#স্যার
#পর্ব_১১
লেখনীতে — আফরোজা আক্তার
সিঁড়ি বেয়ে দু’জনেই উপরে উঠে যাচ্ছে। রিমি একটু বিরক্ত রুশার প্রতি। তার বিরক্তের যথার্থ কারণ আছে। সে রুশার বদলানোতে বিরক্ত। রুশার চুপ হয়ে যাওয়াতে বিরক্ত। রুশার কথায় কথায় খিল খিল করে না হাসাতে বিরক্ত। আর আজকে চরম বিরক্ত হয়েছে রুশার ফুচকা না খাওয়া নিয়ে। কোন মেয়ে ফুচকা না খায়। কার না ফুচকা পছন্দ। রুশাকে বার বার বলেও ফুচকা খাওয়াতে পারেনি রিমি।
রুশার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিলো। তাই থেমে থেমে হাঁটছে সে। উপরে উঠে খানিকটা সময় দাঁড়িয়ে পড়ে রুশা। রিমি এটাতেও বিরক্ত তবে মুখে কিছু বলেনি। শুধু নরমাল প্রশ্ন করে,
“দাঁড়িয়ে গেলি যে? ক্লাসে যাবি না?”
“যাবো। একটু জিড়িয়ে নেই। পা টা টন টন করছে।”
“ওহ।”
রুশা রিমির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মলিম হাসি দিচ্ছে সে। সে-ও জানে, রিমি তার উপর খুব বিরক্ত। আর সে এটাও জানে রিমির বিরক্ত হওয়ার কারণ কী?
“খুব বিরক্ত হয়ে আছিস মনে হচ্ছে?”
রুশার প্রশ্নে রিমি মুখ তুলে তাকায়। রুশার চেহারা দেখে রিমিরই কেঁদে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে এই মুহুর্তে। কত্ত সুন্দর রুশা। কিন্তু কোথাও যেন যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে। বিশেষ করে রুশার চোখ জোড়া। মনে হচ্ছে, পলক পড়ার সাথে সাথে গড়িয়ে পড়বে পানি। প্রশ্নটাও এমন ভাবে করেছে মনে হচ্ছে রুশার একপাশ কোথাও যেন তলিয়ে গেছে।
“বিরক্ত কেন হবো? বিরক্ত হইনি।”
“মিথ্যা বলিস কেন? তুমি বিরক্ত আমার উপর।”
রিমি আর চুপ থাকতে পারেনি। সরাসরি প্রশ্ন করে,
“কেন এমন চুপসে গেছিস? তোকে এইভাবে দেখতে আর ভালো লাগে না। এইভাবে আর কত? একটা মানুষ আর কত গুমোট হয়ে থাকতে পারে। বলতে পারিস?”
রুশা মলিন হাসি দিয়ে বলে ওঠে,
“আমি গুমোট কোথায় হলাম। আর চুপসেই বা গেলাম কবে। তোর ভুল ধারণা এইসব।”
“আমার ভুল ধারণা? লাইক সিরিয়াসলি!”
“হ্যাঁ।”
“ফুচকা কেন খেলি না। যে রুশা কলেজ মাঠে ফুচকাওয়ালাকে দাঁড় করিয়ে ইচ্ছামতো ফুচকা খেয়েছে সেই রুশা আজ ফুচকার দিকে ফিরেও তাকায় না। কেন? কোথায় সমস্যা তোর? কোথাও একত্রে বসিস না। কারো সাথে কথাও ঠিকমতো বলিস না। ক্লাসের অন্যান্য মেয়েরা অলরেডি গসিপ করা শুরু করে দিয়েছে। তুই নাকি একঘেয়ে টাইপ মেয়ে। আলাদা থাকিস সব সময়। এইসব কী রুশা।”
“তারা আমায় দেখলোই একদিন। এরমধ্যে গসিপ শুরু করে দিয়েছে?”
“গসিপ করার জন্য একদিনের প্রয়োজন হয় না, এক মিনিট-ই যথেষ্ট।”
“আচ্ছা।”
“কী আচ্ছা! রুশা, তুই এইভাবে থাকিস না প্লিজ। দম বন্ধ হয়ে নয়তো স্ট্রোক করে মরে যাবি। কোনদিন ঘুম থেকে উঠে শুনবো তুই মরে গেছিস।”
“সেদিন কিন্তু নিজ হাতে আমায় শেষ সাজা সাজিয়ে দিতে হবে তোকে। এই বলে দিয়ে গেলাম আমি।”
রুশার কথা শুনে কলিজা মোচড় দেয় রিমির। সে কি একটু বেশি বলে ফেলেছে? না না একটু বেশি না, অনেকখানি বেশি বলে ফেলেছে। তার জন্যই রুশা এমন কথা বলেছে। রিমি খুব লজ্জিত তার কথার জন্য।
“স্যরি রুশা।”
“কিসের জন্য স্যরি?”
