#সোনার সংসার
#লেখিকাঃ সাদিয়া সিদ্দিক মিম
#পর্বঃ১
আমি কখনও মা হতে পারব না বলে আজ আমার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করছে।আমাকে দুদিন যাবৎ একটা ঘরে আটকে রেখেছে।আমার শ্বাশুড়ি বলেছে আমার মত অলক্ষী,অপয়ার ছায়া যাতে তার ছেলের উপর না পড়ে।বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেও বলেছিল কিন্তু যাওয়ার কোন জায়গা নেই বলে মুখ বুঝে সবটা শয্য করছি।যাওয়ার জায়গা নেই বলতে আমার আজ সব থেকেও কিছু নেই।সবই আমি হারিয়েছি সাত মাস আগে।আমি আমার স্বামীর বিয়েটা চুপচাপ মেনে নিয়েছি,কারন আমি ত কখনও আমার স্বামীকে সন্তান সুখ দিতে পারব না,আর না পারব তাদের বংশধর দিতে।
হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে আমার ধ্যান ভাঙ্গে,,,সামনের ব্যাক্তিটিকে দেখে আমার চোখ জোড়া ছলছল করে উঠে।সামনে থাকা ব্যাক্তিটি আর কেউ নয় আমারই স্বামী শরীফ আহনাফ।সে ধীর পায়ে আমার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে আলতো হাতে আমার গাল ছুঁয়ে কপালে ভালবাসার পরশ একে দেয়।আমি তার স্পর্শে চোখ বন্ধ করে অনুভব করি,,,পরমুহূর্তেই মনে পড়ে যায় আজ ত তার বিয়ে এখন সে এখানে কীভাবে?তবে কী বিয়েটা হয়ে গেছে!সে কী আজ অন্য কারো হয়ে গেলো?ভাবতেই বুকের ভিতর তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণ নিজেকে যতই বোঝাই না কেন এখন আর নিজেকে শক্ত রাখতে পারছি না।ইচ্ছে করছে তাঁকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতে।যেখানে সে শুধু আমার হবে,শুধু আমার হবে।এসব ভাবতেই চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।আমার চোখের পানি তিনি সযত্নে মুছে দিয়ে বলে উঠে,,,
“ক্ষমা করো আমাকে।”
কথাটা শোনার পরেই একটা ব্যাথা অনুভব করি,আর ডলে পড়ি তার বুকে।সে পরম আবেশে আমাকে বুকে আগলে নেয়।
____________________________
যখন আমার জ্ঞান ফিরে তখন নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করি।আমি ধরফরিয়ে বিছানা থেকে উঠতে গেলেই হাতে টান অনুভব করি।হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি স্যালাইন লাগানো,পরক্ষণেই স্যালাইন এর ক্যানেলটা টান দিয়ে খুলতে গেলে আরেকটা হাত আমার হাত ধরে ফেলে।আমি তাকিয়ে যাকে দেখি তাকে দেখার জন্য মোটেও প্রস্তত ছিলাম না।কিন্তু তাকে দেখে আর চোখেরজল আটকে রাখতে পারি না।তাই জাপিয়ে পড়ি তার বুকে আর হাউমাউ করে কাঁদতে থাকি,,,
“আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি মা,আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি।আমার সোনার সংসার ভেঙ্গে গেছে মা,,,আমার স্বামী আজ অন্য কারো হয়ে গেছে।আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি মা,সব হারিয়ে আজ আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি।”
মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলে উঠে,,,
“কে বলল তুই নিঃস্ব হয়ে গেছিস হে,আমরা আছি তোর পাশে।তোর পুরো পরিবার আছে তোর পাশে,তুই শান্ত হ মা।”
“একটা বেঈমানের জন্য না করো কাঁদতে তোমার মেয়েকে,ভালবাসা ফুরিয়ে গেছে ছেড়ে দিয়েছে।দুইদিনের ভালবাসার জন্য তোমার মেয়ে তার পরিবার পরিজন সব ছেড়ে চলে গিয়েছিল।এখন সব ভালবাসা শেষ হয়ে গেছে তাই ফেলে চলে গিয়েছে।”
দরজা দিয়ে ডুকতে ডুকতে কথাটা বলল শাহজাহান সাহেব।আমি বাবার কন্ঠ শুনে মাকে ছেড়ে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি বাবা দাঁড়িয়ে আছে আর তার পাশেই আমার ছোট দুই ভাই ফরহাদ আর আরাফাত।মা বাবাকে ধমকে বলে উঠল,,,
“তুমি থামো,মেয়েটার এমনিতেই মন মানসিকতা ভালো না তার উপর তুমি এভাবে বলে মেয়েটাকে আর কষ্ট দিও না।”
বাবা মায়ের কথা শুনে চুপচাপ কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন।আর তখনই আমার পাশে আমার ছোট ভাই আরাফাত এসে আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,,,
“আপু তুই কাঁদিস না প্লিজ,তকে যে বা যারা কষ্ট দিয়েছে তাকে আমরা দুই ভাই কঠিন শাস্তি দিব।”
ছোট ভাইটার কথা শুনে তাকে বুকে আগলে ধরে আবারও কেঁদে উঠি আমি তখনই পাশে থেকে ফরহাদ ধমকে বলে উঠে,,,
“এত কাঁদিস কেন বল ত?তরা মেয়েরাও না এই একটা কাজই করতে পারিস।কান্না বন্ধ কর নয়ত এই হসপিটালের ছাদঁ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিব।”
“এই তোরা থামবি,এখান থেকে যা ত তরা তোদের আপুর সাথে আমার কথা আছে,যা এখন এখান থেকে।”
মায়ের কথা শুনে চুপচাপ ফরহাদ,আরাফাত বের হয়ে যায় কেবিন থেকে।তখন মা আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠে,,,
“তোর বাবার কথায় কিছু মনে করিস না মা,জানিসই ত মানুষটা কত রাগি আর তুই সেদিন শরীফের সাথে পালিয়ে গেলি সেটা তোর বাবা এতদিনেও মেনে নিতে পারে নি।তাই ওভাবে বলে ফেলেছে তুই কষ্ট পাস না মা।”
“না মা কী মনে করব?বাবা তার জায়গায় ঠিকই আছে।কিন্তু মা আমি এখানে কীভাবে আর তোমরাই বা এখানে কীভাবে?”
আমার কথা শুনে মা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠল,,,
“হসপিটাল থেকে ফোন দিয়ে তোর কথা বলল তখন সেটা শুনেই আমরা আসলাম।”
“কিন্তু আমি ত ঐ বাড়িতে ছিলাম,এখানে কীভাবে এলাম আমি।”
মা আমার কথা শুনে আবারও কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠল,,,
“সেটা তুই ই ভালো জানবি,এখন এসব বাদ দিয়ে একটু খেয়ে নে তারপর বাড়িতে ফিরব আমরা।”
মার কথাশুনে ভাবতে লাগলাম আমি কীভাবে এখানে এলাম।তখনই মনে পড়ল গাড়ে কিছু একটা ব্যাথা অনুভব হওয়ার পর জ্ঞান হারাই তারপর আর কিছু মনে নেই।তখন মা আমার মুখের সামনে খাবার তুলে বলে উঠে,,
“হা কর,স্যুপটা খেয়ে নে।”
“আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে না মা,আমি এখন কিছু খাব না।আমাকে বাড়িতে নিয়ে চলো।আমার এখানে দম বন্ধ হয়ে আসছে মা।”
“বাড়িতে নিয়ে যাব ত,কিন্তু তার আগে খেয়ে নে নয়ত বাড়িতে নিয়ে যাব না।”
অতঃপর মায়ের জোরাজুরিতে খেয়ে নিলাম।
__________________________
“আমি সাদিয়া,গতবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি।তারপর আর পড়ার সৌভাগ্য হয় নি,শরীফের সাথে তিন বছরের রিলেশন ছিল।বাড়িতে জানানোর পর দুই পরিবারের কেউ মেনে নেয় নি তাই ভালবাসার পূর্নতা দেয়ার জন্য পালিয়ে বিয়ে করি।বিয়ের পর আর পড়াশোনার কথা মাথায় আনি নি।বাবা,মা ছোট দুই ভাই নিয়ে আমার পরিবার,,,আমার ছোট দুই ভাই টুইন।আমার বাবা ছোটখাটো একটা ব্যাবসা করে আর মা গৃহিনী।ছোট দুই ভাই ক্লাস এইটে পড়ছে।”
“শরীফের পরিবারে তার বাবা,মা,বড় এক ভাই, ভাবি আর তাদের মেয়ে স্বর্না এক বছর বয়স আর ছোট এক ভাই অমিত,সে ক্লাস সেভেনে পড়ছে।তাদের সাথে তাদের চাচা,চাচী,চাচাত বোন নিলুফাও থাকে।নিলুফা আপু শরীফের এক বছরের ছোট।অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে এবার।শরীফ এবার ডিগ্রি থার্ড ইয়ারে পড়ছে আর তার পাশাপাশি বাবা আর বড় ভাইয়ের সাথে বিজনেস সামলাচ্ছে।”
🍁🍁কেটে গেছে এক মাস,এই এক মাসে অনেক কিছু পাল্টে গেছে।নিজেকে যতটা সম্ভব শক্ত করার চেষ্টা করছি।সারাদিন নিজেকে যতই শক্ত রাখি কিন্তু রাতের বেলা আর পারি না।তখন মন খুলে কাদি।কেউ সে কান্না দেখে না,শরীফের সাথে বারবার কথা বলতে ইচ্ছে করে।সে কী আমাকে ভুলে গিয়ে তার নতুন বউকে নিয়ে সুখে আছে আমার কথা কী তার একবারও মনে পড়ে না,,,এসব ভেবে খুব কষ্ট হয়।আমার বাবাও এ কয়দিনে আগের থেকে অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে।কিন্তু বাবা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছি ঐ পরিবারের কারো সাথে কোন যোগাযোগ করা যাবে না।তাই আমিও আর কারো সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি নি।ঐ বাড়িতে কারো সাথে কথা বললেই পুরনো ক্ষতটা আবার নতুন হয়ে উঠবে।আর মা সবসময় চোখে চোখে রাখে আমাকে।ছোট দুইটা ভাইও সারাদিন পাশে পাশে থাকে,,,স্কুল থেকে ফিরেই তাদের গল্পের ভান্ডার খুলে বসবে কী কী করেছে সারাদিন স্কুলে।মা চাইছে আমি ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে জীবনটা নতুন করে সাজাতে।আমিও রাজি হয়ে যাই পড়াশোনার মধ্যে থাকলে ত নিজেকে ব্যাস্ত রাখতে পারব।ব্যাস্তাতার মধ্যে থাকলে হয়ত শরীফ আহনাফ নামের লোকটার কথা ভুলে থাকতে পারব।
রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়ার পরপরই ফোনটা বেজে উঠে।আমি রিসিভ করে বলে উঠি,,,
“হ্যালো আসসালামু আলাইকুম।”
“———”
“হ্যালো,কে বলছেন আপনি?”
“———-”
“আজব ত কথা না বললে ফোন কেন দিয়েছেন?”
কথাটা বলে রেগে ফোনটা রেখে দেই আর শুতে চলে যাই।
অন্যদিকে ফোনের ওপর পাশের মানুষটা একটা তৃপ্তির হাসি হাসে।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নিলাম।কালো একটা গাউন পরেছি তার সাথে ম্যাচিং হিজাব।চোখে কাজল আর ঠোঁটে হালকা গোলাপি কালার লিপস্টিক।কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে নিচে নেমে এলাম তারপর বাবার সাথে চললাম ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।বাবার পরিচিত একজনের ভার্সিটিতেই ভর্তি করাবে।দীর্ঘ এক ঘন্টা পর ভার্সিটিতে পৌঁছালাম আমরা তারপর বাবা আমাকে ভর্তি করিয়ে দিয়ে চলে যায় গাড়ি নিয়ে তার কাজে।ভার্সিটির ছুটির সময় আবার এসে নিয়ে যাবে।ভার্সিটির একজন দারোয়ান আমাকে নিয়ে যাচ্ছে আমার ক্লাসে।আমি নিজেকে যতটা সম্ভব গুটিয়ে রেখেছি,,,নতুন ভার্সিটি নতুন সবকিছু।কাউকে চিনি না কীভাবে কী করব এসব ভেবে খুব নার্ভাস আমি।
এসব ভাবতে ভাবতে হাঁটছিলাম তখন কেউ একজন আমাকে জড়িয়ে ধরে।এমন ভাবে ধরেছে যে তাকে দেখতেও পারছি না।
#চলবে,,,