স্মৃতিচারন পর্ব-০২

0
1005

#স্মৃতিচারন
#পর্বঃ২
#লেখিকাঃরূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

দিন সাতেক হবে আমি গৃহবন্দী। খাবারের সময় আম্মু এসে খাবার দিয়ে যায়। গোসল করি না ৭ দিন। কোনো বেলা খাই আবার কোনো বেলা খাই না। তারপর আরো দুই দিন যায়। ১০ দিনের মাথায় বাবা দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করে। আমাকে দেখে আঁতকে ওঠেন তিনি। বাবা নিজেকে ধাতস্থ করে বলেন,

-এলাকায় ছি ছি করছে। মান সম্মান আর কিছু নাই। তোমাকে নিয়ে সবাই বাজে কথা বলছে।

কোনোরকম কান্না আটকে আবার বলে,

– কোনোদিন ভাবি এমন দিন আমাকে দেখতে হবে। কাল তোমার বিয়ে। ঘরোয়া ভাবে কাউকে বলি নাই। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে অমত করো না।

পাপেটের ন্যায় সব শুনলাম।পরেরদিন যথারীতি ঘরোয়াভাবে বিয়ে হয়ে গেলো। আমি পুতুলের ন্যায় কবুল বললাম। দুজনের মাঝের পর্দা যখন সরানো হলো মানুষটাকে দেখে চমকে উঠলাম। কাউকে পরোয়া না করে ঝাপটে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে দিলাম । কারণ সে আর কেউ না আমার প্রিয় মানুষটা বরবেশে ছিলো। যেহেতু আমি তাদের বাড়ির কাউকে চিনি না তাই বিয়ে টা কার সাথে হয়েছে বুঝতে পারিনি। মজার ব্যপার হলো তখনও আমার হাতে বি-ষে-র বোতল ছিলো।বাবা পোকা নিধনের জন্য এনেছিল। ভেবেছিলাম টুক করে খেয়ে নিবো। সেটা ফেলে দিয়েছিলাম সবার অগোচরে। এই ব্যপারটা আজও আমার ওনি জানেন না। মিনিট পাঁচেক পর নিজের থেকে ছাড়িয়ে আমার কপালে লম্বা চুমু দিয়ে নিজের জায়গায় বসে পড়লো।

পাশ থেকে আমার এক কাজিন অশ্রুসিক্ত নয়নে বলেছিল, তোমরা আসলেই লাভবার্ডস আপু। দেখো সবাই কিভাবে কান্না করছে। তুমি অনেক লাকি আপু এমন একজনকে বেটার হাফ হিসেবে পেয়েছো।এবাড়িতে আসার পর ভাইয়া চাচ্চু আর ওনার বাবার হাত ধরে অনেক কেঁদেছে বিয়েতে ওনারা রাজি হয়েছে বলে। সুখে থাকো আপু দোয়া করি।

ননদ রাহা আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ভাইয়া কিভাবে সবাইকে রাজি করিয়েছে শুধু আমি জানি। আমি চাই তুমি আমাদের সংসারটা আগলে রাখো। আমার বাবার ভ্রান্ত ধারণা তোমাদের এলাকার মেয়েরা খারাপ। মিলেমিশে সংসার করতে পারে না। আমি চাই তুমি তোমার ব্যবহারের মাধ্যমে তার ধারণা ভুল প্রমান করো। মা চেয়েছিলেন তার বোনের মেয়েকে ভাইয়ার বউ করতে। ভাইয়া নাছোরবান্দা তোমাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না। মা ভাইয়ার জন্য তোমাকে মেনে নিয়েছে। তোমার ভালোবাসা আর যত্নের মাধ্যমে তার মন জয় করো। একজন নারী সব পারে। তোমার মনে হতে পারে আমি কেন রাজি হলাম। কারণ আমি জানি আমার ভাই তোমাকে কতটা ভালোবাসে। আমার ভাইয়ের সুখ তোমার মাঝেই নিহিত।কঠিন সময়ে তুমি যদি আমার ভাইয়ের পাশে থাকো সে সাহস পাবে নিজেকে সুখী মনে করবে। সবশেষে বলবো আমাদের সবাইকে আগলে রেখো।

বিদায়ের সময় সবাইকে দেখলেও বাবাকে দেখেনি। রাগ অভিমান নাকি অন্যকিছু আমি জানি না। ছোট ভাইটা আমাকে ঝাপটে ধরে বলেছিল, আপু তুই যাস না।আমি আর তোর সাথে ঝগড়া করবো না।তুই আমাকে ঘুম পাড়িয়ে না দিলে আমার ঘুম আসে না। যাস না তুই। ৯ বছর বয়সী ভাইটার জন্য আমার কলিজাটা ছিড়ে যাচ্ছিলো।

মা আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলেছিলো, তোর ননদ যা বলেছে আমিও তাই বলবো। সবার মন জয় করে চলো। তোমার শ্বাশুড়িকে নিজের মায়ের মতো মনে করো। মনে রাখবা তোমারও একটা ভাই আছে
তুমি তোমার শ্বাশুড়ির সাথে খারাপ আচরণ করলে ভবিষ্যতে তোমার ভাইয়ের বউও তোমার মায়ের সাথে সেম আচরণ করবে। আজ তোমার বাবা অভিমান করে দূরে আছে একটা সময় যেন তোমাকে নিয়ে গর্ব করে। আজ যারা তোমাকে বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছে ভবিষ্যতে তোমার ব্যবহারের কারণে যেন তোমাকে চোখে হারায়। মন দিয়ে সংসার করো মা।

রাফাত কে উদ্দেশ্য করে বলেছিল, তোমার বোকামির জন্য আজ মেয়ের এই অবস্থা। যেভাবে সবাই কে মানিয়ে তাকে বিয়ে করছো সেভাবে তাকে আগলে রেখো। বড় আদরের মেয়ে আমার। তার ভুলত্রুটি গুলো তুমি সংশোধন করে দিও।

শ্বশুরকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল, আমার মেয়েটাকে আপনাদের ভরসায় দিলাম। নিজের মেয়ে মনে করবেন।ভাইজান আপনারও একটা মেয়ে আছে। রূপন্তিকেও নিজের আরেকটা মেয়ে মনে করবেন। কথা গুলো হয়তো রূপন্তির বাবা বলতো বাধ্য হয়ে আমাকে বলতে হলো।

গাড়িতে উঠে বসার পরে সে এক মিনিটের জন্যও আমার হাত ছাড়ে নাই। চোখে মুখে ছিল উপচে পড়া আনন্দ। আমি শুধু তাকে দেখেছি। বরন শেষে আমাকে তার রুমে দেওয়া হলো। আধা ঘণ্টা ব্যবধানে রাফাত খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে রুমে আসল। প্লেট ছোটো টি-টেবিলে রেখে আমার কাছে এসে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। সারা চোখে মুখে চুমু দেওয়া শুরু করে। পুনরায় জড়িয়ে ধরে বলে, আজ আমার সবচেয়ে খুশির দিন। যাকে ভালোবাসি তাকে নিজের করে পেয়েছি।

তারপর খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে বলে, চোখ মুখের কি অবস্থা করেছো? আমি তো এই রূপন্তিকে ভালোবাসি নাই। নিজের যত্ন নিবে না।

– ১০ দিন বাসায় বন্দী। মন চাইলে খাইছি। এইদিকে তোমার টেনশন। খাবার গলা দিয়ে নামে? আমি তো ভেবেছিলাম,,

– থাক আর কিছু বলতে হবে না। লক্ষি মেয়ের মতো নিজে খাও আর আমাকেও খাইয়ে দাও।

– তা কিভাবে সবাইকে রাজি করালে?

– তোমাদের এখান থেকে আসার পর বাবা মা কে বিয়ের কথা বলাতে তারা রাজি হয় নাই। কেন রাজি হয় নাই রাহা তো বললোই। তারপর তাদেরকে বলেছি, যদি বিয়ে করতে হয় তোমাকেই করবো আর না হয় কখনো করবো না। মাকে বলেছি যাকে ভালোবাসি না তাকে কি করে বিয়ে করবো। মনে অন্য কাউকে রেখে আমি আরেকজনের সাথে সংসার করতে পারবো না। বাবাকে বলেছি, সব এলাকায় ভালো খারাপ মিলিয়ে আছে। আমাদের এলাকায়ও অনেক মেয়ে সংসার করতে পারে নাই। মা বাবা থেকে সন্তানকে আলাদা করে দিয়েছে তাই বলে কি সব মেয়ে খারাপ? বাবা আমি ওই মেয়েটাকে কথা দিয়েছি।সে সম্পর্কে আসতে চায় নাই আমি জোর করছি তাকে। আর আজকের পর হয়তো সবাই ওকে খারাপ বলবে।তোমাদের কাছে অনুরোধ যেদিন তোমরা রাজি হবে সেদিন খাবার মুখে তুলবো। খাবার না খেয়ে খেয়ে যখন হাসপাতালে ভর্তি হই মা মানলেও বাবা তখনও রাজি ছিলো না। পরে মা বাবাকে বলেছেন, যদি আমার ছেলেটা বেঁচে না থাকে আপনার ধারণা দিয়ে কি হবে? আমার নাড়িছেঁড়া ধন। আল্লাহর দোহাই আপনি রাজি হন।

– আপনি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন? এখন কেমন শরীর? খুব কষ্ট হয়েছিলো না?

– রিল্যাক্স আমি সুস্থ আছি।

– আমার বাবা মা কিভাবে রাজি হয়েছে?

– সেদিনের পরের দিন বাবা মা তোমাদের বাড়ি যায়। তোমার বাবা প্রথমে রাগারাগি করে।পরে তোমার মা ওনাকে বোঝায়। পরে ওনি শান্ত হয়। তারপর চারজন ঠান্ডা মাথায় কথা বলে। বাবা তোমার বাবার হাত ধরে বলেছে, ভাইসাব আপনিও সন্তানের বাবা আর আমিও। আমার ছেলেটা হাসপাতালে ভর্তি। একজন সন্তানের বাবা হিসেবে ভাবুন। তিন তিনটা সন্তান মারা যাওয়ার পর আমার ছেলেটা হয়েছিল। আপনার মেয়েটাকে ভিক্ষা দিন। আপনার মেয়ে টার দিকে তাকান। একজন অসহায় বাবা মা আপনার কাছে অনুরোধ করছে। যা হওয়ার হয়ে গেছে সব ভুলে যান। তোমার মায়ের সাথে আলোচনা করে ওনি রাজি হয়।

– আজ তুমি অনেক ক্লান্ত। তোমাকে আর জ্বালাবো না। কাবার্ডে তোমার জন্য জামা কাপড় রাখা আছে। ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। কালকে কিন্তু ছাড় পাবে না।

ফ্রেশ হয়ে তার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে ছিলাম শান্তির ঘুম। বিয়ের পর শ্বশুর বাবা মন থেকে মেনে নিলেও শ্বাশুড়ি মা মানতে পারেন নাই। মনের পোষে রাখা ইচ্ছে তো হুট করে উল্টে যেতে পারে না। অনেক আগে থেকেই তার ইচ্ছে ছিল ওনার বোনের মেয়েকে ছেলের বউ করবে সেটা তো পারেন নাই। হয়তো বোনের সাথে তার সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। তিনি ছেলের জন্য মেনে নিয়েছেন কিন্তু মন থেকে না। ওনি সব কাজে আমার খুঁত ধরতেন। খুব খারাপ লাগতো আমার। পরে মায়ের বলা কথাগুলো মনে পড়তো আর একটু জোর পেতাম। আমাকে ওনার মন জয় করতেই হবে।

বিয়ের কয়েকদিন পরের কথা খাটে পা ঝুলিয়ে বসে ছিলাম। ওনি কোথাও যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল। তাকে বললাম, আপনি খুব সুদর্শন। আর অনেক স্মার্ট। আমি তো আহামরি কিছু না। তারপরও আমাকে কেন এতো ভালোবাসেন? এতো কেন পছন্দ করেন?

সে মুচকি হেসে আমার কপালে অধর ছুঁয়ে বলে,

– এতো ভালোবাসি কারন,,,,

#চলবে ইনশাআল্লাহ

ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে