#স্যার
#পর্ব_৪
লেখনীতে — আফরোজা আক্তার
ক্লাসে বসে আছে রুশা। মনটা তেমন ভালো নেই। রিমি এসে পাশে বসে।
“কী ব্যাপার রুশা? কী হয়েছে?”
“কিছু না।”
“আমাকেও বলবি না?”
“রাসিন কোথায় রে?”
“ইশার সাথে লাইব্রেরিতে বসে আছে।”
“ইশার সাথে ওর বন্ধুত্বের সম্পর্ক নাকি অন্য কোনো কিন্তু আছে? জানিস কিছু?”
“অন্য কিছু বলতে?”
“ন্যাকামি করিস নাকি? অন্য কিছু বলতে বুঝিস না?”
“ইউ মিন লাভ?”
“হুম।”
“দেখে তো তাই মনে হয়।”
“ওহ।”
“তোর রেজাল্ট এতো খারাপ কেনো হলো রে। সবাই অবাক হয়েছে।”
“জানি না।”
রুশা ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছে। ক্লাস থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। রিমি বললো,
“যাচ্ছিস কোথায়?”
“বাসায় বলে যাই।”
“পরের ক্লাস করবি না?”
“নাহ। আজ আর করবো না।”
এই বলে সে চলে যায়। রাসিনের পরিবর্তনটা মানতে পারছে না সে। বন্ধুরা এতোটাও বদলায়? কই সে তো বদলায় নি? রাসিন বদলে গেছে। ইশার সাথে চলে সে বদলে গেছে। রুশা নামের কেউ যে তার বন্ধু ছিলো সে তা-ও ভুলে গেছে। আশ্চর্যজনক ব্যাপার!
বাসায় এসে ফোন হাতে নেয় রুশা। ফেসবুক ঘাটাঘাটি করছে। নিউজফিড স্ক্রল করতে গিয়ে সাত্তার আংকেলের মেয়ে মিমের একটা পোস্ট সামনে পড়ে। পোস্টের কমেন্ট চেক করতে গিয়ে দেখে ফায়াজ কারিম আইডি থেকেও কমেন্ট করা হয়েছে। রুশা দ্রুত আইডির টাইমলাইনে যায়। অবাক হয়ে যায় সে। এ যে তার স্যার। বাহ! প্রোফাইল পিকটা তো খুব সুন্দর। এক এক করে ফায়াজের সব পোস্ট সব ছবি চেক করে সে।
নাসরিন এসে মেয়ের হাতে মোবাইল দেখে বলে,
“ফ্রেশ না হয়েই ফোন চাপতে বসে পড়েছিস? স্যারের পড়াগুলো হয়েছে?”
“পড়ে নিবো।”
“কয়টা বাজে এখন। ফ্রেশ হতে হবে না?”
“একটু পরে যাই?”
“নাহ, এক্ষুনি যাবি। ওঠ, ফোন রাখ।”
এতো শাসন ভালো লাগে না রুশার। সে স্বাধীনচেতা মানুষ। কিন্তু শাসন যেন বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। মায়ের কথা মতো ওয়াসরুমের দিকে ছুটে রুশা। পরবর্তী পদক্ষেপ, খাওয়া দাওয়া করে একটা লম্বা ঘুম। বিকেলে উঠে স্যারের হোমওয়ার্ক শেষ করা।
ঘড়িতে সাতটা বেজে পঁচিশ মিনিট। ফায়াজ রুশাকে সূত্র বোঝাতে ব্যস্ত। রুশা তার স্যারকে দেখায় ব্যস্ত। চোখাচোখির এই বিশেষ ব্যাপারটা ফায়াজের দৃষ্টি এড়ায়নি। কয়েকবার দেখার পর সে প্রশ্ন করে,
“আড় চোখে কী দেখছো তুমি?”
“আপনাকে দেখছি।”
রুশার এই উত্তরে ফায়াজ বিষ্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে। এই মেয়ে বলছে কী? আবারও প্রশ্ন করে,
“আমায় দেখার কী আছে?”
“অনেক কিছু।”
“যেমন?”
“স্যাররা কি আদৌ এত সুন্দর হয়?”
“আমার তো মনে হয় না।”
“তবে আপনি এতো সুন্দর কেন?”
“আমার সেটাও মনে হয় না।”
“আপনি খুব সুন্দর৷”
ফায়াজ চোখ বড়ো করে তাকায় রুশার দিকে। স্যারের চোখ রাঙানোও যেনো ভালো লাগছে তার। তাই সে-ও নির্দ্বিধায় তাকিয়ে আছে তার স্যারের দিকে। বিরক্ত ভরা কন্ঠে ফায়াজ বলে ওঠে,
“এমন থাপ্পড় মারবো তোমার কানের নিচে। ফাইযলামি করো নাকি তুমি সঙ্গে? চুপচাপ সূত্রগুলো দেখো। আমি পড়া ধরবো। না পারলে তোমার খবর আছে।”
“কয়টার খবর স্যার?”
“রুশা, আমার মেজাজ খারাপ করাবে না। দ্রুত পড়া শেষ করো।”
রুশা কিছুক্ষণের জন্য দমে যায়। স্যারের দেওয়া সূত্রগুলোতে চোখ বুলায়। কিন্তু কিছুই মাথায় ঢুকছে না।
মিনিট দশেক পর।
ফায়াজ রুশার সামনের থেকে বইটা নিয়ে নেয়।
“পড়াগুলো বলো।”
রুশা তো পড়া পারে না। এখন কী হবে? স্যার কি তাকে মারবে নাকি বকবে? যদি মারে! নাহ, এত্তো বড়ো মেয়ের গায়ে কি আর হাত তুলবে নাকি? যদি বকা দেয়! কি-ই বা আর বলবে? দুই একটা বকা-ই তো দিবে। দিক, আমার সমস্যা নেই। ওদিকে স্যার পড়া জিজ্ঞেস করছে, এদিকে সে এইসব ভেবে যাচ্ছে।
ফায়াজ কয়েকবার প্রশ্ন করার পরেও উত্তর পায়নি। স্টুডেন্ট চুপ থাকলে সেই লেভেলের মেজাজ খারাপ হয় তার। সহ্য করতে না পেরে স্কেল দিয়ে রুশার হাতের আঙুলে মারে সে। বারিটা হয়তো বেশ জোরেই লাগে আঙুলে।
“আহ! স্যার আপনি আমায় মারলেন কেন?”
“পড়া জিজ্ঞেস করেছি তোমায়। চুপ করে আছো কেন?”
“তাই বলে মারবেন?”
“আবারও মুখেমুখে তর্ক করছো?
“স্যার, আপনাকে একটা কথা বলি?”
“আবার কী কথা বলতে চাও?”
“স্যার, না মানে আসলে।”
“হ্যাঁ, কী হয়েছে?”
“মানে, আপনার এই জেন্টেলম্যান লুকের সাথে এই আচরণ একদমই মানাচ্ছে না।”
কথা শুনে ফায়াজের চোখ দুটো আরও বড়ো হয়ে যায়। এই মেয়ে এইসব কী বলে?
“তুমি কি আমার ওপর নজরদারি করো নাকি রুশা?”
স্যারের কথায় রুশা ভেতর ভেতর হাসছে। কিন্তু সেই হাসি বাহিরে বের করছে না। সে জানে, হাসি বের হলেই তার বিপদ। তাই নিজের সামলে নিচ্ছে। রুশার দিক থেকে নীরবতা পেয়ে ফায়াজ আবারও প্রশ্ন করে,
“কী হলো বলো?”
“স্যার, আই থিংক!”
“ইউ থিংক?”
“আই থিংক, আই ফল ইন লাভ উইথ ইউ।”
“হোয়াট?”
“স্যার, আই থিংক। প্লিজ ডোন্ট বি সো ওরি।”
“স্যাট-আপ। পড়ো।”
স্যারের ধমক খেয়ে রুশা দ্রুত বইয়ের পাতায় নজর দেয়। এদিকে ফায়াজের খুব অস্বস্তি হচ্ছে। তার টিউশনি জীবনে এই প্রথম কোনো ফিমেইল স্টুডেন্ট তাকে এই কথা বলেছে। তার ভাষ্যমতে, এই কাজ করার দুঃসাহস এই পর্যন্ত কেউ করেনি। রুশার দিকে চোখ যায় তার। চেহারায় স্পষ্ট বাচ্চামির ভাব বোঝা যাচ্ছে। তার মা ঠিকই বলেছিলেন প্রথম দিন, তাদের মেয়ে বয়স অনুযায়ী অত্যন্ত বাচ্চামো করে। কিন্তু এ কেমিন বাচ্চামো? যে সে তার স্যারকে চারদিনের মাথায় প্রপোজ করে বসে। ফায়াজ ভাবছে রুশার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলবে কি-না? আবার ভাবছে এই কথা বলা কি উচিত হবে? রুশা বাচ্চা মেয়ে। বয়সা সর্বোচ্চ আঠারো কি উনিশ হবে। এ সময় সবাইকেই ভালো লাগে। ক্লাসমেট থেকে শুরু করে ত্রিশ বছর বয়সের পুরুষ পর্যন্ত সবার প্রতিই এট্রাকশন কাজ করে। এটা শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রেই নয়, ছেলেদের ক্ষেত্রেও তাই-ই। ভাবছে আরও কিছুদিন সে নিজেই ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করবে। এরপর বাকিটা দেখা যাবে।
সেদিনকার মতো ফায়াজ চলে যায়। বই খাতা বন্ধ করে ফেসবুকে তার স্যারের আইডি ঘাটছে। লাস্ট পোস্ট বিশ মিনিট আগে। রুশা সময় মেলাচ্ছে। স্যার বাসা থেকে বের হয়েছে আধা ঘন্টা হবে। তার মানে বাসা থেকে বের হয়েই পোস্টটা করেছে। রুশা পোস্টে চোখ দেয়। কী লিখেছে তা দেখছে সে।
