#স্তব্ধের_স্নিগ্ধতা
#মাশফিয়াত_সুইটি(ছদ্মনাম)
পর্ব:১৭
স্নিগ্ধতাদের বাড়িতে তালা লাগানো দেখে স্তব্ধ বিষন্ন মন নিয়ে গাড়ির কাছে যেতেই পেছন থেকে কেউ ডেকে বলল,
– দুলাভাই আপনি এখানে?
স্তব্ধ পেছনে ঘুরে একটা ছেলেকে দেখলো কিন্তু চিনতে পারলো না। স্তব্ধের মুখের ভঙ্গি বুঝতে পেরে ছেলেটা এগিয়ে এসে বলল,
– আমি শুভ স্নিগ্ধা আপুর ছোট ভাই।
স্তব্ধ শুভর কথা আগে শুনেছে তবে কখনও না দেখায় চিনতে অসুবিধা হয়েছে।স্তব্ধ অস্থির গলায় প্রশ্ন করল,
– স্নিগ্ধ কোথায়? বাড়িতে তালা কেন?
– বাবা আবারো হার্ট অ্যাটাক করেছে হাসপাতালে ভর্তি মাও হাসপাতালে বাড়িতে কেউ নেই তাই তালা লাগানো ছিল আমি এসেছি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিতে।
স্তব্ধ চিন্তিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
– কখন এমন হয়েছে?
– আজ।
– আর স্নিগ্ধ?
– আপুর কথা জেনে কি করবেন? বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার আগে একবারও ভেবেছিলেন? আপনার কারণে মা আপুকে অনেক মে’রেছে আর বাবাও চিন্তায় অসুস্থ হয়ে গেছেন।
স্তব্ধের ভেতর অপরাধবোধ কাজ করছে কিন্তু এ ছাড়া তো কোনো উপায় ছিল না, স্তব্ধ অননুনয় করে বলল,
– নিজের ভুল শুধরে নিতে চাই প্লিজ বলো স্নিগ্ধ কোথায়?
– স্নিগ্ধা আপুকে শিরিন আপু সঙ্গে করে নিয়ে গেছে।
– শিরিন কে?
– আপুর বান্ধবী বাবার এমন অবস্থার কারণে আমি চলে এসেছি মা আপুকে সহ্য করতে পারছে না আপুকে পেলে মে’রেই ফেলবে আপুও অনেক অসুস্থ তাই শিরিন আপু নিয়ে গেছে তার বাড়িতে।
– শিরিনের বাড়ির এড্রেসটা দাও।
– শিরিন আপু তো বাসা পাল্টিয়ে ফেলেছে বর্তমান এড্রেস তো জানি না আর এখন আমায় হাসপাতালে যেতে হবে বাবা অনেক অসুস্থ।
– আচ্ছা চলো আমিও তোমার সঙ্গে যাব।
– এখন আপনার যাওয়া ঠিক হবে না মা খারাপ ব্যবহার করতে পারে।
স্তব্ধ জবাব দেওয়ার মতো কিছু পেল না তাই ওখান থেকে চলে গেল।
স্নিগ্ধতা শিরিনের সঙ্গে তার ফ্ল্যাটে এসেছে, নতুন চাকরির জন্য শিরিন কলেজের কাছাকাছি ফ্ল্যাট নিয়েছে আগে স্নিগ্ধতার বাড়ির পাশেই থাকতো। শিরিনের বাবা-মা স্নিগ্ধতাকে নিজের মেয়ের মতোই আদর করেন তবে তারা বাড়িতে নেই গ্ৰামের বাড়িতে গেছেন। স্নিগ্ধতা বিছানায় হাঁটু মুড়ে বসে কান্না করছে, শিরিন পাশে এসে বসে,
– আবারো কাঁদছিস কেন? যারা তোর কথা ভাবে না তাদের জন্য চোখের পানি অপচয় করার কি দরকার?
– আমি তো তাদের ভালোবাসি তারা আমার আপন মানুষ।
– স্তব্ধকে কি তুই ভালোবাসিস?
– হু।
– কখনও বলেছিস?
– উহু।
– বলিসনি কেন?
– বলার মতো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি তাই বলিনি।
– সম্পর্ক গড়ার আগেই ভেঙ্গে গেল এমনিতেও এটা হওয়ারই ছিল ছেলে মানুষকে জোর করে বিয়ে দিলে কখনো কি সম্পর্ক টিকে।
– এতে উনার তেমন দোষ নেই উনার মায়ের কারণে..
– এসব আমায় বুঝাস না তোর হাজব্যান্ড বাচ্চা নয় যে মা যা বলবে তাই শুনবে এসব বড়লোক ছেলেদের আমার চেনা আছে তোর এই ভালোমানুষীর কারণে আজ তোর এই অবস্থা তোকে যেন আর কাঁদতে না দেখি কারো সঙ্গে যোগাযোগ করারও চেষ্টা করবি না।
শিরিনের কথার উল্টো পিঠে কথা বলার সাহস নেই স্নিগ্ধতার। শাহিলী ওয়াজেদের কঠোরতার কারণেই স্নিগ্ধতা চুপচাপ স্বভাবের কখনও নিজের চঞ্চলতা প্রকাশ করতে পারেনি ছোট থেকেই অনেক মার হজম করে এত বড় হয়েছে কিন্তু মুখ ফুটে প্রতিবাদ করতে পারেনি ভয়ে।
_______________
শরীরের আঘাত গুলোর জায়গায় এখনও তিব্র ব্যথা, হাতে দাগগুলো দেখা যাচ্ছে শিরিন পরম যত্নে ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছে। মাঝরাতে শিরিন স্নিগ্ধতাকে টেনে ঘুম থেকে তুললো, স্নিগ্ধতা চোখ ডলতে ডলতে জিজ্ঞেস করল,
– সকাল হয়ে গেছে এত তাড়াতাড়ি?
– না, রেডি হয়ে আয় তোদের বাড়িতে যেতে হবে।
– রাতের বেলা বাড়িতে! কারো কি কিছু হয়েছে?
– গেলেই দেখতে পাবি।
স্নিগ্ধতা রেডি হয়ে আসতেই দু’জনে মিলে বের হয়ে গেল।এত রাতে গাড়ি পাওয়া দুষ্কর তাই শিরিন তার পরিচিত ক্যাব ভাড়া করেছে। গাড়ি চলছে নিজ গতিতে শিরিনি স্নিগ্ধতার হাত ধরে বলল,
– যাই হয়ে যাক মন শক্ত রাখবি একদম ভেঙে পড়বি না এই দুনিয়াতে কেউ স্থায়ী নয় সবাই একদিন না একদিন দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবে।
– কার কি হয়েছে? আচ্ছা বাবার কিছু হয়নি তো!
– বললাম তো গেলে সব জানতে পারবি।
এবার স্নিগ্ধতার অনেক চিন্তা হচ্ছে শিরিনকে আর প্রশ্ন করলো না কারণ সে জানে জিজ্ঞেস করলেও কোনো উত্তর পাওয়া যাবে না।
সকালে বাড়ি থেকে বের হয়েছে অথচ মাঝরাত হয়ে যাওয়ার পরেও বাড়ি ফেরেনি স্তব্ধ। বাড়ির সবাই অনেক চিন্তা করছে অরিত্রি শিকদারের তো যায় যায় অবস্থা। তিহান, রাতুল শিকদার অনেকবার কল দেওয়ার পরেও স্তব্ধ ধরেনি।
বড় এক লেকের ধারে বসে আছে স্তব্ধ এই প্রথম জীবনে একাকীত্ব অনুভব হচ্ছে।স্নিগ্ধতাকে ছাড়া সে ভালো নেই অনেক চেষ্টার পরেও স্নিগ্ধতাকে খুঁজে পায়নি।বাড়ি থেকে অনেক কল এসেছে দেখেও রিসিভ করেনি সবাইকে বিরক্ত লাগছে বিড়বিড় করে বলছে,’আমার স্নিগ্ধতাকে আমার থেকে আলাদা করার জন্য সবাই দায়ী ওদের কারণেই স্নিগ্ধ আমায় একা করে দিয়ে লুকিয়ে আছে।’
স্তব্ধ নিজের চুলগুলো শক্ত করে ধরে,’একবার ফিরে এসো না স্নিগ্ধ আর কখনও তোমাকে আমার থেকে দূরে যেতে দিব না।’
রাতুল শিকদারের নাম্বার থেকে স্তব্ধের ফোনে মেসেজ এসেছে।স্তব্ধ মেসেজ গুলো দেখতে লাগলো, মেসেজ দেখেই স্তব্ধ থমকে গেল দ্রুত গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিল।
বাড়ির সামনে এসে স্নিগ্ধতা দাড়িয়ে আছে মুখে ভয় ফুটে উঠেছে। শিরিন বলল,
– দাড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে চল।
– মা যদি আবার মারে?
– মারবে না আমি আছি তো।
ভয়ে ভয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকছে স্নিগ্ধতা, বাড়িতে অনেক আত্নীয় স্বজনের ভীড় কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে।স্নিগ্ধতার ভেতরটা কেঁপে উঠলো বসার ঘরে যেতেই থমকে গেল হাত-পা কাঁপা শুরু হয়ে গেছে।খাটিয়ায় কাফনে জড়ানো সানজিদ ওয়াজেদ শুয়ে আছে তার কিছুটা দূরে শাহিলী ওয়াজেদ আর স্নিগ্ধতার আপন ফুফু কান্না করছে কিছু মহিলা তাদের ধরে রেখেছেন।
স্নিগ্ধতার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, খাটিয়ার কাছে গিয়েই ঢপ করে বসে পড়লো।শাহিলী ওয়াজেদ স্নিগ্ধতাকে দেখেই অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়ে বলতে লাগলেন,
– এই অপয়ার জন্য আজ আমার স্বামী মা’রা গেছে ওরে আমি মে’রে ফেলব ছাড়ো আমায়।
শিরিন স্নিগ্ধতার কাধে হাত রাখতেই স্নিগ্ধতা বাচ্চাদের মতো কান্না করতে করতে জিজ্ঞেস করল,
– বাবা এভাবে শুয়ে আছে কেন? বাবাকে সাদা কাপড় পড়ানো হয়েছে কেন?
সানজিদ ওয়াজেদকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
– বাবা কি হয়েছে তোমার? কথা বলো আমার সঙ্গে ও বাবা কথা বলছো না কেন?
কোনো উওর না পেয়ে স্নিগ্ধতার পাগলামীটা বেড়ে গেল।শুভ স্নিগ্ধতাকে দূরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল,
– বাবা আর বেঁচে নেই আপু মৃত মানুষ কিভাবে কথা বলবে?
স্নিগ্ধতা থেমে গেল একবার বাবার দিকে আরেকবার শুভর দিকে তাকালো।ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,
– বাবা বেঁচে নেই?
শুভ স্নিগ্ধতাকে ছেড়ে বাবার লাশের মুখটা ঢেকে দিল। স্নিগ্ধতার মস্তিষ্কে কথাটা বারবার আঘাত করছে চারিপাশ ঝাপসা লাগছে, শরীর অসার হয়ে যাচ্ছে দাড়িয়ে থাকার শক্তি পাচ্ছে না। একপলক সানজিদ ওয়াজেদকে দেখেই হঠাৎ করে স্নিগ্ধতা অজ্ঞান হয়ে গেল মেঝেতে লুটিয়ে পড়ার আগেই স্তব্ধ ধরে ফেলল, নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরল।
সানজিদ ওয়াজেদের মৃত্যুর খবর শুনেই স্তব্ধ দ্রুত তাদের বাড়িতে চলে এসেছে। রাতুল শিকদার অরিত্রি শিকদার এবং তিহান নিজেদের মতো করে আলাদা এসেছে। নিস্তেজ অজ্ঞান স্নিগ্ধতাকে একটা ঘরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল স্তব্ধ। শিরিনও পেছনে পেছনে গেল, অরিত্রি শিকদার এগিয়ে গিয়ে বললেন,
– মুখে একটু পানি ছিটিয়ে দে জ্ঞান ফিরে আসবে।
শিরিন রূঢ় কন্ঠে বলল,
– জ্ঞান ফেরানোর দরকার নেই এভাবেই থাকুক, জ্ঞান ফিরলেই আঙ্কেলের জন্য পাগলামী করবে তখন ওকে সামলানো কঠিন হবে।
তিহান এতক্ষণে শিরিনকে খেয়াল করল।শিরিনকে এখানে দেখে বেশ অবাক হয়েছে তবে এখন এখানে কোনো প্রশ্ন করা উচিত হবে না। অরিত্রি শিকদার ব্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,
– তুমি কে?
– স্নিগ্ধার বান্ধবী, আপনি কে?
অরিত্রি শিকদার মুখটা কাঁচুমাচু করে,
– স্তব্ধের মা।
– ওহ আপনি স্নিগ্ধার সেই দজ্জাল শাশুড়ি।
– কি বললে?
– কিছু না।
স্তব্ধ স্নিগ্ধতার হাত ধরতে যাবে তখনি শিরিন স্নিগ্ধতার হাত সরিয়ে দিয়ে,
– স্নিগ্ধার থেকে দূরে থাকুন এখন আর মানবতা দেখাতে হবে না ।
স্তব্ধ কিছু বলতে যাবে তার আগেই রাতুল শিকদার স্তব্ধকে টেনে নিয়ে বাইরে চলে গেলেন। শুভর কাছ থেকে জানতে পেরেছেন, একবার বড়সড় হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছিল সেখান থেকে কোনমতে বেঁচে ফিরলেও ঠিক মতো ওষুধ না খাওয়ায় এবং অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় আবারো হার্ট অ্যাটাক করে একসময় হাসপাতালেই মা’রা যান সানজিদ ওয়াজেদ।
সানজিদ ওয়াজেদের মৃতদেহ দাফন করে সবাই বাড়িতে ফিরেছে।শুভ ভেঙ্গে পড়েছে কিভাবে সব সামলাবে তাই ভাবছে একদিকে বাবার মৃত্যুর শোক আরেকদিকে মা আর বোন। শাহিলী ওয়াজেদ স্নিগ্ধতার প্রতি নির্মম,কঠোর এবং খারাপ মা হলেও একজন আদর্শ স্ত্রী যে স্বামীকে অনেক ভালোবাসে স্বামীর মৃত্যুতে এখনও কান্নাকাটি করছেন।
স্নিগ্ধতার জ্ঞান ফিরেনি স্তব্ধ শিরিনের কারণে স্নিগ্ধতার কাছে যেতে পারছে না। শিরিন কাউকে স্নিগ্ধতার কাছাকাছি ঘেঁষতে দিচ্ছে না, অরিত্রি শিকদার অনুতপ্ত নিজের ছেলের ভালো থাকার জন্য এখন তিনি স্নিগ্ধতাকে আবারও স্তব্ধের জীবনে ফিরিয়ে দিতে চাইছেন নিজের ভুল শুধরে নিতে চান।
স্তব্ধ বেশ বিরক্ত হলো, মুখে রাগ ফুটে উঠেছে শিরিনকে পরোয়া না করে এবার গিয়ে স্নিগ্ধতাকে কোলে তুলে নিলো শিরিন ধমক দিয়ে বলল,
– কোলে নিলেন কেন ওকে? নামান বলছি কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন স্নিগ্ধাকে?
– আমার ওয়াইফকে যেখানে ইচ্ছে সেখানে নিয়ে যাব আপনি জিজ্ঞেস করার কে? আমাদের মাঝখানে আর যদি কেউ আসে তাহলে একদম ভালো হবে না।
বলেই স্নিগ্ধতাকে নিয়ে স্তব্ধ বেরিয়ে গেল। সবাই স্তব্ধের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।
________________
স্নিগ্ধতার জ্ঞান ফিরেছে আশেপাশে তাকাতেই পরিচিত ঘর দেখতে পেল নিজেকে স্তব্ধের বিছানায় আবিষ্কার করল পরক্ষনেই বাবার লাশটা চোখে ভেসে উঠতেই বিছানা থেকে উঠতে গেল কিন্তু স্তব্ধ এসে আটকে দিল।স্নিগ্ধতা ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
– আমাকে যেতে দিন আমি বাবার কাছে যাব।
স্তব্ধ স্নিগ্ধতার গালে হাত রেখে বলল,
– তোমার বাবা আর বেঁচে নেই উনাকে দাফন করা হয়ে গেছে।
– আপনি মিথ্যে বলছেন সরুন আমি বাবার কাছে যাব বাবা আমায় একা রেখে চলে যেতে পারে না।
– বাস্তবতা মেনে নাও স্নিগ্ধ তোমার বাবা আর নেই।
স্নিগ্ধতা এবার জোরে কেঁদে দিল আর স্তব্ধ তাকে নিজের বুকে আগলে ধরলো।বাবা যে মা’রা গেছে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে পৃথিবীতে আপন বলতে একটা মানুষই ছিল স্নিগ্ধতার,মা তো জম্ম দিয়েই ম’রে গেছে রেখে গেছে স্বার্থপর মানুষদের কাছে।
চলবে ………