স্বপ্ন হলেও সত্যি পর্বঃ-১২

0
913

স্বপ্ন হলেও সত্যি পর্বঃ-১২
আফসানা মিমি

বাহুটা এমনভাবে ধরে আছে যার কারনে প্রচুর ব্যথা পাচ্ছি হাতে। মনে হচ্ছে যেন ধরে রাখা জায়গাটা অবশ হয়ে আসছে। মানুষটা কি টের পাচ্ছে না যে এতো জোরে ধরে রাখায় আমি ব্যথা পাচ্ছি! দাঁতে দাঁত চেপে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। চোখে পানি আসতে চায়ছে কিন্তু আমি চেষ্টা করছি যেন না আসে। অন্তত শ্রাবণ যেন আমার চোখের পানি না দেখতে পায়।

—কোথায় যাচ্ছো?
—রুমে।
—আমার প্রশ্নের উত্তর দাও!
—বাধ্য নই দিতে।
—তাহলে এখানে কেন এসেছো? ঢং করে কান্নাকাটি করছো কেন শুধুশুধু?
—হাত ছাড়েন ব্যথা পাচ্ছি।
—আমার ব্যথার কাছে তোমার এই ব্যথা কিছুই না।
—যার যার কাছে তার ব্যথা সীমাহীন। যা সহ্য করা কঠিন হয়ে যায়। আপনার ব্যথা আপনি নিয়ে বসে থাকেন। তা আমার দেখার বিষয় না। আমাকে ব্যথা দেওয়ার কোন অধিকার আপনার নেই। সেই অধিকার আপনাকে আমি দেইনি। তাই হাতটা ছাড়েন।
—খুব চটাংচটাং কথা বলতে শিখে গেছো তাই না? আমার ঘরে এসে আমার সাথেই এভাবে কথা বলছো!
—ভুল হয়ে গেছে আমার। প্লিজ হাতটা ছাড়েন! মনে হচ্ছে কাঁধ থেকে ছিঁড়ে পড়ে যাবে। এতো জোরে কেউ ধরে? একটুও কি মায়াদয়া নেই?
—কোনকালেই আমার মায়াদয়া ছিল না। ছেড়ে দিব জাস্ট একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাও। এরপর যা ডিসিশন নেওয়ার নিব।
—আমি আপনার দাসী নই যে আপনি যা বলবেন আমার তাই করতে হবে! বরং…..

কথা শেষ করতে পারলাম না। তার আগেই শ্রাবণ আমার দুই বাহু শক্ত করে ধরে একেবারে তার মুখোমুখি দাঁড় করালো। কারেন্ট এখনো আসেনি। অন্ধকারে চোখ সয়ে যাওয়ায় দেখতে পেলাম শ্রাবণ রক্তচক্ষু হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। যে চোখে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। মনে হচ্ছে সেই আগুনে আমাকে ভষ্ম করে দিবে। তবুও আমি তার চোখ থেকে চোখ সরালাম না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম ঐ চোখের গভীরে। খুঁজতে লাগলাম আমার জন্য ঐ চোখে ভালবাসা লুকিয়ে রেখেছে কিনা। কিন্তু এমন চাহনির মাঝে খুঁজে পেতে ব্যর্থ হলাম। তবুও তাকিয়ে রইলাম অনড়। হঠাৎ তার ঝাঁকিতে ঘোর ভাঙলো।

খেয়াল করলাম আস্তে আস্তে তার চাহনি কেমন নরম হয়ে আসতে লাগলো। কাঁপা কাঁপা হাত আমার দু’গালে রেখে অনুনয় করে বললো
—প্লিজ বলো না আমি তোমার কে?

মনে মনে বলতে লাগলাম, আপনি যেহেতু আপনার মনের কথা আমাকে বলতে এতো সংকোচবোধ করছেন তাহলে আমি যেচে পড়ে কেন বলতে যাব? আপনার আত্মসম্মানবোধ আছে, আমার কি তা নেই? আপনি যেমন মনের কথা লুকাতে পারেন, তেমনি আমিও পারি লুকাতে। আপনি যেমন নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে এতোদিন টিকে ছিলেন, তেমনি আমিও টিকে ছিলাম এবং যতদিন বেঁচে আছি থাকবো। আপনি যেমন আমার মুখ থেকে শুনতে চাচ্ছেন আমার মনের কথা, তেমনি আমিও তো এতোদিন যাবৎ অপেক্ষা করে আছি শ্রাবণ। কেন আপনি এতোদিনেও সাহস করে বলে উঠতে পারেননি আপনার অব্যক্ত অনুভূতিগুলো? কোন অন্যায় তো হতো না এতে, তাই না? তবে কেন আপনি আজও পর্যন্ত বলে উঠতে পারেননি? আপনি যেহেতু পারেননি অথবা ইচ্ছে করে করেননি, সেহেতু আমিও আমার মতোই থাকবো। আমিও বলবো না আমার ভালবাসার কথা। কি দায় পড়েছে আমার? এতো ভীতু মানুষ আমার পছন্দ না শ্রাবণ। আপনি বড্ড ভীতু!

শ্রাবণকে কোনভাবেই আমার মনের কথা জানতে দেয়া যাবে না। তাই মনের কথা মনের গোপন কুঠরিতেই তালাবদ্ধ করে চাবিটা কোন এক মন বিষণ্ণ করা নদীতে ফেলে দিয়ে কাঠ কাঠ গলায় বললাম
—আপনি আমার কেউ না শ্রাবণ! কেউ না আপনি আমার!

আমার এমন কথা শুনে শ্রাবণ যেন যারপরনাই বিস্মিত হলো। যা তার চোখে মুখে স্পষ্ট ভেসে উঠছে। হাতের কাঁপাকাপি বন্ধ হয়ে গেল। অস্থির দুটো চোখের মনি স্থির হয়ে গেল। অসাড় হয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো এক দৃষ্টিতে। যে দৃষ্টিতে রাগ নাকি ক্ষোভ নাকি অভিমান কিছুই টের পেলাম না।
হঠাৎই ক্রুদ্ধদৃষ্টি হেনে চিৎকার করে বলতে লাগলো

—তবে কেন এমন করলে আমার সাথে বলো? কি দোষ ছিল আমার? আমায় এমন অকূলপাথারে ফেলে দিয়ে কি এমন শান্তি পেলে তুমি?

শ্রাবণের এমন আচরণে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। তার এমন উন্মত্ত আচরণের সামনে আমার টিকে থাকা দায় হয়ে পড়ছে। তাই চলে আসার জন্য পা বাড়াতেই আবারো বাধা প্রদান করলো সে। এবার নিজেকে তার বাহুডোরে আবিষ্কার করলাম। এতো জোরে ধরেছে যার জন্য নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। নিজেকে শ্রাবণের বাহুডোর থেকে আলগা করতে জোরজবরদস্তি শুরু করে দিলাম। কিন্তু ফলাফল শূণ্য। ওর শক্তির সাথে কি আর আমি পেরে উঠবো!?

—আমি তো তোমার কেউ না, তাই না? তাহলে তোমার ‘কেউ’ টা কে আমাকে বলো? ঐ আকাশ? ঐ আকাশই তোমার সব তাই না? যার কারণে আমাকে পাত্তা দিচ্ছো না! কি আছে ঐ আকাশের মাঝে, যা আমার মাঝে নেই? উত্তর দাও!
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share

শ্রাবণের কথা শুনে হাসবো না কাঁদবো ভুলে গেছি। লাইক সিরিয়াসলি! শ্রাবণ এখনো ঐ আকাশকে নিয়েই পড়ে আছে? অবিশ্বাস্য! হঠাৎই আমার হাসি পেয়ে গেল। শ্রাবণ আকাশকে নিয়ে জেলাস ফিল করছে!

—ও আচ্ছা বুঝতে পেরেছি সব কিছুর মূলে ঐ আকাশ রয়েছে তাই না? কি বোকাপাঁঠা ছেলে আমি! তোমার মতো মেয়ের ছলচাতুরী বুঝতেই পারিনি। ঐদিকে আকাশের সাথেও রিলেশন কন্টিনিউ করে গেছো। আর এদিকে আমার…..। যাক গে শেষমেষ একটা প্রশ্নের উত্তর দাও! ঐ আকাশ কি তোমাকে এতোটাই ভালবেসেছে যার কারনে আমার ভালবাসাটা তোমার দৃষ্টিগোচরে আসেনি?
—শ্রাবণ আপনি উন্মাদ হয়ে গেছেন! কিসব বলে যাচ্ছেন আপনি ভেবে বলছেন তো? বারবার আকাশের প্রসঙ্গটা এর মাঝে টেনে আনছেন কেন?
—আকাশের ব্যাপারে কথা বললে এতো খারাপ লাগে কেন তোমার? ও কি তোমাকে এতোটাই ভালবাসা দিয়েছে যার জন্য তাকে এখনো ভুলতে পারছো না? খুব উপভোগ করতে বুঝি ওর দেওয়া ভালবাসাগুলো? এখনো খুব মিস করো বুঝি ওর ভালবাসা?

শ্রাবণের কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে ঘৃণায় শরীর রি রি করে উঠলো। লজ্জায় কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে মনে হচ্ছে। এতোটা নিচ তার মেন্টালিটি? এখন মনে হচ্ছে যেন পুরোই মানসিক বিকারগ্রস্ত একজন মানুষ উনি। আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই আমি হুঙ্কার দিয়ে উঠলাম

—জাস্ট স্টপ! এমন নোংরা মেন্টালিটি নিয়ে চলাফেরা করেন আপনি? মনের মধ্যে এমন বিশ্রী মনোভাব নিয়ে কাউকে কি করে ভালবাসেন আপনি? এইই আপনার ভালবাসার নমুনা! ছিঃ! আরে যার অস্তিত্বই কিনা এই পৃথিবীতে নেই তার সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে কিভাবে এই নোংরা কথাগুলো বলতে পারলেন? আপনার মন মানসিকতা যে নর্দমার কীটের মতো এতো নোংরা তা কিনা আমি আজ জানতে পারলাম! এতোদিন ভালোমানুষির রূপ দেখিয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন! ছিঃ! ঘৃণা করি আপনার ঐ কদর্যপূর্ণ মেন্টালিটিকে।

এক ঝটকায় নিজেকে শ্রাবণের কাছ থেকে ছাড়িয়ে দ্রুতবেগে বেরিয়ে আসলাম ওর রুম থেকে। বাইরে বৃষ্টি এখনো থামেনি। চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলাম। আমার সাথেই কেন এমন হলো! তবে কি শ্রাবণকে ভালবেসে ভুল করেছি আমি!? এমন একটা মানুষকে কেন আমার সর্বস্ব উজার করে ভালবাসতে গেলাম? রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দরজার কোল ঘেঁষেই ফ্লোরে বসে পড়লাম। হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলাম। নিজের মাথার চুল নিজেরই ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে কেন জানি। আমি আসলেই একটা বোকা! বোকা না হলে কি আর এতো বড় একটা ভুল আমার দ্বারা করা সম্ভব হতো!?

সেই ঘটনার পর শ্রাবণের সাথে আমার আর কোন বাক্যালাপ হয়নি। শুধু দুই একবার চোখাচোখি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল দুজনের মাঝে। এর মাঝে ভাইয়া ফোন দিয়েছিল। ভাইয়াকে নাকি একটা ফ্ল্যাট বাসা দিয়েছে তার কোম্পানি থেকে। বাসা গোছাতে যে কয়দিন সময় লাগে ততদিন এ বাড়িতেই থাকতে হবে। তবে কেন জানিনা দুইদিন যাবৎ এ বাড়িতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। শ্রাবণ চলে যাবে আজ বিকেলে। বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। অস্থির অস্থির লাগছে নিজেকে। ঐ মানুষটার জন্য এমন লাগছে ভাবতেই নিজের ওপর নিজেই বিরক্ত হলাম।

সেদিন রাতে শ্রাবণের ঘর থেকে বের হয়ে আসার পর আর দ্বিতীয় কোন বাক্যালাপই বিনিময় হয়নি আমাদের মাঝে। যাও দুয়েকবার চোখাচোখি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল দুজনের মাঝের কমিউনিকেশন। সেও চেষ্টা করেনি কথা বলার আর আমিও আগ বাড়িয়ে যাইনি অপদস্থ হওয়ার। শ্রাবণের বিদায়ের মুহূর্তটা যতই ঘনিয়ে আসছিল ততই যেন বুকের ভেতরটাকে এক নাম না জানা কষ্ট খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করছিল আমাকে। আমার ভিতরে যে দহন হচ্ছে ক্রমান্বয়ে সেটা ধীরে ধীরে বাড়ছে বৈ কমছে না। জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে একেবারে ভেতরটা। মনে হচ্ছে দু’চোখ যেদিকে যায় সেদিকেই পা বাড়াই। সহ্য করা একটু বেশিই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ্ যদি মিলিয়েই না দিতেন তাহলে এতো ভালবাসা দিয়েছিলেন কেন তার প্রতি? সারা রুমের ভেতর পায়চারী করছি অস্থিরভাবে। মাথা ব্যথা করছে প্রচুর। নিজের মাথার চুল নিজেই টানছি। কি করবো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এমন মুহূর্ত আমার জীবনে কোনদিনও আসেনি। আর যেন কোনদিন না আসে। মনের মাঝে শুধু একটা কথাই বারবার ঘুরপাক খেতে লাগলো। শ্রাবণকে আমি হারিয়ে ফেলবো। আজকের পর থেকে হয়তোবা শ্রাবণের কোন অস্তিত্ব থাকবে না আমার জীবনে। কিন্তু তাকে আমার মনের রাজ্যের যে জায়গাটায় চিরস্থায়ীভাবে স্থান দিয়েছিলাম, সে সেখানে আজীবন রাজ করে যাবে সদর্পে। আমি শত ইচ্ছে করলেও আমার মন থেকে তাকে মুছে ফেলতে পারবো না।

খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে কিন্তু এ বাসায় তা সম্ভব না। কারন কেউ যদি জিজ্ঞেস করে কিসের জন্য কাঁদছি তাহলে কি জবাব দিব? দরজায় কড়া বাড়ার শব্দে সচকিত হলাম। দরজা খুলে দেখি আন্টি দাঁড়িয়ে আছেন। উনার মুখটা কেমন শুকিয়ে আছে। হয়তো আদরের একমাত্র বড় সন্তান চলে যাবে বলেই এমন মেদুর ছায়া ঘনিয়ে এসেছে ঐ মুখমণ্ডলে। নিজেকে স্বাভাবিক করে স্তিমিত গলায় বললাম

—আন্টি কিছু বলবেন?
—“হ্যাঁ মামনি একটু নিচে আসবে? শ্রাবণ এখন রওয়ানা দিয়ে দিবে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে।

মুহূর্তেই হৃদপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠলো। শ্রাবণ চলে যাবে! দূর বহুদূর! সহস্র মাইল পাড়ি দিয়ে চলে যাবে আমাকে একলা ফেলে! ভুলে যাবে কি সে আমাকে?! বুকটা আস্তে আস্তে আবারও ভারী হয়ে আসতে লাগলো। কান্নারা দল বেধে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চায়ছে। গলা পর্যন্ত দলা পাকানো কান্নাগুলো এসে বিরতি নিয়েছে। প্রাণপণে বাইরে বেরিয়ে আসছে চায়ছে। কিন্তু আমি নিজেকে শক্ত করে কান্নাগুলো খুব কষ্টে গিলে ফেললাম। শ্রাবণের চলে যাওয়ায় আমি কাঁদলে সবার চোখে দৃষ্টিকটু লাগতো। তাই নিজেকে যতটুকু সম্ভব স্বাভাবিক করে নিচে নামার জন্য বাইরে পা বাড়ালাম।

সিঁড়ি ভেঙে এক ধাপ এক ধাপ করে নামছি আর মনে হচ্ছে শ্রাবণের বিদায়ের মুহূর্ত এমন একটু একটু করেই ক্ষয় হয়ে আসছে। বুঝতে পারলাম না আমার পা কাঁপছে নাকি সিঁড়িগুলো কাঁপছে! বারবার একটা কথাই মাথার এ পাশের দেয়াল থেকে ঐ পাশের দেয়ালে ঘুরেফিরে বারি খাচ্ছে ‘শ্রাবণ আমাকে নিঃসঙ্গ করে সহস্র মাইল পাড়ি দিয়ে দূরদেশে বসত গড়বে। আর আমি এখানে একলা গুমরে গুমরে কেঁদে মরবো। মরে গেলেও ও আমাকে দেখতে আসবে না। কেন দেখতে আসবে সে আমাকে? আমি তার কে? দুইদিনের অপরিচিতা মাত্র!

নিচে নেমে দেখি সে বিষণ্ণ মুখে মাথা নিচু করে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আছে দুই হাতের মুঠোয় চিবুক ঠেকিয়ে। পাশেই তার কাপড়চোপড়ের দুইটা লাগেজ দাঁড় করানো। এগুলো দেখেই আমার চোখ ভরে আসতে চায়লো নোনাপানিতে। আমি যথাসম্ভব নিজেকে সামলে তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম অনড়। আঙ্কেল বোধহয় বাইরে গেছে। আন্টি কিচেনরুমে কি যেন একটা করছে। ফাল্গুনী আপুকেও আশেপাশে দেখছি না। যাওয়ার আগে একটু কথা বললে কি এমন পাপ হয়ে যাবে?

আমি স্থিরভাবে সেখানেই দাঁড়িয়েছিলাম বেশ কয়েকটা মুহূর্ত। পুরোটা সময় আমি শ্রাবণের দিকেই তাকিয়েছিলাম। মন চায়ছিল ওকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ মন খুলে কাঁদি। কেঁদে হালকা হয়ে মনের কথাটা ওকে জানিয়ে দেই। না জানানোর ভারটা এতো ভারী যা বইতে পারছি না। একবার পাও বাড়িয়েছিলাম ওর কাছে যাওয়ার জন্য। কিন্তু পরক্ষনেই আবার আমার আরেক মন আমাকে কঠোরভাবে শাসিয়ে বললো ‘ওর কাছে অপদস্থ হতে এতো ভালো লাগে কেন তোর? সেদিন এতোগুলো বাজে কথা বলার পরও তোর শিক্ষা হয়নি? আবার যেচে পড়ে যাচ্ছিস অসম্মানিত হতে!’ মনের কাছে বাধা পেয়ে পা গুটিয়ে নিয়েছিলাম। আমার ইগো আমাকে যেতে দেয়নি তার কাছে। সেও তো আমাকে একবার এসে স্যরি বলতে পারতো, পারতো না?

হঠাৎই সে উঠে দাঁড়ালো। আস্তে আস্তে কদম ফেলে আমার সামনে এসে থামলো। কয়েক সেকেন্ড পার হওয়ার পর আমি তার মুখের দিকে তাকালাম। শেষবারের মতো নজর ঘুরিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম উষ্কখুষ্ক চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালে পড়ে আছে অযত্নে। চোখের কালো মনির চারপাশ লাল টকটকে বর্ণ ধারন করেছে। তার মাঝেও যেন চোখের ভেতরের শিরাগুলো স্পষ্ট ভেসে উঠছে। চোখের কোলজুড়ে কালো মেঘের ঘনঘটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে স্পষ্টত। গালে কয়েকদিনের না কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি গজিয়ে আছে। প্রচণ্ড ইচ্ছে করছে গালে এবং এলোমেলো চুলগুলোতে হাতটা আলতো করে ছুঁয়ে দিতে। আর…আর ঐ ঠোঁটজোড়া রুক্ষ প্রান্তরের ন্যায় খরখরে হয়ে আছে। যেন ভেজানো হয় না বহুদিন যাবৎ। অজান্তেই অবাধ্য চোখ চলে গেল তার বুকের দিকে। যেখানে কিছু অবাধ্য লোম ফাঁকফোকর দিয়ে লুকিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে সন্তর্পণে। এ লোমগুলোর প্রতি আমার অনেকদিনের লোভ। আবারো তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেই একভাবেই তাকিয়ে আছে। তার কি কোন কথা বলার নেই যাওয়ার আগে শুধু এভাবে তাকিয়ে থাকা ছাড়া? কি মনে করে আশেপাশে চোখ বোলালাম। দেখি আপুর কৌতূহলী আঁখিদ্বয় আমাদের দুইজনের দিকেই নিবদ্ধ। শ্রাবণের এতে কোন হেলদুল নেই। তাই আমিই পাশ কাটিয়ে চলে আসলাম শ্রাবণের সামনে থেকে।

একে একে সবার কাছ থেকে যখন বিদায় নিচ্ছিল তখন আমার মনে হচ্ছিল আসমানটা বুঝি আমার ওপর ধসে পড়বে। আচ্ছা এতো কেন খারাপ লাগছে? সে তো আমার প্রেমিকও না, আমার স্বামীও না। তাহলে এতোটা তীব্রভাবে খারাপ লাগার কারণ কি? প্রাণপণে চেষ্টা করার পরও চোখের পানিটা ধরে রাখতে পারলাম না। কাউকে বুঝতে না দিয়ে অন্যদিকে ফিরে টিস্যু চেপে পানিটা মুছে নিলাম আলগোছে। একে একে আঙ্কেল আন্টিকে জড়িয়ে ধরে টলমল চোখে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিল। ফাল্গুনী আপুর সামনে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে কি যেন বলে জড়িয়ে ধরলো। আপুকে ছেড়ে দিয়েই উল্টো ঘুরে পা বাড়ালো গাড়িতে উঠার জন্য। শ্রাবণের এমন কাণ্ডে অভিমানে আমার বুকটা ভারী হয়ে আসলো। আমার সাথে ও এমনটা করতে পারলো? একটিবার তাকালোও না আমার দিকে! এতটা নিষ্ঠুর! এতোটা পাষাণ সে! দৌড়ে বাড়ির ভেতর চলে আসলাম। ভেতরের কান্নাটা আর আঁটকে রাখতে পারছি না। একটু জোরেই চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। মুহূর্তেই মনে পড়লো উনারা দেখলে কি ভাববে? যদি জিজ্ঞাসা করে কি জবার দিব আমি? তাই দ্রুত রুমে এসে ব্যালকনিতে গিয়ে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে পড়লাম। হাত কামড়াচ্ছি আর কাঁদছি। আমার তো এতো খারাপ লাগার কথা না তবুও এতো কষ্ট লাগছে কেন? কই শ্রাবণকে দেখে তো মনে হয়নি যে সবাইকে ছেড়ে চলে যাবে বিধায় ও কষ্টে আছে! হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠলাম।

চলবে……..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে