ভার্সিটিটা বদলানোর কোনো ব্যবস্থা আছে?”
রুশার কথায় বেশ বড়সড় ধাক্কা খায় আশরাফ। এখন ভার্সিটি বদল? কীভাবে কী! তারা স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই অবাক।
“ভার্সিটি বদলানোর ব্যবস্থা বলতে?”
“মানে আমি ভার্সিটি চেঞ্জ কর‍তে চাচ্ছিলাম।”
“কেন মামুনি? এই ভার্সিটিটা তো অনেক ভালো।”
“আসলে আমার ভালো লাগছে না।”
“হুট করে এইভাবে বদলানোর তো ব্যবস্থা নেই। নেক্সট ইয়ার ছাড়া কিছু করাও যাবে না। তাতেও সমস্যা। তোমার ইয়ার লস হবে। কী হয়েছে রুশা? বাবাকে বলো। কোনো সমস্যা? ভার্সিটিতে কেউ কিছু বলেছে?”
রুশা প্লেটে খাবার নাড়াচাড়া করছে। কিছুই বলতে পারছে না। ভেতরের আগুন কাউকে দেখানোর নয়।
“নাহ। কোনো সমস্যা হয়নি। সব ঠিক আছে।”
রাতে শুয়ে আছে রুশা। কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে। কাব্যিক টাইপ কিছু। নিজেকে কবি বানাতেও ইদানীং ইচ্ছা জাগে রুশার। অদ্ভুত ইচ্ছা সব। ভাবছে আচ্ছা মন ভেঙে যাওয়া মানুষগুলোই কি তবে কবি হতে পারে?
সে-ও কয়েকবার কিছু লিখতে চেয়েছিলো কিন্তু পারেনি। তার মনে হয়, তার মাথায় কেবল পরিসংখ্যানের ওই কঠিন কঠিন সূত্র ছাড়া আর কিছুই নেই। কাব্যিকতার ক টাও ধারে কাছে নেই। কাব্যিকতা তো দূরে থাক।
সাউন্ড সিস্টেমে রবীন্দ্র সংগীত শুনতে মন চাইছে। ঘড়িতে নজর দেয়। এগারোটা বেজে বিশ মিনিট। এখন সাউন্ড সিস্টেমে গান শুনলে বাবা-মা কি তাকে বকবে? অবশ্য এই দুই বছরে বকা কি জিনিস তা রুশা ভুলে গেছে।
সাত-পাঁচ না ভেবেই রুশা সাউন্ড সিস্টেমে গান প্লে করে। আমারও পরাণ যাহা চায়, তুমি তাই, তুমি তাই গো। আমারও পরাণ যাহা চায়। তুমি সুখ যদি নাহি পাও, যাও সুখের-ও সন্ধ্যানে যাও, আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়ও মাঝে, আর কিছু নাহি চাই গো। আমারও পরাণ যাহা চায়। তুমি তাই, তুমি তাই গো। আমারও পরাণ যাহা চায়।
গান শুনছে আর গ্যালারি দেখছে রুশা। তাতে আলাদা একটা ফোল্ডার সেভ আছে। যার নাম স্যার নামে রাখা হয়েছে। গ্যালারিতে ফায়াজের প্রায় ৫০+ ছবি সেভ করা। দুই বছর আগে রুশা ফেসবুক থেকে ছবি গুলো নামিয়ে রেখেছিলো। এখন অবশ্য আগের থেকে একটু পরিবর্তন হয়েছেন। টিচার বলে কথা। শুধু টিচার না, রীতিমতো লেকচারার।
গানের সাথে নিজেকে মেলাচ্ছে রুশা। আসলেই কি তাই? স্যার কি তবে সুখের জন্য তাকে ছেড়েছিলো? হৃদয় মাঝে তো সে তার স্যারকেই ধারণ করে রেখেছে এখনো। হয়তো আজীবন রাখবে।
সাউন্ড সিস্টেমে পরবর্তী গান প্লে হয়েছে। আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো, তবু আমারে দেবো না ভুলিতে। বাতাস হইয়া জড়াইবো কেশ, বেনী যাবে যবে খুলিতে। আমারে দেবো না ভুলিতে।
এই গানের সাথেও মিল পাচ্ছে সে নিজের। স্যার হারিয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু সে তাকে ভুলতে পারছে না। সত্যিই ভুলতে পারছে না। হয়তো কখনো পারবেও না।
দু’চোখের কোণ বেয়ে পানি গড়াচ্ছে। ঠোঁট জোড়া কাঁপছে ভীষণ। কিন্তু উপায় নেই তার। জোরে কান্না করার কোনো জায়গা নেই। আজ অনেকদিন পর তার চোখ দিয়ে পানি গড়াচ্ছে। ইমোশন জিনিসটা খুব খারাপ। ভেতরটাকে ভেঙে গুড়িয়ে দেয়। কিন্তু বোঝার অবকাশ নেই।
পনেরো দিন পর।
আজ ভার্সিটিতে অনুষ্ঠান। শাড়ি পরে যেতে হবে। রুশা শাড়ি পরতে পারে না। কিন্তু তার শাড়ির অভাব নেই। চোখে যেই শাড়িই ভালো লাগে সেইটাই কেনে। কিন্তু পরা আর হয় না। নিজের পছন্দের ওপর খুব একটা ভরসা নেই তার। সে শুধু মানুষ হিসেবে তার স্যারকেই পছন্দ করেছিলো। মা’কে বলায় মা এসে সব থেকে সুন্দর শাড়িটা বাছাই করে দেয় তাকে। নাসরিন বেশ ভালো মর্ডান চিন্তাভাবনার মানুষ। নাসরিনের মতো হয়েছে মেয়েটা। আশরাফ মাঝে মাঝে রুশার মাঝে নাসরিনের আদল খুঁজে পান। তবে দু’জনের চরিত্র আলাদা। নাসরিন রুশাকে শাড়ি পরিয়ে দেয়।
“খোঁপা করে দেই? নাকি চুল ছাড়া রাখবি?”
“ছাড়া রাখবো না আম্মু। গরম লাগবে পরে। এমনিতেই গরম লাগছে।”
“গরম লাগার তো কথা না। শাড়িটা তো নরমালই।”
“কী জানি, হয়তো আমারই গরম লাগছে।”
“খোঁপা করবি?”
“দাও তাহলে খোঁপা করে।”
“তোর বাবা তো আজ বাসায় আছে। বাহিরে পাঠাই। একটা বেলীফুলের মালা নিয়ে আসুক। তোর তো বেলীফুলের মালা খুব পছন্দের। খোঁপায় পরবি।”
“নাহ আম্মু। ওসবের প্রয়োজন নেই। ওইখানে আর্টিফিশিয়ালের সাদা গাজরা রাখা আছে। ওইবার নিউমার্কেট থেকে কিনে দিয়েছিলে। সেটাই পরিয়ে দাও।”
“আচ্ছা।”
নাসরিন মেয়ের চুল বেঁধে দেন। রুশা সেখানেই বসে হালকা সাজতে শুরু করে। যদিও সাজ তার ততটা ভালো লাগে না। তবুও সাজতে হয় মাঝে মাঝে। সে বিশ্বাস করে, মনের কষ্টকে ঢাকতে সাজটা বেশ জরুরী। সাজের ভাজে কষ্ট লুকানোর মজাই আলাদা। সম্পূর্ণ সাজ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত নাসরিন মেয়ের বিছানায় বসে আছেন। মেয়েকে দেখছেন। কী যে অপূর্ব লাগছে তার মেয়েটাকে! সেই ছোট্ট রুশা আজ ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। একদিন পরের বাড়ি পাঠাতে হবে। কিন্তু মেয়ে কি তার পরের বাড়ি গিয়ে ভালো থাকতে পারবে? মেয়ের মনে যে একজনই বাস করছে।
“মা, চোখে কাজল দিবো? নাকি খালি থাকবে।”
“কালো কাজলটা দে। সুন্দর লাগবে।”
“আচ্ছা।”
চোখটাকে ন্যুড কালারের প্যালেট দিয়ে সাজিয়েছে বলে অপূর্ব লাগছে। মাসকারা দিয়ে ল্যাশগুলো টানা টানা করায় আরও ভালো লাগছে। নাসরিন কয়বার যে মনে মনে মাশা-আল্লাহ বলেছেন এর ইয়ত্তা নেই।
সাজ সম্পূর্ণ। রুশা উঠে দাঁড়ায়। শাড়ি পরাতে তাকে লম্বা লাগছে নাকি সে এমনিতেই লম্বা এটা ভাবছে। নাকি আয়নার দোষ? তাও ভাবছে সে। ঘড়িতে সময় দেখছে রুশা। তাদের দশটায় যেতে বলা হয়েছে। কিন্তু এখন নয় টা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। একটু দেরি হবে।
রিমিকে ফোন করে রুশা। রিমি ফোন রিসিভ করে কানে নেয়৷ রুশা বাসায় বসে বুঝে গেছে রিমি এখন ভার্সিটিতে। আশেপাশে অন্যান্যদের বক বক শোনা যাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তার মাথা ধরে গেছে।
“হ্যালো রিমি, তুই কি ভার্সিটি চলে গেছিস?”
“হ্যাঁ। তুই কখন আসবি। রেডি হয়েছিস। সানজিদা তো চলে এসেছে। ওকে যা সুন্দর লাগছে! আমি তোকে দেখার অপেক্ষায় আছি।”
“আমি এখনো বাসায়। একটু পর বের হবো।”
“তাড়াতাড়ি কর। কখন আসবি। সব জায়গায় দেরি করে।”
রুশা ফোন রেখে মায়ের দিকে তাকায়।
“স্লিপার না হিল?”
“কোনটায় তুই কমফোর্ট ফিল করিস?”
“দুটোতেই। তবে পায়ে যে ব্যথা।”
“স্লিপার ভালো লাগবে না। হিলটা ট্রাই কর।”
“আচ্ছা। আব্বুকে বলো আমি বের হবো।”
“তোর আব্বুও হয়তো রেডি। আয়।”
কোনো কারণে আশরাফের অফিস আজ ছুটি। রুশা ভেবেছে বাবার সাথেই যেতে পারবে। সেই অনুযায়ী গতকাল রাতে বাবাকে বলে রেখেছে।
মেয়েকে নিয়ে আশরাফ রওনা দিয়েছেন ভার্সিটির পথে। রিকশায় মেয়ে চুপচাপ বসে আছে। আশরাফের মন চাইছে কথা বলতে। মেয়েটাকে তার ভালো লাগে। খুব ভালো লাগে। অফিসের সবাই যখন রুশাকে নিয়ে প্রশংসা করেন তখন নিজেকে বাবা হিসেবে খুব গর্বিত লাগে সেই সাথে মনটা আনন্দিত লাগে।
“খুব গরম পড়ছে। তাই না মামুনি?”
“হ্যাঁ আব্বু।”
“ঠান্ডা কিছু কিনে দেই?”
“নাহ, লাগবে না।”
“টাকা আছে সাথে?”
“আছে।”
“কত আছে?”
“গুনে দেখিনি।”
আশরাফ ওয়ালেট থেকে পাঁচ’শ টাকার একটা নোট বের করে বললেন,
“এটা রাখো। খরচ কোরো৷”
“আমার লাগলে আমি চেয়ে নিবো আব্বু। এখন দিয়ো না প্লিজ।”
আশরাফ আর কিছু বলেনি। টাকাটা ওয়ালেটে রেখে দিয়ে চাপা নিঃশ্বাস ছাড়ে। জ্যামের কারণে বিশ মিনিট পর রিকশা এসে ভার্সিটির সামনে দাঁড়ায়।
“দেরি হয়ে গেল। তাই না মামুনি?”
“সমস্যা নেই। আমি ম্যানেজ করে নিবো। তুমি আসবে ভেতরে?”
“নাহ। তুমি ভেতরে যাও। সময় মতো বাসায় চলে যেয়ো। নয়তো আব্বুকে ফোন কোরো।”
“আচ্ছা।”
রুশা ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। পেছন থেকে হুবুহু নাসরিনের মতো লাগছে মেয়েকে। নাসরিনের হাঁটাও এমন ধীর গতির। আশরাফ রিকশা ঘুরিয়ে দিতে বলেন। বাসায় যাবেন তিনি এখন।
অডিটোরিয়ামের সামনে যেতেই সবার নজর পড়ে রুশার দিকে। মেয়েদের নজর রুশার শাড়ি আর সাজের ওপর। ছেলেদের নজর রুশার সৌন্দর্যের ওপর। সবুজ রঙের সিল্ক শাড়িতে অপূর্ব লাগছে রুশাকে। এত সিম্পল সাজ অথচ এত অপূর্ব।
রুশার একবার অস্বস্তি হচ্ছিলো আবার হচ্ছিলোও না। নিজের ব্যাপারে অস্বস্তি হলে অন্যরা সুযোগ পেয়ে যায়। তাই যতটা পারা যায় নিজেকে কমফোর্ট জোনে রাখা। কয়েক কদম দিতেই রিমি দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে রুশাকে। রুশাও মিষ্টি হাসি দেয়।
“ইশ! আমি কেন ছেলে হলাম না?”
“হলে কী করতি?”
“তোকে নিয়ে পালিয়ে যেতাম।”
“আশরাফ সাহেব থানা পুলিশ এক করে প্যাদানী খাওয়াতো।”
রুশার কথায় রিমি খিল খিল শব্দ করে হাসে। এর মধ্যেই স্পোর্টস টিচার এসে রুশাকে নিয়ে যায়। সেখানে সানজিদা নামের মেয়েটিও ছিলো। স্পোর্টস স্যার রুশাকে সব বুঝিয়ে দিচ্ছে। রুশাও মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হ্যাঁসূচক ইশারা করছে।
রুশার এই মাসুম চেহারাটা দূর থেকে লক্ষ করছে একজন। কাছে গিয়ে গাল দুটো টেনে দিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, এই মেয়ে তুমি এত সুন্দর আর ইনোসেন্ট কেন? কিন্তু উপায় নেই।এমন করলে চড় থাপ্পড় খাওয়ার চাঞ্চ বেশি। মনে প্রশ্ন জাগে, রুশার হাত তার গাল অবধি উঠবে তো? মনে তো হয় না। আপাতত দুটো ছবি তুলতে নিশ্চয়ই না করবে না সে। ধীর পায়ে রুশার পেছন দিকে গিয়ে দাঁড়ায় সে। এক হাত দিয়ে রুশার কাঁধে স্পর্শ করলে রুশা পেছনে তাকায়। ফুয়াদকে দেখে হালকা হেসে বলে,
“কী ব্যাপার! তুমি এখানে?”
এই পনেরো দিনে ফুয়াদ আর রুশার সম্বোধন তুমিতে এসেছে। রুশার চোখে ফুয়াদ শুধু একজন বন্ধু। কিন্তু রুশা জানে না ফুয়াদের চোখে রুশা কী? রুশা আর ফুয়াদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রিমিও এসে দাঁড়ায় সেখানে। রিমির সাথেও ফুয়াদের বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক। রিমিকে দেখে একটু নারাজ হয় ফুয়াদ। সে চেয়েছিলো একা কথা বলবে রুশার সাথে। কিন্তু তা হলো না।
“আসো তোমার দুটো ছবি তুলি। তোমায় আজ দারুণ লাগছে।”
“ছবি তুলতে ভালো লাগছে না। পরে তুলি?”
রিমি তখন বলে,
“ফুয়াদ, আমার কয়েকটা ছবি তুলে দাও।”
মুখের ওপর না করতে পারে বা ফুয়াদ। তাই ব্যথিত মনে সে রিমির ছবি তুলে দেয়।
এরই মাঝে মেয়েদের নজর পড়ে অন্য আরেকজনের ওপর। সবুজ রঙের পাঞ্জাবিটা তাকে দারুণ মানিয়েছে। স্যারের ওপর ক্রাশ খাওয়া ন্যাকি মেয়েগুলোর অবস্থা দেখে হেসে খুন হওয়ার মতো অবস্থা। এমন ব্যাচেলর স্যার থাকলে কোন ফিমেল স্টুডেন্ট ক্রাশ না খাবে। ফায়াজ আজ পাঞ্জাবি পরে এসেছে। যেহেতু অনুষ্ঠান, তাই একটু ফিটফাট হওয়ার চেষ্টা। এমনিতেও সে ফিটফাট। আজকে একটু বেশিই ফিটফাট হয়েছে মনে হচ্ছে। তার ধারণার বাহিরে ছিলো যে তার পোশাকের রঙের সাথে অন্য একজনের শাড়ির রঙটা হুবুহু মিলে যাবে। স্টেজে এসেই সে রুশাকে দেখতে পায়। পুরো হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সে রুশার দিকে। অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছিলো ওই মুহুর্তে তার মনের মধ্যে। রুশা চুপচাপ এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে এখনো এদিকে তাকায়নি। তাকালে হয়তো লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলতো। নয়তো তার নজর এড়িয়ে যাওয়ার জন্য এখান থেকে সরে পড়তো।
এগারোটায় প্রধান অতিথির আগমন ঘটে। সবাই তাকে ফুলের বৃষ্টি দিয়ে বরণ করে। ভার্সিটির গেইট থেকে স্টেজ পর্যন্ত ফুলের বর্ষণ হয়। প্রিন্সিপাল স্যার সহ প্রতি ডিপার্টমেন্টের স্যাররা সবাই প্রধান অতিথির সাথে কথা বলেন। এরপর তাদের আসন গ্রহণ করার জন্য বলা হয়। প্রথমেই ব্যাচ পরানো হবে। মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, ফার্স্ট ইয়ার থেকে দু’জন এসে ব্যাচ পরাবেন। কথানুযায়ী সানজিদা শারমিন নামের মেয়েটি প্রধান অতিথির বাম পাশ থেকে ব্যাচ পরানো শুরু করে। আর রুশা প্রধান অতিথিকে দিয়েই শুরু করে।
এখানে হাসতেই হবে৷ না চাইতেও হাসতে হবে তাকে। মলিন হাসি দিয়ে রুশা সালাম দেয়। প্রধান অতিথিও সালাম গ্রহণ করেন। নাম জিজ্ঞেস করেন।
“নাম কী?”
“তনিমা আফরোজ।”
“গড ব্লেস ইউ।”
“থ্যাংক ইউ স্যার।”
ডান পাশ থেকে এক এক করে সব স্যারদের ব্যাচ পরানো শুরু করে রুশা। প্রত্যেককে একবার করে সালাম দিয়ে ব্যাচ পরাচ্ছে রুশা। পা জোড়া একজনের সামনে এসেই স্তব্ধ হয়ে যায়। ক্যামেরায় ছবি তোলা হচ্ছে। রুশা এই মুহুর্তে তার স্যার অর্থাৎ ফায়াজের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হাত-পা অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে তার। কলিজায় কামড় পড়ছে অনবরত। কণ্ঠনালী ধরে আসছে। পানির পিপাসা পেয়েছে। হাত তার ফায়াজের বুক অবধি উঠছে না। ফায়াজ তাকিয়ে আছে রুশার দিকে। চাপা স্বরে বলছে,
“মনকে শক্ত করে ব্যাচটা পরাও। সবাই তাকিয়ে দেখছে।”
রুশা যেন তার কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। হাত-পা কাঁপছে তার। কাঁপা হাতে ফায়াজের বুক পকেটের পাশে হাত রাখে রুশা। ফায়াজ লক্ষ করছে রুশার হাত কাঁপছে। ফায়াজের বুকের বাম পাশের জায়গাটা হাত রুশার। ফায়াজ আড় চোখে চারপাশটা দেখছে। একটা সময় ফায়াজ সুযোগ বুঝে বলে,
“বুকের বাম পাশে হাত রেখেছো। বুঝে শুনে ব্যাচ পরাও। ভয় হচ্ছে এখন। কাঁপা হাতে ব্যাচ পরাতে গিয়ে পিনটাই না আমার বুকে বসিয়ে দাও। পরে আমার থেকে যন্ত্রণাটা তোমারই বেশি হবে। সহ্য করতে কষ্ট হয়ে যাবে তোমার।”
রুশার নিশ্বাস ভারী হচ্ছে। সে চাইছে এই ব্যাচ পরানোর কাজটা যত তাড়াতাড়ি শেষ করা যায়। কোনো রকম স্টেজ থেকে নামতে পারলে সে বাঁচে। ফায়াজের সামনে থাকাটা তার জন্য অত্যন্ত যন্ত্রণার। যা সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।

পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায়………………………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে