#সে_প্রেমিক_নয়
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#পর্ব ৪৬(অন্তিম পর্ব)
হসপিটালের কডিটরে মাথা নিচু করে বসে আছে আনাবিয়া। তাজীব অশান্ত ভঙ্গিতে পায়চারি করছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই ওটি থেকে বেরিয়ে আসে ডাক্তার। আনাবিয়া উঠে দাঁড়ায়। মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
-তারা কেমন আছে ডক্টর?
-আপনার কী হয় তারা?
-আমার শাশুড়ি আর ননাশ ভিতরে। সুস্থ আছে তো তারা?
-দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে তারা আর বেঁচে নেই। আমরা অনেক চেষ্টা করেও তাঁদের বাঁচাতে পারিনি মিসেস শেখ।
আনাবিয়া দুর্বল হয়ে পরে। না চাওয়ার শর্তেও বোন হিসেবে তাজীব আনাবিয়াকে আলগাস্থে ধরে বেঞ্চে বসিয়ে দেয়। আনাবিয়া অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপতে থাকে কিছু বলতে চেয়েও পারে না।
ডাক্তার চলে যায়। তাজীব আনাবিয়াকে সান্ত্বনা স্বরে বলে,
-বোন ভেঙে পরো না নিজেকে শক্ত রাখো।
এতকিছুর পরও আনাবিয়া কাঁদে না। অতঃপর তারা ইরানের ক্যাবিনের সামনে যায়। আনাবিয়া তাজীবের কথায় নিজেকে শক্ত করে নেয়। ডাক্তার বের হয়ে মুখের ম্যাক্স খুলে। আনাবিয়ার করুণ অবস্থা দেখে কিছু বলতে ভয় পাচ্ছে সে। বড় একটি নিঃশাস নিয়ে বলে,
-সরি আমরা পারিনি ইরান শেখকে বাঁচাতে। ভয়ংকর অবস্থা তার। হাসপাতাল আনার আগেই সে মৃত্যুবরণ করেছেন।
আনাবিয়া রেগে অগ্নিমূর্তি হয়ে তেড়ে যায়। ডাক্তারের কলার ধরে উঁচু স্বরে বলে,
-আপনার সাহস কিভাবে হয় এতো বড় কথা বলার? আমার ইরান বেঁচে আছে ওর কিছু হয়নি।
তাজীব আনাবিয়ার হাত টেনে দূরে নিয়ে আসে। আনাবিয়াকে আটকাটে অক্ষম হচ্ছে সে। নিজের মধ্যে নেই আনাবিয়া। পারে না তাজীবকে ফেলে সে ডাক্তারের ওপর আক্রমণ করে বসে। ডাক্তার শান্ত স্বরে বলে,
-এতো বড় দুর্ঘটনার পর নিজেকে সামলানো ভীষণ কঠিন। উনার খেয়াল রাখবেন।
-আমরা কী একবার স্যারকে দেখতে পারি?
-জি পারেন। তবে বিকেয়ারফুল।
-ধন্যবাদ।
আনাবিয়া দৌড়ে ইরানের ক্যাবিনের ভিতরে প্রবেশ করে। তার পিছু পিছু তাজীবও যায়। কিছুক্ষন আগেই জরুরি তলবে শিখাকে হসপিটালে আনা হয়েছে। সেও আনাবিয়ার সাথে যায়। সাদা কাপড়ে মুড়ে রাখা হয়েছে হসপিটাল বেডে শুয়িত রোগী মানে ইরানকে। আনাবিয়া কাঁপাকাঁপা পায়ে ইরানের বডির সামনে যেয়ে দাঁড়ায়। গাল দিয়ে অশ্রু কণা গুলো অবহেলা গড়িয়ে পরছে। কাঁপাকাঁপা হাতে ইরানের মুখের থেকে কাপড় সরাতেই দু পা পিছিয়ে যায় আনাবিয়া। উঁচু স্বরে আতর্নাদ করে মেঝেতে বসে পরে। মুখের একপাশের মাংস প্রায় নেই। রক্তে মিশ্রিত মাড়ির হাড্ডিগুলো দৃশ্যমান। সকালে যেই গালে সে হাত বুলিয়ে দিলো সেই গালের কোনো অস্তিত্বই নেই জানো! এইরকম বীভৎস দৃশ্য দেখে শরীর বরফের মতো জমে যায় তাজীবের। সেও কান্নায় ভেঙে পরে মেয়েদের মতো। শিখা মেয়েটি আনাবিয়ার পাশে এসে বসে। চিৎকার করে কান্না করছে আনাবিয়া। ইরানের দিকে তাকানোর সাহস হচ্ছে না তার। একসময় কান্না করতে করতে জ্ঞান হারায় আনাবিয়া। লুটিয়ে পরে মেঝেতে।
”
”
”
”
২০ বছর পর,
সময়টা বসন্তকাল। মেঘলা আকাশ। মৃদু বাতাসে মুখরিত চারপাশ। গাছে গাছে নতুন পাতার সমাহার। রোদের তেজ নেই বললেই চলে। সুবিশাল ময়দানে দাঁড়িয়ে আছে এক রমণী। ক্রিম কালার জামদানি শাড়ী কায়ায় জড়ানো। গোল্ডেন কালার বড় বড় চুলগুলো খোঁপা বাঁধা। চশমা পরিহিত ঘোলাটে নয়নে চোখ বুলাচ্ছে আশেপাশে। মস্তিকে নাড়া দিয়ে উঠলো ২০ বছর আগের কিছু বেদনাদায়ক স্মৃতি। তার চোখের সামনে আগুনে ধাঁও ধাঁও করে জ্বলে উঠলো সবটা জায়গা। একপাশে প্রিয়জনদের কান্না আরেকপাশে আহত মানুষদের বীভৎস দেহ। সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে দাঁড়িয়ে থাকা রমণীর।
-বোন।
পরিচিত কণ্ঠস্বর কানে আসতেই ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে মানবী। শান্ত ভঙ্গিতে পাশে ফিরে তাকায় সে। সেই পরিচিত মুখ, সেই পরিচিত স্নেহ শুধু বয়সটাই একটু বেড়েছে লোকটার। চুল সাদা হয়ে গিয়েছে, দাঁড়ি পেঁকেছে কিন্তু এখনও বলিষ্ঠ দেহের মানুষ।
-আনাবিয়া বোন কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?
চশমাটা ভালোমতো পরে নেয় সামনে দাঁড়ানো মধ্যবয়স্ক রমণী অর্থাৎ আনাবিয়া সাবরিন। সরি এখন সে আনাবিয়া সাবরিন নয় আনাবিয়া শেখ। ওয়ান অফ দা মোস্ট সাকসেসফুল এন্ড পাওয়ারফুল বিজনেস ওম্যান ইন বাংলাদেশ। গম্ভীর স্বরে তাজীবের কথার উত্তরে বলে,
-আই এম ওকে তাজীব ভাই। আপনার নেতা সাহেব কোথায় তাকে এখানে দেখছি না কেনো?
তাজীব মৃদু হাসে। হাত ঘড়িতে সময় দেখে চাঁপা স্বরে বলে,
-আর কোথায় থাকবে সে! এতো বছর পর আমাদের চ্যাম্প আসছে তাকে নিতেই চলে গিয়েছে নেতা সাহেব।
-তার যাওয়ার প্রয়োজন ছিল! কিছুক্ষন পরই তাকে স্টেজে ডাকা হবে।
-সে এসে পরবে বোন চিন্তা করো না। তুমি যেয়ে আরাম করে বসো। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে পা ব্যাথা করবে।
-আমি জাস্ট পুরো জায়গাটা দেখছিলাম। সময় পরিবর্তন হয় কিন্তু কিছু কিছু স্মৃতি আজীবনের জন্য মনে গেঁথে যায়।
-আসলেই। আজ ২০ বছর হয়ে গেলো তবুও আমাদের মন থেকে কিছুই মুছলো না! এই তো সেই ময়দান। আর আজ সেই একই দিন।
-আমার ফের ভয় করছে ভাই। এই দিনে, ঠিক এখানেই আমি আমার সব কিছু হারিয়ে কাঙ্গাল হয়েছিলাম। আজ আবার সেই স্টেজে আমার ছেলে উঠবে। অনেক বছর পর আজ প্রথম কোনো কিছু নিয়ে ভয় করছে আমার।
-তোমার ব্যক্তিত্বের সাথে ভয় যায় না বোন। তুমি মেয়েদের জন্য গর্ব আর পুরুষদের জন্য তাঁদের হিংসার একমাত্র কারণ। যে বাঘিনীর বাঘের বাচ্চার মতো দুটো ছেলে আছে তার কিসের ভয়।
-অবশ্য হিংসের মতো ঢাল হয়ে দাঁড়ানোর জন্য একজন ভাইও আছে!
আনাবিয়ার কথায় মুচকি হাসে তাজীব। আনাবিয়ার মুখে কোনো হাসির রেশ মাত্র নেই। প্রায় ২০ বছর ধরে আনাবিয়া প্রসন্ন হয়ে হাসে না। তার একটাই কথা, “যেদিন তার স্বামীর খুনির ভয়ংকর মৃত্যু নিজের চোখে দেখতে পারবে সেদিনই মন খুলে হাসবে সে।”
-তাজীব ভাই প্লিজ আপনি যান যেয়ে ওদের দুইটার কান ধরে নিয়ে আসুন। আজ আসুক অনেক বকা অপেক্ষা করছে তাঁদের জন্য।
-যাচ্ছি আমি। শুনো বোন আজকে নজর ডানদিকে রেখো।
-কেনো?
-সারপ্রাইস।
___________________🌸
এয়ারপোর্টে মানুষদের ভিড় ঠেলে রাস্তা ফাঁক করছে কয়েকজন বডিগার্ড। সেই রাস্তা ধরে দ্রুত পা ফেলে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে একজন শ্যামবর্ণের পুরুষ। তার পিছনেও কয়েকজন বডিগার্ড। ধবধবে সাদা রঙের পাঞ্জাবী, সেট করা চুল ও চাপ দাঁড়ি, হাতে ব্ল্যাক কালার ঘড়ি, মুখে লেগে আছে কঠোর ভাব। বয়স ২৯ কী ২৮ হবে। তাগড়া যুবক! মানুষজন চোখ গোল গোল করে তাকে দেখছে। মেয়েরা ফিদা হয়ে একজন আরেকজনকে বলাবলি করছে,
-ঐ ছেলেটা কে জানিস?
-না। কিন্তু অনেক হ্যান্ডসম ইয়ার!
-ফেমাস ব্যবসায়ী আনাবিয়া শেখের বড় ছেলে এহেমাদ শেখ। আমি তাকে সব জায়গা ফলো করি।
-ওওও। অনেক অহংকার দেখায় হয়তো!
-হুম এটিটিউড ম্যান!
কিছুক্ষন আগেই রাশিয়া থেকে বাংলাদেশে প্লেন ল্যান্ড করেছে। এহেমাদ একবার ঘড়িতে টাইম দেখছে তো একবার সামনে তাকাচ্ছে। বেশি দেরি হয়ে গেলে আবার মা অসন্তুষ্ট হবে। প্রায় দশ বছর পর ছোট ভাই দেশে আসছে কিভাবে তাকে নিতে না আসে সে! কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর কাঙ্খিত মানুষের দেখা পায় এহেমাদ। গম্ভীর মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে। সহসা কিছু নজরে পরতেই এহেমাদ নিজের কপাল নিজেই চাপড়ায়। বিড়বিড় করে বলে,
-এই ছেলে আর ভালো হবে না!
মাত্রই প্লেন থেকে নেমেছে এক সুদর্শন ভিনদেশি বালক। অবশ্য ভিনদেশি শুধু দেখতেই! একদম আনাবিয়ার কার্বনকপি। ইরান শেখ ও আনাবিয়ার ছেলে ইমাম শেখ। পড়াশোনার জন্য বড়মা মানে আনাবিয়ার গ্রান্ডমাদের সাথে রাশিয়া থাকে সে। ভাইয়েই বিশেষ দিনে সে থাকবে না এমনটা কিভাবে হয়! তাই মায়ের অমতেই দেশে চলে এসেছে সে। একজন সুন্দরী মেয়ের সাথে দেখা হয়েছিল তার। তাকেই পটানোর চেষ্টা করছিল ইমাম যেটা এহেমাদ দেখে ফেলে। ভাইকে দেখে দৌড়ে আসে ইমাম। দুইজন দুইজনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
-বিগ ব্রো হাউ আর ইউ?
-আই এম ওয়েল। বেশি ইংরেজি শিখে গিয়েছিস বিলাতিইঁদুর!
-ব্রো প্লিজ নট নাউ।
-হ্যাঁ চল এখন। মা আজ আমাদের সেই বকা দিবে।
-অনেকদিন ধরে মাম্মার বকা শুনি না।
-ডোন্ট ওয়ারি মাই বয়েস আজ তোমাদের নাকাচুবানী দেওয়া হবে!
পিছন থেকে কারো কণ্ঠস্বর শুনতে দুইভাই পিছনে ফিরে তাকায়। ইমাম বড় একটি হাসি দেয় তাজীবকে দেখে। মামু বলে জড়িয়ে ধরে। এহেমাদ শুধুই হাসে ইমামের কান্ড দেখে। অতঃপর তিনজন মিলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরে।
ফোন টিপতে টিপতে ইমাম বলে,
-এতো বছর পর আমি এলাম ভাবলাম কোথায় তোমরা আমাকে স্পেশাল ভাবে ওয়েলকাম করবে কিন্তু এ কী!
-তা ইমাম সাহেব কেমন ওয়েলকাম চায়?
ইমাম বাঁকা হেসে এহেমাদের দিকে তাকায়। তাজীবের মুখেও বাঁকা হাসি। শুধু এহেমাদ শান্ত। ইমাম নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,
-গ্রান্ড ওয়েলকাম! লাইক বোম ফাটানো হবে, ফুলের তোরা দেওয়া হবে, অগ্নির বর্ষণ হবে সাথে ধোঁয়ারও!
-তাই নাকি? অগ্নির বর্ষণ!
তাজীব হাসতে হাসতে বলে,
-ইমাম তোমার মনে হয় তোমার কোনো চাওয়া তোমার মামু আর ভাই অপূরণ রাখবে?
-অবশ্যই না।
এহেমাদ ড্রাইভারকে আদেশ স্বরে বলে,
-গাড়ি মিনিস্টার হাসিব আলীর বাড়ির সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক।
ইমাম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
-ঐ অধম আজ বাসায় নাকি!
-হ্যাঁ। ইরান শেখের ছেলে মন্ত্রী হবে সেটা দেখতে কী আর উনি আসবেন!
তাজীবের কথায় শব্দ করে হেসে দেয় ইমাম। এহেমাদের চোখ মুখে প্রতিশোধের নেশা ভর করে। হাসিব আলীর আলিশান বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সে কাউন্ট করতে থাকে। এক, দুই আর তিন। সাথে সাথেই ব্লাস্টের শব্দে কেঁপে উঠে বাড়ি সহ রাস্তাঘাট। ইমাম গাড়ির জালানা দিয়ে মাথা বের করে দৃশ্য পরোক্ষ করে। তৃপ্তির হাসি তার মুখে। মুহূর্তেই মানুষদের ছোটাছুটি ও ধোঁয়ায় ভরে যায় জায়গা। চোখের পলকে তাঁদের গাড়ি চলে যায়। এহেমাদ তাজীবের দিকে তাকিয়ে বলে,
-মামা আমার জীবন স্বার্থ।
-হ্যাঁ বাচ্চা।
ইমাম প্রশ্নবোধক চাহিনী নিক্ষেপ করে বলে,
-বিগ ব্রো কিভাবে করলে সবটা?
-আমি কিছুই করিনি। তার পিএই যা করার করেছে আমি তো শুধু টাকা ফেলেছি!
-ইউ আরে জিনিয়াস বিগ ব্রো।
__________________
নিদিষ্ট স্থানে গাড়ি থামতেই একে একে তিনজন বেরিয়ে আসে। আনাবিয়া একজনের সাথে কথা বলছিল। ছেলেদের দেখে অস্থির হয়ে এগিয়ে আসে। রাগী কণ্ঠে বলে,
-এতো সময় লাগে আসতে!তুমি না গেলেও পারতে এহেমাদ।
-ক্ষমা করে দেন মা।
ইমাম এতক্ষন এহেমাদের পিছনে লুকিয়ে ছিল। সামনে এসে আনাবিয়াকে জড়িয়ে ধরে। আনাবিয়া আর রাগ করতে পারে না। দুইজন ছেলেকে নিয়ে ভিতরে যায়। হটাৎ সবাই লক্ষ্য করে ডানদিক থেকে অস্বাভাবিক ভাবে ধোঁয়া আসছে। আনাবিয়া ভ্রু কুচকায়। মানুষজন বলাবলি করছে,
-অনেক বড় গ্যাস সিলিন্ডার ব্লাস্ট হয়েছে হাসিব আলীর বাসায়। আগুনে জ্বলছে পুরো বাড়ি।
-ভাই আজকের দিনটাই অশুভ। এই দিনে এমপি ইরান শেখও এভাবেই মারা গিয়েছিল আজ হাসিব আলীও!
আনাবিয়া চমকিত হয়ে ছেলেদের দিকে তাকায়। এহেমাদ দৃষ্টি সরিয়ে স্টেজে যেয়ে বসে। আনাবিয়া আর কোনো প্রশ্ন করে না। অতঃপর এহেমাদকে মিনিস্টার পদে নিয়োগ করা হয়। ফাঙ্কশন শেষ হতেই সবাই শেখ বাড়িতে ফিরে আসে। ড্রইংরুমে নিউজ চলছিল। যেটায় দেখানো হচ্ছে মন্ত্রী হাসিব আলীর অগ্নি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। এই দিন আরেকজন গণমান্য ব্যক্তির মৃত্যুর শোকে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এহেমাদ, ইমাম, তাজীব সেটা দেখেও দেখলো না। বাড়িতে উৎসবের আয়োজন জানো! আনাবিয়ার মা তন্নী ফারুক মিষ্টির বাটি নিয়ে এগিয়ে আসে। এহেমাদের মুখে ও ইমামের মুখে মিষ্টি পুরে দেয়। অনেক চিকিৎসার পর সে এখন পুরোপুরি সুস্থ। কিন্তু আনাবিয়ার বাবা আর বেঁচে নেই। ইমাম সবার সাথে পরিচিত হচ্ছে। জেসিকাও ছিল। ইমাম বোনের সাথে শয়তানি করে। তাজীব যেহেতু আর বিয়ে করেনি তাই তার আর নিজস্ব কোনো পরিবার নেই। এহেমাদ, ইমামকে বড় করতে করতেই তার জীবন পার।
সবাইকে রেখে রুমে চলে আসে আনাবিয়া। যেই রুমে বিয়ের প্রথম রাত ইরান তাকে এনেছিল সেই রুমেই এখন আনাবিয়া থাকে। ধপ করে বিছানায় বসে সে। জীবনের ২০ টা বছর যুদ্ধ সমান ছিল তার জন্য। ইরান তাকে ছেড়ে চলে গেলো এই জঘন্য দুনিয়ায়। তারপর অসুস্থ শরীর নিয়ে স্বামীর খুনিকে খুঁজতে থাকে আনাবিয়া। যখন জানতে পারে হাসিব আলীই সব করিয়েছে তখন পুলিশের কাছে যায় সে। কোনো প্রুভ না থাকায় পুলিশ তাকে বিশ্বাস করে না। বরং কু প্রস্তাব দেয় তাকে। সেদিন নিজেকে অনেক ছোট মনে হয়েছিল আনাবিয়ার। বিয়ের পর স্বামী ছাড়া কোনো মেয়ের অস্তিত্বই নেই জানো!
তাজীব তার পাশে এসে দাঁড়ায়। তাকে বুঝ দেয়। এখন তারা সম্পূর্ণ একা। কেউ তাঁদের সাহায্য করবে না। আনাবিয়াকে ধয্য ধরে কয়েক বছরের অপেক্ষা করতে বলে। আনাবিয়া নিজেকে শক্ত করে ইরানের অফিস নিজে পরিচালনা করতে শুরু করে। করুণ পরিস্থিতে আনাবিয়া ইমামের জন্ম দেয়। তার দেখাশোনা করতে গ্রান্ডমা ও আনাবিয়ার খালামুনি জয়তি বেগম আসে শেখ বাড়িতে। এর মধ্যেই তাজীব ঐ ছেলে মানে ইরানের যে পিএ ছিল হাসিব আলীর চামচা। তাকে খুঁজে বের করে এবং ভয়ংকর শাস্তি দেয় তাকে। প্রথম প্রথম লস হলেও দুই বছর পর আনাবিয়া ইরানের কোম্পানিকে আরো ওপরে তুলে। এহেমাদকে এডপ্ট নেয়। নিজের ছেলের পরিচয়ে বড় করে তাকে। তার একটাই ইচ্ছে ছিল সেটা হলো একদিন এহেমাদকে হাসিব আলীর পদে বসাবে। তার দুই ছেলেকে নিয়ে সে নিজের প্রতিশোধ নিবে। হলোও তাই। আনাবিয়া ব্যবসায় এগিয়ে গেলো। যেটা দেখে জ্বলতে থাকে হাসিব আলী কিন্তু কিছু করতে পারে না।
সর্বশেষে আনাবিয়ার একটাই আপসোস। এতো শত বড় বড় ব্যক্তির সাথে ইরানের সম্পর্ক ছিল অথচ যখন সে মারা গেলো তখন কেউই জানতে চাইলো না ইরান আসলে কিভাবে মারা গেলো! ঐ বিস্তফোড়ন কী স্বাভাবিক ছিল নাকি কেউ ইচ্ছে করে করিয়েছে এটা কেউই খোঁজ নিলো না! সবাই স্বার্থপরের মতো মুখ ঘুরিয়ে নিলো!
ফ্রেশ হয়ে মায়ের রুমে আসে এহেমাদ ও ইমাম। আনাবিয়া তখনও মূর্তির মতো বসে ছিল। দুইজন আনাবিয়ার দুইপায়ের পাশে বসে পরে। ছেলেদের দিকে তাকালো না আনাবিয়া। এহেমাদ শান্ত স্বরে বলে,
-মা তোমার স্বপ্ন পূরণ করে তোমার এই ছেলের জীবন স্বার্থ আজ।
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,।
-কথা বলবে না মা?
-মাম্মা প্লিজ এভাবে বসে থেকো না। কিছু তো বলো?
আনাবিয়া কিছু বলে না। চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরে তার। এহেমাদ হাত বাড়িয়ে মায়ের অশ্রু মুছে দেয়। করুণ কণ্ঠে বলে,
-আজকের দিনে ইরান বাবা তোমাকে কাঁদতে দেখলে সেও মাইন্ড করবে মা।
আনাবিয়া এহেমাদের দিকে তাকায়। এহেমাদের গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
-তোমাকে অন্য কেউ জন্ম দিলেও তুমি ইরান শেখেরই ছেলে। তোমার মধ্যে আমি আমার ইরানকে দেখতে পাই। আজ আমার মনে হচ্ছে ইরান মারা যায়নি সে তোমার রূপে আমার কাছে আছে এখনও!
-আমি তোমারই ছেলে মা। কেউ যদি ফাঁসিতে ঝুলিয়েও বলে তুই আনাবিয়া শেখের সন্তান নয় তবুও আমি বলবো আমি আনাবিয়া শেখের বড় ছেলে ইমাম শেখের বড় ভাই।
-রত্ন দিয়েছিল সৃষ্টিকর্তা আমাকে!
এহেমাদ আনাবিয়ার ভালোবাসা দেখে গাল ফুলায় ইমাম। অভিমান কণ্ঠে বলে,
-আমিও আছি এখানে!
এহেমাদ আনাবিয়ার পায়ে মাথা রেখে মজার ছলে বলে,
-তুই আবার কে? মা এইরকম বিদেশিকে কী তুমি রাশিয়া থেকে নিয়ে এসেছো?
-একদম। রাশিয়া থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এসেছিলাম।
ইমাম এহেমাদের মাথায় টোকা দিয়ে বলে,
-আমি মিনিস্টার এহেমাদ শেখের আপন ছোট ভাই। সম্মান দিয়ে কথা বলো আমার সাথে বাচ্চা।
-আচ্ছা বাচ্চু!
আনাবিয়া আজ আর নিজের হাসি লুকাতে পারলো না। দুই ছেলে এবং ছেলেদের তার প্রতি ভালোবাসা দেখে প্রসন্ন হয় আনাবিয়া। স্মিত হেসে সেও মেঝেতে বসে। দুই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে পরম আদরে। গর্ব করে বলে,
-আমার দুই হীরার টুকরা।
দুইজনের কপালে চুমু দেয় আনাবিয়া। এহেমাদ মুচকি হেসে আনাবিয়ার মতো সেও মা ও ভাইয়ের কপালে চুমু দিয়ে বলে,
-আমার প্রিয় মানুষদের খুশিতে কারো নজর না লাগুক।
-বিগ ব্রো নানুমা নাকি তোমার জন্য স্পেশাল কিছু রান্না করেছে যাই আমি আগে আগে যেয়ে ভাগ বসাই।
ইমাম কথা শেষ করে দৌড় লাগায়। এহেমাদ উঁচু স্বরে হাসতে হাসতে আনাবিয়ার থেকে অনুমতি নিয়ে সেও চলে যায়। এতো সুখ দেখে বুক ভরে উঠে আনাবিয়ার। আনাবিয়া আনমনে বলে,
-দেখছেন আমার প্রেমিক না হওয়া হাসব্যান্ড আজ আমাদের সংসার ঠিক আমাদের স্বপ্নের মতো। শুধু আপনিই নেই! অনেক মিস করি আপনাকে। আমার সংসারকে এভাবেই গুছিয়ে রেখো সৃষ্টিকর্তা। পরিবারের সবাইকে সবসময় হাসি খুশি রেখো। আর হ্যাঁ আমার ছেলেদের সকল মনের আশা পূরণ করিও। এটাই চাওয়া আমার তোমার থেকে।
_____সমাপ্ত_____