#সোনার_কন্যা
#পর্ব১
#রাউফুন
‘এইযে বালিকা, এদিকে আসো। একটা হরলিকস্ কিনে দিই, নিয়ে বাসায় যাও।’
নুরিশা পিছু মুড়লো।অত্যন্ত অসন্তোষজনক মুখাবয়বের সহিত কচ্ছপের গতিতে এগিয়ে গেলো ব্যাক্তিটির নিকট।সুন্দর পুরুষটি মাথা চুলকে গা দুলিয়ে হাসলো।নুরিশা কাছে যেতেই বললো,
‘তুমি এমন মুখ বেজার করে আছো কেন? তুমি যে হরলিকস্ খাও এটা আমি জানি৷ তাই কিনে দিই। তাহলে খুশি হওয়ার বদলে মুখ ভার কেন?’
‘এমনি!’
‘আমায় ভয় পাও? পেলেও, কেন পাও? আমি কি খুব ভয়ংকর দেখতে? মানে ভুতের মতো দেখতে?’
নুরিশা চুপ করে রইলো। তাজফি আবারও হাসলো। মুখ গম্ভীর করে বললো,’কি হলো, বলো? আমাকে কি ভুতের মতো দেখতে?’
‘নাহ!’
‘তাহলে শুকনা মুখে আমার সামনে আসো কেন? দেখে মনে হয় অনেক ভয় পাও!’
নুরিশার গলা ফাটিয়ে বলতে ইচ্ছে করলো,’ভয় পাই না, নুরিশা ভয় পাওয়ার মেয়ে নয়। আপনাকে আমার অসহ্য লাগে। আপনার বিরক্তিকর হাসি দেখলে গা জ্বলে যায়! গায়ে পড়ে কথা বলাটা বিরক্ত লাগে। রোজ আমাকে কিছু না কিছু কিনে দেওয়াটা বিরক্ত লাগে। সবচেয়ে বেশি বিরক্ত হয় তখন যখন আমাকে বালিকা সম্বোধন করেন আর সবার সামনে হরলিকস্ কিনে দেন!’
কিন্তু নুরিশা একটা রা ও কা’টতে পারলো না। নিশ্চুপ মুখোভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো। মানুষটা হরলিকস্, তার প্রিয় চকলেট আর দুইটা কোক কিনে দিলো। যাওয়ার আগে আবারও বললো, ‘শোনো বালিকা, তোমার যখন বিয়ে হবে তখনো হরলিকস্ খাবা, বিয়ের পরেও খাবা, তারপর যখন তোমার বাচ্চা হবে তখনও বাচ্চার সঙ্গে খাবা। মেয়ে আর মা মিলে পিকপিক করে হরলিকস্ খাবা আর আমি দেখবো!’
‘আপনি দেখবেন কি করে? আপনি তো আর আমার শ্বশুর বাড়িতে থাকতে যাবেন না!’
‘আমিই থাকবো বুঝলা বালিকা? এই জন্যই এখনো হরলিকস্ খেতে হয়। বুদ্ধি তো হাঁটুতে। তোমার রোজ একটা করে হরলিকস্ এর বোতল খালি করা উচিত। দ্রুত বুদ্ধি হবে!’
লজ্জায় লাল হয়ে নুরিশা সেখান থেকে চলে এলো।
কিছুটা আসতেই আবারও লোকটার আগমন ঘটলো।
‘রিকশা ঠিক করে দিলাম, রিকশা করে যাও বালিকা।’
‘দুই মিনিট লাগবে যেতে, এটুকুর জন্য রিকশায় চাপবো?’
‘হ্যাঁ চাপবে। ননীর পুতুল কিনা হেঁটে, বাসায় যাচ্ছে। যাও রিকশাই চেপে বসো।’
নুরিশা জানে, এখন রিকশায় না বসলে এই লোকটা তাকে তো যেতেই দেবে না আর না নিজে এখান থেকে নড়বে। তাই না ঘাটানোই ভালো মনে হলো তার। তাছাড়া আজকে শরীরটা ভালো লাগছে না। তার শরীর দুলছে। তার কাছে টাকা নেই। টাকা ছিলো না এমন না। তার বান্ধবী মিশুর আজ পিরিয়ড হয়েছে। ফার্মেসী থেকে এক সঙ্গে অনেক গুলো প্যাড আর ব্যাথার ওষুধ কিনে দিয়েছে সে। আর তার কাছে যা টাকা ছিলো তাও মিশুর অজান্তে ওর ব্যাগে দিয়ে দিয়েছে। মিশুকে রিকশায় তুলে দিয়ে সে ভাড়া মিটিয়ে দিয়েছে। সে জানে মিশুর ভাই বোনের খাতা কলম কেনার টাকা নেই৷ সামনাসামনি দিলে মিশু টাকা নিতে লজ্জা পাবে বলে সে লুকিয়ে দিয়েছে। সে কখনো হাঁটাহাঁটি করে না। পায়ের সমস্যাটা বোধহয় বেড়েছে। রগটা এখনো চিনচিন করছে ব্যাথায়। লোকটা কি তার অসুস্থতা বুঝেই রিকশা ঠিক করে দিলো? সে কোচিং থেকে আসার পথে রোজ মানুষটা একটা করে হরলিকস্ এর বোতল ধরিয়ে দেবে। আর এটা সেটা বলে ব্যাঙ্গ করবে। নুরিশার খুব কাঁন্না পেলো। বাসাতেও লোকটার নামে নালিশ করে কিছু বলতে পারে না সে। সবাই লোকটার অন্ধ ভক্ত কি না। কিন্তু আজ সে একটা না একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে। আর কত সহ্য করবে এই লোককে? সে হরলিকস্ খাই, তো খেলেই কি হয়েছে? তার বাবা কি তাকে হরলিকস্ কিনে দিতে অক্ষম নাকি যে ঐ লোক কিনে দিবে? যদিও সে লোকটার দেওয়া একটা হরলিকস্ ও খাই না। নুরিশা বাড়িতে ঢুকে ধুপধাপ শব্দ করে রুমে গিয়ে ব্যাগ ছুড়ে মা’র’লো। রাগে সর্বাঙ্গে শিরশিরানি অনুভব হচ্ছে। সে চুল খামচে ধরে নিজেকে শান্ত করতে চাইলো। রিক্তা বেগম মেয়ের মতিগতি ভালো না দেখে মতিউর রহমানকে জানালেন। শাসন করলেও মেয়ের রাগকে উনারা ভীষণ ভয় পান৷ মেয়ের রাগ সম্পর্কে তো তারা অবগত।
‘হে-গো শুনছেন? রেহানের বাবা, আপনার মেয়ের আজকে আবার কি হয়েছে? এতো রেগে আছে যে! আপনি একটু ওর কাছে গিয়ে দেখুন না!’
‘আমি কেন যাবো? তুমি যাও! তুমি তো মা! মেয়েরা মায়ের সঙ্গ বেশি পছন্দ করে।’
‘হুম আপনাকে বলেছে, মেয়েরা বাপ ভক্ত হয় বেশি। দেখেন না, মেয়ে আপনি ছাড়া কিছু বোঝে না।’
মতিউর রহমান খবরের কাগজ দিয়ে মুখ ঢেঁকে ফেললেন৷ বললেন,’আমার মেয়ের রাগ তার নানীর মতো হয়েছে। চেহেরাও তো তার মতোই। দেখো না? এই জন্যই আমার তোমার মেয়েকে ভয় লাগে। কখন কি ছুড়ে মা’রে মুখের উপর ঠিক নেই। তোমার মা বেঁচে থাকতেই আমি তাকে ভয় পেতাম। নিজে তো গেছেন কিন্তু আমার মেয়েকে নিজের সব গুণাবলী দিয়ে গেছেন!’
‘এই থামেন তো। আমার মাকে নিয়ে একটাও বাজে কথা না। হ্যাঁ আমার আম্মা একটু রাগী ছিলেন কিন্তু মানুষটা ছিলেন খাঁটি!’
‘এক কাপ চা কি পাবো?’
‘পাবেন, আগে মেয়ের কাছে যান!’
‘তুমি যাও!’
‘পারছি না!’
রিক্তা হাত কঁচলাতে লাগলেন৷ চোদ্দ বছরের মেয়ের এতো রাগ হলো কি করে? এতো রাগকে নিয়ন্ত্রণেই বা আনবেন কিভাবে? উনার মেয়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে ভয় লাগছে। নিজের মেয়ের মাঝে নিজের মাকে দেখে বলেই কি, কিছু বলার সাহস হয় না উনার? কি আশ্চর্য, এই টুকু মেয়ের রাগকে তিনি ভয় পাচ্ছেন? তারা উনারা কেউ-ই যেতে চাইছেন না জনক-জননী হয়েও?
নুরিশা চুপচাপ হাত মুখে পানি দিয়ে আবারও শব্দ করে হেঁটে দাদি আছিয়া খাতুনের কাছে গেলো। কোনো বাক্যলাপ না করেই দাদির কাছে, দাদির বিছানায় শুয়ে পড়লো। তাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করলো। আছিয়া খাতুন মুচকি হেসে নুরিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শুধালেন,’কি হইছে আমাগো নুরির? কেউ কিছু কইচছে কোচিং থেইক্কা আসার সুময়?’
‘দাদি, তুমি ঐ কালাচাঁদকে আমার হরলিকস্ খাওয়ার কথা জানিয়েছিলে প্রথমে?’
‘হো তাইলে কি হইছে বুবুজান? তোমারে কি কিছু কইছে আমার কালাচাঁদ?’
‘তোমার কালাচাঁদ মানে কি দাদি? আমার তারে সহ্য হয় না। ঐ কালাচাঁদকে আমি দেখতে পারি না জানো না? কালো রঙের মতো ঐ কালাচাঁদরেও ঘৃণা করি। আর তুমি ঐ কালাচাঁদরেই ভালোবাসো বেশি, আমারে না।’
‘আহা, এতো রাইগা আছো ক্যান? আমি কি কইছি তারে আমি তোমার থেইক্কা বেশি ভালোবাসি? কেউ কালা হইলে তারে কালা কইতে হয় না জানো না? সৃষ্টির সেরা জীব হইলো গিয়া মানুষজাতি৷ আল্লাহর সৃষ্টিকে অবহেলা করা মানে আল্লাহ্কে অবহেলা করা৷ কোনো মানুষরেই তাই ছোডো কইরা দেহন উচিত না। আর আমার কালাচাঁদ তো ম্যালা ভালা মানুষ।’
‘আমি তারে সহ্য করতে পারি না দাদি।’
‘শান্ত হও। এইটুকুন বয়সে এতো উত্তেজিত হওয়া ভালা লক্ষ্যন না। নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করো!’
‘পারছি না দাদি।’
‘আইচ্ছা ধরো, সকালে উইঠা তুমি দেখলা, তোমার সব গুলা চুল পাইকা গেছে। তোমার কি ভালো লাগবো? সাদা চুলে? এই বয়সেই তোমারে হজ্ঞলে বু’ড়ি বইলা ক্ষ্যাপাবো।’
‘মোটেও না। ক্ষ্যাপাবে কেন? তাছাড়া আমি এখনো ছোট মানুষ, আমার চুল ক্যান সাদা হবে। তোমার মতো বয়স হলে না হবে চুল সাদা!’
‘কালা যদি মন্দ হয় তাইলে কেশ পাকিবার কথা শুনলে কাঁন্দে ক্যা মানুষ? তোমার দাদা আমার যখন প্রথম চুলে পাক ধরলো তখন কইছিলো, “ মা*** দেহি বুড়ি হইছস। তোর তো চুল পাঁইকা গেছে। তোরে দিয়া কি করমু রে। তোর কাম শেষ! ” বলেই পরদিন একটা কচি মাইয়ারে বিয়া কইরা আনলো। আমি সেদিন তার কথার উত্তর দিছিলাম, আমার কয়েকটা চুল সাদা হইছে বইলা একটা বিয়া কইরা আনলেন? এইডা কিন্তু মিথ্যা। আসলে আপনে আরো আগেই বিয়া করতে চাইছিলেন। আমার শ্বশুর বাঁইচা আছিলো জন্য পারেন নাই। কালা কেশের মর্ম বুঝলেন, আমার কালা চামড়ার মর্ম বুঝলেন না? একদিন কিন্তু আপনার এই কচি বউটারও চুলে পাক ধরবো।’
‘আচ্ছা, দাদা কি তোমারে অনেক কষ্ট দিসিলো?’
‘এই সব আর মনে আনবার চাই না। মানুষটা তো আর বাঁইচা না। তাই থাউক এই কথা গুলান!’
‘দাদা কিভাবে মা’রা গেছিলো?’
‘আমাগো মণে মণে ধান হইতো। একদিন ধান কাইটা আইসা কইলো, ক্ষেতের মধ্যে ইন্দুরের গর্ত আছিলো। উনি হেই গর্তের কাছে হাত নিয়া যাইতেই সাপে ছোবল দিসে। মানুষটা দৌঁড়াইয়া আইছে বাড়িতে। কিন্তু ততক্ষণে ম্যালা দেরি হয়ে গেছিলো। মানুষটারে বাঁচানো যায় নাই। তার লাল টুকটুকে ফর্সা শরীর খানা হইলো সাপের বিষে নীল। চোখ বন্ধ করনের আগে আমারে কাছে ডাইকা কইলো, ”আমি বাঁচুম না, কারণ আমি আজরাইল দেখবার পারতাছি। তোমার সঙ্গে আমি ম্যালা অন্যায় করছি, আমারে মাফ দিও। তুমি আমার পরথম বউ, তুমি মাফ না দিলে আল্লাহও আমারে মাফ করবো না।”
কথা শেষ কইরাই মানুষটা আমার হাতে নিঃশ্বাস ছাইড়া দিলেন।’
নুরিশার দুই চোখ বেয়ে পানি পরছে। কাঁদতে কাঁদতে নুরিশা জিজ্ঞেস করলো,’তাইলে দাদার ছোটো বউ কোথায়?’
‘ঐ মা’*** তো আরেক নাগরের লগে ভাগছে। আমার সোয়ামির কাছে বিয়া বইছিলো তো তার এত্তো এত্তো সম্পত্তি দেইখা। ভাড়ার ঘর থেইক্কা ধান, গম, আর ঘরত থেইকা মাল কড়ি নিয়া ভাগছে। যদিও আসল যে সম্পত্তি আছিলো তার কথা খালি আমিই জানতাম। ঐ সম্পদ গুলা যদি না পাইতাম না তাইলে তোমার আব্বা আর বড় চাচাগোর মানুষ করবার পারতাম না।’
‘দাদি আমি যায়, আমার পড়া আছে!’
নুরিশা উঠে চলে এলো। আছিয়া খাতুন হাসলেন। বড়োই আদরের নাত্নী তার। একদম সোনার কন্যা। খালি রাগটা একটু বেশি।
#চলবে