‘এক ঘোর বর্ষার রাতে জন্ম আমার। আমার জন্মের সময় প্রবল বাতাসে মাটির ঘরের আলোর একমাত্র উৎস হারিকেনটি নিভে গিয়েছিল। দাই মহিলা চিল্লাচিল্লি করে দাঁড়াতে গিয়ে গরম পানির হাড়ি ফেলে উল্টে। নাড়ি কাটার জন্য হাতের পাশে বাটিতে রাখা ব্লেডের ওপর পা পরে মহিলার পা যায় কেঁটে। তবু নিয়তির অমোঘ আদেশে আমার জন্মটা হয়েই যায়। অন্ধকার ঘর হাতড়ে অল্প সময়ে আমার বাবা কিভাবে যেন সব যোগাড় করে ফেলেন আবার।
নিজের কাটা পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘর থেকে বের হবার সময় সেই দাই বলে যায়, ‘এই মাইয়া না তোর ঘরে অশান্তি ডাইকা আনেরে জয়নাল। এমন সব ঘটনা আমার এতোদিনের দাইজীবনে ঘটে নাই।’
ভাবছেন এই ঘটনা আমার বাবা মা আমায় বলেছে? এটা কি সম্ভব? মা তখন ব্যথায় মারা যায় বলে। আর বাবা তখন মায়ের কি হয়, ছেলে না মেয়ে বাচ্চা সে চিন্তায় অস্থির। এতো সব খুঁটিনাটি মনে থাকার তো কারণই নেই। আমি এসব গল্প জানি ঐ দাইয়ের কাছেই।
আমার জন্মের পর থেকেই দিনে দিনে আমার মায়ের রক্তস্বল্পতা দেখা দেয় যা দিনে দিনে কেবল বাড়তেই থাকে। শেষ দিকে মা সারাদিনই কোন কাজই প্রায় করতে পারতোনা। সাত বছরের এই আমি মায়ের সাথে যতোটা ঘরের কাজ সম্ভব করতাম। উপায়ান্তর না দেখে বাবা মা কে নিয়ে শহরের হাসপাতালে যায়। ডাক্তার জানায় মায়ের জরায়ু ফেলে দিতে হবে। জরায়ু ছাড়া মেয়েলোকের কোন দাম হয়? ভাগ্যিস আমার মাকে সেই মূল্যহীন জীবন নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়নি। কয়েক ব্যাগ রক্ত যোগাড় করে অপারেশনের পরেও ওটি টেবিলেই মা মারা যায়। আমার বাবার তিন কূলে আর কেউ ছিলনা। নয়তো দেখা যেত কেউ না কেউ ধরে একটা বিয়ে করিয়েই দিত। আর তাই মা মারা যাবার পর তৃতীয় কারো উপস্থিতি ছাড়াই আমাদের বাপ বেটির জীবন শুরু হয়।
আমার বাবা ছিলেন দিনমজুর। সারাদিন বাইরে বাইরে থেকেই তার দিন কাটতো। আমি বড় হই সেই দাইয়ের কাছে। তাকে ততদিনে দাইমা বলে ডাকি। নিতান্তই মায়ার বশে, বাবার আর কেউ ছিলনা বলেই সেই মহিলা আমাকে ফেলে দেয়নি। তার নিজেরও যে কেউ ছিলনা। খুব অল্প বয়স থেকে দাইয়ের কাজ করা শুরু তার কারণ এক বিধবা দাইয়ের কাছেই সে এতিম হিসেবে বড় হয়েছিল। গ্রামের স্কুলে সকালবেলার ক্লাস সেরে এসে আমি দাইমার সাথে বাড়ি বাড়ি যেতাম পোয়াতি মেয়েলোকের বাড়িতে। আমি যে কোন কিছু খুব ভালো মনে রাখতে পারতাম। আর তাই মাস কয়েকের মধ্যে আমি তার পূর্ণ সহযোগী হয়ে উঠি। যেসব মহিলাদের ডেলিভারী কঠিন ছিল তাদের সাথে দাইমা ভ্যানে চড়ে হাসপাতালে যেতেন। আমাকেও নিয়ে যেতেন। সেই হাসপাতালেরই একজন ডাক্তার আমাকে একদিন বলে আমি কি তার বাসায় কাজ করবো কি না? কাজ বলতে তার বাচ্চাকে দেখে রাখা। আমার অবশ্য আপত্তি ছিলনা। বোধ করি আমার বাবারও না। কিন্তু বেঁকে বসেন আমার দাইমা। তিনি ডাক্তার আপার মুখের ওপর বলে বসেন, ‘এইডা আমার নাতিন। ওয় আপনের লাহান ডাক্তার হইবো। মাইনষের ঘরে কাজ করনের লাইগা তাইনে জন্মায় নাই।’ ডাক্তার আপা খুব অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘ও স্কুলে যায়? আপনার মতো দাই ছাড়া কি হবে শুনি? আপনি বুঝি নিজেকে ডাক্তার মনে করেন?’
আমার নাই পেটে ভাত, গ্রামের স্কুলে নিতান্তই বিনামূল্যে পড়ায় দেখে স্কুলে যাই সেই আমি হবো ডাক্তার? বয়সে ছোট হলেও এটা যে অবিশ্বাস্য কল্পনা সেটা বুঝে আমিও কতক্ষণ আমার বাবার সাথে গলা মিলিয়ে হেসেছিলাম। সামনাসামনি হাসলেও আমার মনে বোধহয় সেদিন থেকেই একটু একটু করে কৌতুহলের পাহাড় জমছিল। ঐ ডাক্তার আপাতো আমার মতোই মানুষ। তাহলে কি যে কেউ পড়ালেখা করলেই ডাক্তার হতে পারে? দাইমার কাছে আমার প্রশ্নের বহর দিনদিন বাড়তে থাকে।
আগে যখন সারাদিন টইটই শেষে সন্ধ্যা হলেই ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসতো এই আমিই দিনে দিনে একটু একটু করে বই পড়ার আনন্দ পেতে থাকলাম। বছর শেষের বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল আনতে বাবার ডাক পরলো স্কুলে। ক্লাস ফোরের চল্লিশ রোল নাম্বার এই আমি প্রথম হয়ে গেছি। বাবা বিস্ময়ে হতবাক হলেও দাইমা পান চিবুতে চিবুতে বলে, ‘জোহরা দাইয়ের চোখ জহুরীর মতো। মানিক চিনতে ভুল করেনা।’
আমার দাইয়ের মানিক চেনার জোরে নাকি আমার পরিশ্রম আর একাগ্রতার জোরে আমি পঞ্চম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে গ্রামে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেই।
তারপরের প্রতিদিনের গল্প শুধু একটু একটু করে সব বাঁধা ঠেলে সামনে এগিয়ে যাবার।দাইমা থানা, ইউনিয়ন, চেয়ারম্যান অফিস ঘুরে ঘুরে কিসব বৃত্তি যোগাড় করে আনতেন। পড়ালেখা তাই আর থামাতে হয়নি। বাবা শুধু কষ্ট করে খাওয়ার খরচ চালিয়ে নিতেন। স্কুল, কলেজ, মেডিকেল কলেজের প্রতিটা বছরের যে কোন প্রয়োজনে আমার দাইমা লাগলেই চলে আসতো আমার কাছে। ইন্টার্নশীপের সময় একদিনের নোটিশে যখন আমার বাবাও চলে যায় পৃথিবী থেকে সেদিনও আমার মাথার ওপর ছায়া হয়ে দাঁড়ায় দাইমা। বিসিএস দিয়ে নিজের গ্রামে পোস্টিং নিয়ে যেদিন কাজ শুরু করি সেদিন আমার দাইমা তার ডেলীভারী করানোর চটের ব্যাগটা আমার হাতে তুলে দিয়ে বলে, ‘আজকা থিকা আমার ছুটিগো নাতিন।’
ছুটোছুটি করে কাজ করতেন বলে এই বুড়ো বয়সেও আমার দাইমা এখনো বেশ শক্তপোক্ত আছেন। আমি কাজ শুরুর পর আর ওনাকে কাজ করতে না দিলেও রোজদিন সকাল সকাল আমার সাথে হাসপাতালে এসে বসে থাকেন। উনি বাসায় থেকে আমার বাচ্চার কাছে থাকতেন বলে আমি সহজেই গাইনিতে পোস্টগ্রাজুয়েশনটা শেষ করে ফেলতে পারি। গ্রামের মানুষের জন্য কিছু করার নেশা সবসময় ছিল বলেই শহরের ব্যস্ত জীবনে না থেকে আমি গ্রামেই ফিরে আসি। আমার স্বামীরও এই এলাকায় পসার ভালো থাকাতে ও আপত্তি করেনা।
…………..
আমি তোরে এক জায়গায় নিয়া যামু আইজ সালমা।
– কোথায় দাইমা?
গেলেই দেখবি।
রিকশা চড়ে যাই বাজারের কাছে একটা ডাক্তারের চেম্বারে। বাইরে সাইনবোর্ডে লেখা ডা. নুরুননাহার, জেনারেল প্র্যাকটিশনার, পিজিটি( গাইনি এন্ড অবস)।
আমার হাত টেনে ধরে গটগট করে দাইমা ঢুকে যান ভেতরে।
– ভালো আছেন ডাক্তার আপা?
জ্বি ভালো। রোগী কে?
– আমরা কেউ রোগী না। এইটা আমার নাতিন। ম্যালা বছর আগে আপনে তারে আপনের বাসায় কাজ করতে কইসিলেন। তাইনে কিন্তু আমার লাহান দাই হয় নাই। বড় ডিগ্রী নেয়া গাইনি ডাক্তর সে।
পেছনে হতবিহবল ডা. নুরুন নাহার কে রেখে দৃপ্ত পায়ে হেঁটে বেরিয়ে আসেন আমার দাইমা। আমি মুগ্ধ চোখে তার পথের দিকে তাকিয়ে শুধু তাকেই দেখি, আমাকে আলোকিত জীবনের স্বপ্ন দেখাবার কারিগর যে তিনিই।
#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস