#সে_ফিরে_আসবেই
#২য়_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
আজ অন্যদিনের চেয়ে একটু রাত করে বাসায় ফিরি আমি। এমনিতেই আমার মন খুব খারাপ।গা ভর্তি রাগ।এই রাগ এবং মন খারাপ যেন নীলা বুঝতে না পারে এই জন্য অদ্ভুত একটা কাজ করি আমি।মোড়ের যে কসমেটিক্স এর বড় দোকানটা আছে ওখান থেকে নীলার জন্য এক প্যাকেট বাহারি রঙের টিপ কিনি।আর এক ডজন কাঁচের চুড়ি। এইগুলো নীলা খুব পছন্দ করে। কিন্তু বাসায় ফিরে গিয়ে অবাক হই আমি।মানহা কাঁদছে।গলা ছেড়ে কাঁদছে।টিপ আর চুড়ি পকেটেই পড়ে থাকে।বের করি না। আমাকে দেখেই মানহা এসে আমায় আঁকড়ে ধরে কাঁদতে থাকে।
আমি তখন হাঁটু গেড়ে বসে মানহাকে কাছে টেনে নেই। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলি,’কী হয়েছে মা? কাঁদছো কেন?’
মানহা তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে,’মা মেরেছে।’
মানহার মুখ থেকে এই কথাটা শুনে আমি ভীষণ রকম অবাক হই।কী বলছে এটা মানহা!যে মেয়েকে নীলা আজ অবধি একটা ধমক পর্যন্ত দেয়নি সেই মেয়েকে সে মারে কী করে!
মানহাকে কোলে তুলে নিয়ে আমি নীলার কাছে যাই। নীলা বিছানায় শুয়ে আছে।সিলিঙে চলন্ত ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আনমনে কী যেন ভাবছে!
আমার পায়ের শব্দ পেয়েও তার ভাবান্তর হলো না। হয়তোবা সে পায়ের শব্দ শুনতেই পায়নি!
আমি ওর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করি,’ও কী করেছিলো?’
নীলা ঈষৎ কেঁপে উঠে আমার গলা শুনে। হঠাৎ করে কারোর গলা শুনলে এমন হওয়ার কথাই।
নীলা আমার কথার উত্তর দিলো না।
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম,’মানহা কী করেছিলো?’
নীলা তখন বিরক্ত মুখে আমায় পাল্টা প্রশ্ন করে বলে,’আমার মেয়েকে আমি মেরেছি এর জন্য কী তোমার কাছে জবাবদিহি করতে হবে?’
আমি এবারও অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে যাই !ভেবেও পাই না যে নীলার আচরণ এমন কর্কশ হতে পারে কীভাবে?
নীলার সাথে আমি কথা বাড়াই না।সে হোক ভদ্রতার খাতিরে অথবা আমাদের সম্পর্কের সম্মানের খাতিরে। চুপচাপ আমি মানহাকে নিয়ে বেলকনিতে চলে যাই। ওখানে গিয়ে মানহাকে বলি,’কী হয়েছিল মা? তোমার মা তোমায় মেরেছে কেন?’
মানহার কান্না তখন থেমেছে।সে বললো,’মাকে বলেছিলাম নুডুলস করে দিতে।মা করে দেয়নি।আমি তখন মার হাত ধরে টেনে বলেছিলাম না দিলে মানবো না।দিতে হবে। তখন মা আমার গালে দুটো চড় মেরেছে!’
কথাগুলো বলে মানহা আবার কাঁদতে শুরু করেছে ।
মানহা আমার কোলে।তার মুখটা আমি আমার বুকের সাথে চেপে ধরে বললাম,’আর কাঁদে না পাপ্পা।আমি তোমার জন্য এক্ষুনি নুডুলস করে দিবো!চলো আমরা এখন কিচেনে যাই!’
মানহাকে নিয়ে কিচেনে গিয়ে দেখি ঘরে কোন সবজি নাই।এমনকি পিঁয়াজ কাঁচা মরিচটাও নাই। সন্দেহ বশত ভাত শালুনের হাঁড়ির ঢাকনা খুলে দেখি নীলা কিছুই রান্না করেনি। তারপর ওর জন্য সকালে ঢেকে রেখে যাওয়া খাবারটা দেখলাম খেয়েছে কিনা।দেখি ওটাও খায়নি।নীলা তবে আজ সারাদিন কিছুই খায়নি!
খাইনি তো আমিও। সেই যে সকাল বেলা খেয়েছিলাম দু নলা। তারপর সারাদিনে তিনগ্লাস বরফ শীতল পানি আর একটা সিগারেট। এছাড়া আর কিছু খাইনি। এমনিতে অফিসে যাওয়ার সময় রোজ নীলা টিফিন ক্যারিয়ারে করে আমার জন্য দুপুরের খাবার দিয়ে দেয়।আর বারবার নিষেধ করে দেয়, বাইরে কিন্তু কিচ্ছু খাবে না বললাম। অসুখ বাঁধাবে পরে।আজ অফিসে যাওয়ার সময় সে বলেওনি আমার শরীর ভালো না। দুপুরের খাবারটা তুমিই টিফিন ক্যারিয়ারে করে নিয়ে যাও!
আমার খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু এখন আর রাগ করতে পারছি না নীলার উপর।আমি জানি নীলার উপর রাগ করাটা আমার খুব বড় বোকামি হবে।কারণ ও যে পরিস্থিতিতে আছে ওখানে কিছুতেই ভালো থাকা যায় না!
তমাল ছেলেটার সাথে মনে হয় অনেক আগে থেকেই রিলেশন ছিল নীলার। তারপর হয়তোবা কোন একটা কারণে ওরা দূরে ছিল।সম্পর্ক থেমে গিয়েছিল।আর তখনই আমার সাথে বিয়েটা হয়ে যায় নীলার। কিন্তু নীলা এ পর্যন্ত কিছুই বলেনি এ বিষয়ে। কিংবা ওকে দেখে কোন ভাবেই আমি অনুমানও করতে পারিনি যে নীলার একটা সম্পর্ক ছিল। কিংবা আছে!
আমার বেশি খারাপ লাগছে মানহার জন্য।এতো লক্ষ্মী একটা মেয়ে হয়েছে।দেখতেও যে কী মায়াবতী! নীলা যদি তমালের সাথে চলে যেতে চায় তবে আমি তাকে কিছুতেই বাঁধা দিবো না। বাঁধা দেয়ার অধিকার আমার নাই! ভালোবাসায় বাঁধা হলে যে পাপ বাড়ে! দুজন মানুষের মন কষ্ট পায়।অমি কীভাবে নীলাকে কষ্ট দিবো!
কিন্তু মানহা? আমার লক্ষ্মী মামণি টার কী হবে? মাকে ছাড়া কিংবা বাবাকে ছাড়া দুজনের একজনকে ছাড়া ওর বড় হওয়াটা তো খুব কষ্টের হবে!বড় হয়ে কী মানহা এর জন্য আমায় দোষ দিবে না?বলবে না,বাবা তোমাদের দুজনের জন্য আমার ফুলের মতো সুন্দর জীবনটা ধ্বংস হয়ে গেছে।আমি পৃথিবীতে বেঁচে থেকেও দোযখের শাস্তি ভোগ করছি!
হঠাৎ আমার চোখ থেকে টুপ করে এক ফোটা জল গালের উপর গড়িয়ে পড়ে।মানহা আমার কোলে বসে আছে তখনও।সে আমার চোখ থেকে জল পড়তেই তার ছোট্ট হাত দিয়ে গালের জল মুছে দেয়। তারপর কিছু না বলে বোকার মতো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওকে এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আমার কী যে খারাপ লাগে! ভেতরে কী যে তোলপাড় শুরু হয়!মনে হয় চিৎকার করে কাঁদি!গলা ছেড়ে কাঁদতে কাঁদতে মরে যাই!
কিচেন থেকে মানহাকে কোলে করে নিয়েই বাইরে যাই। কিছু বাজার করে আনতে হবে।নীলা যদি ঠিক থাকতো তবে সে আরো তিনদিন আগেই লিস্ট করে ফেলতো বাজারের।
মানহাকে নিয়ে গেট পেরিয়ে বাইরে যেতেই সে বলে,’বাবা আমরা বের হয়েছি কেন?’
আমি থমথমে গলায় বলি,’মা,ঘরে তো বাজার নেই। বাজার করতে বের হয়েছি।’
মানহা আর কিছু বলে না।চুপ হয়ে থাকে।
আমি হাঁটছি। রাস্তার এক পাশ দিয়ে মানহাকে কোলে নিয়ে হাঁটছি।
একটু পর মানহা বললো,’বাবা,মা একটুও ভালো না। তুমি শুধু ভালো!’
আমি বললাম,’ছিঃ এসব বলে না মানহা!মা তো বাবার চেয়েও ভালো হয়।মার পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত। বুঝলে?’
মানহা হঠাৎ এই বিষয়টা কেটে গেল। তারপর হুট করে বলে উঠলো,’বাবা,মা তোমাকেও পাপ্পা দেয় আর ওই আঙ্কেলকেও পাপ্পা দেয় কেন?’
আমি মানহাকে কী বলবো না বলবো কিছুই বুঝতে পারি না!ও তো ছোট মানুষ।ছোট মানুষের মনে তো কত প্রশ্নই জাগে।ওরা নতুন যা দেখে তাতেই ওদের মনে প্রশ্ন জাগে। এটা তো ওর দোষ না!
এবার নীলার প্রতি আমার সামান্য রাগ হয়!মনে মনে আমি বলি, এসব কী ছোট্ট মেয়েটার সামনেই করতে হয়!একটু আড়ালে গেলে হয় না!
মনে মনে কথাটা বলতে গিয়েও আমার ভেতরটা খা খা করে উঠে কেমন! খুব কষ্ট হতে শুরু করে বুকের ভেতর।একটা হারানোর ভয় এসে ঘিরে ধরে আমায়! তারপর মনে হয় আমার, নীলাকে আমি এই অত বছরের সংসারেও কোনদিন ভালোবাসি বলিনি।নীলাও বলেনি। তবুও ওর জন্য অত কষ্ট হয় কেন? নাকি একসাথে সংসার করলে ভালোবাসি কথাটা বলতে হয় না?আপনা আপনি এসব তৈরি হয়ে যায়!
বাজার করে মানহাকে নিয়ে ফিরে আসি।মানহার হাতে আইসক্রিম। নীলারও খুব প্রিয় আইসক্রিম। তাছাড়া আজ বেশ গরমও পড়েছে। নীলার জন্যও একটা আইসক্রিম কিনেছি। আইসক্রিমের প্যাকেট নীল। নীলার এই রংটা ভীষণ ভীষণ প্রিয়!
বাসায় ফিরে আমি মানহাকে বলি,’মা, তোমার মার কাছে এই আইসক্রিমটা দিয়ে আসো।বলবে তুমি কিনে এনেছো!’
মানহা বলে,’মা যদি আবার মারে?’
আমি মৃদু হেসে বলি,’একটুও মারবে না।আদর করবে তোমায় দেখো!’
মানহা নীলার কাছে আইসক্রিম নিয়ে গেল।আমি বেলকনি থেকে একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে বড় কাঁচের গ্লাসের খোলা ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখছি নীলা কী করে!
মানহা তার মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে ও যে হাতে আইসক্রিম ধরেছে সেই ছোট্ট হাতটা ওর মায়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,’মা,দেখো তোমার জন্য আমি আর বাবা আইসক্রিম কিনে এনেছি!’
নীলা অনেকক্ষণ ধরে ওর দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকে। তারপর একটানে মানহাকে ওর বুকের ভেতর নিয়ে গিয়ে চেপে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে!
#চলবে