‘বাড়ন্ত বয়সে সবারই সব কিছু ভালো লাগে। একদিনের দেখাতেও তার প্রতি ভালোবাসা কাজ করে। আমার মতে, এটাকে ভালোবাসা বলে না। এটা শুধুই মোহ। এছাড়া আর কিছুই না।’
রুশা বুঝে গেছে পোস্টটা তাকে মিন করেই করা। ভাগ্যিস তার স্যারের টাইমলাইন পাবলিক করা, সেইজন্যই সব দেখতে পাচ্ছে সে। ইচ্ছে হচ্ছে একটা কমেন্ট করতে। কিন্তু নাহ, সে করবে না। যদি তার স্যার কোনো ভাবে টের পায় তার আইডি দিয়ে ফলো করা হয়েছে তাহলে সাথে সাথে ব্লকলিস্টে ট্রান্সফার করে দিবে। সেটা ভেবেই চুপসে যায় রুশা।
তিন দিন পর।
ক্লাসের সামনে থাকা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে রুশা। রাসিন এসে তার পাশে দাঁড়ায়। রাসিন তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে তাতে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। রাসিন ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নিজ থেকেই বলে,
“তুই কি আমার সাথে খুব রেগে আছিস?”
রুশা ধীর কন্ঠে বলে ওঠে,
“নাহ। রাগ করবো কেন?”
“আমি কিন্তু তোকে ব্লক করিনি।”
“হ্যাঁ, আমি দেখেছি।”
“তোর কি মন খারাপ?”
“নাহ তো। আমি একদম ঠিকাছি।”
“নাকি মাথায় কোনো দুষ্টু বুদ্ধি আঁটছিস।”
“তোর এমন কেন মনে হলো?”
“তোকে এতোটা শান্ত আগে দেখিনি। তাই বললাম।”
রাসিনের কথার পরে আর কোনো কথা বলেনি রুশা। তার ভাবনা অন্য কিছু নিয়ে। কার কাছে জিজ্ঞেস করলে সঠিক তথ্য জানতে পারবে সে। এটাই ভাবছে সে। রুশার দিক থেকে তেমন রেসপন্স না পেয়ে মুখ কালো করে রাসিনও চলে যায়। ব্যাগ কাঁধে রুশাও সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়।
বিকেলে মায়ের পাশে গিয়ে বসে রুশা। মা তখন টিভি দেখছে। তার মানে মুড ভালো আছে। প্রশ্নটা কি মা’কে করা ঠিক হবে? কলেজের বাংলা ম্যাম বলেছিলেন, তৃতীয় কাউকে এতোটা বিশ্বাস না করে নিজের মা’কে বিশ্বাস করবে। মন খুলে মায়ের সঙ্গে সব কথা শেয়ার করবে। মেয়েদের সব থেকে কাছের বন্ধুই হলো তাদের মা। মায়ের কাছে সব কিছুর সমাধান আছে। সেইজন্যই তো তিনি মা রুপে আমাদের কাছে আছেন। কাজল ম্যাম বেশ ভালো কথা জানেন। পার্ট বাই পার্ট বোঝান।
রুশা চট করেই তার মায়ের পায়ের উপর শুয়ে পড়ে। নাসরিন মেয়েকে নিজের কোলে পেয়ে হাসি মুখে প্রশ্ন করে,
“কী চাই?”
প্রশ্নটা করার কারণ হলো, রুশার যখনই কিছুর প্রয়োজন হয় তখনই সে তার মা’কে আহ্লাদ করে। আহ্লাদ করেই নিজের প্রয়োজনগুলো মিটিয়ে নেয়। তিনি আজকেও ভেবেছেন, মেয়ের বুঝি কিছু প্রয়োজন। তাই এই প্রশ্ন করেছে।
রুশাও আহ্লাদী স্বরে বলে,
“কিছু চাই না আম্মু। শুধু কিছু প্রশ্নের উত্তর চাই।”
“আচ্ছা কর। কী প্রশ্ন করবি?”
“ভালো লাগা মানে কী?”
মেয়ের করা প্রশ্নে একটু অবাক হোন নাসরিন। হঠাৎ এমন প্রশ্ন মেয়ের মনে কোথা থেকে এসেছে। উত্তর দেওয়ার আগে ভাবছে তিনি। রুশা অপেক্ষায় আছে, ভালো লাগা মানে কী প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায়। নাসরিন ভাবছে কতটা সহজ করে উত্তর দিলে তার মেয়ে বুঝবে ভালো লাগা মানে কী?
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায়…………………