স্মৃতিচারন পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0
1050

#স্মৃতিচারন
#লেখনীঃরূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
#পর্বঃ০৩ এবং শেষ।

-এতো ভালোবাসি কারন “তোমার চোখে দেখেছি আমার সর্বনাশ” সত্যি বলতে তোমার চোখের প্রেমে পড়েছি।

– তুমি আরো সুন্দর বউ পেতে। আমি তো দেখতে পঁচা।

-চুপ! আল্লাহর সৃষ্টি সব সুন্দর। আমার কাছে তুমি কি তা আমি জানি। আর আমি বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখে ভালোবাসিনি।

-আচ্ছা হইছে হইছে কোথায় যাচ্ছিলেন যান।

শ্বাশুড়ির মন যোগানোর চেষ্টা ননদিনীর সাথে আড্ডা আর ওনার খুনসুটির মধ্যে দিয়ে দিন যাচ্ছিলো। মা ফোন করে কথা বললেও বাবা কথা বলতেন না। বাবাকে প্রচন্ড মিস করতাম। আর ছোট ভাইটা বাড়ি যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করতো। কিন্তু বাবার মুখোমুখি হওয়ার সাহস আমার ছিলো না। কিভাবে বাবার অভিমান ভাঙাবো সেই চিন্তায় থাকতাম। ছয় ছয়টা মাস কিভাবে চোখের পলকে চলে গেলো। ও আবার ইতালি চলে যাবে।যেদিন ও চলে যাবে তার আগের দিন রাতে আমি আর সে জ্যোৎস্না বিলাস করেছি। ১৮০ টা দিন তার স্পর্শে ছিলাম। আচ্ছা সে যখন হাজার হাজার মাইল দূরে থাকবে তাকে ছুঁতে পারবো না। মাঝরাতে তাকে রাগানোর জন্য কোনো আবদার করতে পারবো না। প্রচুর জ্বর নিয়ে তার কাছে আইসক্রিম খাওয়ার বায়না করতে পারবো না। বলতে পারবো তোমার শরীরের ওম চাই। তাকে জড়িয়ে ধরে সারাদিনের মন খারাপ বিলীন করতে পারবো না। সেদিন তার বুকে মাথা রেখে চুপটি করে বারান্দায় বসে ছিলাম।
ফুঁপানোর শব্দে মাথা তুলে তার দিকে তাকাই বুঝতে বাকি রইলো না অনেক যোদ্ধের পর সে চোখের পানির কাছে হার মেনেছে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।এমন ভাবে ধরেছে মনে হয় ছাড়লে হারিয়ে যাবো। কপালে আলতো করে অধর ছুঁয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলেছিল,

– তোমাকে হাজার বার ভালোবাসি বললেও কখনো মাফ চাওয়া হয় নাই।

– মাফ কিসের জন্য?

– আমার জন্য তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হয়েছে। তোমার চরিত্র নিয়ে কথা বলেছে। সেদিন তোমার পাঠানো ছবি আর মেসেজ দেখে আমার পৃথিবী উল্টে গেছিলো। আমার শুধু মনে হচ্ছিলো তোমাকে হারিয়ে ফেললে আমি ম/রে যাবো। তাই তো ইতালি থেকে সোজা তোমাদের বাড়ি যাই। তোমাকে অনেক মেন্টাল প্রেশারের মধ্যে থাকতে হয়েছে জানি। তোমাদের বাবা মেয়ের সম্পর্ক নষ্ট করছি। বিশ্বাস করো অনেক বার চেষ্টা করেছি ওনার সামনে যাওয়ার আর ক্ষমা চাওয়ার কিন্তু সাহস হয় নাই। যার রাজকন্যাকে আমার জন্য সবাই ছি ছি করছে তার সামনে কোন মুখ নিয়ে যাবো বলতে পারো? রূপন্তি মানুষের হায়াত মউতের কথা বলা যায় না। আমাকে ক্ষমা করে দাও।

– রাগ হয়েছিল তোমার প্রতি। তবে এখন নেই। যে এতোটা ভালোবাসে তার প্রতি আর রাগ থাকে?

– আমার মা বড্ড সরল সোজা। যে যা বলে তাই বিশ্বাস করে আর মনে রাখে। ওনি কিছু বললে মন খারাপ করো না।কারণ তোমরা দুইজন আমার কাছে সমান । একজনকে ছাড়াও আমি থাকতে পারবোনা। আমি জানি আমার রূপন্তি সবাইকে তার মায়ায় জড়াতে পারবে।

এয়ারপোর্টে সবাই গেলেও আমি যাইনি। এই নিয়ে সে অনেক রাগারাগি করেছিলো। শুনেছি সে নাকি শ্বাশুড়ি মাকে বলেছিল,

– মা নিজের খেয়াল রেখো। আমার প্রতি কোনো রাগ রেখোনা। তোমার কথার অবাধ্য হয়েছি আমি। রূপন্তি কে ছাড়া আমি থাকতে পারতাম না। তুমি কি কখনো চাইবে তোমার ছেলে আফসোস নিয়ে বেঁচে থাকুক। কখনো চাইবে তোমার ছেলে সংসার জীবনে অসুখী থাকুক। তুমি তো চাও তোমার ছেলে সুখী হউক। তোমার ছেলের সুখ যে রূপন্তিতে। মা মেয়েটা আমার জন্য অনেক কিছু হারিয়েছে। বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত। ওর কাছে আমি এমনিতেই অপরাধী। আর আমাকে অপরাধী করো না। নিজের মেয়ের মতো দেখো।

প্রতিত্তোরে ওনি শুধু মাথা নেড়েছেন। আর শ্বশুর বাবা জড়িয়ে ধরে হেঁচকি তুলে শুধু কেঁদেছেন। গন্তব্যে পৌঁছানোর পর আমাকে দেওয়া তার প্রথম মেসেজ ” তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসো না। ভালোবাসলে এয়ারপোর্টে আসতে বিদায় দিতে “।

সে যাওয়ার অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেছে। শ্বাশুড়ি মা ও এখন স্বাভাবিক ব্যবহার করেন।আমার ওনি পাগল হয়েছিলেন চলে আসার জন্য। অনেক কষ্টে বুঝিয়ে রেখেছি। বিনিময়ে অনেক কথা শুনতে হয়েছে তার। হঠাৎ করে শ্বাশুড়ি ব্রেইন স্টোক করে। ওইদিকে ওনার ভিসা জনিত কারণে দেশে আসতে পারছিলেন না। শ্বাশুড়ি পুরো শয্যাশায়ী। আবোলতাবোল বকতেন। পুরো সংসারের দায়িত্ব । ননদ ভয় পেয়ে আমার সাথে সাথে থাকতো আর কান্না করতো।আর শ্বশুর একেবারে চুপচাপ হয়ে গেলেন। ওইদিকে ওনার পাগলামি। কত নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি। এদের সবার দেখাশোনা করা। আমার ভার্সিটি জীবন এক বছর ড্রপ দিলাম। এরা বেঁচে থাকলে অনেক পড়তে পারবো কিন্তু কেউ একজন হারিয়ে গেলে আর ফিরে পাবোনা।

প্রোপার ট্রিটমেন্টে শ্বাশুড়ি মা অনেকটা সুস্থ। সবকিছু স্বাভাবিক হচ্ছে। তবে এখন শ্বাশুড়ি মা এখন একটু পরপর ডাকে তার সামনে বসিয়ে রাখে। কোনো একদিন সকালে নাস্তা বানাচ্ছিলাম সবার জন্য। কলিংবেল বাজায় দরজা খুলে সামনের মানুষগুলোকে দেখে আমি চমকে গেলাম আর কেউ না আমার বাবা মা। দৌড়ে বাবাকে ধরে কেঁদে দিলাম। কতদিন পর এই মুখটা দেখলাম । পরে মায়ের থেকে জেনেছি শ্বশুর বাবা নাকি তাদের কল করেছেন আর বলেছেন,

– আপনার মেয়ে আমার ঘরের লক্ষি। এইটুকু মেয়ে কত সুন্দর সংসার সামলাচ্ছে। আমার অসুস্থ স্ত্রীর সেবা করছে। এখন মনে হচ্ছে আমার ছেলে হিরে এনেছে। আপনি আর রাগ করে থাকবেন না। ভুল তো মানুষই করে। একবার এসে মেয়েকে দেখে যান।

বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, একজন বাবা তখন সবচেয়ে বেশি খুশি হয় যখন কেউ তার সন্তানের প্রশংসা করে৷ আর তোমার শ্বশুর তোমাকে হিরে বলেছেন। আর কি চাই। দোয়া করি সুখে থাকো।

৩ বছর পরে রাফাত দেশে আসে। বেবীর জন্য ট্রাই করি কিন্তু হয় নাই। ৪ বছর পরে পিরিয়ড প্রবলেম শুরু হয়। প্রচন্ড পেট ব্যথা করতো।এই মানুষটা আমাকে সামলেছে। ল্যাপারোস্কপিক হয় আমার। মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ি। দিন যায় দিন আসে। ডাক্তার বলেছিলেন আপনি এখন কনসিভ করতে পারবেন তবে এখন না করাই ভালো শারীরিক আর মানসিক দুই ভাবে আরো স্টেবল হতে হবে। কিন্তু আমি তখনই কনসিভ করি। ডাক্তার রাফাতের সাথে কথা বলেতে চেয়েছিলেন। আমি তো জানি ও কেমন ডিরেক্ট বলবে এবোর্শন করো। এতো গুলো মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে লাইফ রিস্ক নেওয়াই যায়। সাড়ে ৬ বছর পরে বেবি পেটে আসে। সবাই কতো খুশি। রাফাত যেদিন জেনেছিল অর্ধেক রাত কেঁদেই পাড় করেছিলো। লাইফ রিস্কের ব্যপার টা শুধু আমার ননদ জানতো। মেয়েটা আমার জন্য অনেক করেছে। রাফাত যে সময়টা সাথে থাকতো না এই মেয়েটা আমার দেখাশোনা করতো। সে জড়িয়ে ধরে শুধু কাঁদতো আর বলতো তোমার কিছু হলে আমার ভাইটা মরে যাবে। একটু ভেবে দেখো।বেবি তো পরেও নিতে পারবে। তাকে বার বার বলতাম, এতোগুলা বছর পরে মাতৃত্বের স্বাদ পাচ্ছি তাকে খু/ন করার সাহস আমার নেই।

৯ মাস পরে যখন আমার অবস্থা বেগতিক।আমার ননদ রাফাতকে সব বলে দেয়। সেদিন অসহায় চাহনি দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। টানা দুই দিন কথা বলে নাই সে।সেদিন বুঝেছি এই মানুষটার অভিমান কতটা তীব্র। এতো ঝড়ঝাপটা গেছে কখনো কথা বলা বন্ধ করে নাই। অথচ দুই দিন কথা বলা থাক আমার সামনে আসে নাই। গেস্ট রুমে ছিলো। রাতের বেলা ভারী পেট নিয়ে গেস্ট রুমে তার কাছে গেলাম। আমাকে দেখা মাত্র মুখ ফিরিয়ে নিলো। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলাম,

– আমার শারীরিক যন্ত্রণার কাছে তোমার অবহেলা প্রচন্ড পীড়াদায়ক। আমি যদি আর ফিরে না আসি তখন কি করবা? হায়াত থাকলে অবশ্যই ফিরে আসবো। কথা বন্ধ করো না। কষ্ট হয় খুব। ম/রে গেলে,,,,

মুখের কথা মুখে রইলো ঝড়ের বেগে শক্ত জড়িয়ে ধরলো।

– এমনটা কেন করলে কষ্ট হয় খুব। তুমি জানো না তুমি ছাড়া আমি অচল।আমার কথা ভাবলে না।

দুই হাত দিয়ে তার পিঠ খামচে ধরলাম। বহু কষ্টে তাকে বললাম, মা কে ডাকো

– কেন? কোনো সমস্যা?

– মাকে ডাকো আমার পেইন হচ্ছে। আর সহ্য করতে পারছি না। প্লিজ ডাকো।আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তারপর আর কিছু মনে নেই।

যখন চোখ খুলি তখন হাসপাতালে। ওটিতে নেওয়ার বন্দোবস্ত চলছে। রাফাত অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে। আমার বাবা মা ফুপিয়ে কাঁদছে। ছোট ভাইকে দেখে আমার ভিতরটা জ্বলে যাচ্ছিলো। কেঁদে কেটে কি হাল করেছে। শ্বাশুড়ি মা আমার হাতে তার কপাল ঠেকিয়ে বললেন,

– শাস্তি দিচ্ছিস আমাদের? তোকে প্রথম বকাবকি করতাম বলে। আমার সংসার টা যে তুই ছাড়া অচল।

– দোয়া করেন মা যেন ফিরে এসে আপনাকে আবার জ্বালাইতে পারি।

ওটিতে নিয়ে গেলো আমাকে।

– পেশেন্টর অবস্থা খারাপ। আপনাদের ডোনার রেডি রাখুন আর আল্লাহ আল্লাহ করেন।

যখন সিজার শেষে বাচ্চা নিয়ে নার্স বের তখন রাফাত ভেবেছে আমি আর নাই। সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে যায়। যদিও অবস্থা খারাপ ছিলো। পরের দিন সন্ধ্যায় জ্ঞান আসে। সেবা করবে দূরের কথা সবাই একদফা বকাবকি করেছে। রাফাত হাত জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে। হাসি কান্না সব মিলিয়ে ভালো আছি। আমার মেয়েটা সবার চোখের মনি।রাহার বিয়ে হয়ে গেছে সে প্রেগন্যান্ট। আমার ভাই এডমিশন টেস্ট দিলো।

চিরচেনা স্পর্শে #স্মৃতিচারন শেষে বাস্তবে ফিরে আসলাম। কাঁধে থুতনি রেখে বললো হ্যাপি এ্যানিভার্সারি কলিজা। পিছনে ফিরে তার ঠোঁট আলতো ছুঁয়ে বললাম, আপনাকেও স্যার। আপনার বিবাহবার্ষিকীর উপহার ওইখানে রাখা।

আপনাদের বলা হয় নাই রাফাত আর ইতালি যায় নাই দেশেই থাকে। ছোট্ট একটা বিজন্যাস করে। আলহামদুলিল্লাহ ভালোই চলছে সব।

প্রেগন্যান্সির রিপোর্টে পজিটিভ লেখা দেখে স্থির হয়ে গেলো রাফাত ।

– কেমন লাগছে স্যার?
– মিশ্র অনুভূতি। দ্বিতীয় বার বাবা হওয়ার আনন্দ আবার তোমার জন্য টেনশন। এইদিকে আমার মেয়েটা খুব ছোট। প্রথমবার কথা মনে পড়ছে। তোমাকে হারানোর ভয়। বলতে পারো অনুভূতি শূন্য আমি।

তার বুকে মাথা রেখে বলি, ডাক্তার বলেছে সব ঠিক আছে। প্রতি মাসে একবার চেকাপ করলেই হবে। তুমি আছো তো।আর তোমাদের সবার দোয়া। এবারও কিছু হবে না। জানো তো রাফাত আমার এই ১০ বছরে যেমন স্যাক্রিফাইস করছি প্রাপ্তির খাতাটাও পরিপূর্ণ। নতুন বাবা মা পেয়েছি বোনের মতো ননদ পেয়েছি। মা হয়েছি। মাতৃত্বের স্বাদ পেয়েছি।সবচেয়ে বড় কথা আমি তোমাকে পেয়েছি। যার কাছে আমার দাম ষোলো আনা। আমি পূর্ণ। সারাজীবন পাশে থেকো এভাবেই। আর কিছু না। রাফাত আমার মাথায় চুমু দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আমাকে। মনে মনে বললাম একটা সোনার সংসার আছে আমার আর কি চাই।

#সমাপ্ত

ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে