#স্নিগ্ধ চাহনি
#পর্বঃ৩
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত
মৃন্ময়ী ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো ধ্রুবকে। আচমকাই এভাবে জড়িয়ে ধরায় কিঞ্চিত বেসামাল হয়ে পরে সে। তার গলা দিয়ে আপনাআপনি মৃদুস্বরে ‘আহ’ করে আর্তনাদ বেরিয়ে আসল। পরক্ষনেই নিজেকে সামলিয়ে নেয়। ঠোঁট প্রসারিত করে মুচকি হাসলো। মৃন্ময়ী তার বুকে মুখ গুজে দিয়ে কান্না করছে। বাচ্চাদের মতো নাক টেনে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে মেয়েটা। হয়তো এই আশ্রয়টা-ই তার প্রয়োজন ছিল। এই মানুষটাকেই খুব করে পাশে চাচ্ছিল। এখন এই মানুষটাকে কাছে পেয়ে যেন কান্নার বাধ ভেঙেছে। নির্দ্বিধায়, নির্ভয়ে নিজের সকল কষ্ট গুলোকে মানুষটার কাছে প্রকাশ করছে। ধ্রুব আলতো করে মৃন্ময়ীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সে জানে এই মেয়ের কান্না এত সহজে কিছুতেই থামবে না। তার বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল। আশেপাশের কয়েক জোড়া কৌতূহলী চোখ তাদের দিকে স্থির। ভার্সিটির দারোয়ান ধ্রুব আর মৃন্ময়ীকে দেখে তার পান খাওয়া লালচে দাঁত বের করে তাদের হাসি উপহার দেয়। ধ্রুব দারোয়ানের উদ্দেশ্যে ডান হাত উঁচু করে নাড়ালো। মৃন্ময়ী এখনও কান্না করেই যাচ্ছে। এবার তার একটু খারাপ লাগছে। তার জন্যই মেয়েটা এতদিন কত কষ্ট পেয়েছে। একা একা থেকেছে কয়েকটা মাস। ধ্রুব পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য রসিকতা করে বলল-
‘উফফ! তরূ তুই এমন ছিঁচকাঁদুনি হলি কিভাবে বল তো! কার মতো হয়েছিস তুই? আমার মতো তো একদমই না। কই এতদিন পর আসলাম একটু ভালো করে আমাকে স্বাগতম জানাবি তা না, উল্টো আমার এত্তো সুন্দর শার্টটা তোর নিজস্ব সমুদ্রের পানিতে ভাসিয়ে দিচ্ছিস। এটা কেমন কথা! দেখি দেখি সোজা হয়ে দাঁড়া তো!’
ধ্রুব এক প্রকার জোর করেই মৃন্ময়ীকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। চোখেরজলে মৃন্ময়ীর চোখমুখের বারোটা বেজে গেছে। সারা মুখে চুল লেপ্টে আছে। ধ্রুব তার দু’হাতের মাঝে মৃন্ময়ীর মুখ চেপে ধরে। গাল দুটো চটকাতে চটকাতে ভীষণ হতাশা নিয়ে বলল-
‘হায় হায় এটা আবার কোন পেত্নি? আমি তো একটা মাটির তৈরি রাজকুমারীকে রেখে গিয়েছিলাম, এখন দেখি সে পেত্নির রূপ নিয়েছে। ছিঃ ছিঃ কেমন বাজে লাগছে রে তোকে। আমার তো তোকে দেখেই ভয় লাগছে।’
মৃন্ময়ী এক ঝাটকায় ধ্রুবর হাত সরিয়ে দেয়। হাতের তালুতে চোখের পানি মুছে কঠিন গলায় বলল-
‘ভাই!!…’
ধ্রুব শব্দ করে হেসে উঠলো। মৃন্ময়ী কান্না করতে করতেও রাগে ফুসতে লাগলো। ভীষণ রাগ আর অভিমান নিয়ে গজগজ করেই হাঁটা শুরু করে। ধ্রুব হাসি থামিয়ে ভার্সিটির দারোয়ানের উদ্দেশ্যে উচ্চস্বরে বলল-
‘চাচা থ্যাঙ্কিউ। এই কয়েকমাস তরূকে দেখে রাখার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। আজ আসি পাগলিটা রাগ করেছে খুব।’
দারোয়ান চাচা হাসতে হাসতে বললেন-
‘আইচ্ছা আইচ্ছা। বাজান এবার যাও।’
ধ্রুব পেছন ফিরে ছুটে চলল মৃন্ময়ীর কাছে। দৌড়াতে দৌড়াতে আসলো মৃন্ময়ীর কাছে। সে তাকাল তার অভিমানী তরূর দিকে। মৃন্ময়ী থেমে হিচকি তুলছে আর বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছে। চোখের পাপড়ি গুলো একটা আরেকটার সাথে লেগে আছে। খুব মোহনীয় লাগছে। বৃষ্টি ভেজা সতেজ ফুলের মত স্নিগ্ধ।
‘তরূ! একটু আস্তে আস্তে হাঁট না প্লিজ। এত রেগে আছিস কেন? অদ্ভুত।’
ধ্রুব তার কথার প্রতিত্তোরে মৃন্ময়ীর কাছ থেকে কোনো জবাব পেল না। সে জানে মৃন্ময়ী এখন কোথায় যাবে। প্রায় দশ মিনিট চুপচাপ হাঁটার পর মৃন্ময়ী তার গন্তব্যে এসে পৌঁছায়। চিরচেনা, কিছু মধুর স্মৃতি জড়ানো ছোট্ট একটা পার্ক। আশেপাশে কিছু পথশিশুরা খেলা করছে। মৃন্ময়ী ছাউনির নিচে এসে বসল। তার পাশেই বসেছে ধ্রুব। কিছুক্ষণ পথশিশুদের দিকে তাকিয়ে থেকে মৃন্ময়ী নিম্নস্বরে ডাকল ধ্রুবকে-
‘ভাই!..’
ধ্রুব তার শীতল দৃষ্টি মৃন্ময়ীর দিকে স্থির করে। মৃন্ময়ী ছোট করে একটা শ্বাস ফেলে বিষন্ন গলায় বলল-
‘সবার বাবা-মা আছে তাহলে আমাদের নেই কেন? আমিই কেন মা কে দেখার সুযোগ পেলাম না!’
ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মৃন্ময়ীর মাথায় হাত রেখে আদুরে গলায় বলল-
‘কারণ তুই খুব স্পেশাল।’
‘তুমি তো মা’কে দেখেছো। তোমাকে খুব ভালোবাস তো তাই না ভাই! খুব বেশিই আদর করতো! কিন্তু আমি তো একদিনের জন্যেও সেই ভালোবাসার ভাগ পেলাম না।’
মায়ের কথা মনে পরতেই শূন্যতায় হাহাকার করে উঠলো ধ্রুবর বুক। মায়ের সাথে কাটানোর অল্প কিছু মধুর স্মৃতি গুলোই ভেসে উঠলো তার চোখের সামনে। এই স্মৃতি গুলো ভেবেই যেন তার মরুভূমির মতো উত্তপ্ত হৃদয়ে শীতল হাওয়া বয়ে যায়। কিন্তু মৃন্ময়ী! তার কাছে তো মা’কে নিয়ে খুব ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর স্মৃতিটুকুও নেই৷ মা’য়ের ভালোবাসা পাওয়ার আনন্দই তার কাছে নেই। তাহলে সে কি ভেবে নিজেকে স্বান্তনা দিবে! ধ্রুব তার বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করল। তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল-
‘তুই মা’র ভালোবাসা পাসনি তো কি হয়েছে! আমি তো সব সময়ই ছিলাম তোর পাশে।’
‘আচ্ছা ভাই! তোমার রাগ হয় না আমার উপর? ঘৃণা হয় না?’
ধ্রুব বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে-
‘এমন কথা বলছিস কেন?’
‘এই যে আমার জন্মের জন্য তুমি আম্মুকে হারিয়েছ আর আমার ভুলের জন্যই আব্বুকে হারাতে হয়েছে। আমি যদি জন্মদিনের সময় আব্বুকে তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে না বলতাম তাহলে হয়তো আব্বুর কার এক্সিডেন্ট হতো না। তোমার কি মনে হয় না আমার জন্মটাই তোমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে! আমার জন্মদিনেই তুমি সবাইকে হারিয়ে ফেলছো!’
ধ্রুব চুপচাপ মৃন্ময়ীর সব গুলো কথা শুনল। তবে ধৈর্য্য হারালো না। মৃন্ময়ীর দিকে চেয়ে নরম গলায় বলল-
‘কে বলল সব হারিয়েছি! তোকে পেয়েছি তো! তুই জানিস আমি তোর নাম তরূ কেন রেখেছি! তরূ মানে হচ্ছে গাছ। গাছ আমাদের অক্সিজেন দেয় বলেই আমরা বেঁচে আছি। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য গাছ যেমন ইম্পর্ট্যান্ট। তেমনি আমার কাছে তুই আমার জীবনের চেয়েও বেশি ইম্পর্ট্যান্ট। আর বাকি রইলো আব্বু আম্মুর মৃত্যুর কথা! তাহলে জেনে রাখ যার যার মৃত্যু যেভাবে লেখা আছে সেভাবেই হবে। এটাই নিয়তি। এতে আমার কিংবা তোর কারও কোনো হাত নেই।’
মৃন্ময়ী চুপ করে বসে রইল। নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে পার্কের বাচ্চা গুলোর দিকে। ছোট বেলায় তার বাবার হাত ধরে এসেছিল এই পার্কে। কত মজা করেছে একসাথে। তার বাবা আর ভাই কখনই তাকে মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি। কিন্তু নিয়তি বুঝি তার বেলাই খুব নিষ্ঠুর হয়ে গেল। তার চৌদ্দতম জন্মদিনেই চিরকালের মতো হারিয়ে ফেলল তার বাবাকে। তার বাবার মৃত্যুতে কোনো না কোনো ভাবে সে নিজেকেই দায়ী মনে করে। এই তো সেদিন সন্ধ্যায় তার বাবাকে ফোন করে খুব অভিমানী কন্ঠে বলছি-
‘বাবা!! রাত হয়ে যাচ্ছে। তুমি আজ আমাকে নিয়ে ঘুরতে গেলে না। আমি আর ভাই কেক নিয়ে বসে আছি এখনও যদি না আসো তাহলে আর কথাই বলবো না তোমার সাথে।’
ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে তার বাবা খুব মিষ্টি গলায় বলল-
‘এই তো মা এসে পরবো আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর। অফিসে অনেক চাপ যাচ্ছে তো আমার কি দোষ বল!’
‘আচ্ছা আরেকটু অপেক্ষা করছি। তাড়াতাড়ি এসো কিন্তু!’
ফোন কেটে গেল। দুই ভাইবোন বসে অপেক্ষা করতে লাগলো তার বাবার। রাত প্রায় বারোটায় ধ্রুব খবর পেয়েছিল তার বাবার গাড়ি এক্সিডেন্টের কথা। আর সাথে তার বাবার মৃ’ত্যুর কথা। মৃন্ময়ী তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল। ধ্রুব ভেঙে পরেছিল কান্নায়। কিন্তু তার বোনকে ঘুম থেকে তোলেনি। সকাল হলো। মৃন্ময়ীর ঘুমও ভাঙলো। ঘুম ভাঙার সাথে সাথেই বাবার প্রতি প্রচন্ড অভিমানে অন্ধকার হয়ে আসলো তার মুখ। রুম থেকে বের হতেই শোকের ছায়ায় পাথর হলো সে। একুশ বছর বয়সী ধ্রুব তখন চারদিক সামলাতে সামলাতে দিশেহারা৷ তার ছোট্ট বোনটার নিস্তব্ধতা আর বাবার অনাকাঙ্ক্ষিত মৃ’ত্যু সব কিছুর ধাক্কা সামলে নিতে নিতে যেন নিজের কষ্টটা-ই প্রকাশ করতে ভুলে গেল সে। নিজের পড়াশোনা, বাবার ব্যবসা, এই বাড়ি আর ছোট্ট একটা মাটির তৈরি রাজকুমারী সব কিছুর দায়িত্ব তখন এসে পরল তার নাজুক কাধে। প্রথম প্রথম সব কিছুতে হাঁপিয়ে উঠলেও আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যায়৷ আর তাদের দেখাশোনা করতে দিনরাত এক করে দিয়েছেন তার বাবার ম্যানেজার রসিদ মিয়া। মানে রঞ্জনের বাবা। তিনিই ব্যবসায়ের সকল কিছু দেখাশোনা করেন। আর ধ্রুব ব্যস্ত হয়ে পরে তার বোনের দায়িত্ব পালনে আর বাবার স্বপ্ন পূরণে। ছেলেকে একজন ভালো ডাক্তার হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন ধ্রুবর বাবা। ধ্রুব সেই ইচ্ছে পূরণ করেছে। জরুরি কাজেই তিন মাসের জন্য গিয়েছিল অন্য শহরে। এই প্রথম বুঝি মৃন্ময়ীকে রেখে কোথাও গিয়েছিল। চাইলেই মৃন্ময়ীকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারতো। কিন্তু সে চেয়েছিল মৃন্ময়ী একা চলতে শিখুক। নিজেকে সামলিয়ে নিতে শিখুক। কিন্তু কে জানতো তার এই অভিমানী পাগলিটা তার সাথে একেবারেই সব যোগাযোগ বিছিন্ন করে দিবে। সব জায়গায় থেকে ব্লক করে নিজের নাম্বারই চেঞ্জ করে দিবে! মেয়েটা যে এত অভিমানী হয়েছে তা সে বুঝতেই পারেনি।
‘দেখ তো আমার এত প্রিয় একটা শার্টকে ভিজিয়ে কি অবস্থা করেছি!’
ধ্রুবর কথায় মৃন্ময়ী আড় চোখে তাকায়। হাল্কা গোলাপি রঙের শার্ট ধ্রুবর গায়ে জড়ানো। শার্টের রঙের কারণে যেন ধ্রুবকে অল্প বয়সী ছেলে মনে হচ্ছে। এই কালার ধ্রুবর মোটেও পছন্দ না। তার ভাষ্যমতে এটা বাচ্চা মেয়েদের কালার। ধ্রুবর জন্মদিনে মৃন্ময়ী নিজেই এই শার্টটা গিফট করেছিল। তার পর থেকেই এটা ধ্রুবর প্রিয় শার্ট।
‘চুপ করে আছিস কেন! আচ্ছা এবার বল তো তুই আমাকে সব জায়গায় ব্লক করে রেখেছিস কেন? আর ব্লক করেছিস তো করেছিস এতেও কি তোর মন শান্ত হয়নি যে নাম্বারই পালটে ফেললি! আমি কিভাবে তোর খোঁজ নিতাম বল তো!’
মৃন্ময়ী এবার মুখ খুলল। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল-
‘চারপাশে তো স্পাই লাগে-ই রেখেছিলে। তারা নিশ্চয়ই আমার নাড়িভুড়ি থেকে শুরু করে সব কিছুর খবর তোমাকে জানিয়েছে।’
ধ্রুব হাসতে হাসতে বলল-
‘আচ্ছা এবার বাসায় চল। প্রচুর ক্ষুধা লেগেছে। সকাল থেকে কিছু খাইনি। ঠিক করেছি বাসায় এসে একেবারে তোর হাতের বিরিয়ানি খাবো।’
‘আফনান চলে গেছে এই খবর পেয়েই তুমি তাড়াতাড়ি এসেছো তাই না ভাই!’
মৃন্ময়ীর কন্ঠস্বর জড়িয়ে যাচ্ছে। চোখদুটো আবারও চিকচিক করে উঠেছে। ধ্রুব হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল-
‘একদম চোখের পানি ফেলবি না৷ যারা তোকে সম্মান করে না, তোর চোখের পানির মূল্য দেয় না তাদের জন্য কক্ষনও চোখের পানি ফেলবি না। আমাদের বাবা-মা নেই বলে কি আমাদের পরিচয় নেই! নাকি আমরা রাস্তার ছেলে মেয়ে যে ওই মহিলা তোকে তুচ্ছ মনে করবে! আর আমার তো রাগ হচ্ছে আফনানের উপর। ওর তো উচিত চুড়ি পরে মায়ের আঁচল ধরে ঘুরা। একটা ছেলে হয়েও নিজের ভালোবাসাকে পূর্নতা দিতে পারে না। নিজের মা’কে বুঝিয়ে বলতে পারে না তাকে তো ছেলে না মেয়ে বলা উচিত। সাধারণ মেয়ে না ন্যাকা টাইপের মেয়ে।’
ধ্রুবর কথায় মৃন্ময়ী খিলখিল করে হেসে উঠলো। ধ্রুব চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে মৃন্ময়ীর দিকে। কতদিন পর মেয়েটার মুখে হাসি দেখেছে।
চলবে..