স্নিগ্ধ অনুভব পর্ব-১৮+১৯

0
1558

#স্নিগ্ধ_অনুভব
#পার্ট:১৮
#পিচ্চি_লেখিকা

পার্কে বসে থাকতে থাকতে চোখ যায় এক জোড়া কপত-কপতির দিকে। ২ জনে কিছু নিয়ে ঝগড়া করছে। মেয়ে টা কান্না করছে। আমি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আইদা কে বললাম,,
“আইদা তুমি ওদের খেয়াল রাখো আমি আসছি।”
“কোথায় যাচ্ছো আপু?”
“তুমি থাকোই না। আসতেছি।”
আইদার থেকে সরে এসে ওই দুজনের কাছো গিয়ে গলা ধাকাড়ি দিলাম। ছেলে আর মেয়েটা আমার দিকে তাকালো,,
“ঝগড়া করছেন কেন? কোনো প্রবলেম? আপু তুমি কাঁদছো কেন?”
“তাতে আপনার কি? এটা আমাদের পার্সোনাল ম্যাটার!’
” পাবলিক প্লেসে তোমরা লোক দেখিয়ে এমন করলে সেইটা আর পার্সোনাল থাকে না। যায় হোক তোমাদের পার্সোনাল প্রবলেমে কথা বলার জন্য আই’ম সরি বাট একটা কথা বলি সময় থাকতে সময়ের মূল্য দাও। সময় গেলে আর আসবে না। আজ যাকে কষ্ট দিচ্ছো সময়ের বিবর্তনে তার জন্যই তুমি কষ্ট পাবে।
একটু থেমে বললাম,,,ওই যে দুরে দেখছো একটা বাচ্চা ছেলের সাথে বড় একটা ছেলে বাচ্চাার মতো করে খেলছে উনি আমার হাজবেন্ড। সময়ের বিবর্তনে আজ সে মানসিক ভারসাম্যহীন।”
আমার কথা শুনে দুজনেই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি মুচকি হেঁসে বললাম,,
“তাও আমি তার সাথে সুখী কেন জানো কারণ উনি আমার ভালোবাসা। উনিই আমার স্নিগ্ধ অনুভব। ভালোবাসাকে অবহেলা না করে সামলে রাখতে শিখো নয়তো পরে পস্তাবে। আজ এই মেয়েটা তোমার ব্যবহারে বা অবহেলায় কান্না করতেছে একদিন হয়তো তোমারও কান্না করতে হবে। তাই সময় থাকতে সত্যিকারের মানুষটা চিনে আগলে রাখো।”
আমি আর কথা না বাড়িয়ে চলে আসলাম। আমার কথাকে নাই বা গুরুত্ব দিক তবুও জানি ওরা একবার হলেও বিষয়টা নিয়ে ভাববে।

কেটে গেছে আরো ২ দিন। তন্নির কাছে যে ক্যামেরা গুলো দিয়েছিলাম তা আমার ফোনের সাথে কানেক্টেড হওয়ায় সবার গতিবিধিই আমি দেখেছি। ভিডিও টা দেখে বাকা হেঁসে বললাম,,
“সময় হয়ে গেছে সবার সামনে আসার। জাস্ট ওয়েট কয়েক ঘন্টা।”
অনুভব গাল ফুলিয়ে এসে আমার পাশে বসে বললো,,
“আপনি অনেক পঁচা।”
“কেন কি করলাম আমি?”
“এই যে আমাকে নিয়ে চলে যেতে চাচ্ছেন। সিফাত আর ওই আপুটার সাথে আমার আর খেলা হবে না। আপনি আমাকে কোথায় নিয়ে যাবেন? ওই লোক গুলোর কাছে নিয়ে যাবেন না তো?”
“ওদের কাছ থেকে এনেছি কি আবার নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমরা এমন জায়গায় যাবো যেখানে আপনার পরিবার আছে, যেখানে আপনার বাবা-মা, ভাই বোন, কাকা-কাকি, ফ্রেন্ডস আর সব থেকে বড় কথা যেখানে গেলে আপনি আপনার স্নিগ্ধবতীকে চিনবেন।”
“কচু। আপনার মতো স্নিগ্ধবতীও অনেক পঁচা। সেও আমার কাছে আসে না।”
আমি মুচকি হেঁসে অনুভবের বুকে মাথা ঠেকিয়ে বললাম,,
“আসবে তো। স্নিগ্ধবতী আপনার কাছে আসবে। এখন তো অনেক প্রবলেম তাই সে আসতে পারছে না।”
অনুভব কোনো উত্তর দিলো না। উত্তর না পেয়ে মাথা উপরে তুলে তাকিয়ে দেখি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। হয়তো বুকে মাথা রাখাটা নিয়ে উনার এমন রিয়েকশন। হোক তাতে আমার কি? উনি ভুলে গেছেন সব আমি না হুহ😏

লিভিং রুমে আন্টি,আঙ্কেল, ভাইয়া,ভাবি,সিফাত আর আইদা মন খারাপ করে বসে আছে। সবার একটাই কথা আরো তো থাকতে পারি তাহলে চলে কেন যাচ্ছি?আন্টি বললো,,
“তুই আমাদের পর করে দেওয়ার জন্য চলে যাচ্ছিস তাই না?”
“আরে আন্টি কি বলছো এসব? এমন কিছুই না। তোমরা তো আমার আত্মার সাথে মিশে গেছো। আত্মার সম্পর্ক পর হয় না বুঝছো।”
“তাহলে থেকে যা না!”
আমি আন্টির হাত মুঠো করে নিয়ে বললাম,,
“আন্টি তুমি চাও না যাদের জন্য আজ অনুভব এমন তারা শাস্তি পাক?”
আন্টি মাথা নাড়িয়ে বোঝায় “হুম” যার মানে সে চাই।
“তাহলে প্লিজ মন খারাপ করো না। খুব তাড়াতাড়ি আমরা আবার আসবো।”
“হুম। অপেক্ষা করবো তোদের! ভুলে যাস না কেমন!”
“উম্মাহ আন্টি। আমার কিউটি আন্টি।”
“হয়ছে আর পাম দিতে হবে না।”
“আপু তোমাকে একা ছাড়তে একদম ভালো লাগছে না। আমি তোমার সাথে গেলে কি প্রবলেম হবে?”
“না আইদা এখন তোমার যাওয়া ঠিক হবে না। একটু অপেক্ষা করো তোমাকে আমি নিজে নিয়ে যাবো।”
“হুম!”

১ ঘন্টা জার্নি করে অনুভবকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি বাড়ির সামনে। এটাই সেই বাড়ি যেখান থেকে শুরু হয়েছিলো তার প্রতি অনুভূতি,, তার প্রতি ভালোবাসা। অনুভবের দিকে তাকিয়ে দেখি ও বার বার এদিক সেদিক দেখছে। হয়তো বোঝার চেষ্টা করছে এটা কোন জায়গা? আমিও নিজেকে ঠিক করে নিয়ে বাড়ির কলিং বেলে হাত দিলাম। আসার আগে তন্নি, তিশা আপু, তুষার ভাইয়া, তামিম সবাইকে আসতে বলে দিয়েছি। মেঘুও হয়তো আসবে। তিশা আপু তো আসতেই নারাজ ছিলো। কিন্তু আমার আর অনুভবের কথা শুনে সাথে সাথেই বাড়ি আসায় রওনা দিয়ে দিয়েছে। কলিং বেল বাজার সাথে সাথেই চোখ মুখ কুচকে দরজা খুললো মামুনি। মামুনি আমাকে দেখেই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। অনুভব আমার থেকে কিছুটা দুরে দাঁড়িয়ে সবটা চোখ বড় বড় করে দেখছে। আমি মামুনিকে জড়িয়ে ধরে বললাম,,
“কেমন আছো মামুনি? তুমি কি এখনো আমার ওপর রেগে আছো?”
মামুনি শকড হয়ে গেছে। কি রিয়েকশন দেবে হয়তো সে নিজেই বুঝতে পারছে না। নিজেকে সামলে বললো,,
“এতদিন কোথায় ছিলি তুই?”
“সব কি এখানেই শুনবে? ভেতরে নিয়ে যাবে না?”
“হুম আয়।”
“দাড়াও তোমাদের জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে!”
মামুনি ভ্রুকুচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,,,
“কিসের সারপ্রাইজ?”
আমি মামুনির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে অনুভবের দিকে হাত বাড়িয়ে নিজের কাছে এনে দাঁড় করাতেই মামুনির চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। কয়েক মিনিট শকড কাটিয়েই অনুভবকে জড়িয়ে ধরলো৷ কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,,
“এত অভিমান বাবা তোর? নিজের পরিবারকে ছেড়ে চলে যেতে পারলি তুই?”
অনুভবকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাচ্ছে। তাই মামুনিকে বললাম,,
“ওকো ছাড়ো মামুনি। ওর কষ্ট হচ্ছে। এভাবে জাপটে ধরো না। আর ওর মেন্টাল সিচুয়েশন একদম ভালো না। ওর কিছুই মনে নেই + মানসিক ভারসাম্যহীন উনি।”
আমার কথা শুনে মামুনি অনুভবকে ছেড়ে ২ কদম পিছিয়ে দাড়ায়। চোখ চিকচিক করছে জলে। আমি মামুনির পেছনে বাঁকা হেঁসে বললাম,,
“সব কথা পরে বলছি। তিশা আপুরা এসে পড়লো বলে। ততক্ষণ ভেতরে আরাম করে বসে নেই।”
কথা না বাড়িয়ে অনুভবকে নিয়ে ভেতরে গিয়ে বসে পড়লাম৷ বেচারা ভয় পেয়ে আমার শাড়ির আঁচল টেনে ধরে রেখেছে। যেন ছেড়ে দিলেই আমি পালিয়ে যাবো ওকে রেখে। লিভিং রুমে আরাম করে বসতেই বাবাই, কাকা, কাকি এসে উপস্থিত হলেন। আমাকে দেখেই কাকি বাজখাই গলায় বললো,,
“তুই? এখানে কি করিস তুই? তোর লজ্জা করে না আবার এই বাড়িতে আসতে? ভাবি সেদিন তোকে এত কথা শুনালো আর তুই বেহায়ার মতো আবারও চলে এলি? বলি তোর কি কান্ডজ্ঞান নেই রে। এত বেহায়া মানুষ কিভাবে হয়?”
আমি মুচকি হেঁসে বললাম,,
“কথা গুলো আমাকে না বলে নিজেকে বলো কাকি! আমি আমার স্বামীর বাড়িতে এসেছি তাতে বেহায়ার কিছু নেই বলেই আমি মনে করি। আর তোমরা হয়তো ভুলে গেছো এই পুরো প্রোপার্টি আমার হাজবেন্ড অনুভবের। আর শোন কাকি তুমি আমার স্বামীর বাড়িতে থেকে আমাকে অপমান করার সাহস কই পাও?”
“স্নিগ্ধা..(চেচিয়ে)
” চুপ। গলা নামিয়ে কথা বলো। একদম বড় গলায় কথা বলবে না। আমার স্বামীর বাড়িতে থেকে আমাকেই ধমকানোর সাহস কই পাও তুমি? এতদিন আমরা ছিলাম না তাই তোমরা এই রাজপ্রাসাদের রাাজকার্য চালিয়েছো তাই বলে এখনও চালালে ভুল করবে। আর হ্যাঁ একদম ভেবো না এই স্নিগ্ধা আগের স্নিগ্ধার মতো মুখ বুজে সব সহ্য করে যাবে। এখন থেকে আমি আর অনুভব যা বলবো এই বাড়িতে তাই হবে।”
“স্নিগ্ধু তুই কিভাবে কথা বলছিস তোর কাকির সাথে? আর তোর কথা সবাই কেন মানবে?”
“আরে মামুনি মানবে মানবে সবাই মানবে। মানতে তো হবেই।”

আমাদের কথার মাঝেই তিশা আপু দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। তিশা আপু জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। তুষার ভাইয়া, তন্নি, মেঘু, তামিম সবাই এসেছে। মেঘু কান্না করছে তবুও আমার কাছে আসছে না। অভিমানে অন্য দিকে তাকিয়ে হাত গুটিয়ে কান্না করছে। তিশা আপু আমার গালে মুখে ছুয়ে দিয়ে,,
“তোকে খুব মিস করেছি স্নিগ্ধু,,তুই জানিস তোর জন্য আর ভাইয়ার জন্য প্রতিদিন পথ চেয়ে বসে থাকতাম। আজ আমার অপেক্ষা পূর্ণ হয়েছে।”
“হুম। আমিও তোমাদের মিস করেছি আপু।”
আপু আমাকে ছেড়ে অনুভবের সামনে ফ্লোরে বসে পড়লো। অনুভব কিছু বুঝতে না পেরে শুধু তাকিয়ে আছে সবার দিকে৷ তিশা আপু অনুভবের হাত ধরতেই লাফিয়ে উঠে অনুভব আমার পিছে এসে আমাকে ধরে দাঁড়ালো। সবাই অনুভবের এমন কাজে হা করে তাকিয়ে আছে। আমি অনুভবকে ধরে বললাম,,
“এটা আপনার ছোট বোন অনুভব। যান উনার সাথে কথা বলুন।”
“ও বুঝি আমার বোন হয়? তাহলে আমি ওকে চিনি না কেন?”
“কারণ আপনি সব ভুলে গেছেন তো তাই। আমি তো বলছি ওটা আপনার বোন। আমি কি আপনাকে মিথ্যা বলতে পারি?”
অনুভব মাথা নাড়িয়ে বোঝালো,,”না”। তিশা আপু আমাকে বললো,,
“ভাইয়া এসব কি বলছে স্নিগ্ধু?”
“আপু ভাইয়ার মানসিক ভারসাম্য ঠিক নেই। সেসব তোমাকে পরে বলবো। যায় হোক তুমি একটু উনাকে নিয়ে রুমে যাবে প্লিজ।”
“হুম।”
তিশা আপু অনুভবকে ধরতে গেলেই ও আমার দিকে তাকায়। আগেই বলেছিলাম আমি বাদে কারো কাছে না যেতে সেই কথাটাই মাথায় ঢুকিয়ে নিয়েছে। আমি মেঘুর কাছে যেতেই ও মুখ ফিরিয়ে নিলো। আমি ঠোঁট উলটে বাচ্চাদের মতো করে বললাম,,
“ও মেঘু আন্টি রাগ করেন কেন?”
“আমি কারো ওপর রাগ করি না। কে হন আমার যে রাগ করবো?”
আমি মেঘুকে জড়িয়ে ধরে বললাম,,
“প্লিজ মেঘু সোনা রাগ করিস না। আমি তোকে সবটা বুঝিয়ে বলবো প্লিজ তাও রাগ করিস না।”
মেঘলা এবার আমাকে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলো,,
“আরে আরে কান্না করিস না। থাম প্লিজ।”
“……………
” তুই তো এমন ভাবে কান্না করছিস যেন আমি মরেই গেছি!”
“চুপ কর। একটা থাপ্পড় দিবো তোকে। ৮ টা মাস তোর আমাদের কথা মনে পড়েনি? বল!”
“৮ মাস কি সেন্স ছিলো আমার যে মনে পড়বে!”
মেঘলা আমাকে ছেড়ে বললো,,
“মানে?”
“মানে ৮ মাস কোমায় ছিলাম। এই তো ১ মাস আগে কোমা থেকে ফিরছি। বাদ দে এসব। তোর আর ফাহিম ভাইয়ার কি খবর?”
“হুম ভালো।”
“ওই পোলাপান তোরা দুরে কেন?”
তন্নি আর তামিমকে কথাটা বলতেই দুজনেই বললো,,
“পোলাাপান কে?”
“এহহহ পোলাপান কে? তোরা পোলাপান!”
“চুপ ছেরি। আইতে পারলি না ঝগড়া শুরু করছোস। তোরে তো টিকটিকির জুসস খাইয়ে উস্টা দিয়ে উগান্ডা ফালায় দেওয়া উচিত!”
“এহহহ। পোলাপান কইছি দেইখা ২ টা জ্বইলা উঠছে একদম হুহ।”
“তা নয়তো কি? ঠিক সময় বিয়ে করে নিলে এতদিনে পোলাপানের মা হইয়া যাইতাম। নেহাতই তোর ভাসুর+ ভাই আমারে এক্সেপ্ট না করে ঘুরায় শুধু..”
তন্নির কথা শুনে তুষার ভাইয়া তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে। কটমট করে বলে,,
“নিজেরা যা ইচ্ছা করো আমারে টানো কেন? আর তোমারে এক্সেপ্ট করবে কোন পাগলে? আমার খেয়ে কি কাজ নাই নাকি!”
“একদম ঠিক কথা কইছেন ভাইয়া। এইডারে বিয়া করলে মানুষ আর মানুষ থাকবে না পুরাই পাগলু হয়ে যাবে।”
“ওই তামিম্ম্যা খবরদার যদি আমারে নিয়া নিন্দা করস তো? আরে শালা যদি পারোস একটু সেটিং করাইয়া দে নাইলে এমন কানপোড়া দিছ না। শালা ভ্যাটকাইম্ম্যা।”
“ধুরো। তোদের কাছে এসেও আমার তোর ঝগড়া দেখতে হচ্ছে। তোরা থাম নাইলে আমি যাইতাছি গা।”
“স্নিগ্ধু তুই ছাড় এদের কথা উপরে চল। অনুভব ভাইয়ার কাছে যায়।”
“হুম চল!”
“এই খাড়া আমরাও যামু।”
“আইতাছোস আয়। ওর সামনে ঝগড়া করিছ না মেরি ভাই বোনেরা নয়তো পরে আমার চুল একটা একটা কইরা ছিড়বো।”
আমার কথা শুনে তিনজনই হেঁসে দিলো। তুষার ভাইয়া ঠোঁট কামড়ে হেঁসে উপরে চলে গেলো। আমরাও গেলাম। রুমে গিয়ে দেখি…..

চলবে……

#স্নিগ্ধ_অনুভব
#পার্ট:১৯
#পিচ্চি_লেখিকা

সবাই মিলে হাঁসতে হাঁসতে রুমে ঢুকতেই দেখি তিশা আপু নিরবে কাঁদছে আর অনুভব তার কোলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। একটা স্বস্থির শ্বাস নিয়ে আপুর কাছে এগোলাম। তন্নি, তামিম, মেঘলা সবাই এসে রুমে থাকা সোফার উপর বসলো। আর তুষার ভাইয়া অনুভবের ঘুমন্ত চেহারায় তাকিয়ে ছলছল দৃষ্টি নিয়ে বিছানায় বসলো। আমি তিশা আপুর দিকে এগিয়ে ওর মাথায় হাত রাখতেই জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। আমি মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম,,
“কান্না কেন করছো আপু? দেখো অনুভব তোমার সামনে আছে।”
তিশা আপু কান্নার জন্য কথায় বলতে পারছে না। কোনো রকম ভাঙা ভাঙা গলায় বললো,,,
“কেন এভাবে সব এলোমেলো হয়ে গেলে বলবি স্নিগ্ধু? আমি তো চায়নি এমন ভাইয়াকে! জানিস ছোট থেকেই ভাইয়াকে খুব ভালোবাসি আমি। ভাইয়া তো সব সময়ই আমাকে আগলে রেখেছে। কখনো কোনো ইছা অপূর্ণ রাখেনি,কখনো একটা ধমক দিয়েও কথা বলেনি। আর আজ আমার সেই ভাইয়ার এ কি অবস্থা?”
“আপু শান্ত হও। অনুভব সুস্থ হয়ে যাবে খুব তাড়াতাড়ি।”
তিশা আপুকে অনেক কষ্টে শান্ত করে বসিয়েছি। কান্নার আওয়াজে অনুভবের ঘুম ভেঙে গেছে। পিটপিট করে তাকিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,,
“ও এভাবে কাঁদছে কেন?”
তিশা আপু এবার অনুভবকে শক্ত করে আরো জোড়ে কেঁদে উঠলো। ভাঙা ভাঙা গলায় বললো,,
“এই ভাইয়া ভাইয়া রে,,তোর কি মনে পড়ে না আমাকে? তোর এই ছোট বোনের সব ইচ্ছা তুই পূরণ করেছিস একটা লাস্ট ইচ্ছা পূরণ কর না রে! তুই একবার সুস্থ হয়ে যা প্লিজ। আমি আর কখনো তোকে কষ্ট দিয়ে কথা বলবো না। কখনো কিছু চাইবো না।”
তিশা আপুর কাঁদতে কাঁদতে হিচকি উঠে গেছে। তবুও নিজের ভাইকে ধরে কেঁদেই যাচ্ছে। রুমের সবার মাঝেই পিনপতন নিরবতা। সোফায় বসে ৩ টা ব্যাক্তি কাঁদছে মাথা নিচু করে। এদিকে তুষার ভাইয়াও মাথা নিচু করে আছে। তুষার ভাইয়া যথেষ্ট শক্ত তবুও এই পরিস্থিতিতে যে কাঁদছে তা ঢের বুঝতে পারছি। পৃথিবীর সব থেকে মধুর সম্পর্কই হয় নাকি ভাই বোনের। ভাই বোনের ঝগড়া খুনসুটিময় দিনগুলো যত আনন্দের তেমনই কারো কোনো বিপদ হলে সব থেকে বেশি কষ্ট পায় এই ভাই বোনই। তাই তো আজ ৩ ভাই বোনই কাঁদছে। অনুভব কি বুঝেছে জানি না। তবুও তিশার কান্না দেখে সে নিজেও কাঁদছে। চোখের কুর্নিশ বেয়ে পড়া পানি গুলো মুছে তিশা আপুকে টেনে সোজা করে বসিয়ে কোনো রকম শান্ত করালাম। কিন্তু তুষার ভাইয়া আর বসে থাকলো না। উঠে বারান্দার চলে গেছে। ওর পিছে তন্নিও গেছে।
“আপু এভাবে কান্না করলেই কি সব ঠিক হয়ে যাবে বলো? আমাদের শক্ত থাকতে হবে। নয়তো অনুভবের সাথে যারা অন্যায় করেছে তাদের কিভাবে শাস্তি দিবো বলো? আর তাছাড়া তোমরা এভাবে ভেঙে পড়লে আমিও দুর্বল হয়ে পড়বো অনুভবও তোমাদের কান্নায় মন খারাপ করে থাকবে। ডক্টর বলেছে ওকে সব সময় খুশি রাখতে হবে। প্রোপার কেয়ার করতে হবে। তুমি তোমার ভাইকে সুস্থ করতে সাহায্য করবে না??”
তিশা আপু মাথা নাড়িয়ে বুঝালো সে সাহায্য করবে। তিশা আপু শান্ত হয়ে বসে আছে। অনুভব এখনো নাক টেনে বাচ্চাদের মতো কান্না করছে। ওর এমন কান্না দেখে যেমন হাঁসি পাচ্ছে তেমনই অবাক লাগছে। আমি অনুভবের কাছে গিয়ে বসে বললাম,,
“এভাবে বাচ্চাদের মতো কান্না করছেন কেন?”
অনুভব নাক টেনে টেনে বললো,,
“আপুটা কান্না করছে যে তাই। আমার আবার কারো কান্না দেখলে কান্না পায়।”
বলেই আবার কান্নায় মনোযোগ দিলো। অনুভবের কথা শুনে আমার প্রচুর হাঁসি পাচ্ছে। মেঘু, তিশা আপু, তামিম ৩ জনই একাবার একে অপরের দিকে তাকিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে তো অনুভবের দিকে তাকাচ্ছে। ফট করেই ৪ জন এক সাথে হেঁসে উঠলাম। তিশা আপু চোখে পানি রেখেও হাঁসছে। তার ভাই যে এমন বাচ্চাদের মতো ব্যবহার করছে সে যেন মানতেই পারছে না। আমাদের হাঁসি দেখে অনুভব এবার ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে শব্দ করে কান্না করে দিলো। এবার আমি ধমক দিয়ে বললাম,,
“ওই চুপ। কান্না করছেন কেন হুদাই?”
“এ্যাাাাাা আপনি আমাকে বকলেন? আমি থাকবো না আপনার কাছে!”
“লে এবার বলে থাকবো না। এই আপু এইটা তো ওই বাড়িতেই ভালো ছিলো। সারাদিন সিফাতের সাথে খেলতোআর হাসাহাসি করতো। এখানে এসে মেয়েদের মতো কাঁদুনি হয়ে গেছে।”
“ওই একদম আমার ভাইকে কাঁদুনি বলবি না। আর ওই বাড়ি মানে?”
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললাম,,
“দাঁড়াও বলছি।”
এটুকু বলেই দরজা লক করার জন্য এগিয়ে গেলাম। ওদেরও সবটা জানা জরুরি। ওরাও আমাকে সাহায্য করবে জানি। দরজা লক করে আসতে গিয়ে চোখ যায় বারান্দার দিকে। তুষার ভাইয়া তন্নিকে জাপটে ধরে কাঁদছে। অপর পাশে তন্নিও কাঁদছে। ওদের এমন দৃশ্য দেখে আপনা আপনি মুখের কোণে হাঁসি ফুটে উঠলো। বেচারি তন্নি এবার হয়তো তুষার ভাইয়ার ভালোবাসা পাবে। আমি তিশা আপুদের কাছে এগিয়ে গিয়ে আরাম করে বসে সবটা বলতে লাগলাম।

সব শুনে সবাই আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। তন্নি আর তুষার ভাইয়াও এসে বসেছে সবার সাথে। তন্নির সাথে আমার আগেও দেখা বা কথা হয়েছে শুনে সবাই ক্ষিপ্ত চোখে তন্নির দিকে তাকিয়ে আছে। পারলে এখনি চোখ দিয়ে গিলে ফেলবে। তন্নি সবাইকে এমন ভাবে৷ তাকাতে দেখে বললো,
“কি? সবাই এভাবে দেখছো কেন? তোমরা তোমাদের সাধের স্নিগ্ধুরে জিগাও সে কেন আমারে কিছু বলতে নিষেধ করছে!”
“তোরে তো….
মেঘলা কে থামিয়ে তিশা আপু বললো,,
” ওই থামো তোমরা। সারাদিন ঝগড়া না করে কি কেউই শান্তি পাও না হুম? তোমরা পরে ঝগড়া করো। তার আগে স্নিগ্ধু তুই বল তোর এক্সিডেন্ট কি করে হলো?”
“রাস্তায় আনমনে হাঁটছিলাম তখন কেউ পাশ থেকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তার মাঝে ফেলেছিলো যার ফলে এক্সিডেন্ট হয়।”
“ধাক্কা কে দিয়েছে? দেখেছিস?”
আমি বাঁকা হেঁসে বললাম,,
“সময় আসুক জানতে পারবে। তার আগে আমাদের অনুভবকে সুস্থ করতে হবে। ওকে হাসি খুশি রাখতে হবে। আর অবশ্যই অনেকের থেকে দুরে রাখতে হবে। এখন কেউ ওকে অ্যাটাক করলেও ও তার থেকে বাঁচতে পারবে না। কিন্তু সুস্থ হয়ে গেলে ও নিজেই সব হ্যান্ডেল করতে পারবে আর ডক্টর বলেছে ওর সেই বাজে স্মৃতি গুলো ভুলাতে হবে নয়তো ও সুস্থ হতে পারবে না।”
“হুম সব তো বুঝলাম বাট কে আছে এসবের পিছে?” (তুষার ভাইয়া)
“হুম আমিও সেটাই বুঝতেছি না কে ভাইয়ার শত্রু?” (তিশা আপু)
“আচ্ছা স্নিগ্ধু যে ক্যামেরা গুলো দিয়েছিলি তা থেকে কিছু পেয়েছিস?” (তন্নি)
রহস্যময় হাঁসি দিয়ে বললাম,,
“পেয়েছি তো অনেক কিছু।”
“কি পেয়েছিস দেখা!” (তিশা আপু)
“দাঁড়াও”
এটুকু বলেই ব্যাগ থেকে একটা পেনড্রাইভ আর ল্যাপটপ বের করে রাখলাম। পেনড্রাইভ দিয়ে ল্যাপটপ অন করতেই একটা ভিডিও চালু হলো। ভিডিওটা দেখে সবাই যেমন অবাক হয়েছে তেমনই তিশা আপু আর তুষার ভাইয়া রাগে ফুঁসছে।
“ওদের এতো সাহস? এত নোংরা মন মানসিকতা কি করে হয় কারো? ছিঃ” (তিশা আপু)
“ওদের তো আমি আজই” (তুষার ভাইয়া)
তুষার ভাইয়া উঠে চলে যেতে নিলে আমি আটকে দিলাম।
“ভাইয়া শান্ত হও। যা করার মাথা ঠান্ডা করে করতে হবে। আর এখনই কিছু করতে গেলে অপরাধী পালাবে। আমি তো চায় সে একটু ভুল করুক৷ যাাতে তাকে ধরা সহজ হয়ে যায়। তোমরা এমন করলে কিছু হবে না ভাইয়া।”
“হুম স্নিগ্ধু একদম ঠিক বলেছে। ভাইয়া তুমি বসো।” (তিশা আপু)
তুষার ভাইয়া রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করেই বসে পড়লো। তিশা আপু বললো,,
“রাগের মাথায় কিছু করলে আমরাই হেরে যাবো ভাইয়া। যে যা করছে করতে দাও। তারা শেয়ানা হলে আমরাও ডাবল শেয়ানাহয়ে দেখাবো। এবার স্নিগ্ধু বল তোর কি প্ল্যান?”
” হুম,,মেঘু তোরও হেল্প লাগবে,,তোদের সবার হেল্প লাগবে!”
“বলই না কি হেল্প?”
“মেঘু তুই তোর বাড়িতে নজর রাখবি। কে কি করছে? কখন কোথায় যাচ্ছে? এসব জানার চেষ্টা করবি। আর তুষার ভাইয়া তোমাকে একটা নাম্বার দিচ্ছি তুমি ডিটেইলস আনতে পারবে কোনোভাবে?”
“হ্যাঁ পারবো।”
“ঠিক আছে। তিশা আপু আমি যেদিন যেদিন অনুভবকে নিয়ে বাহিরে যাবো সেদিন সেদিন তুমি আর তুষার ভাইয়া মিলে বাড়িতে সবাইকে ব্যস্ত রাখবে। তামিম আর তন্নি আমার সাথে যাবে।”
“ওকে ডান।”
“আর হ্যাঁ প্লিজ সবাই স্বাভাবিক থাকবে যাতে কেউ সন্দেহ না করে। এমন ভাব নিবো আমরা যেন অনুভবের এই অবস্থাকে আমরা একান্তই একটা এক্সিডেন্ট মনে করছি। আর অবশ্যই আমাদের হাঁসি, মজা, আনন্দ করতে হবে। অনুভবও কিছুটা স্বাভাবিক হবে আর কেউ সন্দেহও করবে না।”
“আরে বাহ,,স্নিগ্ধু তোরে তো গোয়েন্দা বা এক্টিং এ দেওয়া ছিলো। তোর যা বুদ্ধি বাবাগো।”
“চুপ তামিম্ম্যা,,নিজের কাম কর হালা।”
“তোরা কি সারাদিন ঝগড়া ছাড়া কিছু পারিস না?”
“থাম তো তোরা। স্নিগ্ধু কার নাম্বার বললি না?”
বাঁকা হেঁসে বললাম,,
“আরে ভাইয়া কাল সকালে দেখবে সে আমাদের বাড়িতে হাজির। কিছুটা বুঝে নিও তোমরা। আর হ্যাঁ সবার দিকে খেয়াল রাখবে। কাউকে চোখের আড়াল করবে না। অনুভবকে নিজেদের থেকে আলাদা করা যাবে না।”
“হুম। আজ রাতে কি তুই একা থাকবি? না মানে রিস্ক নেওয়াটা কি ভালো হবে?”
“ভাবছি সেটাই।”
“আমি তোদের সাথে থাকলে কি খুব সমস্যা?”
“আরে না। ভালোই হবে। রাতে কিছু হলে আমি একা সামলাতে পারবো না। তুমি থাকলে তাও একটু নিশ্চিন্ত থাকবো।”
“স্নিগ্ধু কিছু মনে না করলে একটা কথা বলবো?”
“হুম বলেন।”
“না মানে তোরা দুজনই তো মেয়ে তোরা রিস্ক নিতে পারবি না। তোরা না হয় তিশার রুমে ঘুমা আমি অনুভবের সাথে ঘুমাবো।”
“কিন্তু ভাইয়া অনুভব যদি…..
আমাকে থামিয়ে মেঘলা বলে,,
” আচ্ছা আজ সারারাত আমরা সবাই এক সাথে থাকলে কেমন হয়?? সবাই মিলে আড্ডা দিতে দিতেই সময় কেটে যাবে। কি বলো?”
“তা ঠিক আছে বাট ফাহিম ভাইয়া তোকে থাকতে দেবে??”
“কেন দেবে না! দাঁড়া আমি ওকে ফোন দিয়ে বলে দিচ্ছি।”
“আচ্ছা যা।”

মেঘলা কথা বলার জন্য চলে গেলো। আর আমরা সবাই আড্ডায় মেতে উঠলাম। এত কিছুর মাঝেও হাঁসি মজা করা উচিত। তবে একটু হলেও মনটা শান্ত হয় নয়তো দেখা যাবে অতিরক্ত চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়বো। আর তাছাড়াও এখন আমাদের সবার সামনে হাঁসি খুশি থাকতে হবে………

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে