সোনার কন্যা পর্ব-০৩

0
456

#সোনার_কন্যা
#পর্ব৩
#রাউফুন

নুরিশার হাতে তাজফির এতো দিন পর্যন্ত দেওয়া হরলিক্স এর বোতল। এগুলো আজকে মিশুকে দিয়ে দেবে সে। মিশুর দশ বছরের একটা বোন আর আট বছরের একটা ভাই আছে। ওরা খাবে এগুলো। ক্লাসের সবাই নুরিশার সঙ্গে মিশতে চাই শুধুই তার চাকচিক্য দেখে। তবে নুরিশার কাউকেই ভালো লাগেনি যতটা মিশুকে তার ভালো আর আপন লেগেছে। মেয়েটা এতো মায়াবী। চোখ গুলো দেখলেই মনে হয় যেনো স্বচ্ছ সরোবর। ওর ভাসা ভাসা চোখগুলো যেনো তারার মতো চিকচিক করে সব সময়। এতো মায়াবী মুখের দিকে তাকালে কি যে শান্তি লাগে তার। নুরিশা স্কুলে গিয়ে নুরিশার হাতে হরলিকস্ ভর্তি ব্যাগটা ধরিয়ে দিলো। মিশু হরলিক্স দেখে অবাক হয় না। কারণ নুরিশা প্রায়ই তার ভাই বোনদের জন্য এগুলো কিনে আনে। কিছু বললেই মিশুকে হুমকি সরুপ বলে, ‘এগুলো না নিলে তোর সঙ্গে সম্পর্ক শেষ!’ কালকে তার ব্যাগে যে টাকা গুলো নুরিশা রেখেছে তা সে জানে।

‘আজকে আসতে এতো দেরি হলো যে?’

‘এমনিতেই, হেঁটে এসেছি তাই।’

‘তোর তো বেশি হাঁটা বারণ। কেন তুই জেদ করিস? পায়ের সমস্যাটা বাড়ুক, দেখবি কি ঝাড় খাস আমার থেকে।’

নুরিশা তার কথায় পাত্তা না দিয়ে মুচকি হেসে মিশুর হাত চেপে ধরলো। বললো, ‘ছুটির পর আমরা মার্কেটে যাবো। যাবি সঙ্গে?’

‘মার্কেটে? কিন্তু কেন?’

‘সেসব জেনে তোর কাজ নেই। স্কুল শেষে মার্কেটে যাচ্ছি আমরা ব্যস্!’

‘আচ্ছা। তোর কালাচাঁদ এর কি খবর বল!’

‘আমার কি হুম? এই আমার কি করে কালাচাঁদ সে? তাকে আমার দাদি কালাচাঁদ বলে। আমাকে একদম ক্ষ্যাপাবি না।’

‘তো? ক্ষ্যাপানোর বিষয় হলে ক্ষ্যাপাবো না?’

‘নাহ! ঠিক কোন বিষয়ের জন্য তুই আমাকে ক্ষ্যাপাবি বল তো?’

‘কেন? এই যে তোর এতো খেয়াল রাখে, তোকে তো আবার আদর করে বালিকাও বলে। হরলিকস্, চকলেট, কোক এটা সেটা কিনে দেন। রিকশা ঠিক করে দেন। এসব কি একটা পুরুষ মানুষ এমনিতেই করে?’

‘হ্যাঁ এমনিতেই করে। একটা মাস্টার্স পাশ গাঁধা লোকটা। পড়াশোনা শেষে চাকরি বাকরি না করে টো-টো কোম্পানির মতো ঘুরে বেড়ায়। তাছাড়া ঐ লোকটার আর আমার বয়সের তারতম্য দেখেছিস? সে টোয়েন্টি এইট আর আমি অনলি ফোরটিন। বয়সের গ্যাপ গুণে গুণে চোদ্দ বছর বেশি। আমার মতো বাচ্চাকে সে পছন্দ করবে? মাথা তোর খারাপ না ঐ কালাচাঁদের? আর আমার কি ওসব প্রেম ভালোবাসার বয়স? লোকে শুনলে খারাপ বলবে না?’

‘বয়স কোনো ম্যাটার না বান্ধবী! আমি স্পষ্ট দেখতে পাই তোর জন্য তার মনের দূর্বলতা আছে।’

‘তুই থামবি? চুপ কর এখন। ক্লাস শুরু হবে!’

ক্লাস শেষে নুরিশা আর মিশু গেলো মার্কেটের উদ্দেশ্যে। বেশ কিছু জিনিস কিনলো সে। মিশু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। গুনে গুনে কতকগুলো কোম্বল আর সোয়েটার কিনে একটা ভেন ঠিক করে তার উপর রাখলো। হাতে এখনো বেশ কিছু টাকা আছে। শেষ টাইমে তার চোখ পড়লো একটা সুন্দর সোয়েটারের দিকে। সে কি যেনো মনে করে দুটো শার্ট আর একটা সোয়েটার কিনলো। আলাদা করে সেগুলো ব্যাগে ভরে ভেনে চেপে বসলো। মিশু অবাকের পর অবাক হয়ে শুধু নুরিশাকে দেখছিলো।

‘তুই এসব কি করবি বল তো?’

‘দেখবিই তো। ভেনওয়ালা চাচা চলুন। আমরা শক্ত করে চেপে বসেছি।’

ভেন চলতে শুরু করলো। নুরিশা আগের দিন কোচিং থেকে বাসায় যাওয়ার সময় দেখেছিলো রাস্তার পাশে বসে থাকে কত গুলো গরীব মানুষ। তারা শীতে ভীষণ কষ্ট পায়। এই প্রচন্ডরকম শীতে তাদের হাত পা ফেঁটে গেছে বিশ্রিভাবে। তাদের জন্যই নুরিশা এতো গুলো টাকা নিলো বাবা মায়ের থেকে। নুরিশা উড়না দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো এবং মিশুর মুখও ঢেকে দিলো। গরীব দূস্থ মানুষের হাতে একটা করে কোম্বল আর একটা করে সোয়েটার দিলো। সবার চোখে আনন্দের অশ্রু। সবাই নুরিশার হাত ধরে, কেঁদে কেঁদে দোয়া করলো একদম অন্তর থেকে।

কোম্বল বিতরণ শেষে সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলো মিশু আর নুরিশা। মিশু যারপরনাই অবাক হয়ে বললো,

‘তুই এই মানুষ গুলোর জন্য এতো ভাবিস?’

‘ভাবি না তো ভাবতে হয়। আমার মাথায়, আমার বুকে জ্বালাপোড়া হয়। আমার দম বন্ধ হওয়ার মতো কষ্ট হয়। আমার দু-চোখে সহ্য হয় না এই মানুষ গুলোর কষ্ট। মনে হয় আমি কেন বেঁচে আছি? আমি বেঁচে থাকতে কেন তাদের এতো কষ্ট পোহাতে হচ্ছে? দুই হাজার চোদ্দ সালে এসেও এই অবস্থা মানুষের, মানা যায়? আমি মানতে পারি না। আমার মানতে কষ্ট হয়। আমার যদি ক্ষমতা থাকতো তবে আমি এই রকম সব দুস্থ মানুষের জন্য কিছু না কিছু করতাম। তাদের এরকম খারাপ অবস্থা থেকে তাদের মুক্ত করতাম।’

‘তাই বলে তোর ভাবতে হবে? আমরা অনেক ছোট নুরি!’

‘তো কি? কাউকে মন থেকে কিছু দেওয়ার জন্য ছোট আর বড় হওয়ার কোনো ব্যাপার নেই। কাউকে কিছু দেওয়াটাই আসল ব্যাপার! আমি বড় হওয়ার অপেক্ষা করবো কেন? কাউকে সাহায্য করার জন্য অনেক বড়লোক হওয়ার প্রয়োজন নেই। যদি ইচ্ছে থাকে নিজের খারাপ অবস্থা থেকেও সাহায্য করা যায়। আর হ্যাঁ আমি যায় করি না কেন, যা কিছু করবো, তুই অবশ্যই আমার সঙ্গে থাকবি। কিন্তু ততদিন, যতদিন এই বিষয় গুলো লুকায়িত থাকবে সবার কাছে!’

‘কিন্তু লোক জনের জানা দরকার আছে। হতেই পারে এসব জেনে তারাও সাহায্য করবে তোর মতো। তাছাড়াও তোর কত নামডাক হবে বলতো? যখন তোর এতো সুন্দর ভাবনা গুলোকে সম্মান জানাবে সবাই তখন তোরও ভালো লাগবে।’

‘আমি কি এসব সম্মান, নাম-ডাক আর নিজেকে ভালো প্রুফ করার জন্য মানুষকে সাহায্য করি? আমার লোক দেখিয়ে সাহায্য করে নাম কেনার কোনো মনোবাসনা নেই৷ তুই আমার প্রিয় বান্ধবী তাই তোকে সঙ্গে রাখছি। তাছাড়া কিছুই না। লোককে সাহায্য করার মাঝে যে আনন্দ পাওয়া যায়, দুনিয়াতে এমন আনন্দ কোথাও পাওয়া যায় না।’

আরও বিভিন্ন কথা বলে নুরিশা আর মিশু কোচিং এ গেলো। কোচিং থেকে ফেরার সময় আজ নুরিশা নিজেই তাজফির নিকটে গেলো। তাজফি যাবে কি? সে তো নুরিশার আগমণে হতবাক। নুরিশা ব্যাগ থেকে সোয়েটার আর শার্ট বের করলো। কোনো রকম বাক্য বিনিময় না করে সেগুলো তাজফির হাতে ধরিয়ে দিলো। তাজফি নির্বাক ছিলো। সে যেনো স্বপ্ন দেখছিলো। তার যখন সম্বিত ফিরলো তখন সে ডাকলো নুরিশাকে!

‘এই যে বালিকা দাঁড়িয়ে যাও। এসব কি? আমাকে কেন দিচ্ছো?’

নুরিশা দাঁডাইনি। সে তাজফির ডাক উপেক্ষা করে চলে গেছে নিজের বাড়িতে।

তাজফি দেখলো, ভেতরে টকটকে লাল খয়েরি রঙের একটি সোয়েটার বেশ দামী। আর কালো আর সাদা শার্ট। শার্ট দুটোও বেশ দামী। সব কিছু এক হাজারের কমে তো হয়নি৷ সে উল্টেপাল্টে দেখার সময় খেয়াল করলো একটা ছোট্ট চিরকুট!
গোটাগোটা অক্ষরে লেখা,

‘আপনি গত বছরেও এই ছেড়া-ফাড়া সোয়েটার পড়ে কাটিয়েছেন। আপনি একটা পুরনো শার্টের নিচে সোয়াটারের সেই ছেড়া অংশ ঢাঁকার চেষ্টা করেন। এতো দিন এতো এতো হরলিকস্ কিনে দিয়েছেন তার বিনিময়ে আজকের এই শার্ট আর সোয়েটার দিলাম। আবার অন্য কিছু ভাবার দরকার নেই। আমি এখনো ছোট, নিজের মন আর মস্তিষ্ককে দমিয়ে রাখুন!’

চিরকুটটার আগে পিছে কিছু নেই৷ তাজফি নিজের দিকে তাকালো৷ কোথায়? ছেড়াটা তো কোনো ভাবেই দেখতে পাওয়ার কথা না তবে মেয়েটা দেখলো কিভাবে?

তাজফি হেলেদুলে বাসায় গেলো। মেয়েটা কি তাকে নিয়ে ভাবে? এই বাচ্চা মেয়ের প্রতি তার এই টান কেন তাজফি তা জানে না। দুই ধরনের মানুষ নিজের অনুভূতি ব্যাক্ত করতে পারে না, সবল মনের মানুষ আর দূর্বল মনের মানুষ! তাজফি মনে করে সে খুবই দূর্বল মনের মানুষ! সে জীবনেও নুরিশাকে তার পছন্দের কথা বলতে পারবে না।

সন্ধ্যায় তাজফি উপস্থিত হলো নুরিশার বাড়িতে। নুরিশা তখন সবে স্নান করে সোফায় বসে গিদগিদ করে কাঁপছে। কাঁপতে কাঁপতে সে হুংকার দিয়ে বললো,’আম্মা আমাকে এক কাপ গরম চা দাও। ভীষণ শীত করছে!’

‘করবেই তো, আমি কতবার বললাম এখন গোসল করিস না।’

‘গোসল না করলে তো নামাজ হতো না আম্মা। আসার সময় কু’ত্তার মলে পা পড়েছিলো।’

কথাটা বলতে বলতে হা হয়ে গেলো নুরিশা। কি যেনো ভেবে সে দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেলো। তাজফি তাজ্জব বনে নুরিশার প্রস্থান দেখলো। মেয়েটা এভাবে পালিয়ে গেলো কেন? তাকে কি সাদা শার্ট আর খয়েরী রঙের সোয়েটারে বিশ্রি লাগছে? নিজেই তো দিয়ে আসলো এখন নিজেই দেখে পালাচ্ছে? আজব তো!

‘আরে তাজফি বাবা, কখন এলে?’

‘এইতো আন্টি এখনি। ভালো আছেন?’

রিক্তা এগিয়ে এলেন। কন্ঠে স্নেহ ঢেলে বললেন,’ভালো আছি বাবা। তোমাকে তো দারুণ লাগছে। কিন্তু মুখ শুকনো কেন বাবা? কিছু খাওনি?’

তাজফি লজ্জায় মুখ কাচুমাচু করে বসে রইলো। রিক্তা বুঝলেন ছেলেটা খাইনি কিছুই। বাবা মা না থাকলে বোধহয় এমনি হয়? ছেলেটার কষ্ট তার একদম সহ্য হয় না। তিনি এতো করে বলেছেন যেনো রেহানের সঙ্গে এসে তাদের বাড়িতেই থাকে। কিন্তু ছেলেটার এতো আত্মসম্মানবোধ প্রবল যে এখানে এসে দু মুঠো খাবেও না।

‘আন্টি আমি দাদির সঙ্গে দেখা করে আসি।’

‘যাও বাবা, আজকে আন্টির হাতের রান্না খেয়ে যেও।’

‘আচ্ছা খাবো আন্টি!’

রিক্তা খুশি হলেও আবার মুখ ভার করলেন। এর আগে বহুবার তাজফি বলেছে সে খাবে কিন্তু সে কখনোই খায়নি। এটা, সেটা বাহানা করে চলে গেছে। আজ তিনি কিছুতেই যেতে দেবেন না ঠিক করলেন।

‘প্রেমিকা, তুমি কি রুমেই আছো? আসবো?’

‘আসো কালাচাঁদ। দরজা খোলো আছে।’

আছিয়া খাতুন পানের পিচকারি এস্ট্রেতে ফেলে বললেন,’তা কালাচাঁদের মুখ হুকনা ক্যা? কিছু খাও নাই?’

‘কি যে বলো প্রেমিকা, আমার মুখ তো এমনি। আমি তো চিক্কু মিয়া!’

কথা শেষ করে হো হো করে হাসার চেষ্টা করলো তাজফি।

‘তোমার কি মনে হয়, আমি বুজি না কিছু? আমার চুল গুলান কি এমনি এমনি পাঁকছে?’

‘আহা এতো বিচলিত হইয়ো না প্রেমিকা। আমি ঠিক আছি। টঙের দোকানে একটু আগে গরম চা খেয়ে এসেছি।’

‘আজকে এখানে খেয়ে যেও। এটা আমার আদেশ। ‘

‘আচ্ছা খাবো। তোমার আমাকে খাইয়ে দিতে হবে তবে। না হলে খাবো না প্রেমিকা।’

‘তোমারে যদি হাতে তুইলা খাওয়াই দেই, তয় যে আরেকজনের অন্তর পুঁড়বো গো। দেইখো, তুমি ভষ্ম না হও।’

আছিয়া খাতুন খিলখিল করে হাসলেন। তাজফিও হাসলো। রাতের রান্নার আয়োজন বেশ জমজমাট। মতিউর রহমান নিজের হাতে বড় বড় মাছ, মাংস, কাচা সবজি কিনে এনেছে। আর যায় হোক, এই বৃদ্ধার কথা ফেলার জো তাজফির নেই। এতো দিন সে আছিয়া খাতুনকে সমীহ করে অনেক কথায় শুনেছে। তবে এতোক্ষণ এই বাড়িতে থাকা হয়নি। আজই বোধহয় সবচেয়ে দীর্ঘ সময় কাটালো সে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মানুষের দেখা মিললো না। সে কি তাকে দেখা দেবে বলেই রুমে নিজেকে বন্দী করেছে? এ কেমন যাতনা? সে ইতিউতি করছে।

‘তুমি যারে খুঁজতাছো হেই মনে হয় আইবো না এহন। মন পুঁইড়া যাইতাছে দেহি আমার কালাচাঁদের!বলি, এহন কি আর এই বুড়ি প্রেমিকারে ভালা লাগে না? ‘

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে