#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
স্বপ্ন সারথি পর্ব: ০৫
টি এ অনন্যা
অনিক হায়দার সদর দরজা খুলে দেখলেন খাবার সরবরাহকারী ছেলে খাবারের প্যাকেট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখে তিনি বিস্মিত। কারণ তিনি কিংবা শাহানাজ তো খাবারের অর্ডার করেননি। অনিক ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কাকে চাই?
ছেলেটি জবাবে উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করল, ” এটাই তো অনিক হায়দারের বাড়ি তাই না?”
“হ্যাঁ, কিন্তু আমি তো কোনো অর্ডার দেইনি। তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে না তো?”
“প্রিয়ন হায়দার নামে একজন ভদ্র লোক তো আমাকে এই এড্রেস এবং এই ঠিকানাই দিলো।”
অনিক এতক্ষণে বুঝতে পারেন আসল ঘটনা। তাই তিনি কুণ্ঠাবোধ না করে খাবারের প্যাক গ্রহণ করে বললেন, “ও আচ্ছা, তাহলে ঠিক আছে। প্রিয়ন আমার ছেলে। ”
খাবারের প্যাকেট হাতে ড্রয়িং রুমে ফিরে এলে শাহানাজ জিজ্ঞাসা করলেন, “কিগো তোমার হাতে এগুলো কে দিয়ে গেল? প্রিয়ন আসেনি?”
“না, আমি তো ভাবলাম ও এসেছে। কিন্তু গেট খুলে দেখি ডেলিভারি ম্যান। প্রিয়ন নাকি অর্ডার করেছে।”
শাহানাজ প্রসন্ন হাসি দিয়ে বললেন, “দেখেছ আমাদের ছেলেটা কত দায়িত্বশীল হয়েছে! আমার তো মনেই নেই আজ আমরা আপাদের বাসায় যাব তাই রান্না-ই করিনি। রাতে কী খাব তার তো খেয়ালই ছিল না ছেলের চিন্তায়।”
অনিক হাতের প্যাকেটগুলো ডাইনিং টেবিলে রেখে এসে শাহানাজের বিপরীত সোফায় বসে কফি কাপ পুনরায় হাতে তুলে নিয়ে বললেন, “এইতো শুরু হয়ে গেল তোমার গুণধর পুত্রের গুণ গান। তবে হ্যাঁ এটা স্বীকার করতে হবে ওর কখনো দায়িত্বে অবহেলা করে না। এমনকি শত ব্যস্ততায়ও বাবা মায়ের খেয়াল রাখতে ভুলে না ছেলেটা।”
“হ্যাঁ গো ভাবছি চট্টগ্রাম থেকে ফিরে এসে ওর জন্য পাত্রী খুঁজব। ছেলেটার তো বিয়ের বয়স হয়েছে সেই কবে। ওর সম্মতির আশায় থাকলে আর হবে না।”
অনিক কফির কাপটা টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন, “চট্টগ্রাম থেকে ফিরে পাত্রী খুঁজতে হবে কেন? তুমি কি ভুলে গেলে তোমার বোনের একটা যোগ্য মেয়ে আছে?”
“না, তা ভুলিনি। কিন্তু তুমি তো জানোই তোমার ছেলে নিজেদের মধ্যে আত্মীয়তা করাটা পছন্দ করে না। তাছাড়া ওকে প্রিয়ন ছোট বোনের চোখে দেখে।”
“আরে ওসব কিছু না। আসলে ছেলেটার উপর দিয়ে যে ঝড় গেল তাতেই ও বিয়ে বিদ্বেষী হয়ে আছে। তাই বিয়ে না করার জন্য এসব ছুঁতো খুঁজে।”
শাহানাজ ভারাক্রান্ত স্বরে বললেন, “হ্যাঁ মেয়েটা তো গেল আমার ছেলেটাকে শেষ করে গেল। কী ঝড়টাই না একা সামলেছে আমার ছেলেটা। কী যে হয়েছিল কখনো আর জানা হলো না।”
অনিক হায়দার নিজের বসার স্থান ছেড়ে উঠে গিয়ে শাহানাজের পাশে বসে নিজের হাতের মুঠোয় শাহানাজের হাত নিয়ে বললেন, “যাহোক পুরনো অতীত ঘেটে লাভ নেই। ময়লা ঘাটলে দুর্গন্ধ বের হয় আর অতীত ঘাটলে পুরনো স্মৃতি কষ্ট দেয়। আমার ছেলেটা যে সব কুলিয়ে উঠেছে তাতেই আলহামদুলিল্লাহ।”
আজ অনেকদিন পর হাতে গিটার তুলে নিয়েছে পূর্ণতা। দীর্ঘক্ষণ সাওয়ার নেওয়ার পরে আজ তার মনটা ফুরুফুরেই ছিল। ভুলে গিয়েছিল সারাদিনের সকল কষ্টগুলো, সকালে বলা মায়ের কথাগুলো। মা আর একমাত্র বোনের সাথে খোশমেজাজেই খাওয়া দাওয়া করে টুকটাক কিছু কাজ সেরে ঘুমাতে গিয়েছিল। কিন্তু ঘুম তো আসেনি বরং মনে পড়ে যায় রিয়ানার বলা কথায়।
সে বলেছিল, “দেখো পূর্ণতা, তোমাকে আমি দীর্ঘদিন ধরে চিনি। প্রায়শই তোমার বিমর্ষতা আমাকে ভাবায়। প্লিজ আমার সাথে শেয়ার করো। একটা কথা আমার চেয়ে হয়তো তুমি ভালো জানো আকাশের মেঘ যত গুমোট হয় আকাশ তত বিমর্ষ থাকে, কিন্তু যখন মেঘ বৃষ্টি কনা হয়ে ছড়িয়ে পড়ে প্রকৃতির মাঝে তখন আকাশের গুমোট পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়, ফিরে আসে তার নির্মলতা। তাই নিজের মনের আকাশে জমানো কষ্টগুলো নিজের মাঝে আবদ্ধ না রেখে শেয়ার করো ভালো লাগবে।”
পূর্ণতা ভাবতে থাকে সত্যিই তো সে তার বুকের মাঝে লুকিয়ে রেখেছে কত কত ঘটনা! কিন্তু সে তো কখনো কাউকে তা শেয়ার করতে চায় না। এমনকি বুঝতেও দেয় না তার মাঝে কী চলছে। তবুও এই রিয়ানা মেয়েটা কী করে যেন সব বুঝে যায়। এমন কোনো দিন যায়নি যেদিন পূর্ণতা বিমর্ষ ছিল কিন্তু রিয়ানা তা বুঝতে পারেনি। পূর্ণতা তো তা চায় না কেউ তাকে বুঝুক। কারণ যে-ই তাকে বুঝতে চায় সেই তো পূর্ণতার জীবন থেকে হারিয়ে যায়।
তাছাড়া পূর্ণতা চায় তার অন্তরের দহনে সে একাই পুড়তে। কারণ অন্তরের কষ্টগুলো সে যত শেয়ার করবে তত তার কষ্টগুলো কমে যাবে। আর কষ্ট না থাকলে তার স্মৃতিগুলো তাকে ছেড়ে চলে যাবে। সে পারবে না ওই স্মৃতিগুলো ছেড়ে থাকতে। গত চারটা বছর সে হারিয়ে যাওয়া মানুষটার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে।
এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে সে শোয়ার ঘর ছেড়ে ড্রয়িং রুমে এসে বসেছে তা খেয়ালই করেনি। আনমনে সোফায় বসে থাকার সময় হঠাৎ চোখ যায় শোকেসের এক পাশে যেখানে অতিযত্নে রাখা আছে তার প্রিয় গিটারটি। মা আর বোনের ঘুম ভাঙার ভয়ে গিটার নিয়ে সে চলে যায় ছাদে। তখন রাত বেশি হয়নি। ঘড়ির কাটায় সময়টা মাত্র দশটা পঁয়তাল্লিশ মিনিট। একাই আপনমনে গাইতে থাকে তার প্রিয় গান।
“কীরে বাবা তুই এভাবে অন্ধকার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? এসেও কিছু বললি না। খাবারও খেলি না। বললি খেয়ে এসেছিস। কী হয়েছে আমাকে বল বাবা।”
হঠাৎ পিঠে শাহানাজের হাতের স্পর্শে চমকে উঠে প্রিয়ন। আজ বড্ড নিঃসঙ্গ লাগছিল তার। তাই একাকী অন্ধকারে দূর আকাশে তাকিয়ে ভাবনায় বিভোর হয়ে থেকে খেয়ালই করেনি পেছনে কে?
নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “কই মামনি কিছু হয়নি তো। তুমি কখন এলে?
” এখনই এসেছি। তুই কিছু খেলি না। তাই এক গ্লাস দুধ নিয়ে এসেছিলাম। দেখি তুই রুমে নেই। বেলকনিও অন্ধকার তবুও উঁকি দিলাম। যা ভেবেছিলাম তাই হলো। তুই এই অন্ধকারে কেন দাঁড়িয়ে আছিস।”
প্রিয়ন মাকে জড়িয়ে ধরে রুমে এসে খাটের উপর মাকে বসিয়ে নিজেও পাশে বসে বলল, “এমনি দাঁড়িয়ে ছিলাম মামনি। কিছুই হয়নি আমার। তুমি এত ভাবছ কেন আমায় নিয়ে আমি ঠিক আছি।”
শাহানাজ ছেলের কথায় কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে বললেন, ” আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু কিছু হলে আমায় কিন্তু জানাস। তা বললি না তো কাকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলি।”
প্রিয়ন এক টানে দুধটা পেটে চালান করে দিয়ে পাশে রাখা টেবিলে গ্লাসটা রেখে মায়ের আঁচলে মুখটা মুছে বলল, “গিয়েছিলাম এক পথচারী মেয়েকে নিয়ে৷ কিন্তু পরে জানলাম মেয়েটা মিরাজের গার্লফ্রেন্ড। জানো মামনি শালা এতদিন ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে আর আমাকে জানায়নি।”
“তোকে না জানালে তুই চিনলি কী করে? ওই মেয়ে তোকে বলেছে?”
“না মিরাজকে বলেছি পরে ও গিয়েছিল। পরে দেখে বলল ওর গার্লফ্রেন্ড। পরে মেয়ের পরিবারকে খবর দিয়েছে।”
“তা কী হয়েছিল রে মেয়েটার? তোকে কোথায় পেল?”
“আর বলো না। একটু শপিংমলে গিয়েছিলাম। মিরাজের আসতে দেরি দেখে অপেক্ষা করছিলাম। তখন হঠাৎ করে আমার সামনে এসে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। পরে নিয়ে গেলাম হাসপাতালে। তেমন কিছু না দূর্বলতা ছিল। ওর মা বললেন ওর বাবা নাকি অসুস্থ। ও একটা কোম্পানিতে জব করে সংসার চালায়। কিছুদিন যাবৎ জ্বর ছিল। আর তা নিয়েই অফিসে গিয়েছিল। এজন্য জ্ঞান ফিরতে দেরি হয়ে গেছে। ডাক্তার ঔষধ দিয়ে রিলিজ করে দিয়েছে। ওরা বাসায় চলে গেছে।”
“যাক ভালো হয়েছে তুই ছিলি বলে। এখন তো কেউ কারও জন্য এগিয়ে আসে না। তোর খালামনি কল করেছিল। সেতো রেগে আছে আজ আমরা যাইনি বলে। পরে বুঝিয়ে বলে ঠান্ডা করেছি। ”
“আচ্ছা মামনি কাল সকালেই আমরা রওনা দিব। অনুষ্ঠান তো সন্ধ্যায়। আমরা বিকেই পৌঁছে যেতে পারব।”
“তাহলে এখন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়। আমিও যাই দেখি তোর বাবাই ঘুমালো কি-না।”
মাকে বিদায় দিয়ে প্রিয়ন আবার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দিগন্তজোড়া আকাশ পানে খুঁজতে থাকে হারানো অতীত। হয়তো আরেকটা নির্ঘুম রাত কাটবে তার। একদিকে প্রিয়ন অন্যদিকে পূর্ণতা দুজন দু’মেরুর বাসিন্দা হলেও দুজন একই আকাশের নিচে বসবাসরত কষ্টের ফেরিওয়ালা।
পরেরদিন বিকেল পাঁচটায় প্রিয়নরা তার খালামনির বাসায় পৌঁছে। বাড়ির ভেতর প্রবেশের পর সদর দরজায় যাওয়ার পথে হাতের বামে চমৎকার এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উৎস ফুলের বাগান। সেই বাগানে চোখ যেতেই প্রিয়নের চোখ আটকে যায় এক নীল পরীর মাঝে……..
চলবে……..
ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
আপনার গঠনমূলক মন্তব্য লেখার অনুপ্রেরণা।