#স্বচ্ছ_প্রণয়াসক্ত
#পর্ব_৩
#মুসফিরাত_জান্নাত
ক্ষন কালের ব্যবধানেই তার ফোনে একটি মেসেজ আসে,
“আজকে কি ফ্রী আছো?”
স্ক্রিনে জ্বল জ্বল করছে মাহিনের পাঠানো ক্ষুদেবার্তার দল।আর ফোনের ওপাশ থেকে ভাসছে জেবার কন্ঠস্বর।
“কিরে আল্লাহর বান্দী।টাস্কি খাইয়া গেলি তো?আমরাও খাইছিলাম।সেদিন যে একখান কাহিনি হইলো!সবকিছুর পরেও যে এখন ও ফিরবে কল্পনাই করতে পারিনি।”
প্রতিক্রিয়ায় মৌন রয় ঐশী।নিজের মতো করেই জেবা বলতে থাকে,
“যাইহোক আজ তো তাহলে কলেজে আসছিস?দেখা টেখা হবেনি।টাকা পয়সা ধরে আনিস দোস্ত।মিষ্টিমুখ করাতে দেরি করতে নেই।পাছে আবার আমাদের অভুক্ত রাখার দায়েই তোদের ব্রেকআপ হয়ে যাবে।তখন কিন্তু দোষ দিতে পারবি না,হুহ।”
রসিকতাপূর্ণ কন্ঠ জেবার।সেদিকে ধ্যান নেই ঐশীর।সবকিছু খাপছাড়া লাগছে তার নিকট।এখন তার কি করা উচিৎ বুঝে আসে না।মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে আসে।ঘার ঘুরিয়ে বিছানার দিকে তাকায় সে।অক্ষিকাচে ভাসে সাদাতের ঘুমন্ত বদন।কতো নিষ্পাপ লাগছে মানুষটাকে।বুকের ভেতর কেমন যেন অনুভুত হয় ঐশীর।ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে সে।জবাবে বলে,
“আমি একটু ব্যস্ত আছি দোস্ত।পরে কথা বলছি।”
জেবাকে ওপাশ থেকে দ্বিরুক্তি করার সুযোগ না দিয়ে কল কে’টে দেয় সে।সাদাতের নিষ্পাপ মুখশ্রীতে কিছুসময় তাকিয়ে থাকে।আচমকা এই মানুষটার মাঝে আটকে গিয়েছে সে।চাইলেও অন্যত্র ফেরা দায়।ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। সাদাত তখনও ঘুমে।মানুষটাকে জাগাতে সাধ হয় না তার।কাল কতো মানসিক ধকল গিয়েছে লোকটার উপর দিয়ে।আর একটু বিশ্রাম নিক।তার কোমল পা দু’টি মেলে ধরে কিচেনের দিকে।
_______
আজকে একটু তাড়াতাড়িই রান্না চাপিয়েছেন রাহেলা খাঁন।বাড়িতে নতুন মেহমানরা উঠে যদি নাস্তা রেডি না পায় তো লজ্জায় পড়ে যাবেন তিনি।তড়িঘড়ি করে তাই নিজের হাত চালাচ্ছেন।ঐশীকে এগিয়ে আসতে দেখে মুচকি হাসেন তিনি।অধর জোড়া নাড়িয়ে বলেন,
“আর একটু ঘুমালেই পারতি মা।এতো তাড়াতাড়ি উঠে গেলি যে!”
“এমনি ঘুম ছুটে গেলো।আমি তোমাকে হেল্প করছি দাও।”
ঐশীর প্রতিউত্তরে খুশি হন রাহেলা।মথে রাখা আটা মেয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন,
“তাহলে তুই পরোটা বানিয়ে সেঁকে দে।আমি অন্যান্য আইটেম রান্না করি।”
আদেশ পেয়ে কাজে হাত লাগায় ঐশী।নিজের কাজটা আগাবে জন্য খুশি হন রাহেলা।তার বড় মেয়ে অবুঝপনা করলেও ছোট মেয়েটা কতো বুদ্ধিসম্পন্ন হয়েছে।মায়ের কষ্ট বুঝতে শিখেছে।মেয়েকে দেখে মায়া হয় তার।এই কলিজা চেরা সন্তানকে পরের ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া যে তার জন্য কতো কষ্টের তা একমাত্র সেই জানে।কতোটা দহন হচ্ছে তার হৃদয়ে তা সে ছাড়া অন্য কেও অনুভব করতে পারবে না।যদিও ঐশীর অনার্স শেষ হলে বছর দুই পরে অনুষ্ঠান করে তুলে দিবেন।তবুও মেয়েটা তো পরের অধীন হয়েছে।চাইলেও কি আর নিজের মতো আটকে রাখতে পারবেন?বুকটা হু হু করে ওঠে রাহেলার।লুকিয়ে আঁচলে চোখ মোছেন তিনি।তড়িৎ হাত লাগিয়ে রান্না শেষ করেন।
_______
খাবার টেবিলে সবাই খেতে বসেছে।সাদাত বসেছে আনোয়ার খাঁনের পাশে।তার অপর পাশে সাদাতের মা মাসুদা শেখ বসা।রাহেলা বানু ও মাসুদা শেখ গল্পে মেতে রয়েছেন।অপরদিকে সাদাত ও আনোয়ার খাঁনের মাঝেও টুকটাক কথা হচ্ছে।সবার দিকে এক পলক চেয়ে সাদাতের দিকে দৃষ্টি দেয় ঐশী।লোকটার পড়নে সাদা শার্ট ও কালো প্যান্ট।একদম রেডি হয়ে বের হয়েছে।হয়তো এখান থেকেই কলেজ যাবে।হালকা চাপ দাড়িতে বেশ সুদর্শন লাগছে তাকে।আড়চোখে তাকিয়ে থাকে সে।কথার ফাঁকে হটাৎ ঐশীর দিকে তাকায় সাদাত।চোখে চোখ পড়ে যায়।অস্বস্তিতে পড়ে ঐশী।ইশ কি লজ্জা!সে যে লুকিয়ে লুকিয়ে তার অযাচিতভাবে আপন হওয়া পুরুষটিকে দেখছিলো তা জেনে গেলো লোকটি।নতমুখে বার কয়েক পলক ফেলে সে।অস্বস্তি কাটাতে মা’কে জিজ্ঞেস করে,
“আপু কোথায়?আপুকে দেখছি না যে!”
আনোয়ার খাঁনের দিকে এক পলক তাকিয়ে রাহেলা খাঁন জবাব দেন,
“তাবাসসুম ওর ঘরে আছে।”
“ও খেয়েছে কিছু?”
“কাল রাত থেকেই না খাওয়া।এতোকিছু হওয়ার পর খায় ও?”
বিচলিত হয় ঐশী।
“তাই বলে খাওয়াবা না তোমরা?ও তো একটুও ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না।যত যাইহোক এই বাড়ির মেয়ে তো ও নাকি?”
“অনেক বুঝিয়েও দু মুঠ খাওয়াতে পারিনি।তুই গিয়ে দেখ খায় কিনা।”
অভিমানি কন্ঠে জবাব দেয় রাহেলা।যতই অভিমান জমুক মেয়ের ক্ষুধার্ত শূন্য পেট পীড়া দেয় তাকে।আনোয়ার খাঁন পুরোটা জুরেই নিরব ভূমিকা পালন করেন।বড় মেয়ের উপর রাগ কমেনি তার।ঐশীর আদিখ্যেতা দেখে রুষ্ট হন।কিন্তু নতুন আত্মীয় আছে বলে প্রসঙ্গ এড়িয়ে চুপ থাকেন।একটা প্লেটে মাংস ভুনা ও পরোটা নিয়ে চলে যায় ঐশী।সাথে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা গরম চা। তাবাসসুমের পছন্দনীয় নাস্তা।
বোনকে এগিয়ে আসতে দেখে নড়ে ওঠে তাবাসসুম।জড়িয়ে ধরে অপরাধী গলায় বলে,
“তুইও কি আমার ওপর রেগে আছিস ঐশী?বিশ্বাস কর,আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ।একটুও পালাতে চাই নাই।কোথা থেকে যেন এক গায়েবি শক্তি এসে আমাকে টেনে নিয়ে গেছে ওখানে।ওই শক্তির সাথে আমি পেরে উঠি নাই।তাই পালাইছি।”
ঝাঁকি দিয়ে তার হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে নেয় ঐশী।কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
“একদম ঢং করবি না আমার সাথে।তোর ঘাড়ের বোঝা আমার ঘাড়ে চাপানোর আগে এটা মনে হয় নি?তুই কেমনে পারলি নিজের বোনকে এভাবে ফাঁসাতে?একটুও কলিজা কাঁপলো না তোর?নিষ্ঠুর মহিলা।”
“আমি কি জানতাম নাকি আব্বু এমনটা করবে।ট্রাস্ট মি,জানলে তোকে নিয়েই পালাতাম।আমার গায়েবি শক্তি এতো স্বার্থপর না যে নিজের বোনকে জলে ভাসিয়ে একা ছুটবে।”
“হু জানি ওসব।আসলে তোর উপকার করাই আমার লস হইছে।সাধে কি আর মানুষ বলে দো পায়ের উপকার করতে নেই।কেন যে তোকে এই হিটলার বেটার স্বভাব সম্পর্কে অবগত করতে গিয়েছিলাম।তোকে সচেতন না করলেই তো আমার এখন ডোমের কবলে পড়তে হতো না।কাল রাতটা যা গেলো না উফ!আত্মা হাতে ধরে ছিলাম সারারাত।”
চোখ দুটো প্রসস্থ হয় তাবাসসুমের।তড়িৎ লাফিয়ে উঠে বলে,
“কেন?তোর ডোম জামাই রাতে কা’টাকা’টি করছে নাকি তোকে?অভিজ্ঞতা কেমন ছিলো?হুম।”
তাবাসসুমের বদমাইশি কথায় আড়ষ্ট হয় ঐশী।রক্তিমা বর্ণ ধারণ করে দু গন্ড।দ্রুতই নিজেকে ধাতস্থ করে সে।কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
“চুপ বেয়াদ্দব!নিজের ছোট বোনকে এগুলা বলতে লজ্জা লাগে না?”
নিজের বত্রিশটা দাঁতের পাটি বের করে হাসে তাবাসসুম।
“না লাগে না।কাল থেকে পেটে ভাত নাই তাই লজ্জা গুলে খাইছি।এখন বল কি কি হলো?তোর বিটকেল জামাই কি আদৌ রোম্যাঞ্চ টোম্যান্স বোঝে?”
ঐশীকে লেগপুল করতে লেগে পড়ে তাবাসসুম।বিরক্তি বেড়ে কপাল ছোঁয় ঐশীর।
“তোর ফাও কথার জবাব দিতে পারব না।নাস্তা আনছি খাইলে খা না খাইলে নিয়ে গেলাম।”
“এমন করিস কেন?বিয়ে হইতে না হইতেই পর হয়ে গেছিস।কিসের কি একটু সাধবি।”
“হ আমাকে মর্গের ডোমের কাছে পাঠাইয়া তোমাকে খাবার সাধব এই ধান্দায় আছো।স্বার্থ সন্ধানী কোনহানকার।”
তাবাসসুমের দিকে তাকিয়ে দেখে ঘাপুস ঘুপুস করে গিলছে সে।হাত ঝাড়া দিয়ে উঠে যেতে যেতে ঐশী বলে,
“একটু আস্তে খা পাঠা।গলায় বাঁধবে।”
কিছু একটা প্রতিবাদ করে তাবাসসুম।কিন্তু মুখে খাবার থাকায় স্পষ্ট বোঝা যায় না।
_______
সকাল সকাল একেবারে বিদায় নিতে উদ্যত হয় সাদাত।বের হওয়ার পূর্বে ঐশীর সাথে শেষ সাক্ষাৎ করতে চায়।রাতের না বলা কথাটা সেড়ে ফেলা দরকার।অথচ মেয়েটির সাক্ষাৎ নেই।সেই যে লজ্জা পেয়ে তখন পালিয়ে গেলো আর ধরা দিলো না।এদিকে সময়ও গড়িয়ে যাচ্ছে।হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয় সে।নতুন দুলাভাইকে হাঁসফাঁস করতে দেখে এগিয়ে আসে তুষার।
“কি দুলাভাই কিছু লাগবে?আপনার যেকোনো সমস্যা হলে আমাকে বলতে পারেন।আম্মু বলেছে আপনার কোনো অসুবিধা যেনো না হয়।”
অনিচ্ছা সত্বেও অধর প্রশস্ত করে সাদাত।কপালে হাত চালিয়ে বলে,
“সমস্যা একটা আছে।তোমার আপুকে একটু ডাক দিবে?”
“আপনি প্রেশার নিবেন না।আমি এক্ষুনি ডেকে দিচ্ছি ওকে।”
ঠোঁট চেপে হেসে চলে যায় তুষার।হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রয় পুরুষটি।তার কথাটা যে অন্য অর্থ বের করবে আগে বুঝে আসে নি তার।
মিনিট খানেকের ব্যবধানেই ঐশী চলে আসে।লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে সে।সবার মাঝে এভাবে ডেকে পাঠানোতে আড়ষ্টতা ভর করে।একই ঘরে দাঁড়িয়ে আবারও অস্বস্তি জেঁকে বসে দুজনের মাঝে।এতো সময় ঐশীর সান্নিধ্য পেতে ছটফট করলেও জড়তার জন্য নিজের কথা গুছিয়ে উঠতে পারে না সাদাত।কিছু সময় নিভৃতেই অতিবাহিত হয়।অতঃপর নিরবতার পর্দা ভেদ করে সাদাত।সোজাসাপটা প্রশ্ন ছোড়ে সে,
“আপনি কি কিছু ভেবেছেন?”
ভ্রু কুঁচকে তাকায় ঐশী।সাদাতের কথার অর্থ তার নিকট স্পষ্ট নয়।মেয়েটির দৃষ্টির অর্থ বোঝে অভিজ্ঞ পুরুষটি।স্পষ্ট শীতল গলায় ব্যাখ্যা করে বলে,
“ব্যক্তিগত ও পেশাগত উভয় জায়গা থেকেই আমাদের বর্তমান সম্পর্কটা বেশ এলোমেলো।আমাদের পার্থিব জীবনে বেশ প্রভাব ফেলছে সম্পর্কটা।এই অবস্থায় আমার সাথে গুছিয়ে নিতে চান নাকি অন্য কিছু ভাবছেন?”
কলিজা কেঁপে ওঠে ঐশীর।অন্য কিছু বলতে যে ডিভোর্স মিন করছে তা স্পষ্ট বোঝে সে।কাঁপা গলায় বলে,
“একটা মেয়ে হিসেবে আমার জায়গা থেকে অন্যকিছু ভাবা সহজ নয়।”
“গুছিয়ে নিতে চাইছেন?”
“কিছুটা সময় লাগবে হয়তো।”
“কিন্তু আমার একটা আপত্তি আছে।কলেজের কেও এ বিয়ের ব্যাপারে কিছু জানতে পারবে না।আমাদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবন আলাদা রাখতে হবে।তাছাড়া বেশ ঝামেলা পোহাতে হবে।যদি এতে রাজি থাকেন তবে আপনার মর্জি অনুযায়ী সময় পাবেন।”
কোনো দ্বিরুক্তি করে না ঐশী।সে আগে থেকেই জানতো এমন একটা শর্ত দেবে সাদাত।নিজের বোনের সম্পর্কটাকেই যে ব্যক্তি পেশাগত জীবন থেকে আলাদা রেখেছে, সে যে বৈবাহিক সম্পর্ক পেশাগত জীবনে জড়াবে না তা নিশ্চিত।মেনে নেয় সে।ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে সাদাত।ভালোয় ভালোয় মিটে যায় সব।
_________
শীতের দুরন্ত অন্তরীক্ষ ক্ষণে ক্ষণে রুপ বদলায়।কখনো ধুসর কুয়াশাচ্ছন্ন তো কখনো সোনালী রোদ্দুর খেলা করে অম্বরের আনাচে কানাচে।তেমনই এক শীতার্ত রাত শেষে ম্লান রোদের মাঝে কলেজে উপস্থিত হয়েছে ঐশী।গায়ে সোয়েটার ও কাধে ব্যাগ তার।অফিস রুম ডিঙিয়ে যাওয়ার পথে জানালা দিয়ে এক পলক উঁকি দেয় সে।পত্রিকা হাতে সাদাতের গম্ভীর চেহারা ভেসে ওঠে তিন নম্বর টেবিলে।গভীর মনোযোগ সহকারে কোনো খবর পড়ছে সে।দৃষ্টি নামিয়ে ফেলে ঐশী।সেই যে সেদিন সকালে বেড়িয়ে এলো লোকটা তারপর আর দেখা হয় তার সাথে।ফোনেও যোগাযোগ হয় নি একবার।তপ্ত শ্বাস ফেলে ঐশী।চারিদিকে চোখ বুলিয়ে কাওকে খোঁজে সে।পেয়েও যায়।সতর্ক পা ফেলে কুয়াশায় ভেজা ঘাস মাড়িয়ে এগোয় শহীদ মিনারের উদ্দেশ্যে।সেখানে তার বন্ধুমহল আড্ডারত রয়েছে।আর কয়েক কদম ফেললেই পৌঁছে যাবে ঐশী।পথিমধ্যে ঝড়ের বেগে ছুটে আসে কেও।তার ডান হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুড়ে নেয়।হাত ধরা মালিকটি বলে,
“ঐশী তুমি এসেছো!অবশেষে তোমার দেখা পেলাম।”
চলবে