#সোনার_কন্যা
#পর্ব৫
#রাউফুন
নুরিশা ঘুম থেকে উঠলো বিষন্ন মন নিয়ে। আজ থেকে কলেজে পরীক্ষা শুরু। তার পড়া কমপ্লিট হয়নি। ফিজিক্সে সে দূর্বল। তারপর দেরি করে ঘুমানোর জন্য উঠতেও দেরি হলো। সে আগের তুলনায় আরও বেশ গম্ভীর হয়ে গেছে। সে সঠিক সময় কলেজের জন্য তৈরি হয়ে বের হলো। মনটা বড্ড অস্থির হয়ে আছে। কেনো যেনো এক্সামের আগে তাজফিকে দেখতে চাইছে। মাঝে মধ্যেই লোকটাকে দেখার তৃষ্ণায় ধুঁকে ভেতরে ভেতরে। কেন এই রকম মনোবাঞ্ছা হয় তার উত্তর নুরিশার কাছে থাকলেও নিজেই সেই উত্তরকে উপেক্ষা করে চলে সে। নিজের অনুভুতির কাছ থেকে নিজেই পালিয়ে বেড়াই সে। নুরিশা ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসলে আনিকা খাবার দিলো সামনে। নুরি একটু খেয়ে উঠতে নিলে আনিকা আবার বসিয়ে দিলো। কড়া গলায় বললো,
‘নুরি, এইটুকু খাবার কেন খাচ্ছিস? ঠিক করে না খেয়ে গেলে মাথা ঘুরে পড়ে যাবি পরীক্ষার হোলে!’
‘আমার বমি আসে ভাবি। কি করবো? যেটুকু পারছি খেয়ে নিচ্ছি।’
‘একটুও খাবার রাখলে আছাড় দিবো। তোর ভাইকে আমি বলে দিবো তুই খাচ্ছিস না।’
‘উফফ ভাবি, আগে আম্মা জ্বালাতন করতো এখন তুমি! আম্মা উঠেছেন?’
‘নাহ! মায়ের শরীর ভালো না আজকে।’
‘সেকি! আম্মার শরীর খারাপ, আর আমাকে কেউ বলো নি একবারও?’
‘আহা তোর পরীক্ষা, তুই পড়ছিলি। তাই মা বারণ করেছিলো যেনো তোকে না জানাই!’
‘একদম ঠিক করোনি এটা।’
‘আনিকা, খাবার হয়েছে? মায়ের শরীর কেমন এখন?’
‘এই তো হয়েছে, আপনি বসুন খেতে বসুন!’
‘খাওয়াও তোমার বরকে আমি যায়। আমি হাড্ডি হতে চাই না। যাই।’
‘ইশ, তোর এতো পাকামো করতে হবে না।’
রেহান নুরিশার পাশের চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,’কি রে নুরি, আজকে কি পরীক্ষা?’
‘ফিজিক্স!’
‘ফিজিক্স পারছিস?’
‘পারছি!’
‘কোনো সমস্যা হলে তাজফি ভাইয়ের কাছে যেতে পারিস! তাজফি ভাই দারুণ পড়াই!’
নুরিশা কিছু বললো না। নামটা শুনলেই তার গলায় কাটার মতো খাবার আটকে যায়। ঠিক সেদিনের মতো অনুভুতি হয়। একটা অদ্ভুত যন্ত্রণা দায়ক মিষ্টি অনুভূতি। আঠারো বছরের কিশোরীকে এখনো যখন লোকটা বালিকা সম্বোধন করে, তখন নুরিশা রাগ করতে পারে না আগের মতো। সেবার প্রথম যখন সাত দিন তাজফিকে দেখেনি, নুরিশা বুঝেছিলো, লোকটার শূন্যতা তাকে ভাবাচ্ছে, অন্তর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিচ্ছে। কিন্তু হায়, লোকটা এতো তাকিয়ে থাকে কিন্তু মনের কথা ব্যাক্ত করতে পারে না। ভেতর থেকে একটা চাপা শ্বাস ছেড়ে নুরিশা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলো।
রেহান আর আনিকার বিয়ের এক বছর হলো। হঠাৎই আনিকার বিয়ে ঠিক করে বাসা থেকে। রেহানকে জানানোর পর জেদ ধরে পরিবার নিয়ে হাজির হয়েছিলো আনিকার বাড়িতে। মতিউর রহমান অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে প্রস্তাব দিলেও আনিকার বাবা রাজি হোন না৷ রেহানের মতো এমন বেকার ছেলের কাছে মেয়ে দিতে রাজি না তিনি। সবশেষে রেহান সরাসরি বলেছিলো,’আংকেল আমি আপনার মেয়েকে ভালোবাসি, তাকে বিয়ে করতে চাই। আজই বিয়ের ব্যবস্থা করুন৷ না হলে ঘটনা কিন্তু ঘটে যাবে। আর যদি আপনি চান যে মেয়েকে বড়, অনুষ্ঠান করে বিদায় দিবেন, তবে অনুষ্ঠান হবে। কিন্তু আজ না। আজ, এই মুহুর্তে আপনার মেয়েকে, আমি আমার সঙ্গে নিয়ে আমার বাড়ি যাবো। বৈধ ভাবে, সম্পুর্ন সম্মানের সঙ্গে! আমার বাড়িতে আমার মায়ের আরেকটা মেয়ে হয়ে সে আমার বাড়িতে থাকবে।’
আনিকার বাবা ফরিদ চৌধুরী ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন,’তোমার মতো ম্যানার্সলেস, বেয়াদব ছেলের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দেবো ভাবলে কিভাবে?’
‘আপনি মেয়ে দিতে বাধ্য। না হলে বাড়িতে হরতাল চলবে। পুরো এলাকায় রটিয়ে দেবো আপনার মেয়ে আমার বউ। এখন আমার বউ হওয়ার পরেও আমাকে পছন্দ না বলে অন্যত্র মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইছেন আবার। ঘটনা কতদূর যাবে ভাবতেও পারবেন না। তখন কিন্তু আপনার মেয়ের এমনিতেও বিয়ে হবে না। আমার কাছেই মেয়ে দিতে হবে। নিজের কথা ফিরিয়ে নিতে হবে কিন্তু!’
আনিকা শুধু জ্বলজ্বল করে দেখছিলো রেহানের কর্মকান্ড! ভয়ে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায় তার। এভাবেও কেউ বলতে পারে? এতো দুঃসাহস কেন এই লোকটার? তার এমন ব্যবহারে যে তার বাবা আরও রেগে,অসন্তুষ্ট হচ্ছে লোকটা কি বুঝতে পারছে না?
‘তুমি যে অত্যন্ত অভদ্র, অসামাজিক, গাধা ছেলে তা কি জানো?’
‘হ্যাঁ জানি, আপনার মেয়েও জানে সেটা! কি জানেন না আনিকা?’ রেহানের তেছড়া উত্তরে ফরিদ চৌধুরী আরও রেগে যান।
আনিকার মাথা কা’টা যাচ্ছিলো রেহানের এরকম অসন্তোষ জনক ব্যবহারে। পরিস্থিতি খারাপ দেখে সে দ্রুত সবার সামনে থেকে উঠে চলে যায়। সে চাইলেও বাবার মুখের উপর কথা বলতে পারবে না। কারণ সে তার বাবাকে অত্যন্ত সমীহ করে, সম্মান করে। সেই সম্মানিত মানুষটার মুখে মুখে কথা বলার মতো দুঃসাহসিক কাজ করছে রেহান। রেহানকে পাওয়ার ইচ্ছেটা বোধহয় এখানেই ছেড়ে দিতে হবে।
ছেলের এমন অভদ্র আচরণে মতিউর রহমাজ হতাশ হোন। লজ্জায়, অপমানে তার মুখ থমথমে হয়ে গেছে৷ রাম ধমক দিলেও সে থামেনি। শেষমেষ মতিউর রহমান ছেলেকে সবার সামনে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছেন। থাপ্পড় খেয়েও রেহান নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে ছিলো। মতিউর রহমান চেয়েও ছেলেকে এক চুল নড়াতে সক্ষম হয়নি। অধৈর্য হয়ে মতিউর রহমান সহ সবাই চলে আসেন। যাওয়ার আগে আনিকার বাবা ফরিদ চৌধুরীর কাছে ক্ষমা চেয়ে যান। কিন্তু রেহানও আনিকাকে বিয়ে না করে নড়বে না। পুরো বারো ঘন্টা একভাবে বসে থেকে আনিকাকে বিয়ে করে, তার সঙ্গে নিয়ে তবেই ফিরেছে৷ তার এমন একরোখা কান্ডে মতিউর রহমানকে কম ভুগতে হয়নি। ওঁদের বিয়ের ঘটনা মনে হলে এখনো সবাই হাসে।
সব শেষে নুরিশা দাদির কাছে গেলো। তার দাদী এখন প্যারালাইজড একদম। শুধু ডান হাত নাড়াতে পারে আর কথা বলতে পারে। চোখেও কম দেখছেন তিনি আজকাল। বয়সের ভাড়ে চামড়া ঝুলে গেছে উনার। শরীরের হাড় ছাড়া কিছু দেখা যায় না। দাদির থেকে দোয়া নিতে নুরিশা ভেতরে প্রবেশ করলো। আছিয়া খাতুন এখন চোখে দেখেন না ঠিকই কিন্তু শরীরের গন্ধ আর পায়ের আওয়াজেই চিনতে পারেন সবাইকে।
‘কে নুরি নাকি?’
‘হ্যাঁ দাদি আজ আমার কলেজের পরীক্ষা! দোয়া করিও।’
‘আহা কবে কলেজে ভর্তি হইলা গো, এতো তারাতাড়ি কি পরীক্ষা দিতাছো? আচ্ছা, তোমার কি ট্যাকা লাগবো? তুমি তো হেইদিনও স্কুলে গেলা! আজই কলেজে পরীক্ষা?’
‘দাদি আমি আরও আগে স্কুল পাশ করেছি। এখন কলেজ পড়ি৷ রোজ ভুলে যাও, আমি রোজ মনে করিয়ে দেওয়ার পরেও।’
‘ওও হ্যাঁ তাই তো ভুইলা গেছিলাম। আমার কালাচাঁদ এর লগে দেহা হয় তোমার?’
‘নাহ, আমার কারোর সঙ্গে দেখা হয় না। তাকে দিয়ে তোমার কি কাজ?’
‘তার দেখা পেলে একবার আসতে বলিস,অনেক দিন দেখা হয় না!’
‘বলবো!’
নুরিশা দাদির সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে নিচে নামলো।
যেতে যেতে নুরিশা বিরিয়ানির দোকানে তার বাবাকে খেয়াল করলো। হঠাৎই তার মাথা গরম হয়ে গেলো। পরীক্ষা শুরুর আরও এক ঘন্টা বাকি আছে। নুরিশা বিরিয়ানি হাউজে ঢুকলো। মেয়েকে দেখে মতিউর রহমান হকচকিয়ে গেলো। তিনি চুবচবে তেলে ভাজা পরোটা খাচ্ছেন আর পাশেই রসগোল্লার বাটি। মেয়ের দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে চোখ নামিয়েও নিলেন। পরোটাই এতোই তেল বেশি যে তার হাত চকচক করছে তেলে! মেয়ের তীর্য্বক চাহনীতে মনে হলো পরোটা উনার গলায় আটকে গেলো। খুকখুক করে কেশে উঠলেন তিনি। নুরিশা দ্রুততার সহিত সামনের জগ থেকে পানি ঢেলে দিলো।
বয়সের সঙ্গে মানুষ কতটা বদলায় তা নুরিশা বাবার দিকে তাকিয়ে বুঝলো। রাত জেগে তার পড়ার টেবিলের কাছে বসে থাকে তার বাবা। যেনো সে ভালো ভাবে পরীক্ষা দিতে পারে সেজন্য নফল নামাজ পড়ে দোয়া করেন। ভাইয়ার সময়ও নাকি তার বাবা দিনের পর দিন জেগে নামাজ পড়তেন, নফল রোজা রাখতেন৷ নুরিশা তার বাবার বাচ্চাদের মতো অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক হলো৷ রাগ দমন করে চেয়ার টেনে বসলো।
‘খাওয়া শেষ করুন!’
‘কি রে মা টাকা লাগবো?’
‘নাহ, আপনি যে অসুস্থ এটা ভুলে যান কেন? ডায়াবেটিস আছে আপনার, রসগোল্লা খাচ্ছেন, অতিরিক্ত তেল দেওয়া খাবার খাচ্ছেন। এগুলো যে আপনার খাওয়া বারণ জানেন না? তবুও কেন রোজ রোজ এরকম করছেন?’
‘তোর মা তেল ছাড়া খাইয়ে খাইয়ে আমাকে মে’রে ফেলতে চাই! তুই তো জানিস কতটা কষ্ট হয় আমার। তুই কি তোর আব্বার কষ্ট বুঝবি না মেয়ে হয়ে?’
‘ঐ কষ্ট কোনো কিছু না আব্বা, আপনার সুস্থতা সবচেয়ে বেশি জরুরি! আজকেই এখানে লাষ্ট খাওয়া আপনার। আমি লেবু ভাইকে বারণ করে দেবো যেনো, আপনি আসলে আপনাকে চিনি ছাড়া চা বাদে আর কোনো কিছু যেনো না দেওয়া হয়।’
মতিউর রহমান আরও অসহায় চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন। এই তো সেদিন এই টুকুন বাচ্চা মেয়ে ছিলো। কলেজে ভর্তি হতেই কি মেয়ের আরও জ্ঞান বুদ্ধি বেশি হলো? আরও বেশি কড়া শাসন করতে চাইছে? আগের চাইতেও এখন তিনি বেশি ভয় পান মেয়েকে।
‘তুমি কি একটা পরোটা খাবে নুরি?’
‘আমার সময় নেই আব্বা, আমার পরীক্ষা আছে জানেন তো। আপনি বাসায় যান এক্ষুনি।’
‘মর্নিং ওয়াক শেষ করে এমন ক্ষিধে পেয়েছিলো যে….!’
‘বাড়িতে রান্না শেষ সকাল আটটাই। আপনি যদি নিজের অসুস্থতার কথা চিন্তা না করেন তবে তো আমাদের ই করতে হবে। বাসায় যান, আমার জন্য দোয়া করবেন!’
নুরিশা তাকাতেই মতিউর রহমান সুরসুর করে বেরিয়ে এলেন। মেয়ে আবার কখন যে রেগে যান সেই ভয়। এখন তবুও মাথা ঠান্ডা হয়েছে!
নুরিশা টঙের দোকানের কাছে গিয়ে থামলো। তার দু-চোখ খুঁজলো তাজফি নামক পুরুষটিকে। কেন খুঁজলো তা জানা নেই। তবে অবচেতন মন একটা নজর দেখতে চাইছিলো মানুষটাকে। মনের এই উঁচাটন তাকে অস্থির করে তুললো। হাঁসফাঁস করতে করতে সে পরীক্ষা দিতে গেলো। মানুষটাকে দেখতে চাওয়া যেনো একটা বড়সড় অসুখ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
#চলবে