“এইভাবে বলতে চাইনি। কিন্তু তোকে এইভাবে দেখে আমি খুব অস্বস্তি বোধ করি। আমার সব থেকে কাছের বান্ধবীটা এইভাবে গুমরে গুমরে থাকবে এটা আমি মানতে পারি না। বিশ্বাস কর।”
“রিমি, আমার কী মনে হয় জানিস? আমার মনে হয় আমার মনে পঁচন ধরেছে। ধীরে ধীরে গন্ধ বের হবে। আস্তে আস্তে সেখানে পোকামাকড় বাসা বাঁধবে।”
“রুশা!”
“হ্যাঁ। তা ছাড়া আর কী হতে পারে? আমি কেন হাসতে পারি না। আমি কেন কাঁদতে পারি না। আমি কেন অনুভব করতে পারি না। আমার কোনো অভিযোগ নেই কেন? আমার কারো প্রতি অভিমান হয় না কেন? আমি কেন খাবারে স্বাদ পাই না। গতকাল মা’কে প্রশ্ন করেছিলাম। মা শুনে বলে, খিচুড়ি করে রান্না করি, খাবি?”
রুশার কথার পরিপ্রেক্ষিতে রিমি কী বলবে বুঝতে পারছে না তাই সে চুপ করেই আছে।
রুশা দো-তলা থেকে নিচে ক্যাম্পাসের মাঠের দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি তার বরাবরের মতো শান্ত হয়ে আছে। রিমিরও ভালো লাগছে না।
“চল ক্লাসে যাই।”
“রিমি, তোর স্যারের কথা মনে আছে?”
রুশার মুখে স্যারের কথা শুনে রিমির মেজাজ আরও অনেক খারাপ হয়।
“বালের স্যার কথা বলস কেন? ওই লোকটা চরম বেয়াদব আর অসভ্য। তার জন্যই আজ তোর এই অবস্থা। যদিও আমি তাকে কখনো দেখিনি। কিন্তু, আই হেইট হিম। ইয়েস, আই হেইট হিম।”
“যদি কখনো সে তোর সামনে এসে দাঁড়ায়। যদি কখনো বলে, আমিই রুশার সেই স্যার। তখন কী করবি তুই?”
“বড় ছোট জ্ঞান করবো না। ইচ্ছামতো কথা শোনাবো। ওই লোক গেছে তো গেছে, তোকে একেবারে শেষ করে দিয়ে গেছে।”
“তার কি আদৌ কোনো অপরাধ আছে?”
“আলবাত আছে। সে চাইলেই পারতো তোকে সময় দিতে।”
“আবার সে চাইলেই পারতো আমার সরলতার সুযোগ নিতে। কিন্তু…!”
“এখনো সে তোর চোখে ভালো?”
“ভালো না, তবে খারাপও না। শুধু বুঝতে পারেনি। আমায় যদি খানিকটা বুঝতো। তাহলেও হতো।”
“আমি ওই বদ লোকের কথা শুনতেই চাই না। আমি এতটুকুই বুঝি ওই লোক তোকে শেষ করে দিয়ে গেছে।”
রুশা মুচকি হেসে বলে,
“চল, ক্লাসে যাই। কষ্ট হচ্ছে দাঁড়িয়ে থাকতে।”
রিমি রুশাকে নিয়ে ক্লাসের দিকে রওনা হয়। এই এতক্ষণ যাবত তাদের কথোপকথনগুলো ফায়াজ সিঁড়ির কোণায় দাঁড়িয়ে থেকে শুনে নেয়। প্রতিটা কথাই ফায়াজের কানে আসে। রুশা যখন সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেছে ফায়াজও তখন পেছন পেছন সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে নেয়। তিন সিঁড়ি উপরে উঠেই সে রুশাকে দেখতে পায়। সাথে রিমিকেও। তাই সে দাঁড়িয়ে যায়।
রুশার প্রতিটা কথা ফায়াজ শ্রবণ করে। প্রতিটা শব্দ তার কানে যাচ্ছিলো আর সে অবাক হচ্ছিলো। সে রুশাকে কেমন বানিয়ে দিচ্ছে। কতটা নিষ্প্রাণ করে দিয়েছে সে রুশাকে। কিন্তু তার হাতেও যে কিছুই করার ছিলো না তখন। তাকে যে তখন রাশ টেনে ধরতে হয়েছিলো। মুনতাহার দেওয়া যন্ত্রণা গুলো তাকেও যে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে। ক্যারিয়ার বিল্ড-আপ করার নেশা তাকে এতটাই চেপে ধরেছিলো যে একটা বাচ্চা মেয়ের সরল মনের সরল অনুভূতিগুলোও তখন তার কাছে বিষের মতো লেগেছিলো।
চাপা নিঃশ্বাস ফেলে ফায়াজ ডিপার্টমেন্টের দিকে এগিয়ে যায়।
রুশা ক্লাসে গিয়ে বসে। আর তিন দিন পর ক্লাসে আসায় সবাই যেন তার দিকে কেমন করে তাকিয়ে আছে। যেন সে অন্য গ্রহের প্রাণী। কয়েকজন এসে জিজ্ঞেস করেছে পায়ে কী হয়েছে।
মাঝের সারির পঞ্চম বেঞ্চে বসে থাকা ছেলেটা তাকিয়ে দেখছে রুশাকে। মন্দ লাগছে না মেয়েটাকে দেখতে। মনে ধরেছে খুব। কথা বলা যেতেই পারে। আফটার-অল ক্লাসমেট বলে কথা।
ফুয়াদ নিজের জায়গা ছেড়ে রুশার পেছনের সিটে বসে। রুশা তখন চুপচাপ মোবাইল দেখছে। রিমি কথা বলছে অন্যজনের সাথে। ফুয়াদের মনটা খচখচ করছে রুশার সাথে কথা বলার জন্য।
“এক্সকিউজ মি?”
কারো কথা শুনে রুশা ঘাড়টা সামান্য ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। রুশাকে দেখে ফুয়াদ হালকা হেসে বলে,
“পরিচয় হতে এলাম। যেহেতু ক্লাসমেট আমরা। পরিচয় হওয়া যেতেই পারে।”
রুশাও হালকা হেসে বলে,
“আমার নাম রুশা। ভালো নাম তনিমা আফরোজ।”
“আমার নাম ফুয়াদ। ভালো নাম আবদুল আহসান।”
“সুন্দর নাম।”
“ধন্যবাদ। আপনাকে প্রথম দিন দেখেছিলাম। এরপর আর আসেননি।”
“প্রথম দিনই ছোট একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয় আমার। পায়ে ব্যথা পেয়েছিলাম খানিকটা। তাই রেস্টে ছিলাম।”
“এখনো তো মনে হয় ব্যথা আছে। খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছিলেন দেখলাম।”
“হ্যাঁ একটু-আধটু আছে।”
“কথা বলছি। বিরক্ত হচ্ছেন না তো।”
“একদমই না। আপনি তো বিরক্ত হওয়ার মতো কিছু বলছেন না। তাহলে রাগ করবো কেন?”
“আপনাকে দেখতে এতটা বিষন্ন লাগছে কেন? “আমার তো তা মনে হচ্ছে না।”
কথার এক পর্যায়ে ক্লাসে স্যার চলে আসে। তাই আর কথা বেশি বলতে পারেনি ফুয়াদ। ইচ্ছে করছিলো রুশার পাশে গিয়ে বসতে। কিন্তু উপায় নেই। রুশা যেই বেঞ্চে বসেছে সেখানে আর জায়গা নেই।
পুরো পঁয়তাল্লিশ মিনিট ক্লাস শেষে স্যার চলে যাওয়ার আগে ঘোষণা করেন,
“তনিমা আফরোজ আর সানজিদা শারমিন এই দু’জন দাঁড়িয়ে যাও।”
নিজের নাম শুনে রুশা দাঁড়ায়। স্যার তখন বলেন,
“তোমাদের দু’জনকে সিলেক্ট করা হয়েছে। সামনে অ্যানুয়েল স্পোর্টস এর অনুষ্ঠানে তোমরা দু’জন প্রধান অতিথি সহ বাকি স্যারদের ব্যাচ পরাবে। সানজিদা শারমিন প্রধান অতিথির বাম পাশের সব স্যারদের পরাবে এবং তনিমা আফরোজ, তুমি প্রধান অতিথি সহ তার ডান পাশের সমস্ত টিচারদের ব্যাচ পরাবে। এবারের ফার্স্ট ইয়ারদের থেকে তোমাদের বাছাই করা হয়েছে। কোনো গন্ডগোল করা চলবে না।”
রুশা অবাক হয়ে ভাবে এত স্টুডেন্ট থাকতে রুশাকেই কেন বাছাই করা হলো? অন্য কোনো কারণ নেই তো।
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায়………………..