স্পর্শের_ভাষা part – 3+4

0
1389

স্পর্শের_ভাষা
part – 3+4
writer – তানিশা

— বিয়ে সম্পূর্ণ হবার পরপর সবাই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো, তিন্নি বিছানা এককোণে চুপটি মেরে বসে পরলো। রাগে ঘৃণায় গা জ্বলে যাচ্ছে তার। আজ আরাফ তার সাথে মোটেও কাজটা ঠিক করেনি। এর প্রতিদান সে অবশ্য আরাফকে দিবে, যেটা আরাফ কল্পনাও করতে পারবেনা।

আরাফ রুমে ঢুকে দেখে তিন্নি প্রচন্ড রেগে বসে আছে। দেখতে আরাফের কাছে বিষয়টা ভালই লাগছে, অবশ্য তাকে আরেকটু রাগালে মন্দ হয়না। আরাফ তিন্নির কাছে এগিয়ে গিয়ে তার পাশে বসে একগাল হেসে বলল,,,

আরাফ : তুমি অনেক happy… তাইনা??

— কথাটা শুনার সাথে সাথে তিন্নি আরাফের দিকে মাথা তুলে তাকালো। তিন্নি সুখী হবার মতো আজ পর্যন্ত আরাফ এমন কিছুই করেনি। তার জীবনটা এলোমেলো করে আজ থেকে সুখ নামক জিনিসটা ও তার জীবন থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। এই মানুষটার সাথে সে কখনো সুখী হবে, ভাবতেই হাস্যকর মনে হয়। তিন্নি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল,,,

তিন্নি : কোন দুঃখে?

আরাফ : এইযে একটু আগে তোমার ভালবাসার মানুষটার সাথে তোমার বিয়ে হয়ে গেলো। যে ছেলেটাকে তুমি পাগলের মতো ভালবাসতে, আজ তুমি তাকে সারাজীবনের জন্য নিজের করে পেয়ে গেছো। তুমি আমাকে পেয়ে গেছো তিন্নি। তুমি বুঝতে পারছো, তুমি কতটা ভাগ্যবতী? আমার তো এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা। তুমি আমাকে পেয়ে গেছো? রায়মান এহসান আরাফকে?? আমাকে পেয়ে তোমার জীবন তো ধন্য হয়ে গেলো।

তিন্নি : মিঃ “রায়মান এহসান আরাফ” আপনি এমন কে? যাকে পেয়ে আমি নিজেকে ধন্য মনে করবো? ( ভ্রু কুচকে )

আরাফ : আমার দিকে তাকিয়ে দেখো আমি কতটা smart, handsome… আমার personality দেখে যে কেউ পাগল হয়ে যাবে।

— আরাফের কথায় তিন্নি একটা তাচ্ছিল্য হাসি দিলো। মানুষ দেখতে সুন্দর হলে যে তার চরিত্র, মন, মানুষিকতা সুন্দর হবে এমনটা নয়। তাদের মধ্যে আরাফ একজন। সৌন্দর্য একসময় বয়সের সাথে মলিন হয়ে যাবে, কিন্তু সুন্দর চরিত্র আর মন কখনো মলিন হয়না। তিন্নি কখনো সুদর্শন কাউকে খুঁজেনি, একটা ভালো মনের মানুষকে খুঁজেছে। তিন্নি খুব স্বাভাবিক ভাবেই আরাফকে বলতে লাগলো,,,

তিন্নি : ঠিক বলেছেন আপনি দেখতে অনেক সুদর্শন একজন ব্যক্তি। কিন্তু আপনি কি জানেন সুদর্শন কাকে বলে? জানেন না। মানুষ দেখতে সুন্দর হলেই যে সুদর্শন হয়না এটা আপনাকে দেখলে বুঝা যায়। আপনি দেখতে সুদর্শন হলে কি হবে? আপনার ভিতরে থাকা কুৎসিত হৃদয়টার কারণে আপনার বাহিরের সৌন্দর্য আমাকে আকর্ষিত করেনা। আর আমি কখনো আপনার জন্য পাগল ছিলাম না। আমার কাছে সম্পর্ক আর বিশ্বাসের মূল্যটা অনেক ছিল। সেই সম্পর্ক আর বিশ্বাসকে সম্মান করে আমি আপনার কাছে এসেছিলাম, কিন্তু আপনি যেটার যোগ্য ছিলেন না।

— কথাগুলো বলে তিন্নি বিছানা ছেড়ে উঠে গেলো। আরাফের সামনে তার বসে থাকতে ইচ্ছে করছেনা। আরাফ মাথা নিচু করে বসে আছে। ভেবেছিল তিন্নিকে একটু রাগায়ে তার সাথে কিছুক্ষণ দুষ্ট মিষ্টি ঝগড়া করবে। কিন্তু পিছনের কথাগুলো আবারও তিন্নির মনে নাড়া দিয়ে উঠলো। সত্যি আরাফ তিন্নির বিশ্বাসের যোগ্য ছিলনা। এবার আরাফ যেকোনো মূল্যে নিজেকে তিন্নির বিশ্বাসের যোগ্য করবে। তার ভালবাসাকে জয় করবে।

তিন্নির পরনের বেনারসি শাড়িটা চেঞ্জ করতে হবে। তাই সে রুম থেকে বেরিয়ে আনহার কাছে যাওয়ার সময় দরজার খোলার শব্দ হলে, আরাফ মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে তিন্নি রুমের দরজা খোলছে।

আরাফ : কোথায় যাচ্ছো?

তিন্নি : ভয়ের কিছু নেই, যতদিন পর্যন্ত আপনার সাথে আমার ডিবোর্স না হয় ততদিন আমি এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবো না। আমি আনহার রুমে যাচ্ছি শাড়ি চেঞ্জ করবো।

আরাফ : আনহার রুমে যাওয়ার দরকার নেই। আলমারিতে তোমার জন্য অধিক পরিমাণ ড্রেস রাখা আছে, যেটা পছন্দ হয় পরে নাও।

তিন্নি : বিষয়টা কেমন যেন হাস্যকর মনে হচ্ছে আমার জন্য আগে থেকেই ড্রেস রাখা আছে?? strange…

আরাফ : তুমি আমার একমাত্র বৌ, তোমার ইচ্ছে, আকাঙ্ক্ষা, অফুরন্ত চাহিদা গুলো পূরণ করা যদিও আমার দায়িত্বের মধ্যে পরে। কিন্তু এখন এটা আমার শখ।

তিন্নি : আপনার কাছে আমার একটাই চাহিদা ডিবোর্স। এই মিথ্যা সম্পর্কের বাধন থেকে আমাকে মুক্ত করে দিন। আমার চাহিদা পূরণ করার একটা সুযোগ আপনি পেয়ে যাবেন।

আরাফ : এটা তোমার চাহিদা না, আমার থেকে নিজেকে দূরে রাখার জেদ। যদি কখনো আমার থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টা করো? পা দুটি কেটে বিছানায় পঙ্গু করে ফেলে রাখবো। আমার বৌ পঙ্গু হলে কোনো সমস্যা নেই, সবসময় আমার চোখের সামনে তো থাকবে।

— তিন্নি কিছু না বলে আরাফের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যে মানুষটার সাথে কথার বলতেও তার রুচিতে বাদে, তার সাথে সারাজীবন কিভাবে কাটাবে? আরাফ বুঝতে পারছে এই মুহূর্তে তিন্নি তার সাথে কথা বলতে চাইছেনা। তাই সে বসা থেকে উঠে তিন্নির হাত ধরে বিনয়ীর সাথে বলতে লাগলো,,,

আরাফ : আমার জন্য তোমার মনে যে পরিমাণ রাগ, ঘৃণা জন্মে আছে আমি সেটার যোগ্য। আমার উপর যতটা ইচ্ছা রেগে থাকো, ঘৃণা করো আমি কিছু মনে করবো না। কারণ আমি জানি কিছুদিনের মধ্যেই তোমার সব রাগ, ঘৃণা আমার জন্য ভালবাসায় পরিণত হবে।

তিন্নি : আপনার কথা শেষ? নাকি আরও বাকি আছে??

আরাফ : আমি বুঝতে পারছি আমার কথাগুলো শুনতে তোমার কাছে মোটেও ভাললাগছে না।

তিন্নি : বুঝতে পারছেন তার জন্য শুকরিয়া। এবার আমার হাত ছেড়ে দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলুন।

— আরাফ তিন্নির হাত ছেড়ে দিলো। তিন্নি ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। আরাফ কি বলেছে তাতে তিন্নির কিছু যায় আসেনা। আরাফের সাথে ভালো ব্যবহার করা তার পক্ষে কখনোই সম্ভবনা। অনেকটা সময় পর তিন্নি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখে আরাফ রুমে নেই আনহা একা দাড়িয়ে আছে,,,

তিন্নি : আনহা কিছু বলবে??

আনহা : ভাবি খেতে চলো,

তিন্নি : আমি খাবোনা, তুমি খেয়ে নাও।

আনহা : সেই বিকেলে তোমাকে বাসায় আনা হয়েছে, এখনো কিছু খাওনি। বাবা অপেক্ষা করছে তোমার জন্য নিচে চলো।

তিন্নি : আমার ক্ষুধা নেই, বাবাকে বলো খেয়ে নিতে।

আনহা : তুমি না খেলে আমিও কিন্তু খাবোনা। তুমি খুব ভালো করে জানো আমি না খেয়ে থাকতে পারিনা। ( মাথা নিচু করে )

— তিন্নি এবার হেসে দিলো, আনহার বাচ্চামো গুলো এখনো রয়ে গেছে। এই মেয়েটা তিন্নিকে সবসময় নিজের বড় বোনের মতো ভালবেসে এসেছে। তিন্নি হাসতে হাসতে বলল,,,

তিন্নি : আমিও কিন্তু না খেয়ে থাকতে পারিনা।

আনহা : আমি জানি, এবার চলো।

— তিন্নি আনহার সাথে খাবার টেবিলে চলে গেলো। খাবার টেবিলে বসে তিন্নি অনেক স্বস্তি পাচ্ছে, কারণ আরাফ নেই। আশরাফুল এহসান তিন্নিকে আনহার মতো স্নেহ করে। তিন্নির প্রতি আরাফের এমন আচরণে তিনি নিজেকে অনেক ছোট ভাবছে, তাই খাবারের টেবিলে অনেকবার ক্ষমা চেয়েছে তিন্নির কাছে। ওনার এমন ক্ষমার দৃষ্টান্ত দেখে তিন্নি মন খারাপ করে বলল,,,

তিন্নি : বাবা আপনি কি আমাকে আগের মতো স্নেহ করেন না।

বাবা : বাবার স্নেহ, ভালবাসা কি সন্তানের জন্য কখনো বদলে যায়? না,,রে মা আমি আমার এই মেয়েটাকে আগের মতোই ভালবাসি।

তিন্নি : তাহলে ক্ষমা চাইছেন কেন? বাবারা কখনো সন্তানের খারাপ চাইনা। সময় আর পরিস্থিতি মানুষের জীবনটাকে এলোমেলো করে দেয়।

বাবা : আমি চাইলে হয়তো আরাফকে আটকাতে পারতাম। ( মাথা নিচু করে )

তিন্নি : বাবা আপনার প্রতি আমার কোন রাগ নেয়। আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।

— তিন্নি একগাল হেসে খাওয়া শুরু করলো। খাবার শেষে এখন কি সে আরাফের রুমে যাবে নাকি যাবেনা, এমন একটা দ্বিধায় আছে। কি করবে বুঝতে পারছেনা। আরাফের সাথে একই রুমে থাকা তার পক্ষে সম্ভব না। তাই আমতা আমতা করে আনহাকে বলেই ফেললো,,,

তিন্নি : আনহা গেস্ট রুমের চাবিটা কোথায়?

আনহা : চাবি ভাইয়ার কাছে। বাসায় যেকয়টি খালি রুম আছে, ভাইয়া সেগুলো লক করে রেখেছে। তোমার কাছে কোনো অপশন নেই তোমাকে ভাইয়ার রুমেই ঘুমাতে হবে।

— কথাটা বলে আনহা মৃদু হাসলো, সাথে সাথে তিন্নির মুখটা মলিন হয়ে গেলো। অনিচ্ছা সত্বেও এখন তাকে আরাফের রুমেই থাকতে হবে। তিন্নি সিরি বেয়ে উপরে উঠে দেখে রুমের দরজা বন্ধ। রুমের সামনে দাড়িয়ে থেকে ভাবছে দরজা টোকা দিবে নাকি দিবেনা। আরাফের সাথে একই রুমে থাকার চেয়ে সারারাত ড্রয়িং রুমে কাটিয়ে দিবে এটাই ভালো। কথাটা ভাবতে ভাবতে আরাফ দরজা খোলে তিন্নির দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে দিলো। আরাফের এই হাসিটা তিন্নির মোটেও সহ্য হয়না। তিন্নি আরাফের থেকে মুখ ফিরিয়ে দাড়াতেই আরাফ তাকে কোলে তুলে নিলো। তিন্নি চোখদুটি বড় বড় করে বলল,,,

তিন্নি : হচ্ছেটা কি? কি করছেন?

আরাফ : এখনো কিছু হয়নি, সময় হোক সবকিছু হবে। এতো তাড়া কিসের? অপেক্ষা করো, অপেক্ষার ফল অনেক মিষ্টি হয়। ( রুমে নিয়ে যেতে যেতে )

তিন্নি : আমাকে নামান বলছি ( দাঁতে দাঁত চেপে )

আরাফ : তোমাকে সারারাত কোলে নিয়ে রাখবো নাকি? তুমি যে পরিমাণ মোটা আমার হাত ব্যথা হয়ে যাবে। ( বলেই বিছানা বসিয়ে দিলো )

তিন্নি : কি বললেন আমি মোটা? আর আপনি কি? আপনি তো আস্ত একটা জলহস্তী। ( রেগে গিয়ে )

আরাফ : আমি জলহস্তী?

তিন্নি : নিঃসন্দেহ, যদি বিশ্বাস না হয় আয়না নিজের চেহারা ভালভাবে দেখে নিন। জলহস্তী কোথাকার।

— আরাফ মুচকি হেসে তিন্নির সামনে একটা লাল গোলাপ এগিয়ে দিয়ে বলল,,,

আরাফ : এই জলহস্তীটা তোমাকে অনেক বেশি ভালবাসে।

— তিন্নি কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেছে। নিজের চারপাশে তাকিয়ে দেখে পুরো রুম জুড়ে লাল গোলাপের সমারোহ আর ক্যান্ডল দিয়ে রুমটা খুব সুন্দর করে সাজানো গুছানো। বিছানা পরে থাকা লাল গোলাপের পাপড়ি গুলো যেন রুমের সৌন্দর্য আরও বারিয়ে দিচ্ছে। একপাশে অনেক গুলো বেলুন দিয়ে সাজিয়ে লিখে রেখেছে ভালবাসি মায়াবতী। তিন্নি চারপাশে তাকিয়ে চোখদুটি বন্ধ করে নিজেকে স্থির করার চেষ্টা করছে, কিন্তু কিছুতেই তার মন স্থির হচ্ছেনা। তিন্নি আরাফের দিকে তাকিয়ে বলল,,,

তিন্নি : কি চাই আপনার?

চলবে,,,

#স্পর্শের_ভাষা
writer – তানিশা
part – 4

আরাফ : তোমার সাথে সারারাত গল্প করতে চাই, ছোটবেলা স্মৃতিচারণ ঘুরে আসতে চাই, জীবনের প্রত্যেকটা মুহূর্ত তোমার সাথে বাচতে চাই। তোমাকে প্রাণ খোলে ভালবাসতে চাই। আমি শুধু তোমাকে চাই, আজ রাতে আমাকে কি একটু সময় দেয়া যাবে? শুধু গল্প করবো।

তিন্নি : প্রত্যেকবার একই কথা বলতে বলতে আমি বিরক্ত হয়ে গেছি। আপনার সাথে গল্প করা, সময় কাটানোর রুচি বা ইচ্ছা কোনোটাই আমার নেই। আমার ঘুম পাচ্ছে আমি ঘুমাবো।

— তিন্নি আরাফের পাশ কাটিয়ে সোফায় বসে পরলো। সাজানো ঘরের দিকে তাকিয়ে তার সেদিনের কথা গুলো মনে পরে যাচ্ছে। মূলত তিন্নি একটা ধৈয্যশীল মেয়ে, কিন্তু আজ সে কিছুতেই নিজেকে স্থির করতে পারছেনা। ইচ্ছে করছে ঘরের সব ভেঙ্গে চুরমার করে দিতে, কিন্তু সে এমন করবে না। তিন্নি চোখদুটি বন্ধ করে সোফায় শুয়ে পরলো। আরাফ তার পাশে গিয়ে হাঁটুগেরে বসে বলল,,,

আরাফ : আমাকে একটা second chance… দাও please…

তিন্নি : আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না, আমার প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে আমি ঘুমাবো। আর একবার ডিস্টার্ব করলে আমি এই রুম ছেড়ে যেতে বাধ্য হবো। আর হ্যা দয়া করে রুমটা পরিষ্কার করেন, রুমটা যে জঘন্য ভাবে ময়লা করেছেন, এগুলো দেখে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

— কথাগুলো বলে তিন্নি আবারও চোখদুটি বন্ধ করে ফেললো। আরাফ তিন্নির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সে ঘুমাচ্ছে না, ঘুমানোর ভান করছে। চোখের কোণে নোনাজল চিকচিক করছে, হয়তো কান্না আসছে তবুও নিজেকে আটকে রেখেছে তিন্নি। আরাফ বসা থেকে উঠে সাজানো ঘরটা আবারও আগের ন্যায় গুছিয়ে নিয়েছে। বিছানায় শুয়ে তিন্নির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তিন্নি কি ঘুমাচ্ছে নাকি এখনো জেগে আছে? ভাবতে ভাবতে ঘুমের ঘোরে তলিয়ে গেছে আরাফ।

তিন্নির চোখে ঘুম নেই, কিছুতেই ঘুমাতে পারছে না সে। শুয়া থেকে উঠে বেলকুনিতে গিয়ে দাড়িয়ে আছে। গভীর রাতে চারপাশ অন্ধকারে ছেয়ে আছে। আর চোখ থেকে টপটপ নোনাজল গড়িয়ে পরছে তিন্নির। তার জীবনটাও এই অন্ধকারে তলিয়ে গেছে। এর জন্য হয়তো তিন্নি নিজেই দায়ী। সেদিন যদি সে এই বাসায় না আসতো, আরাফের সাথে শর্তে না জড়াতো, তাহলে আজকে জীবনটা এমন হতোনা। প্রথম দিনে তিন্নির সাথে আরাফের ব্যবহারে বুঝা উচিৎ ছিল, আরাফের মন মানষিকতা কেমন হবে। কই বড় খালামনি আর বাবা তো এমন ছিলনা, আরাফ এমন কেন হলো?? আজ বড্ড মনে পরছে বড় খালামনির কথা।

ছোটবেলা আরাফের সাথে তিন্নির বাগদান হয়ে যায়, আরাফের মায়ের ইচ্ছায়। তার মা, বাবা দুজনে তিন্নিকে অনেক স্নেহ করতো। আরাফের মা কখনো তিন্নিকে ছোট বোনের মেয়ের মতো দেখতো না, নিজের মেয়ের মতো স্নেহ করতো। তিন্নিও সারাদিন তার বড় খালামনিকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না। এই ভালবাসার টানে আরাফের মা তিন্নি হাত চেয়ে নেয় আরাফের জন্য। তখনি তাদের বাগদান হয়ে যায়। কয়েক বছর পর একটা দুর্ঘটনা আরাফের মা মারা যায়। তখন থেকে তিন্নি আর আরাফের সম্পর্ক কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। সবকিছু পিছনে ফেলে আরাফ ছুঁয়েছে সফলতার চাবিকাঠি।
আর তিন্নি রয়ে গেছে তার আগের জায়গায়।
সবকিছু পিছনে ছুটে গেলেও তিন্নির স্বপ্ন গুলো রয়ে গেছে আরাফের সম্মিত পাবার আশায়। তিন্নির বিশ্বাস ছিল, সে বৌ সেজে বসে থাকবে, আর আরাফ মাথায় পাগড়ি পরে বর সেজে এসে তাকে নিয়ে যাবে। মাঝেমাঝে আশরাফুল এহসান আর আনহা আসতো তাদের বাসায়, আরাফ আসতো না। সময় চলতে থাকে আপন গতিতে, আর তিন্নি পা রাখে ২৩ বছরে। কিন্তু আরাফের কোনো খবর নেই। আশেপাশের মানুষের নানান কথা তো আছেই। তবুও সে নিজের জায়গা অটুট ছিল, কারণ ছোটবেলাই যে তার বাগদান হয়ে গেছে। তিন্নি ভাবছে এবার আরাফের সাথে তার সরাসরি কথা বলা উচিৎ।

সেদিন প্রথম তিন্নি আরাফের বাসায় যায়। আরাফের মায়ে মৃত্যুর পর প্রথমবার দুজনে মুখামুখি দাড়িয়ে ছিল। আরাফের সাথে কথা বলতে বলতে একপর্যায় তিন্নি তার সাথে শর্তে জড়িয়ে যায়,,,

তিন্নি : মাত্র ৭ দিন।

আরাফ : আপনার কি মনে হচ্ছে? ৭ দিন কম হয়ে গেলো না?? ( ভ্রু কুচকে ) well… আমি আপনাকে ১৫ দিন সময় দিলাম।

তিন্নি : ok done… ১৫ দিন আমার জন্য অনেক। এই ১৫ দিনে আপনি নিজে আপনার অনুভূতি গুলো নিয়ে আমার কাছে আসবেন। এটা আমার বিশ্বাস।

আরাফ : confidence থাকা ভালো, but over confidence ভালো না। এই ১৫ দিনে আমার সম্পর্কে সব জানার পর আপনি হয়তো নিজেই ফিরে যাবেন।

— তিন্নি আরাফের দিকে তাকিয়ে আছে। এই আরাফ ছোটবেলা তার পিছু ছাড়তো না। কথায় কথায় বলতো,, তিন্নি তুই আমার বৌ হবি?? আমরা দুজন সবসময় একসাথে থাকবো। তোকে অনেক সুখে রাখবো আর এত্তো গুলা ভালবাসবো। কথাগুলো মনে পরলে নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি চলে আসে। তবে আজকের এই আরাফ বড্ড অচেনা। আর সম্পর্ক গুলো কত আগোছালো। তিন্নি কি পারবে, এই সম্পর্ক’কে আরো একবার ভালবাসার ডোরে বাধতে? চেষ্টা না করেই তিন্নি কখনো হার মানতে পারবে না,,,

তিন্নি : আপনার প্রতি আমার কিছু মুহূর্তের চাহিদা নয় যেটা মাত্র ১৫ দিনে শেষ হয়ে যাবে। এটা আমার ১৫ বছরের অপেক্ষা যেটা আমি বিন্দু বিন্দু করে আমার সব স্বপ্ন, আশা, আর অফুরন্ত ভালবাসা দিয়ে জড়ো করেছি। যা কখনো ১৫ দিনে শেষ হতে দিবো না।

আরাফ : আর যদি ১৫ দিন পরেও আমার এটা মনে হয় যে আপনার মতো একটা গ্রাম্য, অখ্যাতি, নিম্ন পরিবারের মেয়ের সাথে আমার থাকা সম্ভব না তখন?

— তিন্নি নিজের জীবনের থেকেও বেশি নিজের আত্মসম্মান’কে ভালবাসে। এমন নয় যে সে আরাফ’কে অনেক ভালবাসে। ভালবাসার জন্য কোনো কারণ থাকতে হয়। শৈশবের কিছু স্মৃতি আকড়ে হয়তো স্বপ্ন দেখেছে আরাফ’কে নিয়ে। আরাফ’কে ভালবাসার জন্য তার কাছে কোনো কারণ নেই। সে আদৌ আরাফের সম্পর্কে ঠিকমতো কিছুই জানে না। এই ১৫ দিনে আরাফ’কে ভালবাসার কোনো কারণ খুঁজে নিবে এটাই ভেবেছিল তিন্নি। আরাফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে বলল,,,

তিন্নি : মিঃ “রায়মান এহসান আরাফ” আপনার সাথে আমার সম্পর্ক জড়ো হয় ১৫ বছর আগে। তখন আমার বয়স মাত্র ৮ বছর। তখন থেকে আজ পর্যন্ত আপনাকে না দেখে, এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ না জেনে সম্পর্কটাকে আমি সম্মান করে এসেছি। একটা সম্পর্কের মূল্য যদি আমার কাছে এতটা মূল্যবান হয়? তাহলে আমার আত্মসম্মান আমার কাছে কতটা মূল্যবান হবে? যেই সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা নেই। আমি “মালিহা মুন তিন্নি” আমার আত্মসম্মানের উপর আজ পর্যন্ত কোনোদিন আচ লাগতে দেইনি। নিজের জীবনের থেকেও বেশি নিজের আত্মসম্মানকে ভালবাসি। আর যার কাছে আমার কোনো মূল্য নেই। তার কাছে নিজের আত্মসম্মান বিলিয়ে থাকার মতো মেয়ে আমি নই। আমি নিজেই এই বাসা ছেড়ে চলে যাবো promise…

আরাফ : well… দেখা যাক কি হয়?

— বলেই আরাফ নিজের রুমে চলে গেলো। তিন্নি গেস্টরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসে মোবাইলটা হাতে নিয়ে তার মায়ের কাছে কল করলো। তার মা কল রিসিভ করে বলল,,,

মা : তোকে এতবার না করার পরেও তুই চলে গেলি। আরাফ না করার পরেও কিভাবে গেলি তুই? তোর কি আত্মসম্মান বলতে কিছু নেই??

তিন্নি : মা!! আমার আত্মসম্মান আছে বলেই তো আজ আমি এই বাসায় এসেছি। তোমার কি মনে হয় তোমার বোনের ছেলে আমাকে না দেখে না করে দিলো। এটা আমার আত্মসম্মানে লাগেনি? অবশ্য লেগেছে।

মা : তোকে দেখে আরাফ কি বলল?

তিন্নি : আমাকে ১৫ দিনের সময় দিয়েছে।

মা : মানে!!

তিন্নি : মানে ১৫ দিনের মধ্যে এটা প্রমাণ করতে হবে যে আমি ওনার অর্ধাঙ্গিনী হবার যোগ্য।

মা : আর যদি প্রমাণ না করতে পারিস?

তিন্নি : এমনটা অবশ্য আমি ভাবিনি, পরে ভেবে তোমাকে জানাবো।

— তিন্নির মা হেসে দিলো, ওনার মেয়ের সম্পর্কে ওনার চেয়ে ভালো কেউ জানেনা। পরের দিন সকালে তিন্নি নাস্তার টেবিলে এসে দেখে আরাফ, আনহা আর তার বাবা বসে আছে। তিন্নি একটা চেয়ার টেনে বসতে যাবে তখনি আরাফ বলল,,,

আরাফ : আপনি এখানে কি করছেন? এই বাসায় মেহমানদের নাস্তা তাদের রুমে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আপনি উপরে যান, আপনার জন্য নাস্তা উপরে পাঠিয়ে দেয়া হবে।

তিন্নি : ভুল বলতে এবং শুনতে দুটোই আমার অপছন্দ। যেহেতু ১৫ দিনের জন্য আমি এই বাসায় আছি, এই দিনগুলো আমি আমার মতো করে চলবো। এই ১৫ দিন আমি মেহমান না, এই বাসার সদস্য হয়ে থাকবো। কে কি বলবে সেগুলো তোয়াক্কা করার সময় আমার নেই। আর আমি আপনার মতো মেহমান সেজে বসে থাকতে পছন্দ করিনা। সবাইকে আপন করে নিতে পছন্দ করি। আপনার মন মানুষিকা চেঞ্জ করেন জীবন বদলে যাবে।

— কথাগুলো বলে সে চেয়ার টেনে বসে পরলো। আনহা আর তার বাবা তিন্নির দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। কথাগুলো আরাফের গায়ে কাটার মতো লাগলো। তাই সে রেগে গিয়ে বসা থেকে উঠে বলল,,,

আরাফ : এই মেয়ের সাথে একই টেবিলে বসে নাস্তা করা আমার পক্ষে সম্ভব না।

তিন্নি : অসম্ভব হলে আপনি নিজের রুমে গিয়ে নাস্তা করতে পারেন।

আনহা : মানে??

তিন্নি : মানে আমি এই বাড়ির বৌ হয়ে আসার পর, এই বাড়িতে সবকিছু আমার কথা মতো চলবে। তাই আগে থেকে আমার কথায় উঠবস করার অভ্যাস করে নিন।

— আরাফ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল,,,

আরাফ : তোমার সাহস ত কম না?

তিন্নি : তো? আপনি কি চান? আমি আপনার মতো ভিতু হয়ে নিজের রুমে গিয়ে নাস্তা করি?? ( ভ্রু কুচকে )

আরাফ : আমি ভিতু?? ( অবাক হয়ে )

তিন্নি : কোনো সন্দেহ আছে নাকি? ( স্বাভাবিক গলায় )

আরাফ : অবশ্য সন্দেহ আছে।

— বলেই আরাফ নিজের চেয়ারে বসে নাস্তা করতে লাগলো। নাস্তা শেষ করে আরাফ উঠে যেতে লাগলে, দেখে তিন্নি তার দিকে তাকিয়ে মিটমিট হাসছে,,,

আরাফ : এই মেয়ে তুমি হাসছো কেন?

তিন্নি : যাওয়ার আগে আমাকে একটা thanks… বলে যাওয়া উচিৎ।

আরাফ : কেন? তুমি এমন কি করলে যে তোমাকে thanks বলতে হবে??

তিন্নি : আপনার পক্ষে একই টেবিলে বসে নাস্তা করা সম্ভব ছিলনা। আমি সেটা সম্ভব করে দিয়েছি।

আরাফ : মানে?

তিন্নি : মানে,, আমি আপনার মধ্যে সন্দেহর বিচ রোপণ করেছি। আর আপনি নিজেকে সঠিক প্রমাণ করার জন্য আমার সাথে একি টেবিলে বসে নাস্তা করেছেন। আমার জন্যই তো আপনার পক্ষে একি টেবিলে বসে নাস্তা করা সম্ভব হলো। কিছু ভুল বললাম?

আরাফ : নিজেকে খুব চালাক ভাবো তাইনা?

তিন্নি : মোটেও না।

চলবে,,,
( ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে