#স্নিগ্ধ চাহনি
#পর্বঃ৫
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত
ধ্রুব বেশ ইতস্তত করে বলল-
‘আমি তোর জন্য একটা ছেলে দেখেছি তরূ। তুই আবার ভাবিস না আমি তোকে না জানিয়ে বিয়ে ঠিক করে ফেলেছি। আমি চাই ছেলেটার সাথে তোর আলাদা ভাবে দেখা-সাক্ষাৎ হোক। তারপর তুই হ্যাঁ বললে হ্যাঁ আর না বললে না ব্যাস এইটুকুই। আমি কোনো প্রকার জোর খাটাচ্ছি না তোর উপর।’
মৃন্ময়ী অপলকভাবে তাকিয়ে রইলো তার ভাইয়ের থমথমে চেহারার দিকে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই বিষয় নিয়ে কথা বলায় ধ্রুবর মাঝে আতংকিত একটা ভাব এসে পরেছে। তার কি উচিত হবে এখন কিছু কঠিন কথা বলে তার ভাইকে ভয় দেখানো! হয়তো তার কঠিন কথা শুনে ধ্রুব ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পরবে। তাকে নিয়ে উত্তেজিত হওয়ার মানুষ নেই বললেই চলে। তাই ধ্রুবকে উত্তেজিত হতে দেখলে তার বেশ ভালো লাগে। মৃন্ময়ী সেরকম কিছুই করল না। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল-
‘এই সামান্য একটা কথা বলতেই তোমার মুখ ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল!!’
ধ্রুব অবাক চোখে তাকা। মৃন্ময়ী কথাটা বলেই খিলখিল করে হেসে ওঠে। মনে হচ্ছে তার এমন বিধস্ত অবস্থা দেখে বেশ মজা পেয়েছে মেয়েটা। মাঝে মাঝে মৃন্ময়ীর এমন বাচ্চামো দেখতে খুব ভালো লাগে তার। অল্পতেই প্রান খোলা হাসি ক’জনেই বা হাসতে পারে?
‘আচ্ছা এখন যাও ফ্রেশ হয়ে নাও। ভেজা জামাকাপড় পরে এখানে বসে থাকতে হবে না। তারপর দেখা যাবে দুজনেই জ্বরে কাঁত হয়ে বিছানায় শুয়ে আছি।’
মৃন্ময়ী শাসনের গলায় কথা গুলো বলল। ধ্রুব নির্মল হেসে মৃন্ময়ীর মাথায় হাত বুলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। মৃন্ময়ী সেদিকে চেয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে।
রাত তখন ন’টা। ধ্রুব খাবার রেডি করে এসে দেখলো মৃন্ময়ী তার রুমে নেই। বারান্দায় কিংবা ওয়াশরুমে খুঁজেও তাকে পাওয়া গেল। ধ্রুব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বেরিয়ে এল মৃন্ময়ীর উদ্দেশ্যে। সে জানে মৃন্ময়ী এখন কোথায় থাকতে পারে।
দুঃখবিলাসী বাগানের দোলনায় পা তুলে উদাসীন ভঙ্গিতে বসে আছে মৃন্ময়ী। ধ্রুব নিঃশব্দে মৃন্ময়ীর পাশে এসে দাঁড়ায়। মৃন্ময়ীর দৃষ্টি আকর্ষণে মিহি কন্ঠে ডাকল-
‘তরূ!’
মৃন্ময়ী ধ্রুব দিকে তাকালো না। আগের ভঙ্গিতেই বসে থেকে বলল-
‘আমার পাশে বসো ভাইয়া।’
ধ্রুব চুপচাপ মৃন্ময়ীর কথা অনুযায়ী বসে পরলো। তবে কেউ কোনো কথা বলছে না। দু’জনের মনেই চলছে নানাবিধ চিন্তা ভাবনা। আর কিছু পুরনো স্মৃতির খেলা। বাবা মারা যাওয়ার প্রায় পনেরো দিন পর মৃন্ময়ী মুখ ফুটে কথা বলেছিল। বিষন্ন গলায় আবদার করেছিল ধ্রুব ভাইয়ের কাছে,
‘বাবা আমাকে জন্মদিনের গিফট দেয়নি। তুমি কি বাবার পক্ষ থেকে আমাকে এমন একটা গিফট দিবে যা সব সময় আমার পাশে থাকবে!’
ধ্রুব তখন কোনো কিছু বলতে পারেনি। তবে তার ঠিক এক সপ্তাহের মধ্যেই এই বাগানটা সুন্দর করে সাজিয়ে উপহার দিয়েছিল। নাম রেখেছিল দুঃখবিলাসী। আর বাড়ির বাহিরে খুব সুন্দর করে নেইম-প্লেট লাগিয়ে দিয়েছিল ‘মৃন্ময়ীর ইচ্ছে তরূ’। মৃন্ময়ী এসব দেখে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল-
‘এসব কেন ভাইয়া?’
‘দুঃখবিলাসীতে তুই তোর সব দুঃখ-কষ্ট এই গাছগুলোর সাথে ভাগাভাগি করে নিবি। দেখবি তোর মন খুব হাল্কা লাগবে। আর এই যে বাড়িটা! এটাও সব সময়ই তোর পাশে থাকবে। আর সেই সাথে আমি তো সব সময়ই আছি তোর সঙ্গে আর কি লাগবে!’
সেদিন ছোট্ট মৃন্ময়ী খুশি মনেই ধ্রুবর কথা মেনে নিয়েছিল। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তার ভাই ঠিক বলেনি। মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছিল তাকে।
‘তুমি মিথ্যা কথা বলেছিলে যে তুমি সব সময় আমার পাশে থাকবে তাই না ভাইয়া! আমার বিয়ে হয়ে গেলেই আমাকে আলাদা হয়ে যেতে। এই বাড়ি, এই বাগান আর তুমি। সব কিছু থেকেই দূরে চলে যেতে হবে আমাকে।’
ধ্রুব হাসার চেষ্টা করে বলল-
‘বিয়ে তো সবারই হয়। আর আমি তো তোকে বনবাসী করে দিচ্ছি না যে এখানে আসতে পারবি না, আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারবি না। আমি সব সময়ই তোর পাশে থাকবো। তাই এসব উল্টাপাল্টা কথা ভেবে শুধু শুধু মন খারাপ করিস না তো তরূ।’
ধ্রুবর কথায় মৃন্ময়ীর ভাবভঙ্গিতে কোনো প্রকার পরিবর্তন হলো না। ঘাড় নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকালো ধ্রুবর দিকে। নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো-
‘আমি না থাকলে তো তুমি একা হয়ে যাবে। তোমার অনেক কষ্ট হবে তাই না?’
ধ্রুব রসিকতা করে বলল-
‘হুহ্ একদমই কষ্ট হবে না। আমি তো বিয়ে করে বউ বাচ্চা নিয়ে বিন্দাস আনন্দ থাকবো।’
ধ্রুব হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। মৃন্ময়ীর নির্লিপ্ত দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। কনুই দিয়ে ধ্রুবর পেটে গুতা মে’রে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল-
‘দেখে নিবো আমাকে ছাড়া কেমন আনন্দে থাকো।’
ধ্রুব উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। বেশ কিছুক্ষন পর হাসি থামিয়ে বলল-
‘এখন চল ডিনার করবি। আর আমি কাল তোকে রেস্টুরেন্টের ঠিকানা আর সময় বলে দিবো তোর ইচ্ছে হলে যাবি আর নাহলে না।’
মৃন্ময়ী কিছু বলল না। চুপচাপ উঠে তার ভাইয়ের সাথে ভেতরে চলে যায়।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসছে। সূর্যের হলদেটে আভা ছড়িয়ে পরেছে বাহিরের পিচঢালা রাস্তায়। রেস্টুরেন্টের জানালার পাশের টেবিলটা দখল করে বসে একজোড়া নিশ্চুপ মানব-মানবী। নিস্তব্ধতায় যেন মুড়িয়ে রেখেছে দু’জনকে। মৃন্ময়ী অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে আছে। কফির মগে চুমুক দিয়ে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকায় তার ঠিক সামনের মানুষটার দিকে। এখানে এসে মুগ্ধকে দেখে কিছুটা বিস্মিত হয়েছিল সে। তবে বিস্ময়ভাবটা প্রকাশ করেনি। লোকটাকে আগে থেকেই পাগলাটে টাইপের মনে হয়েছে তার কাছে।
মুগ্ধ তার চোখ দুটো ছোট ছোট করে মৃন্ময়ীকে দেখছে। খুব নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করছে মৃন্ময়ীকে। বোঝার চেষ্টা করছে মৃন্ময়ীর হাবভাব। এই মুহূর্তে মৃন্ময়ীর চোখে ভয়াবহ বিস্ময় থাকার কথা ছিল। কিন্তু সে এতক্ষন ধরে মৃন্ময়ীর মাঝে একটুও বিস্ময় ভাব দেখতে পেল না। চরম হতাশায় মুখটা মলিন হয়ে গেল তার। মৃন্ময়ীকে চমকাতে চেয়েছিল সে তবে তা আর হলো না। মেয়েটা চমকে উঠবে তো দূরের থাক বিস্ময়ে নিয়ে তাকে কিছু জিজ্ঞাসাও করলো না এখন পর্যন্ত।
‘এবার বলুন আসল কাহিনী কি! ভাইয়ার সাথে আপনার পরিচয় কি করে হলো?’
মৃন্ময়ী নম্রতা সহকারে প্রশ্ন করল মুগ্ধকে। মুগ্ধ তার উদাসীনতা লুকিয়ে সহজ গলায় বলল-
‘সেদিন রাতে আপনাকে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার পর রঞ্জনের সাথে দেখা হয়। আপনাকে ওই লোকের কাছ থেকে রক্ষা করার জন্য ধন্যবাদ জানায়। আর তখনই রঞ্জনের ফোনে আপনার ভাইয়ের সাথে কথা প্লাস পরিচয়। আমরা একই বয়সী তাই খুব ভালো বন্ধুত্বও হয়ে গেছে।’
‘সামান্য পরিচয় বিয়ের কথাবার্তা আর দেখাদেখি পর্যন্ত আসলো কি করে?’
মৃন্ময়ীর প্রশ্নে মুগ্ধ অমায়িক ভঙ্গিতে হাসলো। নরম গলায় বলল-
‘বলেছিলাম তো আমি প্রেমে নয় বিয়েতে বিশ্বাসী। ভালোবাসলে তাকে ডিরেক্ট বিয়ে করে ফেলব।’
‘আমাকে ভালোবাসেন? আমার সম্পর্কে কতটুকু জানেন যে হুট করেই বিয়ে করতে চাচ্ছেন।’
‘তোমার সম্পর্কে ধ্রুব আমাকে সব কিছুই বলেছে। বাকি টুকু না-হয় বিয়ের পর জেনে নিবো। আর বাকি রইলো ভালোবাসা? সেটা আমি নিজেও জানি না। তবে তোমার স্নিগ্ধ চাহনি আমাকে খুব করে টানে। প্রথম তোমাকে রিকশায় বসে কান্না করতে দেখেছি। তোমার এই সিক্ত চোখ দুটো দেখেই গাড়ি থেকে নেমে তোমার পিছু নিয়েছিলাম। কিন্তু কেন নিয়েছি তা আমি নিজেও জানি না।’
মৃন্ময়ী চুপ করে রইলো। মুগ্ধ তার সাথে বেশ আন্তরিক ভঙ্গিতে কথা বলা শুরু করেছে। খুব সহজেই আপনি থেকে তুমি সম্মোধনে চলে এসেছে। মৃন্ময়ী ভ্রু জোড়া ঈষৎ কুঞ্চিত করে গম্ভীরমুখে বলল-
‘আপনার কি মনে হচ্ছে না আপনি অল্প বয়সী ছেলেদের মতো ভীষণ আবেগি কথাবার্তা বলছেন! এসব আবেগ দিয়ে জীবন চলবে না মিস্টার মুগ্ধ।’
মুগ্ধ মৃদু হেসে খানিকটা ঝুঁকে আসে। শীতল কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বলল-
‘তুমি পাশে থাকা অবস্থায় জীবন এক জায়গায় থমকে গেলেও আমি ভীষণ খুশি।’
মৃন্ময়ী রেগে গেলে। ক্ষিপ্ত হয়ে বলল-
‘আপনি কি পাগল?’
‘হুম তবে সব সময় না। তুমি সামনে আসলে তোমার চাহনিতেই নিজেকে পাগল পাগল মনে হয়। খুবই চিন্তার বিষয় তাই না!!’
মৃন্ময়ী ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে। এই লোকের সাথে সে কিছুতেই পেরে উঠেবে না। নাছোড়বান্দা টাইপ মানুষ। না না নাছোড়বান্দা থেকেও চরম পর্যায়ের মানুষ উনি। মৃন্ময়ী চুপচাপ ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে রইল। মুগ্ধ আনন্দিত মুখে তার দিকে একমনে তাকিয়ে আছে। এক সেকেন্ডের জন্যেও তার দৃষ্টি সরাচ্ছে না। মুগ্ধর এভাবে তাকিয়ে থাকায় মৃন্ময়ীর বেশ অস্বস্তি বোধ করছে। নিজেকে যথাসাধ্য গম্ভীর করে বলল-
‘এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?’
‘আমার চোখ তো শুধু তাকেই দেখতে চায়,, যাকে দেখলে মনে প্রশান্তির শীতল হাওয়া বয়ে যায়।’
মৃন্ময়ীর রাগ তরতর করে মাথায় চড়ে বসলো। চোখেমুখে কাঠিন্যতা এনে শক্ত গলায় বলল-
‘থামবেন আপনি? কি শুরু করেছেন এসব? এত কাব্যিক কথা বলছেন কেন? বাস্তবে ফিরে আসুন। বাস্তবতা আপনার কথার মতো এত মধুর নয়। বাস্তবতা খুবই নিষ্ঠুর।’
মুগ্ধ বরাবরের মতোই হাসলো। অত্যন্ত নরম সুরে বলল-
‘এই নিষ্ঠুর বাস্তবতাই তো তোমাকে আর আমাকে যুগলবন্দী করেছে।’
মৃন্ময়ী বিস্ময় নিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল-
‘মানে! কিসের যুগলবন্দী?’
মুগ্ধর কাছ থেকে কোনো উত্তর পাওয়ার আগেই একজন ভীষণ উত্তেজনা নিয়ে মুগ্ধ’র সামনে এসে দাঁড়ায়। মুগ্ধ হাসি মুখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই লোকটা তাকে জড়িয়ে ধরে। জড়িয়ে ধরার পর যা বলে তা শুনেই কৌতুহলে মৃন্ময়ীর চোখ দুটো আপনাআপনি বড় হয়ে যায়।
চলবে…