স্পর্শের_ভাষা part – 9+10
writer – তানিশা
— দেখতে দেখতে ১৫ দিন চলে আসলো। আরাফ অনেক বদলে গেছে। তিন্নির সাথে এখন আর খারাপ ব্যবহার করেনা। এখন তিন্নির আশেপাশে থাকতে ভালোই লাগে, তার সঙ্গে একসাথে বসে গল্প করা, রাতের আঁধারে দোলনা বসে চাঁদ দেখা, তার হাতের রান্না খাওয়া, তিন্নির দিকে মুগ্ধনয়নে অপলক তাকিয়ে থাকা, সবমিলিয়ে তিন্নি এখন তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে আরাফ ভাবছে, আজ তো ১৫ দিন। আজ যদি সে তিন্নিকে তার মতামত না জানায় তিন্নি এই বাসা ছেড়ে চলে যাবে। তিন্নিকে তার সারাজীবনের জন্য চাই। তিন্নিকে কিছুতেই যেতে দেয়া যাবেনা। কিন্তু কি মতামত জানাবে? আরাফ নিজেও জানেনা তিন্নির জন্য তার মনে কি অনুভূতি আছে। কি বলবে ভাবতে ভাবতে ছাদে চলে গেলো।
আরাফ ছাদে গিয়ে দেখে তিন্নি আগে থেকেই সেখানে দাড়িয়ে আছে। তার এলোমেলো চুল গুলো খোপা করে রেখেছে, নেই কোনো সাজ, তবুও যেন তাকে একটা ফুটন্ত গোলাপের মতো লাগছে। আরাফ তার পাশে গিয়ে দাড়িয়ে বলল,,,
আরাফ : তুমি কি তোমার জীবনের বাকিটা সময় আমার সাথে কাটাবে??
— তিন্নি আগে থেকেই জানতো আজ আরাফ তাকে এমন কিছু বলবে। তিন্নি আরাফের দিকে তাকিয়ে বলল,,,
তিন্নি : ভালবাসেন??
আরাফ : জানিনা, তবে জীবনের বাকিটা সময় তোমাকে পাশে চাই।
তিন্নি : পাশে তো সবাই থাকে যেমন আনহা, বাবা, আপনার বন্ধুরা। আর যে মানুষটাকে আপনি অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে গ্রহণ করে নিবেন, সেই মানুষটা আপনার হৃদয়ের অতি মূল্যমান ভালবাসার মানুষ হিসেবে গণ্য হতে হবে। এমনটা যদি না হয়, আমি কেন? যাকে ইচ্ছা পাশে নিয়ে বাকিটা জীবন কাটাতে পারবেন।
— বলেই তিন্নি নিচে নেমে চলে গেলো। আারাফ তার যাবার পানে তাকিয়ে রইলো। কিভাবে বুঝবে সে তিন্নিকে ভালবাসে কিনা? কিভাবে এই উত্তর খুঁজে পাবে। বিষয়টা নিয়ে কারো সাথে আলোচনা করলে হয়তো সে তার উত্তর পেয়ে যাবে। কিন্তু কার সাথে? স্নেহা বা অনিকা তাদের মধ্যে একজনকে সাথে।
আরাফ স্নেহার সাথে দেখা করে তাকে বলল,,,
আরাফ : আচ্ছা স্নেহা বলতো আমি কিভাবে বুঝবো কাউকে ভালবাসি কিনা??
স্নেহা : উমম,, হাজারও ব্যস্ততার মাঝে যার কথা বারবার মনে পরে, সময় অসময় যার সাথে গল্প করতে ইচ্ছে করে, যার প্রতিটা কথা কাজে ভাললাগা সৃষ্টি হয়, যার দিকে তাকালে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, যেন মনে হয় পৃথিবীর সব মায়া এসে তার মাঝে ভিড় করছে। যার সাথে তোমার জীবনের বাকিটা সময় পথ চলতে ইচ্ছে করে, তুমি তাকেই ভালবাসো।
আরাফ : really…??
স্নেহা : হুম
— স্নেহার প্রতিটা কথা তিন্নির সাথে আরাফের মিলে যাচ্ছে। আরাফ ভাবছে তার মানে সে তিন্নিকে সত্যি ভালবাসে। ভাবতেই আরাফের অন্যরকম খুশি লাগছে। কিন্তু তিন্নিকে কথাটা কিভাবে বলবে? তাই আবারও স্নেহাকে জিঙ্গেসা করলো,,,
আরাফ : আচ্ছা তিন্নিকে কিভাবে বলবো? যে আমি তাকে ভালবাসি।
স্নেহা : প্রত্যেকটা মানুষের কাছেই তার ভালবাসার মানুষটা অনেক special… হয়। আমার মতে এই special… মানুষটাকে যেমন তেমন ভাবে propose… করা ঠিক না। বিশেষ কিছু করা দরকার।
আরাফ : thanks…
— আরাফ চলে আসলো। তিন্নির জন্য বিশেষ কিছু করতে হবে তার। আরাফ বাসায় এসে আনহাকে চুপিচুপি বলল তিন্নিকে নিয়ে বাহিরে ঘুরে আসতে। আনহা তিন্নিকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। এই সময় আরাফ তিন্নির পুরো রুম ক্যান্ডল আর ফুল দিয়ে সাজিয়ে নিয়েছে। কিন্তু কি দিয়ে প্রপোজ করবে? আরাফ তার জন্য কিছু নিয়ে আসেনি। তিন্নি বাসায় ফিরার আগে আরাফ তার জন্য কিছু একটা গিফট নিয়ে আসবে। ভাবতে ভাবতে ইমরানকে কল দিয়ে আসতে বলল। ইমরান আরাফের সাথে যেতে যেতে বলল,,,
ইমরান : কিসের gift নিতে যাচ্ছিস? আর এতো তাড়া কিসের??
আরাফ : আজ তিন্নিকে propose… করবো। তাকে special… কিছু gift… করবো, তার জন্য এতো তাড়া। তাকে কতটা ভালবাসি এটা বলতে হবে না?
— মুখে হাসি টেনে। ইমরান আরাফের দিকে বিষময় নিয়ে তাকিয়ে বলল,,,
ইমরান : তিন্নির যে boyfriend… আছে এটা তুই জানিস না??
— সাথে সাথে আরাফ রেগে ইমরানের দিকে তাকিয়ে বলল,,,
আরাফ : এই তুই পাগল হয়ে গেলি নাকি?
ইমরান : আমি পাগল হবো কেন? যা সত্যি তাই বললাম। একটা ছেলের সাথে ওর relation আছে। ছেলেটার নাম কি যেন আমার মনে নাই।
আরাফ : এই ফালতু কথাটা তোকে কে বলল?
ইমরান : তিন্নি নিজের মুখে বলেছে। বিশ্বাস না হলে তুই নিজে গিয়ে ওকে জিঙ্গেসা কর। তোর কি মনে হয় ২৩ বছরের একটা যুবতি মেয়ে এখনো single… থাকবে?? আরাফ এই যুগে ২/৪ টা relation… সবারই থাকে। এটা কোনো ব্যাপার না।
আরাফ : ও হয়তো তোকে আমার কথাই বলেছে।
ইমরান : ও তোর কথা বলেনি। ও অন্য কারো কথা বলেছে।
— আরাফ থমকে গেছে, সত্যি কি তিন্নির অন্য কারো সাথে সম্পর্ক আছে? যদি থেকে থাকে তাহলে সে আরাফের জীবনে কেন আসলো? তিন্নির থেকে তার প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর চাই।
তিন্নি বাসায় ফিরার পর নিজের রুমে গিয়ে অবাক হয়ে গেলো। এতো সুন্দর করে ক্যান্ডল আর ফুল দিয়ে পুরো রুম সাজিয়েছে, তিন্নি মুগ্ধ হয়ে দেখছে। তিন্নি অপেক্ষা করছে কখন আরাফ এসে তার মনের অনুভূতি গুলো তিন্নির সামনে প্রকাশ করবে।
আরাফ বাসায় এসে তিন্নির রুমের দরজায় নক না করে ঢুকে পরলো। তিন্নি তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,,,
তিন্নি : আপনার অপেক্ষা ছিলাম।
আরাফ : কেন?
তিন্নি : কেন জানেন না??
— আরাফ তিন্নির কথার কোনো উত্তর না দিয়ে সোফায় বসে ভ্রু কুচকে বলল,,,
আরাফ : আচ্ছা তোমার কয়টা boyfriend… আছে বা অতিতে ছিল?
— আরাফ মনে মনে ভাবছে, তিন্নি উত্তরটা যেন এমন হয় অতিথি, বর্তমান, ভবিষ্যৎ তিন্নির জীবনে যেন শুধু আরাফকে ঘিরেই।
তিন্নি আরাফের দিকে বিষময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। যে ছেলেটার জন্য তিন্নি গত ১৫ বছর অপেক্ষা ছিল। আজ সে এমন একটা বাজে প্রশ্ন কিভাবে জিঙ্গেসা করতে পারলো? তার মানে তিন্নির চরিত্র নিয়ে আরাফ সন্দেহ করছে? এমন একটা কথা ভাবতেই তিন্নির ঘৃণা লাগছে।
আরাফ : কি হলো উত্তর দাও?
— তিন্নি চুপ করে দাড়িয়ে আছে, যে মানুষটা তার চরিত্র নিয়ে সন্দেহ করে, তার কথার জবাব দিতে তিন্নির ইচ্ছে করছে না।
তিন্নিকে চুপ থাকতে দেখে আরাফ ভাবছে তার মানে ইমরান সত্যি বলেছে। তিন্নি আরাফের সাথে এমনটা না করলেও পারতো। আরাফের প্রচন্ড ঘৃণা হচ্ছে তিন্নির প্রতি।
আরাফ : তোমার চুপ থাকার মধ্যে আমি উত্তর খুঁজে পেয়ে গেছি। ( কিছুক্ষণ চুপ থেকে ) জানো তিন্নি তুমি এই বাসায় আসার পর তুমি আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছো। এই ১৫ দিনে আমি তোমাকে অনেক ভালবেসে ফেলেছি। কিন্তু আমি জানতাম না যে তুমি একটা দুশ্চরিত্রা মেয়ে। যার একটা ছেলে হয়না। অবশ্য দুশ্চরিত্রা মেয়েদের এক ছেলে দিয়ে তাদের দেহের চাহিদা মিটেনা তো। হবে কিভাবে?? তোমার মতো third class… মেয়ের থেকে ভালো রাস্তার কিনারা দাড়িয়ে থাকা পতিতা গুলো। যারা টাকার বিনিময় নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছে। তুমি নিজেকে কিসের বিনিময় বিলিয়ে বেরচ্ছো? তিন্নি তোমার কিসের অভাব নাম, খ্যাতি সব আছে। তবুও এতো নিচু কাজ করতে তোমার বিবেকে বাধেনি? একবারও আমার বাবার কথা চিন্তা করোনি? তোমার boyfriend থাকার পরেও কেন এসেছো আমার কাছে। তোমার মতো একটা third class মেয়ে কখনো আমার যোগ্য হতে পারেনা। আমি প্রথম দিন তোমার ব্যাপারে ঠিক ধারনা করেছিলাম। তোমার ১৫ দিনের সময় শেষ, দয়া করে আজ এই মুহূর্তে আমার বাসা ছেড়ে বেরিয়ে যাও।
— বলেই আরাফ রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। তিন্নি ঠায় দাড়িয়ে রইলো। আরাফ এতটা নিচু মনের মানুষ জানলে তিন্নি কখনো এই বাসায় পা রাখতো না। আজ আরাফ তিন্নির চরিত্র তার আত্মসম্মানে আঘাত করছে। যে কথা গুলো আজ আরাফ তিন্নিকে বলেছে, এর জন্য তিন্নি কখনো তাকে ক্ষমা করবেনা। তিন্নি আর এক মুহূর্ত দাড়িয়ে থাকতে পারছেনা, দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। নিজের কাপড় গুলো গুছিয়ে এই রাতেই সে চলে গেছে তার বাসায়।
তিন্নি যাওয়ার সময় কেউ তাকে দেখেনি। আনহা তাকে খুঁজতে খুঁজতে আরাফকে গিয়ে জিঙ্গেসা করলো,,,
আনহা : ভাইয়া তিন্নি আপু কই?
আরাফ : ঐ third class… characterless…. মেয়ের নাম আমার সামনে নিবিনা।
আনহা : কি বললে তুমি? ( অবাক হয়ে )
আরাফ : একদম ঠিক বলেছি। ঐ দুশ্চরিত্রা মেয়ের আসল চেহারা আজ আমার সামনে এসে গেছে।
আনহা : তুমি কিভাবে বুঝলে তিন্নি আপু চরিত্রহীন? ( তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে )
আরাফ : ইমরান বলেছে, ঐ মেয়ের boyfriend আছে। একটা ছেলের সাথে relation থাকার পরেও আমার কাছে এসেছে। ছিঃ কতটা নিকৃষ্ট হলে একটা মেয়ে এমন কাজ করতে পারে।
— আনহা বিষময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। বাহিরের একটা ছেলের কথা বিশ্বাস করে তিন্নিকে এমন বাজে একটা অপবাদ দিতে পারলো? আজ আরাফকে তার ভাই হিসেবে পরিচয় দিতেও যেন আনহার লজ্জা লাগছে। আনহা স্বাভাবিক ভাবে বলতে লাগলো,,,
আনহা : ইমরান ভাইয়া তোমাকে বলেনি? আজ বিকেলে আমি যখন তিন্নি আপুকে নিয়ে বেরিয়ে ছিলাম। ওনি আমাদের পিছনে পিছনে এসে তিন্নি আপুকে propose করেছে। আর তিন্নি আপু সরাসরি তোমার কথা বলে ওনাকে reject করে দিয়েছে। ওনি বলেনি তিন্নি আপুর boyfriend হিসেবে তোমার পরিচয় দিয়েছে।
— কথাটা শুনার সাথে সাথে আরাফ স্তব্ধ হয়ে গেলো। এটা সে কি করলো? ইমরানের কাছে তিন্নি তার কথাই বলেছে। অথচ আরাফ তার উপর এতটা জঘন্য ঘৃণিত অপবাদ দিয়ে দিলো? এখন সে কি করবে? তিন্নি প্রথম দিন তাকে বলেছিল সে তার জীবনের থেকে বেশি তার আত্মসম্মানকে ভালবাসে। আরাফ তার সাথে এতটা বাজে ব্যবহার করেছে, তার আত্মসম্মানে আঘাত করেছে, তিন্নি কি তাকে কখনো ক্ষমা করবে? আনহা আবারও বলতে লাগলো,,,
আনহা : ছিঃ ভাইয়া তোমার মন মানুষিকতা এতটা নিচু হবে কখনো ভাবিনি। যে মেয়েটা ১৫ বছর নিষ্ঠার সাথে তোমার অপেক্ষা করেছে, তুমি তাকে চরিত্রহীন বলছো? তাকে তোমার অযোগ্য বলছো? তুমি নিজেই তার যোগ্য কিনা সেটা বিবেচনা করে দেখো। আমি তোমার বোন হয়ে বলছি, তোমার মতো ছেলে তিন্নি আপুর জীবন সাথী হবার যোগ্যতা বহন করেনা। সে তোমার থেকে অনেক ভালো কাউকে আশা করে। আমি এটাই চাইবো, তিন্নি আপুকে যে মন থেকে ভালবাসে তাকেই যেন পায়।
— কথা গুলো ভাবতে ভাবতে কারো আসার শব্দ পেয়ে তিন্নি বাস্তবে ফিরে এলো। পিছনে তাকিয়ে দেখে আরাফ দাড়িয়ে আছে। তিন্নি কিছু না বলে বেলকুনি থেকে রুমে চলে গেলো। আরাফ তার পিছুপিছু গিয়ে বলল,,,
আরাফ : তুমি এখনো জেগে আছো কেন?
তিন্নি : চোখের ঘুম কেড়ে নিয়ে এখন জিঙ্গেসা করছেন কেন জেগে আছি। বাহহ,, মাঝেমাঝে আপনাকে দেখলে অবাক হয়ে যাই মানুষ এতটা নিখূঁত অভিনয় কিভাবে করতে পারে।
আরাফ : আমি অভিনয় করছিনা।
তিন্নি : আমি আপনার থেকে কোনো explain… শুনতে চাইনা। দয়া করে আমার সামনে থেকে চলে যান।
— কথাটা বলে তিন্নি সোফায় শুয়ে চোখদুটি বন্ধ করে ফেললো। আরাফ ঠায় দাড়িয়ে আছে কিভাবে সে তিন্নির মনে ভালবাসা জাগিয়ে তুলবে? তিন্নি যে তাকে এতটা ঘৃণা করে তার সাথে কথা বলা তো দূরের কথা, তার চেহারাও দেখতে চায় না।
চলবে,,,
( ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)
#স্পর্শের_ভাষা
writer – তানিশা
part – 10
— সকালে আরাফ ঘুম থেকে উঠে দেখে তিন্নি রুমে নেই। কোথায় গেলো সে? ভাবতে ভাবতে বিছানা ছেড়ে উঠে তাকে খুঁজে দেখে তিন্নি রান্নাঘরে। তিন্নিকে দেখে আরাফ স্বস্তির নিশ্বাস নিলো। আরাফ তার কাছে গিয়ে বলল,,,
আরাফ : তুমি এখানে কি করছো?
তিন্নি : দেখতেই পারছেন রান্নার আয়োজন করছি। ( না তাকিয়ে )
আরাফ : তুমি আমাকে না বলে রুম থেকে বেরিয়েছো কেন?
— তিন্নি আরাফের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল,,,
তিন্নি : এখন কি রুম থেকে বের হলেও আপনার permission… নিতে হবে নাকি?
আরাফ : না মানে,, তোমাকে রুমে না পেয়ে ভয় পেয়ে গেছিলাম।
তিন্নি : আপনার ভয় কেটে গেলে fresh… হয়ে নাস্তা করে নিন।
— বলেই তিন্নি রান্নার আয়োজন শুরু করলো। আরাফ তার দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো। থাক না তিন্নি তার উপর রেগে, করুক না যত ইচ্ছা ঘৃণা, তবুও যে তার চোখের সামনে আছে এটাই আরাফের অনেক বড় পাওয়া। এটা ভেবে আরাফ প্রতিক্ষণে স্বস্তির নিশ্বাস নিতে পারবে।
আরাফ ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে, ড্রয়িংরুমে এসে দেখে তার ছোট খালামনি বসে আছে। আরাফ ওনাকে দেখে বলল,,,
আরাফ : কি গো শাশুড়ি মা,, সকাল সকাল মেয়ের জামাইর বাড়ি চলে এলে যে? মেয়েকে miss করছো নাকি মেয়ের জামাইকে? ( মুচকি হেসে )
তিন্নির মা : আরাফ কালকে কাজটা কি তুই ঠিক করলি?? ( মুখটা মলিন করে )
আরাফ : আমি আবার কি করলাম??
তিন্নির মা : তুই তিন্নিকে এভাবে তুলে নিয়ে আসলি কেন? জানিস আমাদের কতটা লজ্জার সম্মুখে পরতে হয়েছে। গ্রামের মানুষ নানাজন নানা কথা বলতে শুরু করেছে।
আরাফ : কেন? তুমি তাদের বলোনি ছোটবেলা তিন্নির সাথে আমার বাগদান হয়ে গিয়েছিল। আমি আমার বৌকে নিয়ে এসেছি। এখানে কার কি বলার থাকতে পারে??
তিন্নি মা : বৌকে নিয়ে এসেছিস? যদি বৌ নিয়ে আসার ইচ্ছে থাকতো, বরযাত্রী নিয়ে সমাজবদ্ধ হয়ে বিয়ে করে আনলি না কেন?
আরাফ : তোমরা মা, মেয়ে আমাকে সেই সুযোগ দিলে কই? আমার বৌকে অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার চিন্তায় বিভোর ছিলে। কাজটা কি তুমি ঠিক করেছিলে? তাই আমি এমনটা করতে বাধ্য হয়েছি।
তিন্নির মা : কি ঠিক, কি ভুল, আমি এতো কিছু বুঝিনা। আমি চাই তোরা দুজনে সুখী হো।
— আরাফ উঠে গিয়ে তার খালামনির দুগালে হাত দিয়ে বলল,,,
আরাফ : খালামনি আমি তিন্নিকে পেয়ে অনেক সুখী।
তিন্নির মা : আর তিন্নি?
আরাফ : তিন্নিও আমাকে ভালবাসে, হয়তো কোনো এক কারণে ভালবাসাটা অপ্রকাশিত রয়েছে। যেদিন তিন্নির সব রাগ অভিমান কেটে যাবে, সেদিন দেখবে তোমার ছেলে মেয়ে গুলো পৃথিবীর সেরা দাম্পত্যজীবন কাটাবে।
তিন্নির মা : তোদের জন্য সেই দোয়া রইলো। একটা কথা মাথায় রাখ, তিন্নিকে যতটা পারবি জব্দ করে রাখবি।
আরাফ : তোমার মেয়েকে জব্দ করা এতটা সহজ নাকি?
তিন্নির মা : তুই ওর স্বামী, তুই চাইলে অবশ্য পারবি।
আরাফ : তুমি যেহেতু বলেছো চেষ্টা করে দেখতে পারি। ( একগাল হেসে )
— তিন্নির মা আর আরাফের বাবা তাদের বিয়ের ব্যাপারে আলোচনা করছে। বিয়েটা যেভাবেই হোক, বৌভাতের ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠান করলে মন্দ হয়না। তারা ভেবেছিল আরাফ, তিন্নির বিয়ে অনেক বড় অনুষ্ঠান করে ধুমধাম করে বিয়ে দিবে। কিন্তু তিন্নির মনের অবস্থা ভালো নেই, এটা ভেবে ছোটখাটো ভাবে অনুষ্ঠান মিটিয়ে নিবে। যখন তিন্নি সম্পর্কটাকে মন থেকে মেনে নিবে তখন নাহয় ধুমধাম করে বিয়ের অনুষ্ঠান করবে।
তিন্নি রান্না শেষ করে এসে দেখে তার মা এসেছে। তার মায়ের দিকে তাকাতেই তার চোখদুটি ছলছল হয়ে আসছে। কাল হয়তো তার মা বাবাকে সমাজের সামনে অনেক অপমানিত হতে হয়েছে। তিন্নির মা এসে তাকে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা চুমু দিলো। তিন্নিকে অনেকক্ষণ বুঝিয়ে ওনি চলে গেলেন। প্রতিটা সম্পর্ককে দ্বিতীয়বার সুযোগ দেয়া উচিৎ। তিন্নি ওনার কথায় কোনো তোয়াক্কা করেনি। কারণ সে তার নিজের জায়গায় আটুট, আরাফকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দেয়া তার পক্ষে কখনো সম্ভব না।
রাত প্রায় ১১ টা বাজে, তিন্নি বিছানায় বসে বই পড়ছে। তিন্নি বই পড়তে খুব ভালবাসে, তাই আরাফ অনেক গুলো গল্পের বই কিনে রেখেছে। তিন্নি আপন মনে বই পড়ছে আর আরাফ সোফায় বসে তিন্নিকে তাকিয়ে দেখছে। আরাফ ভাবছে প্রথম দেখায় কেন সে তিন্নিকে এতটা গভীর ভাবে দেখেনি?? তিন্নিকে দেখে মনে হচ্ছে যেন জ্যোৎস্না রাতের পূর্ণিমার চাঁদ তার সামনে বসে আছে। কোন এক ফুটন্ত লাল গোলাপ হার মেনে যাবে তিন্নির সৌন্দর্যের কাছে। আরাফের যেন চোখ সরতেই চাইছেনা তিন্নির থেকে। তিন্নি আড়চোখে তাকিয়ে দেখে আরাফ তার দিকে একমনে তাকিয়ে আছে। আরাফের এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে তিন্নির কাছে খুব অস্বস্তিকর লাগছে। তিন্নি পড়ায় মন বসাতে পারছেনা। বই বন্ধ করে তিন্নি উঠে গিয়ে তাকে বলল,,,
তিন্নি : এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? ( তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে )
আরাফ : দেখছি আমার বৌ কতটা সুন্দর।
— বলেই আরাফ একগাল হেসে দিলো। বসা থেকে তিন্নির হাত ধরে একটানে তার কোলে বসিয়ে দিয়ে, দুহাত দিয়ে তার কোমড় জড়িয়ে ধরে চুলে মুখ গুজে বলল,,,
আরাফ : আচ্ছা তিন্নি তুমি এতো সুন্দর কেন??
তিন্নি : ছাড়েন আমাকে। ( নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে )
আরাফ : ছাড়বো না। আমার বৌকে আমি জড়িয়ে ধরেছি, তাতে তোমার সমস্যা কোথায়? ( বলেই আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো )
তিন্নি : আরাফ কাজটা কিন্তু মোটেও ভালো হচ্ছেনা। ( রাগী গলায় )
আরাফ : ঠিক বলেছো। একজন আদর্শ স্বামী হিসাবে কোথায় তোমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করবো, তা না করে শুধু জড়িয়ে ধরে আছি। এটা কি ঠিক হচ্ছে?
— তিন্নির প্রচন্ড রেগে আরাফের থেকে জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। আরাফের থেকে অনেকটা দূরে গিয়ে বলল,,,
তিন্নি : আগে একজন ভাল মানুষ হয়ে দেখান। তারপর নাহয় একজন আদর্শ স্বামীর কর্তব্য পালন করতে আসেন। এখন এখান থেকে সরে বসেন, আমি ঘুমাবো।
— আরাফ সোফায় বসে থেকে ভ্রু দুটি নাচিয়ে বলল,,,
আরাফ : বিছানা থাকতে তুমি এখানে কেন ঘুমাবে?
তিন্নি : আপনার বিছানায় ঘুমানোর মতো ইচ্ছে বা রুচি আমার নেই। ( দাঁতে দাঁত চেপে )
আরাফ : কেন? এতক্ষণ তো আমার বিছানায় বসে গল্প পড়ছিলে। তখন সমস্যা হয়নি? এখন কি ইচ্ছে আর রুচি দুইটাই বদলে গেছে??
— কথাটা বলেই আরাফ হাসতে শুরু করলো। আরাফের হাসি দেখে তিন্নির প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। রাগের চোটে কিছু না বলে তিন্নি বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরলো। আরাফ রুমের লাইট অফ করে বিছানায় গিয়ে তিন্নির পাশে শুতে গেলে তিন্নি শুয়া থেকে উঠে বসে পরলো। অন্ধকার রুমেই সে আরাফের দিকে রেগে কটমট করে তাকিয়ে রইলো। আরাফ সেদিকে তোয়াক্কা না করে বিছানায় শুয়ে পরলো। তিন্নি আরাফকে তার পাশে সহ্য করতে পারছেনা। সে বিছানা ছেড়ে উঠে যেতে লাগলে আরাফ হাত ধরে বলল,,,
আরাফ : কোথায় যাচ্ছো?
তিন্নি : মরতে যাচ্ছি। ( দাঁতে দাঁত চেপে )
আরাফ : তাহলে তো তোমাকে যেতে দেয়া যাবেনা।
— বলেই আরাফ একটানে নিজের কাছে টেনে নিলো। তিন্নি রেগে গিয়ে বলল,,,
তিন্নি : হচ্ছেটা কি?
আরাফ : স্বামী স্ত্রীর মাঝে অনেক কিছু হওয়াটা স্বাভাবিক। যদিও আমাদের মাঝে এখনো কিছু হয়নি, তুমি চাইলে অনেক কিছু হতে পারে।
— বলেই আরাফ চোখ টিপ মেরে তিন্নিকে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ধরলো। আরাফের এমন আচরণে তিন্নির দম বন্ধ হয়ে আসছে। সে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছটফট করতে করতে বলল,,,
তিন্নি : এখন যদি আপনি আমাকে না ছাড়েন আমি চিৎকার করতে বাধ্য হবো।
আরাফ : এই রাতে তুমি চিৎকার করলে বাড়ির সবাই কি ভাববে বলোতো? ছিঃ কি একটা বাজে ব্যাপার হয়ে যাবে। তারচেয়ে ভালো তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পরো, আমি কিছু করবোনা।
তিন্নি : আমাকে ছাড়েন, আপনার প্রতিটা স্পর্শে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে আমার।
আরাফ : আমি ছাড়তে ইচ্ছুক না। ছাড়াছাড়ির চিন্তা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পরো। কালকে অনুষ্ঠানে তোমাকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর দেখাতে হবে। এখন যদি না ঘুমাও চোখের নিচে কালো দাগ পরে যাবে। যেটা আমি মোটেও মানতে রাজি না।
তিন্নি : আপনার এই বাড়াবাড়ির ফল কিন্তু অনেক খারাপ হবে। ( রাগী গলায় )
আরাফ : দেখা যাবে।
— তিন্নি অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও আরাফের থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারেনি। কাল রাতে তার ঠিকমতো ঘুম হয়নি। তাই আজ ঘুমের রাজ্য চোখে এসে ভিড় করছে। তিন্নি, আরাফ দুজনেই কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমের ঘোরে তলিয়ে গেছে।
চলবে,,,
( ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)