#সোনার_কন্যা
#পর্ব৪
#রাউফুন
রাতের খাবার টেবিলে সাজানো হচ্ছিলো। প্রথম বারের মতো তাজফি নুরিশাদের বাড়িতে খেতে বসবে। লজ্জা, অস্বস্তিতে বিমূঢ় হয়ে হয়ে গেছে সে। রেহান হাসি মুখে এটা সেটা গল্প করছে। নুরিশা নত মস্তকে টিভির রিমোট হাতে কার্টুন দেখছে। যদি তার টিভিতে মন বসছে না, তবুও সে টিভি দেখার বাহানায় নিচে এসেছে। নিজের অবাধ্য, চঞ্চল মনকে দমিয়ে রাখতে পারেনি সে। বাড়িতে পা দেওয়া মাত্রই যখন সে তাজফিকে দেখলো, তার মনে হচ্ছিলো তার ভেতরের সবকিছু তোলপাড় শুরু করে দিয়েছে। সম্পুর্ন শরীর অচেনা অনুভূতিতে থরথর করে কাঁপছিলো। বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকা হৃদযন্ত্র টাকে মনে হচ্ছিলো লাফিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসবে। ঢিপঢিপ! ঢিপঢিপ! ঢিপঢিপ! পরপর, বার বার, একবার দু-বার, তিনবার বহুবার। সে আর দাঁড়াইনি। নিজের রুমে গিয়ে সে আয়নার সামনে দাঁড়াতেও লজ্জা পাচ্ছিলো। আশ্চর্য তার লজ্জা কেন লাগছিলো? সে পালাতে চাইছিলো এই নতুন অনুভূতির থেকে কিন্তু নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করেও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে নিচে নেমে আসে। এসেই টিভি ছেড়ে এক ভাবে বসে আছে। নিজের বেহায়া চোখ গুলো চলে যাচ্ছিলো খয়েরি সোয়েটার পড়া ব্যাক্তির দিকে।
টেবিলে খাবার সাজানো শেষে সবাই টেবিলে বসলো রিক্তা বেগম, আছিয়া খাতুন আর নুরিশা এক পাশে বসেছে। অপর পাশে মতিউর রহমান, রেহান, আর তাজফি। নুরিশা তার ভাইয়ের মুখোমুখি বসেছে। তার বুকে এখনো কেমন যেনো হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ হাতুড়ি দিয়ে ক্রমশ আঘাত করছে। আবারও এরকম কেন হচ্ছে? গলা দিয়ে খাবার নামাতে পারছে না সে। মতিউর রহমান গলা ঝেড়ে বললেন, ‘বাবা তাজফি, এখন কি করছো?’
‘জ্বী, কিছু না আংকেল!’
‘তাহলে তোমার চলছে কিভাবে? কিছু করবে না? ফিউচারের জন্য কি ভাবছো? চলবে কিভাবে পরবর্তীতে?’
‘তিনটে টিউশনি করাচ্ছি। আমি একা মানুষ, মাস যেতে চার, সারে চার হাজার টাকা আসছে ওতেই চলছে।’
‘চাকরি বাকরির চেষ্টা করছো?’
‘জ্বী নাহ!’
‘আমার হাতে একটা চাকরি আছে, করবে? মাসে ছয় সাত হাজার সম্মানী পাবে। করবে?’
তাজফি এখনো পর্যন্ত খাবার মুখে তুলেনি, কারণ নুরিশাও মুখে খাবার তুলেনি। মেয়েটা কি তাকে দেখে লজ্জা পাচ্ছে?
‘আব্বা, খাওয়ার সময় আপনে এসব আলোচনা করবেন না তো। আমার ভালো লাগছে না!’
‘তুই চুপ কর রেহান৷ আজীবন তুই বেকার হয়ে ঘুরে বেড়ালেও চলবে, কিন্তু ছেলেটার চলবে কিভাবে? বেশি বুঝবি না।’
রিক্তা আর আছিয়া শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। নুরিশার দপ করে মাথা গরম হয়ে গেলো। কেন এই রাগের উপদ্রব হচ্ছে সে বুঝলো না। তবে রাগ হচ্ছে, কিন্তু রাগ টা কার উপর? নিজের বাবা নাকি মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকা লোকটার উপর? চরম অসহ্য লোকতো? অন্য সময় এতো ফটরফটর করে কথা বলে, তবে এখন কি হয়েছে? উচিৎ কথায়, প্রকাট্য ভাবে জবাব দিতে কি কষ্ট হচ্ছে?
তাজফি অত্যন্ত অপ্রতিভ হয়ে গেছে। সে কোনো কথা বলতেই পারছে না। সে বলতে পারছে না মুখ ফুটে যে, ‘আমার কারোর দয়া চাই না।’ কিন্তু সে একটা বুলিও কা’ট’তে পারলো না। কারণ টা বোধহয় পরিষ্কার। কারণ লোকটা নুরিশার পিতা। সে কোনো ভাবেই মুখের উপর জবাব দিয়ে তাকে অসম্মান করতে চাইলো না।
তম্বন্ধে তাজফির ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো৷ নোকিয়া বাটন ফোন তার হাতে। সে ফোন ধরলো।
ফোনের অপর পাশে একজন কিছু একটা বললো। সে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললো,
‘দুঃখিত আংকেল আন্টি, আমি আসছি। আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে!’
‘সেকি বাবা! তুমি তো মুখে ভাত ই দাওনি।’
‘তুমি আমারে কথা দিসো কালাচাঁদ। তুমি খাইয়া যাবা!’
‘আমি তোমার কথা রাখবো দাদি। কিন্তু এখন আমাকে যেতেই হবে!’
‘আমিও যাচ্ছি তাজফি ভাই!’
‘নাহ, রেহান তুই থাক। খেয়ে নে সবার সঙ্গে। আমি একাই যাচ্ছি।’
তাজফি সালাম দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। নুরিশার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। যে বুকে একটু আগেও দ্রিমদ্রিম শব্দে দামামা বাজছিলো, রাগে, ক্ষোভে জর্জরিত হচ্ছিলো, সেই বুকে এখন চিনচিন ব্যাথা করছে। কাউকে কিছু না বলেই নুরিশা ছুটে চলে গেলো। ক্ষুধার্ত মানুষটা না খেয়ে আছে, আর সে কিভাবে খাবে? কখনোই কি এমন হয়েছে, যে তার সামনে কোনো ক্ষুধার্ত ব্যাক্তি না খেতে পেয়ে কষ্ট পেয়েছে? তাহলে আজ হবে কিভাবে? হতেই পারে না।
‘আরে নুরি যাও কই? খাইবা না?’
নুরিশা জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না। ঘরে ঢুকে দরজা আঁটকে দিলো। আছিয়া খাতুন হাতের ভাত ঝেড়ে চিন্তিত হয়ে বললেন,
‘কি গো বৌ যাও না, নুরি চইলা গেলো ক্যা শুনো। বাচ্চা মাইয়া, শীতের রাত। এতো বড় রাত হে না খাইয়া থাকবো?’
‘আম্মা, ঐ মেয়ের কখন কি হয় বুঝি না। এখন যাবো দেখা গেলো রাগে আমায় ভষ্ম করে দিচ্ছে পারলে। এখন, আজকে রাগ করার মতো তো কিছুই ঘটে নাই।’
মতিউর রহমান কোনো রকম প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। তিনিও টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লেন!
‘আরে কি হইলো মতি? তুমি আবার যাও কয়?’
‘আম্মা, আমার ছোট্ট মেয়েটা না খেলে আমি খাবো কিভাবে?’
‘আমিও খাবো না, আমার বোন না খেলে আমারও গলা দিয়ে খাবার নামবে না।’
‘আমি আর কমু? আমি বুড়ি মানুষ না খাইয়া তো থাকবার পারি না। কিন্তু আমার নুরি যে না খাইয়া রইলো গো! বৌ কিছু করো।’
‘আমি এক কাম করি আম্মা, খাবার গুলান গিয়া ফালাই দিয়া আসি। কারোরই খাওয়ার দরকার নাই।’
বাড়ির মেয়ে খেলো না বলে বাড়ির প্রতিটি মানুষের খাওয়া হলো না। টেবিল ভর্তি খাবার কিন্তু খাওয়ার কেউ-ই নাই। রাগে দুঃখে রিক্তা বেগম বসে পড়লেন। কিছুক্ষণ সেভাবেই বসে থেকে বিড়বিড় করে খাবার গুছিয়ে রাখলেন। এক গ্লাস পানি খেয়ে চলে গেলেন ঘরে। মেয়েটা কি এখন দরজা খুলবে? তিনি কি নিজেই খাবার হাতে যাবেন ওর রুমে? নিজের হাতে ভাত মেখে খাওয়াবেন তিনি? কিন্তু মেয়েটার হলো কি হঠাৎ?
নুরিশা দরজা বন্ধ করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে! এমন কেন হচ্ছে তার? এ কেমন নতুন ব্যাথার উপদ্রব হচ্ছে? কেন হচ্ছে? ঐ মানুষটা তো তার কেউ না। সে না খেলে তার কি? নুরিশা নাক টেনে আবার জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলো। সে ঘরে এসেই তাজফির প্রস্থান দেখেছে। মানুষটা আরও কতক্ষণ আগে চলে গেছে অথচ তার এখনো মনে হচ্ছে এইতো মানুষ টা যাচ্ছে। হাফ স্লিভস লাল সোয়েটার আর সাদা শার্ট পড়নে। তার অবচেতন মন চাইছিলো কিছু একটা৷ যা পেলে সে খুশি হবে, শান্তি পাবে। তাজফিকে যে সে আজই প্রথম বার দেখলো তা তো নয়? তবে আজ কেন তার এমন লাগছিলো? তবে কি আজ থেকেই তার সর্বনাশের দিন শুরু?
তাজফিকে কল করলো রেহান। তিনবারের সময় তাজফি কল ব্যাক করলো। তাজফির ভাঙা ফেঁসফেঁসে কন্ঠ,
‘হ্যাঁ রেহান বল, কি হয়েছে?’
‘আপনার কন্ঠ এমন কাঁপছে কেন ভাই? কি হয়েছে?’
‘কিছু না,বল কি বলবি?’
‘আপনি তো আমাদের আড্ডার জায়গায় নেই, তাজফি ভাই। আজ কারোর সঙ্গে ঝামেলাও হয়নি তবে আপনি কার ফোন পেয়ে ছুটলেন?’
‘আমাকে কিছু দিন পাবি না এলাকায়। আর এখন কোনো প্রশ্ন করিস না, আমি পরে কথা বলবো!’
কল কেটে গেলো। রেহান হতবিহ্বল হয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার মনটা বড্ড খারাপ হয়েছে তাজফির ব্যবহারে। সে একজনকে কল দিলো। অত্যন্ত মন খারাপে সে এই একজনকেই মনে করে। কল রিসিভ হলো। দুজনের নিঃসৃত নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া কোনো কথা হলো না। কোমল গলায় সেই নারীটি প্রশ্ন করলো,
‘আজ মন খারাপ কেন?’
‘তেমন কিছু না। আমার মন খারাপ বুঝলেন কিভাবে আনিকা?’
‘আপনি মন খারাপ ছাড়া আমায় নিজে থেকে কল করেন না। বলুন কি হয়েছে?’
‘কিছু না, আমি তোমার বাড়ির সামনে এসেছি। বারান্দায় আসবে?’
‘কখন এলেন?’
‘এক্ষুনি এসে দাঁড়িয়েছি।’
‘এতো দ্রুত?’
‘আপনাকে ফোন করার আগে থেকেই হাঁটছিলাম।’
‘আচ্ছা আসছি!’
রুমের লাইট জ্বলে উঠলো। রেহান দাঁড়িয়ে থেকে দূর হতে তাকে দেখলো। অন্ধকারের অবয়ব দেখেও তার মন শান্ত হলো। স্পষ্ট নয় মেয়েটির মুখ৷ আনিকার সঙ্গে রেহানের পরিচয় রং নাম্বারের মাধ্যমে। আস্তে আস্তে পরিচিতি বেড়েছে, জানাশোনা হয়েছে। সে জানতোও না আনিকা তার পাশের এলাকার মেয়ে। মেয়েটা তাকে নিয়ম করে মাসে দুবার কল করে। আনিকা শুরুর দিকে ঘনঘন ফোন দিতো। রেহান বিরক্ত হতো খুব। একদিন খুব রাগারাগির পর অনেক দিন রেহানকে কল করেনি আনিকা। পরবর্তীতে রেহান ই যোগাযোগ করেছিলো এবং বলেছিলো মাসে দুবার কল করা যাবে। আনিকা মেনে নিয়েছিলো। তবে রেহান মাঝে মধ্যেই সেই নিয়ম ব্রেক করে অত্যন্ত মন খারাপে আনিকাকে কল করে। এক বছরে তার বিষয়ে সবকিছুই মেয়েটা মুখস্থ করে ফেলেছে।
রেহানের ভাবনার মাঝে আবারো সুন্দর মিষ্টি কন্ঠঃস্বর কানে বাজলো। সম্বিৎ ফিরে পেলো রেহান।
‘বললেন না যে, কি কারণে মন খারাপ!’
‘ইচ্ছে করছে না। আপনি আরও কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকুন আমি চলে যাবো!’
‘আমি আছি। তবে আপনার বিষন্ন কন্ঠ আমায় বড্ড পীড়া দিচ্ছে! দম বন্ধ লাগছে!’
‘জানেন আনিকা, আজ প্রথম বার এমন হয়েছে যে তাজফি ভাই আমাকে কিছু বলেন নি। উনি কোথাও একটা যাচ্ছেন কিন্তু আমাকে জানালেন না।’
‘এই সামান্য কারণে আপনার এতো মন খারাপ?’
‘এটা সামান্য না। যার থেকে আপনি যতো প্রায়োরিটি পাবেন তার কাছে আপনার এক্সপেকটেশন ততোই বাড়বে। কিন্তু হুট করেই যদি আপনি প্রায়োরিটি না পান তখন আপনার বুকে ব্যাথা অনুভব হবে। আমারও বুকে ব্যাথা হচ্ছে। তাজফি ভাইয়ের এই ব্যবহারটা মানতে পারছি না। মনে হচ্ছে, আমাকে বড় কিছু থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে।’
#চলবে