স্বচ্ছ প্রণয়াসক্ত পর্ব-০২

0
1307

#স্বচ্ছ_প্রণয়াসক্ত
#পর্ব_২
#মুসফিরাত_জান্নাত

ড্রয়িং রুমে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে তাবাসসুম।ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। তার এক হাত ধরে পাশে দাঁড়িয়ে আছে তুষার।বাবাকে হড়বড় করে ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছে সে।

” ও ওর বান্ধবী রুবির বাড়ি গিয়ে লুকিয়ে ছিলো,আব্বু।আমি গিয়ে ধরে নিয়ে আসছি।তাও কপাল ভালো আজকেই সন্ধান মিলেছে।সঠিক সময়ে নিয়ে উপস্থিত হতে পেরেছি।নইলে মান সম্মান কিচ্ছু থাকতো না।”

রাগে মাথার রগ দপদপ করছে আনোয়ার খাঁনের।বংশগত কারণেই বাবার রাগটা পেয়েছেন তিনি।তার সূত্র ধরে তুষারের রাগও কম নয়।বোনের উচ্চ শাস্তি কাম্য করছে সে।এছাড়াও সে বাহাদুরের ন্যায় বুদ্ধি খাটিয়ে অনেক কৌশল করে বের করেছে তাবাসসুমকে।বয়সে বড় হলে দু চার ঘা বসিয়ে দিয়ে নিজের দাপট দেখিয়ে দিতো।আনোয়ার খাঁন অবশেষে মুখ খোলেন,

“তুমি মোটেও ওকে সঠিক সময়ে নিয়ে আসতে পারোনি আব্বা।তবে আজকে এনেছো যে এটা ভালো।আমি সঠিক ব্যবস্থা নিয়ে ফেলেছি।তাবাসসুম এর স্থলে ঐশীর বিয়ে দিয়েছি আমি। তোমার বোনকে বলো নিজের মুখ লুকিয়ে রাখতে।নতুন আত্মীয়ের মাঝে ওই অপয়া মুখ দেখাটাও আমাদের জন্য অপমানজনক।আরও বলো আমার সম্মান লুটাতে ও বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে গেলেও নিজের মান সম্মান রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আমি সবসময়ই নিতে পারি।ওর মতো মেয়ের আমার দরকার নেই।”

হু হু করে কেঁদে ওঠে তাবাসসুম।বাবার পর সম্বোধনীয় তিক্ত বুলি তীরের মতো হৃদয়ে বিঁধে।নিজের নেওয়া সিদ্ধান্তকে আচমকাই ভুল বোধ হয়।অনুশোচনা জাগে অন্তরে।অথচ ভুল একবার করে বসলে তা শুধরানো দায়।কান্নারত গলায় বাবার পায়ে লুটিয়ে পড়ে সে।

“আমার ভুল হয়েছে আব্বু।তুমি আমাকে যা শাস্তি দেও আমি মাথা পেতে নেব।তবুও এমন মুখ ঘুরিয়ে নিও না।”

পা ঝাঁকি দিয়ে সড়িয়ে দেন আনোয়ার খাঁন।কড়া কয়টা কথা বলতে অধর ফাঁকা করতেই আটকে দেন তার অর্ধাঙ্গিনী রাহেলা খাঁন।শান্ত মাথায় নরম সুরে বুঝান,

“নতুন মেহমান এখনো বাসায় উপস্থিত আছে।এর মাঝে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করে মেয়েকে মেনে নেন।পরে যা খুশি ব্যবস্থা নিয়েন।যা হওয়ার তা তো হয়েই গিয়েছে।এখন গোলমাল করে নিজেদের সম্মান বাকি যা ছিলো তা ধুলায় মেশাবেন না।এমনিতেই নতুন বর ও আত্মীয়রা তাদের শোবার ঘর ছেড়ে বের হয়ে এসেছে।”

বউয়ের পরামর্শটা বেশ মনে ধরে আনোয়ার খাঁনের।এই প্রথম তার বউ এতো সুপরামর্শ দিলো তাকে।এক হাত দিয়ে তাবাসসুমকে ধরে তুলেন তিনি।সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে দেখেন।স্পষ্ট গলায় বলেন,

“উঠো আম্মা।এভাবে অনুতপ্ত হচ্ছো কেনো?তুমি তো আর অন্য মেয়েদের মতো কোনো ছেলের হাত ধরে পালাও নি।বিয়ে করতে অনিচ্ছুক বলে বান্ধবীর বাড়ি ছিলে।এখন বিয়ে করতে আপত্তি সেটা আমাকে জানালে পারতে।আমি তোমাকে একটুও জোর করতাম না।যাইহোক সারাদিনে অনেক ধকল গিয়েছে।এখন গিয়ে বিশ্রাম নেও।”

সবাইকে শুনিয়ে কথাগুলো বলে প্রত্যকের অন্তরে ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির অব্যর্থ চেষ্টা করেন আনোয়ার খাঁন।ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তুষার।সে ভেবেছিলো কি আর হলো কি?এতো কষ্টে বোনকে ধরে আনাই ব্যর্থ হলো তার।গটগট করে চলে যায় সে।তাবাসসুমকেও ঘরে নিয়ে যায় রাহেলা খাঁন।একে একে সবাই যার যার ঘরে যায়।শান্ত,নিরেট চাহনিতে এসব পর্যবেক্ষন করে সাদাত ও ঐশী।মনে মনে দুজনেই চরম বিরক্ত হয় তাবাসসুমের প্রতি।একজনের বিরক্তি তাকে অসস্তিতে ফেলে দেওয়ায়।আরেকজনের বিরক্তি তাকে জ’মের হাতে তুলে দেওয়ায়।অবশ্য কেওই কারো মনোভাব জানে না এখনো।সাদাত পিছু ঘুরতেই হুড়মুড় করে পিছু ফেরে ঐশী।পায়ের সাথে লেগে শাড়ির সব কুঁচি খুলে যায়।আকষ্মিক ঘটনায় হতবিহ্বল ঐশী।বাসর রাতে নিজের অদক্ষতায় জামাইয়ের সামনে শাড়ি খুলে যাওয়াটা যে কতোটা লজ্জার তা হয়তো ঐশী বাদে দ্বিতীয় কেও উপলব্ধি করেনি।একবার নিজের শাড়ীর দিকে তো আরেক বার সাদাতের দিকে তাকায় ঐশী।কেমন অদ্ভুদ নয়নে তাকিয়ে আছে সাদাত।লজ্জায় মাথা কা’টা যায় ঐশীর।মনে মনে প্রার্থনা করে,

“ইয়া মাবুদ!জমিন ফাঁক করে দাও, আমি ঢুকে যাই।এই মুখ এখন লোকের সামনে দেখাবো কেমনে?”

সত্যিই ভীষণ অস্বস্তিকর পরিবেশে পড়ে সে।বাসর ঘরে অন্য সবার রোম্যাঞ্চকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়,ইতিহাস রচিত হয়ে যায়।যার স্মৃতি চারণে লজ্জাবতীর ন্যায় সারা জীবন নুইয়ে পড়ে যে কেও।আর তার কিনা হচ্ছে নিজের শাড়ী নিজেরই খুলে ফেলার ইতিহাস!এতো বাচ্চা সে!গায়ে ফুটবে ভয়ে শাড়ী পড়ানোর সময় পিন আপ করতে দেয় নি।যার ফলশ্রুতিতে এখন এই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হলো ঐশীকে।কিছুসময় পর গলা খাকাড়ি দেয় সাদাত।সম্বিৎ ফিরে ঐশীর।মাথার ঘোমটা আর একটু টেনে এক হাতে খুলে যাওয়া শাড়ির অংশটুকু গুটিয়ে ধরে সে। কাবার্ড থেকে থ্রি পিচ নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায় তখন বাধে আরেক বিপত্তি ওয়াশরুমে চেঞ্জ করতে নিয়ে শাড়ি ভিজিয়ে ফেলে অনেকটা।দুই হাতে শাড়ি পেচিয়ে মুখ লুকিয়ে বেলকনিতে ভেজা শাড়ি মেলে দিতে এগোয়।সেখানে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ দেখছিলো সাদাত।সারাদিনে তার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ধকল মিলিয়ে দিচ্ছিলো নিকষ কালো অন্তরীক্ষে। আবছা আলোয় শাড়ী হাতে বেখেয়ালে সুঠাম দেহের পুরুষটির সাথে ধাক্কা লাগে ঐশীর।তড়িৎ পড়ে যেতে নেয় সে।অভিজ্ঞ হাতে আগলে নেয় সাদাত।ভয়ে চোখ মুখ খিঁচে সাদাতের বুকে মিশে যায় মেয়েটি।বুকের মাঝে ঢিপ ঢিপ স্পন্দন শুরু হয়।এক অজানা অনুভুতির করাল থাবার আক্রমনে পড়ে সে।দেহে ইষৎ কাঁপন ধরে।চিন্তারা আকাশ ছোঁয়।লজ্জায় ভয়ে একাকার হয়ে যায় নব বিবাহিত কন্যাটি।মুখ তুললেই সাদাত স্যার তার চেহারা দেখে ফেলবে।এ কারণে ওভাবেই চুপটি মে’রে থাকে সে।এদিকে নিজে থেকে সদ্য বিবাহিত স্বামীর শরীরে লেপ্টে থাকাও লজ্জাজনক।বিষয়টা মাথায় আসতেই দোটানায় পড়ে যায় কন্যা।এখন কি করবে সে?লজ্জা থেকে পালাতে মুখ তুলবে নাকি মুখ লুকাতে লজ্জা সইবে?

নিজের শরীরে নিয়ন্ত্রণ আসতেই এক হাতে ঐশীকে সড়িয়ে দেয় সাদাত।ব্যকুল হয়ে বলে,

“কোথাও লাগে নি তো আপনার?”

একটু দুরত্ব বাড়তেই ঐশীর মুখ অক্ষিগত হয় সাদাতের।চোখে চোখ পড়তেই সে বলে ওঠে,

“আপনি?”

ঐশীও চোখ প্রশস্ত করে তাকায়।তার অবাক হওয়াটা অবশ্য পুরোটাই নাটকীয়।সে আগেই মনে স্থির করে রেখেছে কিছু না জানার ভাণ করবে।তাছাড়া লজ্জারা আরও বৃদ্ধি পাবে তার।পাশাপাশি তার অবাক হওয়ার নাটক করার আরও একটা কারণ আছে।সাদাত যেন কখনো পূর্বের ইস্যু ধরে তাকে বিয়ে করার পূর্ব পরিকল্পনা ছিলো ঐশীর এমনটা বলে ব্লেইম না করতে পারে,সেজন্য এমন ভান ধরা।সে মনে মনে ভেবে নেয় সাদাতের প্রত্যেকটা কথার জবাব কিভাবে দিবে সে।এই লোকের একটা কথাও মাটিতে পড়তে দিবে না ঐশী।তাছাড়া এই হিটলার পেয়ে বসবে তাকে।নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাবে।সেও দেখিয়ে দিবে সাদাতের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় ঐশী।সাদাত যদি বুনো ওল হয় তবে সেও বাঘা তেঁতুল।

ঐশীকে দেখা মাত্রই উত্তেজিত হয় সাদাত।কপাল চাপড়ে বলে,

“ইয়া মাবুদ!একি দেখছি আমি।শেষমেশ কিনা আপনার মতো অসভ্য,ফাজিল,ফেল্টুস মেয়ে আমার কপালে জুটলো?কোন পাপের ফল এটা আল্লাহ জানে।”

দ্বিগুণ তেজে প্রতিউত্তর করে ঐশী।

“পাপ আপনার নাকি আমার বুঝতে পারছি না স্যার।আমার কপালেই বা কোন দুঃখে আপনার মতো হিটলার মানুষ জুটলো!”

“এই আপনার লজ্জা করেনি নিজের স্যারকে বিয়ে করতে?”

ঐশীর ত্যাড়া উত্তর,

“আপনার লজ্জা করেনি নিজের ছাত্রীকে বিয়ে করতে?”

“আমি কি জানতাম নাকি পাত্রীর স্থলে ছাত্রী এন্ট্রি করবে?”

“আমিও কি বুঝেছি নাকি আমাকে আপনার সাথে বিয়ে দিয়ে সম্মান বাঁচাবে।”

বিরক্তিতে চ সদৃশ্য শব্দ উচ্চারণ করে সাদাত।কথার পৃষ্ঠে কোনো জবাব দেয় না। আকষ্মিক ঘটনায় মস্তিষ্ক বিগড়ে আছে তার।এমন অবস্থায় প্রতিক্রিয়া দেখালে নিজের ব্যক্তিত্বের বিনাশ ঘটবে।রাগ মানুষকে নিচে নামিয়ে ফেলে।আপাতত নিজের রাগকে দমন করতে ব্যস্ত হয় পুরুষটি।চোখ পিট পিট করে সেদিকে তাকিয়ে থাকে ঐশী।লোকটার পরিকল্পনা তার ছোট্ট মাথায় ধরা দেয় না।সাদাতকে বোঝার ব্যর্থ প্রয়াস চালায় সে।

_______
ঘড়িতে রাত দুইটা ছুঁই ছুঁই।তখনও নির্ঘুম দু’জোড়া চোখ।স্টাডি টেবিলের এক পাশে রাখা চেয়ারে মাথা চেপে বসে রয়েছে ঐশী।আর বিছানার এক কোণে বসে আছে সাদাত।কেও কারো সাথে কথা বলে উঠতে পারছে না।দুজনের মাঝেই অস্বস্তিকর পরিবেশ।ইতিমধ্যেই তারা বুঝে ফেলেছে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে একে অপরের জীবনে জুরে গিয়েছে তারা।না চাইলেও সম্পর্কটাকে মেনে নিতে হবে।তবুও জড়তা কাটানো দায়।সম্পর্ক যে শিক্ষক ছাত্রীর।কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে ঐশীর দিকে তাকায় সাদাত।রাত্রী বৃদ্ধিতে ঘুমে ঢুলুঢুলু করছে মেয়েটি।নিজের ভিতর থেকে আসা প্রশ্নকে ভিতরেই ঠেলে দেয় সে।ধাতস্থ গম্ভীর কন্ঠে বলে,

“কষ্ট না করে বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন ঐশী।ইতস্তত করে কষ্ট বাড়িয়ে লাভ নেই।”

নড়েচড়ে ওঠে ঐশী।ঘুম জড়ানো গলায় শুধায়,

“আর আপনি?”

“যেহেতু ঘরে বিছানা একটাই,তাই ঘুমানোর অন্য কোনো জায়গা দেখছি না।সমস্যা নেই নিজের উপর কনট্রোল আছে আমার।আপনার সমস্যা না থাকলে শেয়ার করে থাকতে পারেন।”

পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে লোকটা।দ্বিধায় পড়ে যায় ঐশী।কি বললো লোকটা?সাদাতের পাশে ঘুমাতে তার ঘোর আপত্তি,অথচ না ঘুমালেও কি ভাববে সে?তার নিজের প্রতি কনট্রোল নেই?আরেক পাশে বালিশ টেনে শুয়ে পড়ে সে।

_______
ভোরের আকাশে রবির আগমন হয়েছে ঘন্টা দুয়েক হবে।আজ সকাল সকাল উঠে পড়ে ঐশী।না এমনি ঘুম ভাঙে নি তার।মুঠোফোনের কর্কশ শব্দে জাগা পেয়েছে সে।ঘুম জড়ানো চোখে নিজস্ব ফোন হাতে নেয় ঐশী।কল পিক করতেই ওপাশ থেকে হড়বড় করে কেও বলে,

“ট্রিট কখন দিবি দোস্ত?জব্বর কাহিনি হইছে?”

ঘুম ছুটে যায় ঐশীর।তাদের বিয়ের খবরটা জেবা জেনে গেলো না তো?কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,

“ক কি হইছে, সেটা তো বল?”

“তোর ক্রাশ মাহিন হয়তো তোর প্রেমে পড়ে গেছে।আমার থেকে তোর পারসোনাল ফোন নাম্বার নিলো।”

হাঁফ ছাড়ে ঐশী।জেবা কিছু জানতে পারেনি।কিন্তু পরক্ষণেই মস্তিষ্কের নিউরন জেগে ওঠে।মাহিন এই অসময়ে তার ফোন নাম্বার নিয়েছে?সেই তো আগে মাহিনকে প্রস্তাব দিয়েছিলো।পরে জানাবে বলে কে’টে পড়েছিলো মাহিন।সে যে ফিরে আসবে কল্পনাতীত ছিলো ঐশীর।এখন কি হবে?ক্ষন কালের ব্যবধানেই তার ফোনে একটি মেসেজ আসে,

“আজকে কি ফ্রী আছো?
-মাহিন।”

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে