স্পর্শের_ভাষা part – 8

0
1022

স্পর্শের_ভাষা part – 8
writer – তানিশা

— পরদিন সকালে আরাফ তৈরি হয়ে গাড়িতে বসে সবার অপেক্ষা করছে। কেমন যেন তার মধ্যে একটা ভয় কাজ করছে, এতো বছরের মধ্যে সে একবারও যে তার খালামনির খুঁজ নেয়নি। এতো বছর পর ওনার বাসায় যাবে, খালামনি তাকে দেখে কেমন রিয়েক্ট করবে?

তিন্নি আনহা আর তার বাবা এসে গাড়িতে বসেছে। তিন্নি তার মাকে যাওয়ার কথা বলেনি, আরাফ বলতে না করে দিয়েছে। কারণ সে তার খালামনিকে সারপ্রাইজ দিতে চায়। আরাফ গাড়ি ড্রাইভ করছে, পেছন বসে তিন্নি, আনহা নানান গল্প জুড়ে দিয়েছে। মাঝেমাঝে তাদের সাথে বাবাও তাল মেলাচ্ছে। আরাফ বিষয়টা উপভোগ করছে, তারও খুব ইচ্ছে হচ্ছে তাদের সাথে একটু গল্পের আসরে অংশগ্রহণ করতে। কিন্তু সে নিজেকে তাদের সাথে মানিয়ে নিতে পারছেনা। কিভাবে গল্প শুরু করবে?? কোনো টপিক নেই তার কাছে। তখনি আনহা বলতে শুরু করলো,,,

আনহা : আপ্পি তোমার মনে আছে? তোমার জহির কাকার বাড়ির পিছনে যে খেত আছে। ঐখানে আমি আর তাহরিম selfee… তোলার সময় style করতে করতে উল্টে গিয়ে খেতে পরে গিয়ে ছিলাম। style করা আর হলো কই? পুরো শরীরে কাদা লেগে ভুত মতো খেতের কিনারায় দাড়িয়ে ছিলাম। খেতের মালিক আমাদের দেখে লাঠি নিয়ে কি দৌড়ানিটাই না দিয়েছিল। কারণ ওনার খেতের ফসল নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

— কথাটা শুনার সাথে সাথে সবাই খুব জোরে হেসে দিলো। আরাফ হাসতে হাসতে বলল,,,

আরাফ : really…??

আনহা : হ্যাঁ ভাইয়া, ঐ দিন কোনোরকম নিজের জীবন বাচিয়ে দৌড়ে পালিয়েছি।

আরাফ : আচ্ছা রাস্তা দিয়ে দৌড়ে আসার সময় তোকে দেখে কেউ আতংকিত হয়ে মারা যায়নি?

আনহা : আতংকিত হতে যাবে কেন??

আরাফ : তুই না বললি, খেতে পরে ভুত হয়ে গিয়েছিলি। ভুত দেখলে তো মানুষ আতংকিত হয়ে যায় তাই বললাম।

— সবাই গল্প করতে করতে কিছুক্ষণের মধ্যে তিন্নিদের বাসার সামনে পৌঁছে গেছে। সবাই গাড়ি থেকে নেমে চলে যেতে লাগলে তিন্নি পিছনে তাকিয়ে দেখে আরাফ এখনো গাড়িতে বসে আছে। তিন্নি ফিরে গিয়ে তাকে বলল,,,

তিন্নি : কি হলো আপনি এখনো গাড়িতে বসে আছেন কেন?

আরাফ : actually ( কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা )

তিন্নি : চলেন ভিতরে।

আরাফ : তুমি যাও আমি আসছি।

— তিন্নি চলে গেলো। তিন্নি আনহা ও তার বাবাকে দেখে তিন্নির মা অবাক হয়ে গেলেন। খুশিতে আনহা আর তিন্নিকে জড়িয়ে বুকে নিলেন। ঘরের দরজায় দাড়িয়ে আরাফ মুচকি হেসে বলল,,,

আরাফ : খালামনি আমাকে জড়িয়ে ধরবেনা??

— তিন্নির মা আরাফের কন্ঠ শুনে দরজায় তাকিয়ে দেখে আরাফ দাড়িয়ে আছে। তিনি যেন নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারছেন না। তাদের দুজনকে ছেড়ে দিয়ে আরাফের কাছে এগিয়ে গিয়ে তার দুগালে হাত দিয়ে টলমল চোখে বলতে লাগলেন,,,

তিন্নির মা : বাবা তুই সত্যি এসেছিস??

আরাফ : তোমার আরাফ কি জমজ নাকি? যে তার জমজ ভাই আসবে।

তিন্নির : এতো বছর পরে বুঝি তোর খালামনির কথা মনে পরলো?

আরাফ : আসলে খালামনি মাকে হারানোর পর নিজেকে কেমন যেন নিজের মধ্যেই বন্দি করে ফেলেছিলাম। sorry… খালামনি আমাকে মাফ করে দাও।

তিন্নি মা : বোকা ছেলে মায়ের কাছে সন্তান কখনো অপরাধী হয়না।

— বলেই আরাফকে জড়িয়ে ধরলো। আরাফের বাবা হাসি দিয়ে বলে উঠলো,,,

আরাফের বাবা : এই সবকিছু আমার তিন্নি মায়ের জন্য সম্ভব হয়েছে।

আনহা : বাবা তুমি ঠিক বলেছো। তিন্নি আপু আজকের দিনটার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।

— তাদের কথা শুনে তিন্নি হেসে দিলো। সত্যি আজকে তিন্নির কাছে অনেক খুশি লাগছে। এখন আর আগের মতো আরাফের অহংকারটা নিজের প্রতি কাজ করেনা। আরাফ হয়তো অনেক বদলে গেছে। বিষয়টা ভাবতেই তিন্নির কাছে অনেক খুশি খুশি লাগছে।

তিন্নির মা আরাফের প্রত্যেকটা পছন্দের খাবার রান্না করে নিজের হাতে তাকে খাইয়ে দিয়েছে। আজ আরাফ অনেকদিন পর তৃপ্তির সাথে খেয়েছে। খালামনির কাছে এসে তার মায়ের অনুপস্থিতি অনুভব করতে পারছেনা। তিন্নিদের বাসায় দুপুরের খাবার শেষ করে, তাদের থেকে বিদায় নিয়ে সবাই বাসায় চলে আসলো।

রাত ৮ টায় আরাফ নিজের রুমে বসে ভাবছে, আজকের দিনটার জন্য তিন্নিকে একটা ধন্যবাদ জানানো দরকার। আরাফ উঠে গিয়ে তিন্নির রুমের দরজায় নক করলো, কোনো সারা শব্দ নেই। আরাফ আস্তে দরজা খোলে ভিতরে গিয়ে দেখে তিন্নি নেয়, হয়তো আনহার রুমে হবে। আরাফ আনহার রুমে গিয়ে দেখে সেখানেও তিন্নি নেই। আনহা তাকে দুষ্টামির হাসি দিয়ে জিঙ্গেসা করলো,,,

আনহা : কি ব্যাপার অসময়ে তিন্নি আপুকে খুঁজচ্ছো?

আরাফ : তেমন কিছুনা ও কোথায় বল?

আনহা : ছাদে গিয়ে দেখো চাঁদ দেখায় বিভোর হয়ে আছে।

— আরাফ সিরি বেয়ে ছাদে চলে গেলো। ছাদে গিয়ে দেখে তিন্নি দোলনায় বসে আপন মনে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। কারো আসার শব্দ পেয়ে পিছনে ফিরে দেখে আরাফ এসেছে। আরাফ তার পাশে গিয়ে দোলনায় বসে বলল,,,

আরাফ : চাঁদে মধ্যে এমন কি দেখো প্রতিদিন?

তিন্নি : অনেককিছু।

আরাফ : কই আমিতো কিছুই দেখিনা।

তিন্নি : চারদিকে তাকিয়ে দেখেন, চাঁদের এই জ্বলমলে আলোয়ে চারপাশ কতো উজ্জ্বল হয়ে আছে। চারদিকে নিস্তব্ধ এক মধুময় পরিবেশ। মাঝেমাঝে ঝিম বাতাস এসে শরীর শিহরিত করে তুলছে। চোখদুটি বন্ধ করে এই সময়টাকে অনুভব করে দেখেন, কতটা স্বস্তি অনুভব হয়। প্রকৃতির মাঝেই যেন নিজেকে বিলীন করে দিতে ইচ্ছে করে। সারাদিনের যত ক্লান্তি আছে সব নিমিষেই মিটে যায়। ( চোখদুটি বন্ধ করে )

— আরাফ তিন্নির দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। জ্যোৎস্না রাতের জ্বলমলে আলো যেন তিন্নির মায়াবী চেহারা ঘিরে তার সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলছে। তিন্নির মতো তার প্রতিটা কথা, কাছেও সৌন্দর্য বিরাজ করে। মেয়েটা সবকিছু নিজের মতো করে গুছিয়ে নিতে পারে। আরাফ মুগ্ধনয়নে তাকিয়ে আছে। সে কি তিন্নির প্রেমে পরে গেলো? নাকি তিন্নির প্রতি তার ভাললাগা কাজ করছে?

তিন্নি চোখদুটি খোলে আরাফের দিকে তাকালো। আরাফ এখনো বেঘোরে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তিন্নি কিছুটা অবাক হয়ে তার হাতে স্পর্শ করে বলল,,,

তিন্নি : এভাবে কি দেখছেন?

আরাফ : চাঁদের সৌন্দর্য দেখছি। তুমি ঠিক বলেছিলে, চাঁদের দিকে তাকালে সব ক্লান্তি নিমিষেই চলে যায়। ভিতর থেকে স্বস্তি চলে আসে। চাঁদ যেমন নিজে সুন্দর, ঠিক তার চারপাশটাও নিজের মতো করে সৌন্দর্যময় করে তুলেছে।

তিন্নি : চাঁদ তো আকাশে, আপনি আমার দিকে তাকিয়ে কি দেখছেন?

আরাফ : আমার পাশে বসা পৃথিবীর সবচেয়ে সৌন্দর্যময় চাঁদেরকণা দেখছি। যে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি। আমার মনে হয় তোমার মধ্যে আকাশের চাঁদের থেকেও বেশি সৌন্দর্য বিরাজ করে।

তিন্নি : আবেগ ভালোই জন্মেছে দেখি।

— বলেই তিন্নি জোরে হেসে দিলো। আরাফ তার হাসির দিকে তাকিয়ে আছে, মানুষের হাসি এতটা সুন্দর হয় এটা তিন্নিকে না দেখলে হয়তো জানা হতোনা। তিন্নি আারও আরাফের দিকে তাকিয়ে বলল,,,

তিন্নি : কি হয়েছে? এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?

আরাফ : তোমার হাসিটা অনেক সুন্দর, ঠিক তোমার মতো।

তিন্নি : আমার প্রেমে পরে গেছেন নাকি?

আরাফ : জানিনা

তিন্নি : আচ্ছা আপনি এখানে বসে জানার চেষ্টা করেন, আমি আসি।

— কথাটা বলে তিন্নি বসা থেকে উঠলে, আরাফ তার হাত ধরে বলল,,,

আরাফ : কোথাও যেতে হবেনা, বসো আমার সাথে।

তিন্নি : বসে কি করবো? আমার কাজ আছে।

আরাফ : আমরা একসাথে বসে চাঁদ দেখবো, নিস্তব্ধ মধুময় পরিবেশটা অনুভব, স্বস্তির নিশ্বাস নিবো। আর একদিন কাজ না করলেও চলবে।

— তিন্নি হা করে আরাফের দিকে তাকিয়ে রইলো, এটা সত্যি সেই প্রথম দিনের আরাফ? নাকি তিন্নি কোনো ঘোরের মধ্যে আছে? সে কি সত্যি এতটা বদলে গেছে? হয়তো। নাহয় এতো বছর পরে তিন্নিদের বাসায় আরাফ কখনোই পা রাখতো না।

চলবে,,,
( ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে