#স্তব্ধের_স্নিগ্ধতা
#মাশফিয়াত_সুইটি(ছদ্মনাম)
পর্ব:১৪
নৌকায় করে হাওর বিলের মাঝামাঝি অবস্থান করছে স্তব্ধ,স্নিগ্ধতা। বাতাসে স্তব্ধের সিল্কি চুলগুলো বারবার কপালে চলে আসছে আর স্তব্ধ হাত দিয়ে সেগুলো কপাল থেকে সরিয়ে দিচ্ছে স্নিগ্ধতা আড়চোখে স্তব্ধকে দেখতে ব্যস্ত মনে মনে বলছে,’এই ছেলেটা একটু বেশিই সুন্দর।’
স্নিগ্ধতাকে পেছন থেকে গিয়ে জড়িয়ে ধরল স্তব্ধ, স্নিগ্ধতা পূর্বের ন্যায় দাড়িয়ে আছে স্তব্ধের এমন কাজ কর্মে স্নিগ্ধতা অভ্যস্ত হয়ে গেছে।স্তব্ধ আহ্লাদি কন্ঠে বলল,
– মহারানী এবার চলুন এখান থেকে বাড়িতে যেতে হবে তো।
– এত তাড়াতাড়ি? এখনও তো পুরো হাওর ঘুরাই হলো না।
– এখন পুরো হাওর ঘুরতে গেলে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভোর হয়ে যাবে আরেকদিন হাতে অনেক সময় নিয়ে এসে পুরোটা ঘুরে যাব।
স্নিগ্ধতা মনটা খারাপ করে বলল,
– আচ্ছা চলুন।
– রাগ করেছ?
– উহু।
– আমার তো মনে হচ্ছে আমার বউ রাগ করেছে।
স্নিগ্ধতা কিছু বলল না স্তব্ধ ঠোঁটে দুষ্টু হাসি এনে বলল,
– বউ রাগ করেছে জামাই হয়ে এটা মেনে নেওয়া অনৈতিক কাজ আসো তোমাকে হাম্মি দিয়ে রাগ ভাঙিয়ে দেই।
স্তব্ধের এমন কথা শুনে স্নিগ্ধতা কিছুটা চেঁচিয়ে,
– না আমি রাগ করিনি চলুন বাড়িতে যাব।
– উহু স্নিগ্ধ বেইবি এসব বললে আমি শুনছি না আমি তোমার রাগ ভাঙাবোই।
– আমি এবার জোরে জোরে কান্না করবো।
স্তব্ধ অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল,
– কান্না করবে কেন? কোথায় কি হয়েছে?
– এখনও কিছু হয়নি কিন্তু আপনি এখানে আমার সঙ্গে কিছু করলে কান্না করবো।
– আমার মতো একটা ভদ্র ছেলে তোমার সঙ্গে কি করবে? আমি তো শুধু হাম্মি দিতে চাইলাম।
– দেওয়া যাবে না মানুষ দেখবে।
– ওহ এই ব্যাপার দাড়াও ওদেরকে অন্যদিকে ঘুরতে বলি।
– এ কেমন লোক আমার কপালে জুটল? লাজ লজ্জা কিছু নেই।
– কি বলো আমার অনেক লজ্জা।
– তার নমুনা দেখতেই পাচ্ছি বাড়িতে যাব চলুন।
– বাড়িতে যাওয়ার এত তাড়া কিসের? দু তিনটে বাচ্চা রেখে এসেছ নাকি?
– আপনিই তো বললেন বাড়িতে যেতে হবে।
– আমি হাম্মি খাওয়ার কথাও বলেছি।
স্নিগ্ধতা কপালে হাত দিয়ে দাড়িয়ে রইল এবার সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর একটা কথাও বলবে না। স্নিগ্ধতাকে চুপ থাকতে দেখে স্তব্ধ বলল,
– আচ্ছা বাড়িতে যাই চলো তারপর হাম্মি দিব।
স্নিগ্ধতা এবারও কথা বলল না। নৌকা পাড়ে গিয়ে থামলো, স্তব্ধ এবং স্নিগ্ধতা দু’জনে নেমে গিয়ে গাড়িতে উঠল।
.
.
স্নিগ্ধতাকে নিয়ে শপিং করে রাতের ডিনার সেরে তারপর বাড়ি ফিরল স্তব্ধ।বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়েছে বাড়ির সবাই শুয়ে পড়েছে। স্নিগ্ধতা বালিশে শুতেই স্তব্ধ স্নিগ্ধতার আঙুলে চামটি কেটে বলল,
– বাড়িতে এসে তোমায় হাম্মি দেওয়ার কথা ছিল।
– এখনও ভুলেননি!
– হাম্মি কি ভুলার জিনিস নাকি? বউকে ঘুমানোর আগে হাম্মি দেওয়া জামাই হিসেবে আমার একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ কাজ আর আমি আমার কাজে অবজ্ঞা করতে পারি না।
স্নিগ্ধতা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
– আপনার মতো কাজের ক্ষেত্রে ফাঁকিবাজ ছেলে আমি দু’টো দেখিনি আপনার বাবা তো আপনাকে টেনে হিচড়ে অফিসে নিয়ে যায় আবার বড় বড় কথা বলেন।
– তুমি বউ বউয়ের মতো রোমান্টিক কথা বলবা তা না করে তুমি কেন ঠেস দিয়ে কথা বলে অপমান করবে আজব।
– গুড নাইট।
– আমার হাম্মি?
– ঘুমান।
স্নিগ্ধতা চোখ বুজে নিলো, স্তব্ধ পরাজিত ভঙ্গিতে ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করল।
______________
রাত পেরিয়ে আরো একটা দিনের আগমন হলো। তিহানের গাড়ি চলছে কলেজের দিকে,ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে তিহান পেছনে বসে জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছে হঠাৎ কাউকে দেখে ড্রাইভারকে সাইড করে গাড়ি থামাতে বলল। তিহান জানালা দিয়ে তাকিয়ে বলল,
– এই পিচ্চি থুরি এই শিরিন ম্যাডাম।
শিরিন কন্ঠস্বর অনুসরণ করে তিহানের দিকে তাকিয়ে ব্রু জোড়া কুঁচকে নিলো।তিহান আবারো ডেকে বলল,
– এখানে দাড়িয়ে আছেন কেন?
– রিক্সার জন্য।
– মনে হয় না এখন রিক্সা পাবেন আমিও কলেজে যাচ্ছি গাড়িতে উঠুন একসঙ্গে যাওয়া যাক।
– দরকার নেই আপনি যান।
– আপনাকে রেখে তো যেতে পারি না এক জায়গায়ই তো দু’জনে যাব।
– বললাম তো আপনি যান।
– আপনি কি আমার সঙ্গে যেতে ভয় পাচ্ছেন?
শিরিন রেগে গিয়ে বলল,
– শিরিন কাউকে ভয় পায় না।
– তাহলে গাড়িতে উঠছেন না কেন?
শিরিন আর উপায় না পেয়ে গাড়িতে উঠে গেল।তিহানকে মুখ বাঁকিয়ে বলল,
– গাড়িতে উঠেছি বলে এই নয় আপনার সঙ্গে ঝামেলা মিটে গেছে।
– আপনি কি আরো ঝগড়া করতে চান!
– ঝগড়া করা আপনার স্বভাব আমি তো শুধু উওর দেই।
– ওহ আচ্ছা।
তিহান আড়চোখে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘নিজে ঝগড়া করে আমার নামে দোষ দেয় অসভ্য মেয়ে।’
গাড়ি কলেজের সামনে থামতেই শিরিন দ্রুত নেমে গিয়ে ভেতরে চলে গেল।তিহান আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে,’একটা ধন্যবাদ দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না!’
রাহেলা বেগমের পায়ে ব্যথা বেড়েছে স্নিগ্ধতা কুসুম গরম তেল দিয়ে পা টিপে দিচ্ছে। রাহেলা বেগম চোখ বন্ধ করে বললেন,
– ব্যথাটা কমেছে তোর হাতে জাদু আছে নাত বউ, এবার আমার পাশে এসে একটু বস।
স্নিগ্ধতা রাহেলা বেগমের পাশে গিয়ে বসল। রাহেলা বেগম আবারো বললেন,
– একটা পান বানিয়ে দে।
– একটু আগেই পান খেলে এখন আবার।
– দে না।
– ডাক্তার তোমায় এত পান খেতে নিষেধ করেছে দিদান।
– তুইও বাকিদের মতো বলছিস?
– তোমার ভালোর জন্যই বলছি।
রাহেলা বেগমের ঘরে এলেই স্নিগ্ধতার একাকীত্ব দূর হয়। রাতুল শিকদার ইদানিং অফিসে খুব ব্যস্ত থাকেন তবে স্নিগ্ধতার খবর নিতে ভুলেন না সানজিদ ওয়াজেদ বাবা হয়ে মেয়ের জন্য যা করতে পারেননি রাতুল শিকদার স্নিগ্ধতার জন্য তাই করছেন নিজের মেয়ের মতো আগলে রাখছেন।স্তব্ধ আগের থেকে কিছুটা ম্যাচিউর হয়েছে।
স্নিগ্ধতার মোবাইলে একটা নাম্বার থেকে আটটা কল এসেছে। পরিচিত ভেবে স্নিগ্ধতা কল ব্যাক করতেই আদ্রিক কল রিসিভ করে বলল,
– অতঃপর তুমি কলটা ধরলে স্নিগ্ধতা।
আদ্রিকের কন্ঠস্বর শুনে স্নিগ্ধতার ভেতরে পুরনো ভয়ের সঞ্চার হলো কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
-আ..আদ্রিক!
– চিনেছ তবে? যাই হোক অনেকদিন তোমার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হয় না একবার কি আমার সঙ্গে দেখা করবে?
– আপনি কেন আমার পেছনে পড়ে আছেন? কেন এমন করছেন?
– তা তো তুমি বেশ ভালো করেই জানো, তোমার সঙ্গে আমার অনেক হিসাব নিকাশ বাকি আছে, তোমার হাজব্যান্ড স্তব্ধ শিকদার শুধুমাত্র তোমার কারণে আদ্রিক খাঁনের গায়ে হাত তুলেছে তোমাদের দু’জনকেই এর ফল ভোগ করতে হবে তবে তোমাকে অত কষ্ট দিব না।
– স্তব্ধ আপনাকে আমার কারণে মে’রেছে!
– কেন তোমায় কিছু বলেনি?
– বাবার কাছ থেকে শুনেছি আপনাকে মে’রেছে কিন্তু কারণটা জানি না আমার জন্য কেন মা’রলো?
– স্তব্ধের কাছ থেকে জেনে নিও আর হ্যা খুব শিঘ্রই আমাদের দেখা হবে আর সেদিন তোমাকে আমার হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না স্নিগ্ধা রানী।
কল কেটে দিল আদ্রিক। মোবাইল পাশে রেখে বিছানায় বসে পড়ল স্নিগ্ধতা বিষ্মিত স্বরে বলল,’আমার কারণে আদ্রিককে উনি মে’রেছেন কি এমন ঘটেছে কি বলেছে আদ্রিক আমার নামে? পুরোটা যদি জানে তাহলে কি হবে আদ্রিকের! আবারও ঝড়ের মতো জীবনে আসতে চাইছে আদ্রিক স্তব্ধের কোনো ক্ষতি করে দিবে না তো?
সন্ধ্যা থেকে নিজেকে ঘরবন্দি করে রেখেছে স্নিগ্ধতা নিচে যেতে ইচ্ছে করছিল না রাতে খাওয়া হয়নি। ঘরে সন্ধ্যাবাতিও জ্বালানো হয়নি। রাতে বাড়ি ফিরে নিজের ঘর অন্ধকার দেখে বেশ বিরক্ত হলো স্তব্ধ। আলো জ্বালাতেই বিছানায় স্নিগ্ধতাকে শুয়ে থাকতে দেখল। স্নিগ্ধতা টের পেয়েছে স্তব্ধ এসেছে কিন্তু স্তব্ধ চুপচাপ আলমারি থেকে পোশাক নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।
ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় বসলো,স্নিগ্ধতা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল,
– এখানে খাবার নিয়ে আসব নাকি নিচে যাবেন?
– খেয়ে এসেছি।
– ওহ।
কিছুক্ষণ দু’জনের মধ্যে নিরবতা চললো স্তব্ধ নিরবতা ভেঙ্গে গম্ভীর গলায় বলল,
– একটা কথা কি জানো স্নিগ্ধ? কাউকে কাছে টেনে নিতে যেমন আমার সময় লাগে না তেমনি কাউকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিতেও সময় লাগে না।
স্নিগ্ধতা অস্থির গলায় বলল,
– হঠাৎ এই কথা? আমাকেই বা কেন বলছেন?
– বলতে বাধ্য করেছ তুমি, তোমাকে যেমন নিজের ওয়াইফ হিসেবে মেনে নিতে এবং কাছে টানতে বেশি সময় লাগেনি তেমনি তোমাকে আমার থেকে দূরে সরাতে বেশি সময় লাগবে না তবে তোমাকে আমি নিজের থেকে দূরে সরাবো না কারণ তুমি এ ক’দিনেই আমার জীবনের বিশেষ একটা অংশ হয়ে গেছ যাই করো না কেন আমাকে জানিয়ে এবং ভেবে চিন্তে করবে তুমি না জানালেও আমি কিন্তু কোনভাবে সব জেনে যাব আর যদি জেনে যাই আর তোমার কারণে আমি কষ্ট পাই সেদিন তুমি আমার ভয়ংকর রূপ দেখতে পাবে আশা করি কথাগুলো মাথায় রাখবে আমি চাই না তোমার সঙ্গে খারাপ কিছু করতে।
স্তব্ধের ঠান্ডা হুমকি গুলো স্নিগ্ধতার ভেতরে কম্পন সৃষ্টি করছে।স্তব্ধ উল্টো পাশ হয়ে শুয়ে পড়েছে, স্নিগ্ধতাও পাশে শুয়ে পড়ল শরীর গরম হয়ে যাচ্ছে শীত লাগছে একের পর এক ঝড় তার জীবনেই কেন আসে বুঝতে পারে না যখনি সুখ ধরা দেয় তখনি কষ্ট গুলো এসে মাঝখানে বাঁধা সৃষ্টি করে। চোখ জোড়া ভিজে উঠেছে নিজের মায়ের মুখটা ভেসে উঠেছে চোখের সামনে,স্নিগ্ধতার চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে,’মা কেন এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আমায় একা ফেলে গেলে আমার যে তোমাকে খুব দরকার, তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমানোর দরকার একটু ভালোবাসার দরকার।’
কথাগুলো ভেতরেই আটকে আছে বলা আর হচ্ছে না। চোখগুলো খুলতে পারছে না মাথায় অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে এই যন্ত্রনা নিরাময়ের ওষুধের খোঁজ এখনও স্নিগ্ধতা পায়নি। শরীর যেন অবশ হয়ে গেছে চেষ্টা করেও নড়াতে পারছে না বাবার কথা মনে পড়ছে কেন জানি মনটা কু ডেকে উঠছে হঠাৎ করেই বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করছে স্নিগ্ধতার। বিড়বিড় করে বলছে,’বাবা তোমায় দেখতে ইচ্ছে করছে একটু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে স্নিগ্ধা মা বলে ডাকবে?’
স্নিগ্ধতার গুঙরানির শব্দে পাশ ফিরে তাকালো স্তব্ধ, নরম কন্ঠে ডাক দিলো,
– স্নিগ্ধ কি হয়েছে?
কোনো উওর এলো না স্নিগ্ধতা বিড়বিড় করে কথা বলেই যাচ্ছে স্তব্ধ শোনার চেষ্টা করল কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলো না।স্তব্ধ স্নিগ্ধতাকে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো,স্নিগ্ধতার শরীর অনেক গরম জ্বর এসেছে স্তব্ধ শোয়া থেকে উঠে আলো জ্বালিয়ে থার্মোমিটার দিয়ে পরীক্ষা করতেই চমকে গেল বিষ্মিত স্বরে বলল,
– ১০৪ ডিগ্ৰি জ্বর!
ভয় আর অস্থিরতা একসঙ্গে দেখা দিলে স্নিগ্ধতার জ্বর উঠে এটা যেন তার এক রোগ। ছোট থেকেই অনেক এমন হয়েছে তখন ভয়ের কারণ ছিলেন শাহিলী ওয়াজেদ। এমন অনেক রাত গেছে স্নিগ্ধতা জ্বর নিয়ে বিছানায় ছটফট করেছে কিন্তু কাক পক্ষীও টের পায়নি শাহিলী ওয়াজেদের ভয়ে কখনও মুখ ফুটে সানজিদ ওয়াজেদকে কিছু বলতে পারেনি। সানজিদ ওয়াজেদও বাড়িতে অশান্তি হওয়ার ভয়ে কখনও অন্যায়ের প্রতিবাদ করেননি তবে এ নিয়ে মনে মনে অনেক অভিমান পুষে রাখলেও বাহিরে কখনও প্রকাশ করেনি স্নিগ্ধতা। কোনো অভিযোগও করেনি। আজ স্নিগ্ধতার এই জ্বরের ছটফটানি দূর করার জন্য সেবা করার জন্য একটা নিজের মানুষ হয়েছে ভালো মন্দ দেখার মতো একটা মানুষ হয়েছে।
সুখ বারবার তার কাছে আসতে চাইছে আবার চলেও যাচ্ছে।
চলবে……..