#সে_প্রেমিক_নয়
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#পর্ব ৪৩
শরীরের ওপর ভারী কিছু অনুভব করতেই ঘুম ভেঙে যায় আনাবিয়ার। ইরান ঘুমের মধ্যে শরীরের সম্পূর্ণ ভার আনাবিয়ার ওপরে ছেড়ে দেয়। দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম আনাবিয়ার। ইরানের কাঁধে মৃদু ধাক্কা দিয়ে তাকে জাগানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ইরানের কোনো সাড়াশব্দ নেই। আনাবিয়া কয়েকবার ইরানকে ডেকে চুল ধরে জোরে টান দেয়।
ঘুমন্ত অবস্থায় হটাৎ আক্রমণে ভড়কে যায় ইরান। চোখের পলক খুলে কপাল কুঁচকে আনাবিয়াকে বলে,
-হোয়াট’স ইওর প্রবলেম আনাবিয়া?
-আপনি যে আমাকে মেরে ফেলতে চাচ্ছেন সেটা কিন্তু আমি বুঝেছি! এই এলিফ্যান্টের মতো দেহ নিয়ে আমার ওপরে ঘুমালে আমি কী নিঃশাস নিতে পারি?
নিজের অবস্থান লক্ষ্য করে চটজলদি সরে যায় ইরান। বিছানায় বসে চোখ ডলতে থাকে। আনাবিয়া কোমর ধরে উঠে বসে। বিরক্তিকর দৃষ্টিতে ইরানের দিকে তাকায়।
-ঠিক আছো তুমি? কোথাও পেইন করছে?
-কাম ডাউন আই এম ওকে।
-আচ্ছা রাতে কী হয়েছিল? আমার মাথা এতো ভার ভার লাগছে কেনো?
আনাবিয়া বিছানা থেকে নেমে আয়নার স্মুখীন যেয়ে দাঁড়ায়। চুল ঠিক করতে করতে বলে,
-ভিজে টইটুম্বুর হয়ে বাসায় আসলে জ্বর তো হবেই।
-ওয়েল। তুমি কী আমার ওপর রেগে আছো? গতকালের জন্য আই এম এক্সট্রিমলি সরি আনাবিয়া।
-কিসের জন্য সরি বলছেন? মিথ্যে বলার জন্য? নাকি ইচ্ছে করে আমাকে এতদিন কষ্ট দেওয়ার জন্য?
ইরান গম্ভীর হয়ে যায়। কাবাড খুলে একটা টি-শার্ট নিয়ে পরে। স্বাভাবিক ভাবেই বলে,
-তোমাকে আঘাত করার জন্যে।
ইরানের কথা শুনে ক্ষুন্ন হয় আনাবিয়ার মন। চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। রাগী কণ্ঠে বলে,
-আমি আমার মমের সাথে দেখা করতে চাই।
ইরান নিশ্চুপ। আনাবিয়া চোখ ছোট ছোট করে ইরানের দিকে তাকায়। কঠিন স্বরে বলে,
-আপনি আমাকে ওয়াদা দিয়েছিলেন ইরান শেখ যে আমার কোনো চাওয়া অপূরণ রাখবেন না। এখন কী নিজেই ওয়াদা ভঙ্গ করবেন?
-তৈরি হও। নিজ ওয়াদায় পাক্কা ইরান।
ইরান ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। আনাবিয়া খুশিতে আত্মহারা। আলমিরা খুলে টকটকে লাল রঙের একটি শাড়ী হাতে নেয় আনাবিয়া। এতো বছর পর তার মা তাকে দেখবে একটু সেজেগুঁজে না গেলেই নয়! আনাবিয়ার মা বাঙালি সাজ ভীষণ পছন্দ করত। কিন্তু আনাবিয়ার বড় বোনের বাঙালি মানুষ আর বাঙালি সাজ একটুও পছন্দ ছিল না। আনাবিয়ার ভালো লাগতো বাঙালি সাজ। কিন্তু ছোট বয়সে শাড়ী হ্যান্ডেল করতে পারত না। আনাবিয়ার মনে আছে তার মা তাকে বলেছিল,
-আনা তোমাকে আমি কোনো বাঙালি ছেলের সাথে বিয়ে দেবো। একদম টুকটুকে লাল বাঙালি বউ বানিয়ে রাখবে সে তোমাকে।
আনাবিয়া তখন মার কথা শুনে শুধু হেসেছিল। আয়নার সামনে যেয়ে শাড়ীটা গায়ে মেলে ধরে। খুশিতে চকচক করছে তার মুখশ্রী। আয়নায় নিজেকে দেখে বলে,
-মম তোমার আনা বড় হয়ে গিয়েছে। সে এখন একজন বাঙালির লাল টুকটুকে বউ! খুব জলদি মাদারও হয়ে যাবে তোমার আদরের আনা।
আনাবিয়া ওয়াশরুম থেকে ব্লাউজ আর পেটিকোট পরে রুমে আসে। শাড়ীটা সম্পূর্ণ মেলে বিছানায় রাখে। আয়নার সামনে বসে হালকা মেকআপ করতে। মুখে ফেইস পাউডার বা ক্রিম কিছুই দেয় না। কারণ সে এমনেই অতিরিক্ত ফর্সা তার ওপর এইসব দিলে ফর্সা ভুত দেখা যাবে আনাবিয়ার মতে! তাই চোখে হোয়াইট কাজল, মাসকারা আর চেরি রেড লিপস্টিকের ওপর লিপগ্লোস দিয়ে নেয়। আয়নার সামনে রাখা জুয়েলারির বক্স খুলে চোখ বুলায়। কানে চকচকে সাদা পাথরের সিম্পল একজোড়া ইরাররিং পরে। গলায় লকেট পরে। ছোট নাকফুলটা হাতে নেয় আনাবিয়া। নিস্পলক তাকিয়ে থেকে সেটাও পরে নেয়। সাজগোজ শেষ হলে উঠে দাঁড়ায় আনাবিয়া। শাড়ীটা সুন্দর মতো শরীরে জড়িয়ে নেয়। কুচিগুলো ঠিক করার সময় আনাবিয়ার নিজের হাতের দিকে নজর পরে। সম্পূর্ণ খালি হাত ভালো দেখাচ্ছে না। তাই আনাবিয়া মনের সাথে যুদ্ধ করে ইরানের দেওয়া রিংটা আঙুলে পরে। সবসময়ের মতো চুলগুলো মধ্যে সিঁথি করে খোঁপা করে নেয়। এই স্টাইলটা অনেক বেশি পছন্দের তার। অতঃপর সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে নিজেকে দেখতে থাকে।
আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে হটাৎ আনাবিয়া আয়নায় ইরানের অবয়ন দেখতে পায়। হতবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে পিছনে ফিরে আনাবিয়া। বুকে হাত গুঁজে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বাঁকা হাসছে ইরান। আনাবিয়া নজর সরিয়ে ফেলে। ইরান ভিতরে আসতে আসতে বলে,
-সিরিয়াসলি আমার দেখা তুমিই একমাত্র মেয়ে যে ১৫ মিনিটে তৈরি হয়ে যায়! পা ব্যাথা হয়ে গেলো!
-কে বলেছিল ঐখানে দাঁড়িয়ে থাকতে?
-তোমাকে ডিসটার্ব করতে মন চাইলো না। বাই দা ওয়ে তোমার শাড়ী পরার স্টাইলটা কিন্তু ইউনিক!
-আগের থেকেই দাঁড়িয়ে ছিলেন আপনি?
-আগে থেকে নাকি জানি না বাট তুমি যখন ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছো তখন থেকেই তোমাকে দেখছি আমি।
দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইলো আনাবিয়া। ইরানের ঠাট্টা বুঝতে অসুবিধা হয় না তার। মানে ইরান এতক্ষন তাকে পর্যবেক্ষণ করছিল! লাজে রাঙা হয়ে যায় আনাবিয়ার গালে। ইরান নিজের ড্রেস বের করতে করতে বলে,
-দরজা লাগিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করবে। আমার জায়গায় যদি অন্য কেউ হতো!
– আপনি বেতীত কারো সাহস নেই এই রুমে আসার।
-ঠিক বলেছ। ইউ নো তুমি মেয়েটা আসলেই আজিব!
-কেনো?
-তোমার জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলে এতক্ষনে আমার ১৪ গোষ্ঠী এক করে ফেলতে। কারণ আমি লুকিয়ে লুকিয়ে তার সব দেখে ফেলেছি তাই!
-লুকিয়ে দেখার মতো আর কিছু নেই আমার। তাছাড়াও আপনি দেখলেও কী না দেখলেও কী!
ইরান বিস্মিত হয়ে আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। এতো ইজিলি এই মেয়ে সবকিছু কিভাবে বলে দেয় সেটাই ভাবছে ইরান। আনাবিয়া ইরানের উত্তরের অপেক্ষা না করে বলে,
-চলুন তাহলে?
ইরান জহুরি দৃষ্টিতে আনাবিয়া পা থেকে মাথা পর্যন্ত আপাদমস্তক পরোক্ষ করে নেয়। ঠোঁটে হাত দিয়ে বলে,
-তৈরি তুমি?
-চোখ কী অন্য কাউকে দিয়ে এসেছেন নাকি?
-ব্রেকফাস্ট করেছ?
-না।
-তো যাও গিয়ে ব্রেকফাস্ট করো আমি ততক্ষনে তৈরি হয়ে আসছি।
-আর কী তৈরি হবেন আপনি? ঠিকই তো আছেন।
-শর্ট’স পরে বাহিরে যাই না আমি।
আনাবিয়া মুখ ভেংচি কেটে চলে যেতে নেয়। হটাৎ ইরানের কিছু মনে পরতেই থেমে যেতে বলে আনাবিয়াকে। আনাবিয়া ভ্রু কুঁচকে বলে,
-সমস্যা কী?
-ওয়েট।
ইরান আলমিরা খুলে একটি ছোট ব্যাগ বের করে। ব্যাগ থেকে একটি বক্স বের করে এগিয়ে দেয় আনাবিয়ার কাছে। আনাবিয়া বক্সটা খুলে বলে,
-চেইন! বাট আমি তো লকেট পরা।
-চেইন না স্টুপিড! কোমর বন্ধনী। অনেকদিন আগে তোমার জন্য গিফট হিসেবে এনেছিলাম বাট দেওয়া হয়নি।
-কিভাবে পরে এটা?
-প্রথমে খুলো। চেইনের মতোই কোমরে পরে।
ইরানের কথা মতো কোমর বন্ধনী খুলে হাতে নেয় আনাবিয়া। কোমরে পরার সময় একটু অসুবিধা হয় তবুও ইরানকে পরিয়ে দিতে বলে আর না ইরান এগিয়ে আসে। দুইজনের ইগো আকাশ সমান! পরা শেষ হলে আনাবিয়া দম নেয়। শাড়ী ঠিক করে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। ইরান আনাবিয়ার ব্যবহার দেখে নিজ কপালে চাপর মারে। হাসতে হাসতে বলে,
-একজন পেয়েছিলাম আমি! একটু জিজ্ঞেসও করল না “আমাকে কেমন লাগছে”! কোথায় আমি আরো তারিফের ঝুঁড়ি খুলে বসেছিলাম! এখন একটাই ভয় আমার নিষ্পাপ বেবিটাকেও না আবার নিজের বহুরূপ বানিয়ে দেয়।
”
”
”
”
অন্যদিকে রাকিয়া চিন্তিত হয়ে ড্রইংরুমের সোফায় বসে আছে। দুইদিন ধরে ইসরাফের কোনো খবর নেই। শেষবার ইসরাফ তাকে বলেছিল বন্ধুদের সাথে ট্যুরে যাচ্ছে সে। কিন্তু এরপর আর একবারও কল দেয়নি। রাকিয়া জানে ইসরাফ তাকে মুখে মুখে মা বললেও মন থেকে মা হিসেবে মেনে নেয় নি। তনুসফা মাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে আসে। পাশে বসে সান্ত্বনা স্বরে বলে,
-আম্মা এতো চিন্তা করো না। ও ওর ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরতে গিয়েছে এখন ফোন ধরার সময় হয়তো পায় না।
-একবার একটু বললে ওর কী ক্ষতি হয়ে যাবে! আমি যে চিন্তা করছি ইসরাফ বুঝে না?
-আম্মা পর কখনই আপন হয় না।
-তুই একটু ওকে ফোন দে না।
-দিয়েছিলাম নাম্বার বন্ধ আসে।
-ওহ।
-চিন্তা করো না। আনাবিয়া কেমন আছে এখন?
-ভালোই আছে।
-ও এখন এতো অসুস্থ হয় আবার বড় কোনো রোগ হলো নাকি?
-চুপ অশুভ কথা বলিস না। ওহ হ্যাঁ আমি আনাবিয়ার জন্য পুডিং আর ক্ষীর রান্না করতাম। দেখ তোর সাথে কথা বলতে গিয়ে ভুলেই গিয়েছি!
তনুসফা সন্দীহান দৃষ্টিতে রাকিয়ার দিকে তাকায়। শান্ত স্বরে বলে,
-হটাৎ এতো রান্না বান্না কেনো আম্মা?
-এখানে এতো কোথায়! আর আনাবিয়ার মিষ্টি অনেক প্রিয় তাই আমি এইসব রান্না করে বিকালে ওর জন্য নিয়ে যাবো।
-ওহ ভালোই তাহলে।
-হ্যাঁ। রান্না সেরে আসি আমি।
__________________🌸
চলন্ত গাড়িতে বসে আছে আনাবিয়া ও ইরান। ড্রাইভ করছে তাজীব। অধয্য হয়ে হাত মুচড়াচ্ছে আনাবিয়া। আনাবিয়া এক্সসাইটমেন্ট দমিয়ে রাখতে না পেরে ইরানকে জিজ্ঞেস করে,
-আমার বোন কী এখন আরো বড় হয়ে গিয়েছে? আর মম, ডেডি সবাই কী সুস্থ আছে?
-গেলেই তো দেখতে পারবে।
-হ্যাঁ। তারা আমাকে দেখলে হয়তো অনেক খুশি হবে। তাই না?
ইরানের মুখে একরাশ অন্ধকার এসে হানা দেয়। মুখে কিছু না বলে মাথা নারায়। বেশ কিছুক্ষন জার্নি করে একটি ভিলার সামনে গাড়ি থামে। তাজীব আগে বের হয়ে আনাবিয়ার দরজা খুলে দেয়। বাহিরে আসতেই আনাবিয়ার খুশি আরো বেড়ে যায়। ইরান মনে মনে ভীষণ ব্যাথা অনুভব করছে আনাবিয়াকে এতো খুশি দেখে। হয়তো কিছুক্ষন পরই এই হাসিখুশি মুখে হাসি থাকবে না! এটাকে বাড়ি থেকে জঙ্গল বললে বেশি ভালো মানায়। বড় বড় গাছগাছালি দিয়ে ভরা। ভিতরে একটি ভিলা দেখা যাচ্ছে সেটাও গাছের জন্য অস্পষ্ট। আনাবিয়া ইরানের দিকে তাকিয়ে বলে ,
-বাড়ি বানানোর জন্য আর জায়গা পাননি আপনি?
-এটা আমার সিক্রেট প্লেস। আমার আপনজন ছাড়া কেউই এই বাড়ির বিষয় অবগত নয়।
-ভুতিয়া বাড়ি!
-এসো। নিচে দেখেশুনে এসো।
তিনজন ভিতরে প্রবেশ করে। গাছের নিচ দিয়ে হেঁটে বাড়ির সামনে পৌঁছায় তারা। কলিংবেল বাজাতেই একজন ভৃত্য দরজা খুলে দেয়। ইরান আনাবিয়াকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বাড়ি দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় আনাবিয়া।
-আমাকে মমের কাছে নিয়ে চলুন ইরান।
-নিয়ে যাবো তার আগে তোমার নিজেকে শক্ত করতে হবে।
আনাবিয়া ইরানের কথার মানে বুঝতে পারে না। তাই অবুঝের মতো জিজ্ঞেস করে,
-মানে?
-তাঁদের দেখলেই বুঝে যাবে।
ইরান আগে আগে হাঁটতে থাকে পিছু পিছু আনাবিয়াও যায়। একটি রুমে প্রবেশ করে ইরান। আনাবিয়া রুমের ভিতরে পা দিবে হটাৎ করেই তার মন বিচলিত হয়ে পরে। অদ্ভুত অনুভূতি হতে থাকে তার। ইরান উঁচু স্বরে ডাক দেয় আনাবিয়াকে। না চাওয়ার শর্তেও আনাবিয়া রুমের ভিতরে প্রবেশ করে। মোটামুটি সব ফার্নিচারই রুমে রাখা। মধ্যে বড় একটি বেড। সবকিছু ঠিক থাকলেও একজন নার্সকে দেখে কপাল কুঁচকে যায় আনাবিয়ার। মনে কু ডাকছে তার। আরেকটু সামনে যেতেই আনাবিয়া বিছানায় শুয়িত তার মাকে দেখতে পায়। খুশিতে চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পরছে তার। আশেপাশের কোনোকিছু খেয়াল না করে আনাবিয়া মায়ের পাশে বসে তার হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নেয়। শব্দ করে কাঁদতে থাকে আনাবিয়া।
আনাবিয়ার কান্নার শব্দ শুনে একসময় তন্নী ফারুকের ঘুম ভেঙে যায়। দ্রুত করে শোয়া থেকে উঠে বসে সে। আনাবিয়া কাঁপাকাঁপা হাতে মায়ের মুখ ছুঁয়ে দেয়। জড়িয়ে ধরতে নেবে এমন সময় তন্নী ফারুক রেগে ধাক্কা দেয় আনাবিয়াকে। ইরান সামলে নেয় আনাবিয়াকে নাহলে বিছানা থেকে নিচে পরে যেত। আনাবিয়ার মা চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে। একদম বাচ্চাদের মতো কান্না করে আনাবিয়াকে দূরে সরে যেতে বলে।
মায়ের এহেন ব্যবহার দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় আনাবিয়া। ইরান এক হাত দিয়ে ধরে রেখেছে আনাবিয়াকে। প্রশ্নবোধক নজরে ইরানের পানে তাকায় আনাবিয়া। ইরান কিছু বলে না। আনাবিয়াকে ছেড়ে হাসি মুখে এগিয়ে যায় আনাবিয়ার মায়ের কাছে।
-বিউটিফুল কান্না করছেন কেনো আপনি? ভালো মেয়েরা কান্না করে না।
-ও কে? ওকে বলো এখান থেকে চলে যেতে।
-ও আমাদের আরেকটা বন্ধু। আর বন্ধুদের সাথে এরকম আচরণ করে না।
-ও বন্ধু?
-হ্যাঁ বন্ধু। ওর সাথে ভালোভাবে কথা বললে ও আপনাকে চকলেট দিবে।
-সত্যি চচচকলেট দিবে?
-হুমমম।
ইরানের কথা শুনে খুশি হয়ে হাতে তালি দেয় আনাবিয়া মা। আনাবিয়া শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে মেঝেতে বসে পরে। অনবরত চোখ দিয়ে নোনা পানি গড়িয়ে পরছে তার। নার্স আনাবিয়ার মা কে চকলেট দিয়ে শান্ত করে রাখে। ইরান আনাবিয়ার পাশে বসে শান্ত স্বরে বলে,
-মানসিক ভারসাম্যহীন উনি। কাউকে চেনে না এমন কী কারো কথা মনেও নেই তার। এতো চিকিৎসা করিয়েও সুস্থ করতে পারিনি। কানাডার ডাক্তার বলেছিল অপারেশন করলে আরো খারাপ অবস্থা হতে পারে সেই ভয়ে অপারেশন করানো হয়নি।
>>>>চলবে।
#সে_প্রেমিক_নয়
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#পর্ব ৪৪
স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষন বসে থাকে আনাবিয়া। ইরান বার বার আনাবিয়ার দিকে তাকাচ্ছে। কী বলে সান্ত্বনা দেবে আনাবিয়াকে বুঝতে পারছে না ইরান। নরম কণ্ঠে আনাবিয়াকে বলে,
-এখন ভেঙে পরার সময় না আনাবিয়া। নিজেকে শক্ত করো। যদি নিজের মা কে সত্যি ভালোবাসো তাহলে শক্ত হয়ে তার সেবায় নিয়োজিত হও। আমরা দুইজন মিলে পুনরায় তাকে বাহিরের দেশের হসপিটালে নিয়ে যাবো।
আনাবিয়া নাক টেনে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে। চোখের পানি গুলো মুছে ফেলে। হয়তো ইরানের কথা কাজ করেছে। ইরানের হাত কাঁধ থেকে সরিয়ে দেয় আনাবিয়া। উঠে দাঁড়িয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে মায়ের কাছে এগিয়ে যায়। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
-আমার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করবেন?
আনাবিয়ার মা ছোট ছোট চোখ করে আনাবিয়াকে দেখে। মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলে,
-তুমি আমার জন্য চকলেট আনো নি তাই ফ্রেন্ডশিপ হবে না।
-আগামীকাল নিয়ে আসবো। ওকে?
-ওকে ওকে।
-তাহলে ফ্রেন্ডশিপ পাক্কা?
আনাবিয়ার মা খুশিতে গদগদ করতে করতে আনাবিয়ার হাত ধরে। আঙুল দেখিয়ে বলে,
-পাক্কা পাক্কা। কাল চকলেট নিয়ে আসবে।
-হ্যাঁ আনবো।
-এখন তাহলে আমার রুম থেকে বের হও বন্ধু আমি ঘুমাবো।
-এখন ঘুমাবে?
-হুম।
ইরান ইশারা করতেই আনাবিয়ার না চাওয়ার শর্তেও মায়ের হাত ছেড়ে দেয়। তারপর দুইজন রুম থেকে বেরিয়ে আসে। আনাবিয়া কিছু বলে না। ইরান আনাবিয়াকে অন্য রুমে নিয়ে যায়। এখানেও একজন নার্স ছিল। এই রুমে আনাবিয়ার বাবা। বিছানায় শুয়ে আছে। আনাবিয়া বাবার পায়ের সামনে বসে পরে। কিন্তু এবার কান্না করে না যা বুঝার বুঝে ফেলেছে সে। ইরান শান্ত কণ্ঠে বলে,
-এতো বছর ধরে কোমায় আছে সে। এই বিছানায়ই শুয়ে থাকে সবসময়। খাইয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে সব কাজ নার্স এবং ভৃত্যরা করে।
আনাবিয়া কিছু বললো না। ইরান মনে মনে ভয় পেতে থাকে আনাবিয়াকে নিয়ে। কিছু সময় অতিবাহি হওয়ার পর গম্ভীর কণ্ঠে আনাবিয়া বলে,
-আমার বোন কোথায়?
-সে বেঁচে নেই। প্লিজ আনাবিয়া কোনো রিএক্ট করার আগে আমার কথা ভালোভাবে শুনে নিও।
আনাবিয়া কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। কত খুশি হয়ে সাজগোজ করে আসলো অথচ! আনাবিয়া পারছে না চিৎকার করে কান্না করে দেয়। তার জীবনেই কেনো এতো কষ্ট!
-আনাবিয়া বাসায় যেতে হবে।
-যাবো না আমি। এখানেই থাকবো।
-এখন এখানে কোনো জামাকাপড় নেই। আগামীকাল সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে এসো একবারের জন্য।
ইরানের কথার বিপরীতে কিছু বললো না আনাবিয়া। কিছুক্ষন সেখানে থেকে দুইজন বাসায় ফিরে আসে। হাসিখুশি হয়ে রওনা দিলেও বাসায় আসে উদাসীন হয়ে। কান্না করায় চোখ ফুলে গিয়েছে। রুমে এসে বিছানায় বসে পরে আনাবিয়া। ইরান রুমে আসতেই আনাবিয়া প্রশ্ন ছুঁড়ে মারে তার দিকে।
-এবার কী তাহলে সত্যিটা বলবেন আমাকে? আর কত মিথ্যের বেড়াজালে রাখবেন?
-বলেছি তো। আমার জন্যই তাঁদের এই অবস্থা। তোমার অপরাধী আমি। তোমার যা মন চায় শাস্তি দেও আমাকে।
আনাবিয়া রেগে উঠে দাঁড়ায়। ইরানের কলার ধরে চেঁচিয়ে বলে,
-কী ভাবেন কী নিজেকে? অনেক ভালো অভিনয় পারেন আপনি? রাশিয়া থেকে আসার পর থেকে আপনার বিষয় সবই জানি। আপনিও নাটক শুরু করেছেন তাই বাধ্য হয়ে আমারও নাটক করতে হয়েছে। আজ সত্যিটা নিজের মুখে স্বীকার করুন ইরান।
-কী জানতে চাও তুমি? কী জানতে চাও?
-সব।
ইরানের কলার ছেড়ে সোফায় বসে পরে আনাবিয়া। ইরান দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বলে,
-আট বছর আগে সিআইডি অফিসার তন্নী ফারুককে এরফান শেখের কালো ধান্দার সকল খবর আমিই দিয়েছিলাম। আমিই তাকে সাহায্য করেছিলাম যাতে এরফান শেখ একটু জেলের স্বাদ অনুভব করাতে পারে। আমরা দুইজন এক টিমে থেকেও শত্রু হওয়ার অভিনয় করেছি। কানাডায় বসেই সবকিছু করছিলাম আমি যাতে এরফান শেখ না বুঝতে পারে। কিন্তু তবুও তার আমার ওপরে সন্দেহ হয় তাই দেশে এসে পরতে বলে। যে ভিডিও তোমাকে পাঠানো হয়েছিল আমার আর তোমার মায়ের কথা বলার সেটাও আমাদের প্ল্যানই ছিল। আমি চেয়েছিলাম এরফান শেখের কাছে ভালো সেজে তার পোল খুলে দেবো। বাট এই কাজে সক্ষম হই না আমরা। যেদিন তাঁদের গাড়ি এক্সিডেন্ট হয় সেদিন আমি আগে আগেই তোমার মা কে সবটা জানিয়ে দেই। সে আমাকে বলেছিল আমি যাতে এরফান শেখের কথা শুনি। তারা দুইটা গাড়ি নিয়ে বের হবে। একটায় একজন পুলিশ থাকবে আরেকটায় তারা থাকবে। ঐ পুলিশটাও এরফান শেখের সাথে মিলে ছিল যেটা আমরা জানতাম না। তো দুইটা গাড়িই সেম ছিল। আমাদের প্ল্যান মতো আমি প্রথম গাড়ির এক্সিডেন্ট করিয়ে দেই। আর সেই গাড়িতেই তোমার ফ্যামিলি ছিল।
ইরান তপ্ত নিঃশাস ছাড়ে। আনাবিয়া আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞেস করে,
-তারপর?
-তারপর যখন আমি দেখি ঐ গাড়িতেই তোমার ফ্যামিলি ছিল আমার পুরো দুনিয়া থমকে যায়। তবুও তাঁদের জন্য মুখে হাসি বজায় রাখি। তখন আমি বুঝতে পারি এই পুলিশটা এরফান শেখের টিমে ছিল। ইসরাফ তাঁদের চেক করতে যেতে নেয় কিন্তু বুদ্ধি খাঁটিয়ে আমিই চেক করতে যাই। তবুও ইসরাফ জা*নো*য়ার আমার পিছনে পিছনে যায়। তোমার মা এবং বোনকে আমি চেক করি। দেখি তাঁদের নিঃশাস চলছে। মনে মনে প্ল্যান করি তাঁদের কোনোভাবে সরিয়ে ফেলবো। কিন্তু ইসরাফ তোমার বাবাকে চেক করে দেখে তার নিঃশাস তখনও চলছে। তাই এরফান শেখ আমাকে বলে তাকে গুলি করে মেরে ফেলতে। ইসরাফ একটু দূরে সরে যেতেই আমি সবার চোখের আড়ালে তোমার বাবার পায়ের কিনারে গুলি মারি। যেটা তার গায়ে লাগে না। অতঃপর এরফান শেখ আমাকে বলে তাঁদের ব্যবস্থা করতে। হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো সবার থেকে লুকিয়ে তাঁদের হসপিটালে নিয়ে যাই আমি। ততক্ষনে তোমার বোন মারা যায়। কিন্তু তোমার বাবা ও মা বেঁচে ছিল। এই দেশে থাকা তাঁদের জন্য রিক্স তাই আমি তাঁদের কানাডায় নিয়ে যাই। সেখানেই তাঁদের চিকিৎসা হয়। সেইসময় তন্নী ফারুকের এক্সিডেন্ট নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিল। তখন এরফান শেখ ভীত হয়ে যায়। অনেকেই বলছিল এক্সিডেন্ট হলে লাশ কোথায়? কয়েকজন বলেছিল হয়তো কিনারের নদীতে পরে গিয়েছে। আর সেইসময়ই তোমাকে আমার পছন্দ হয়। এরফান শেখ আমার দুর্বলতাকে নিজের কাজে লাগায়। আমাকে বলে যদি আমি তোমাকে নিজের করে পেতে চাই তাহলে তন্নী ফারুকের এক্সিডেন্টের দায়ভার সারাজীবনের জন্য নিজের মাথায় নিতে হবে। আমিও সেইসময় বেকুব বনে যাই! তাই তার কথায় রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু কয়েকবছর পর সে ওয়াদা ভঙ্গ করে।
গালে হাত দিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে ইরানের কথা শুনছে আনাবিয়া। ইরানের শরীর ইতিপূর্বে শীতল হয়ে গিয়েছে। মনের ভিতরে অজানা ভয় বাসা বেঁধে বসেছে। তবে আনাবিয়া কী তাকে অবিশ্বাস করবে? নাকি আগের মতো তাকেই দোষী করবে? আনাবিয়ার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে নড়েচড়ে দাঁড়ায় ইরান। মুখে গম্ভীরত্ব ভাব এঁটে বলে,
-আমি জানি তুমি হয়তো আমার কথায় বিশ্বাস করতে পারছো না। কিন্তু এটাই সত্যি। তবুও আমিই তোমার অপরাধী। ভুল করে হলেও তাঁদের এক্সিডেন্ট আমিই করিয়েছি।
মাথা উঁচু করে ইরানের দিকে চোখ স্থির করে আনাবিয়া। দৃঢ়তার সাথে বলে,
-আমি জানি সবটা।
-হাউ? আর আসলেই তুমি সত্যিটা কিভাবে জানলে? কে বলেছে তোমাকে?
-কে বলবে আবার! রাশিয়ায় যেয়ে সত্যিটা আন্দাজ করতে পেরেছিলাম আমি। তারপর আপনার মিথ্যে বানোয়াটে কথা শুনে আমি সবটা বুঝে যাই।
-একটু বুঝিয়ে বলবে?
-ঐ ভিডিওটা দেখে আমি সবসময় ইসরাফ আর আপনার বাবাকেই দোষী হিসেবে জানতাম। তাই তাঁদের থেকে প্রতিশোধ নিতে এ দেশে এসেছি। আপনার বিষয় কিছুই জানতাম না আমি। বিয়ের পরও সব ঠিকই ছিল। রাশিয়া যেয়ে মমের রুম গুছানোর সময় আমি একটা ডায়রি পাই। ঐ ডায়রির মধ্যে এরফান শেখের বিরুদ্ধে কিছু প্রুভ ছিল। তো আমার ঘটকা লাগায় ডায়রি খুলে পড়া শুরু করি। মমের পার্সোনাল বিষয়ে লিখা ছিল। পড়তে পড়তে একসময় শেষের পেজে নজর আটকে যায় আমার। সেখানে আপনার বিষয়ও লিখা ছিল।
ইরান বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
-কী লেখা ছিল?
আনাবিয়া কিছু না বলে শান্ত ভনিতায় উঠে দাঁড়ায়। আলমিরা খুলে যেখানে তার ড্রেস রাখে সেখানে হাতিয়ে একটা ডায়রি বের করে। ইরান আনাবিয়ার গুপ্ত স্থান দেখে চোখ বড় বড় করে ফেলে। আনাবিয়া এগিয়ে এসে ডায়রিটা ইরানের হাতে ধরিয়ে দেয়।
-একদম শেষের আগের পৃষ্ঠা পড়ুন।
আনাবিয়ার কথা মতো সোফায় বসে ইরান। ডায়রি খুলে হাতে নিয়ে পড়া শুরু করে। সেখানে লেখা ছিল,
“কর্মের ক্ষেত্রে অনেকের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে আমার তবে ইরান ছেলেটা অন্যরকম। এইটুকু বয়সেই ছেলেটার মধ্যে অনেক সাহস। নিজের অধম বাবাকে শাস্তি দিতে নিজেই উঠে পরে লেগেছে! সবাই যদি এমন হতো তাহলে হয়তো দুনিয়াতে কোনো দুর্নীতি হতো না! প্রথমে আমি ছেলেটাকে বিশ্বাস করিনি কিন্তু এখন অনেক প্রিয় হয়ে উঠেছে সে। সামনে অপরাধীদের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে না জানে কবে নিজের জান ত্যাগ করি আমি। আনাবিয়া বা আনতাসিয়া তোমরা কেউ যদি এই ডায়রিটা পড়ে থাকো তাহলে আমি মারা যাওয়ার পর একবারের জন্য হলেও বাংলাদেশে যেয়ে এই সাহসী বালককে আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ এবং অনেক ভালোবাসা জানিও।
আমি দোয়া করি এইরকম একজন বালক যাতে আমার মেয়েদের ভাগ্যে জুটে। তাহলে আমার আর কোনো চিন্তে নেই। সত্যি যদি এই বারে সফল্য হয়ে ফিরতে পারি তাহলে ইরানকে বলবো আমার বড় মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিতে চাই সারাজীবনের জন্য। ছোটজন তো এখন অনেক ছোট! আশা করি সৃষ্টিকর্তা আমার এই স্বপ্ন পূরণ করবে।
পড়া শেষ হলে ডায়রি বন্ধ করে কিনারে রাখে ইরান। আনাবিয়া মুখ বাকিয়ে বলে,
-শেষের অংশ ভালো করে পড়েছেন?
ইরান বুঝলো আনাবিয়া জেলাস হয়ে কথাটা বলেছে। তাই এইসময় আনাবিয়ার রাগ না বাড়িয়ে চুপ রইলো ইরান। আনাবিয়া ইরানের কাছে আসতে আসতে বলে,
-আজ মম সুস্থ থাকলে সব কিছু স্বাভাবিক থাকলে আপনি আমার ব্রাদার ইন লও হতেন ইরান শেখ!
-এখন হইনি তো। এখন আমাকে বলো তোমার মম বেঁচে আছে এটা কে বলেছে তোমাকে?
এতক্ষন স্বাভাবিক থাকলেও এখন একটু নরম হয়ে যায় আনাবিয়া। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলে,
-হননি বাট হতেন।
-এনি চান্স তুমি কথা ঘুরানোর প্রয়াস করছো আনাবিয়া? আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি।
-সরি বলতে পারব না আমি।
আনাবিয়া মাথা নত করে ফেলে। ইরান কঠিন চোখে আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে রুক্ষ কণ্ঠে বলে,
-আমি জিজ্ঞেস করছি তাই বলতে হবে।
-বলবো বাট আপনি তাকে কিছু বলতে পারবেন না আর না কোনো শাস্তি দিতে পারবেন। সে আমাকে বলতে চায়নি একদম। আমিই আপনার কসম দিয়ে তার মুখ থেকে সত্যিটা বের করেছি।
আনাবিয়ার কথায় ইরান বুঝে যায় এই সাদু মানুষটা কে। তাই চট করে বলে,
-তাজীব?
-ইয়েস।
-ওকে তো আমি! আমার সাথে গাদ্দারি করেছে না এর শাস্তি ও পাবে।
-ওকে কিছু বলতে পারবেন না আপনি। সে চায়নি আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হোক তাই সত্যিটা বলছে। এখন আপনার উচিত ওকে ধন্যবাদ বলা।
-ওকে তো আমি পরে দেখে নেবো।
___________________🌸
এতদিন পর হালকা হয় আনাবিয়ার মন। তবুও মা বাবা ও বোনের জন্য চাঁপা কষ্ট রয়েই গেলো জানো! রাত নয়টা বাজে এখন। শরীর দুর্বল হওয়ায় ঘুম দিয়েছিল আনাবিয়া।
বিকেলে রাকিয়া এসেছিল তাকে দেখতে। অনেকক্ষণ কথা বলে দুইজন। আনাবিয়া রাকিয়াকে সব খুলে বলে। সবটা শুনে রাকিয়া খুশি ও হয় আবার কষ্টও পায়। আনাবিয়ার বাবা মা বেঁচে আছে শুনে খুশি হয় কিন্তু তাঁদের অসুস্থের কথা শুনে মন খারাপ হয়ে যায় তার। নিজ হাতে আনাবিয়াকে ক্ষীর খাইয়ে দেয়। দুই ঘন্টার মতো থেকে চলে যায় রাকিয়া। ইরান অফিসে। তাই রুমে এসে ঘুম দেয় আনাবিয়া। এখনই ঘুম ভেঙেছে তার। ফ্রেশ হয়ে নিচে এসে দেখে ইরান ড্রইংরুমের সোফায় বসে আছে। ডায়নিং টেবিলে খাবারের ব্যবস্থা চলছে। আনাবিয়ার নজর যায় তাজীবের ওপর। ইরানের পাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আনাবিয়া এগিয়ে যেয়ে সোফায় বসে।
-তাজীব ব্রো এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো বসুন।
-সমস্যা নেই ম্যাম।
ইরান গম্ভীর হয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
-তো তোমাকে কী শাস্তি দেবো তাজীব? আমার সাথে গাদ্দারি করেছ অবশ্য বড় শাস্তিই পাবে।
তাজীব মলিন মুখে দাঁড়িয়ে রইলো কিছু বললো না। আনাবিয়া রাগী কণ্ঠে চেঁচিয়ে বলে,
-আপনি তাকে কোনো শাস্তি দিতে পারেন না ইরান।
-এটা আমার আর আমার পিএ এর ম্যাটার আশা করি তুমি মধ্যে আসবে না।
ইরানের কথায় জব্দ হলো আনাবিয়া। মুখ ভার করে বসে তাঁদের কার্যকলাপ দেখতে থাকে। ইরান পুনরায় উঁচু স্বরে বলে,
-বলো তোমাকে কী শাস্তি দেবো?
-আপনি যে শাস্তি দেবেন সেটাই আমি মাথা পেতে নেবো স্যার।
-ঠিক আছে আমার জন্য নতুন পিএ খোঁজা শুরু করো। দুইদিনের মধ্যেই আমার নতুন পিএ চাই। আর নতুন পিএ পেয়ে গেলে তোমাকে তোমার পথ থেকে বহিস্কার করা হবে।
কাঁদো কাঁদো হয়ে যায় তাজীবের মুখ। আনাবিয়াও দুঃখিত হয়ে কিছু বলতে যেয়েও চুপ করে রয়। তাজীব মাথা নাড়িয়ে বলে,
-ঠিক আছে স্যার। আমি আজই এই বাসার থেকে চলে যাচ্ছি। আপনার জন্য নতুন পিএ খোঁজা হলে অফিস থেকেও চলে যাবো।
ইরান অসন্তুষ্ট হয়ে তাজীবকে বলে,
-এই তোমার অনুগত্বতা? বাহ্!
-মানে? আমি বুঝতে পারছি না স্যার।
বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় ইরান। তাজীবের দুই কাঁধে হাত দিয়ে বলে,
-শোন্ তাজীব, তোমাকে কখনই আমি আমার পিএর নজরে দেখিনি। আপন ভাইয়ের থেকেও বেশি ভালোবেসেছি তোমাকে। সেই ভাইকে কিভাবে চলে যেতে বলি!
ইরান আড়চোখে আনাবিয়ার দিকে তাকায়। প্রশ্নবোধক চাহনি আনাবিয়ার। ইরান স্মিত হেসে বলে,
-আমার পিএ এর পথ থেকে বহিস্কার করেছি তোমাকে এই বাড়ির থেকে নয়! তোমার যেহেতু তোমার বোনের প্রতি এতই চিন্তা তাই আজ থেকে তুমি আনাবিয়ার অ্যাসিস্ট্যান্ট। বাসায় থাকবে সারাদিন ওর খেয়াল রাখবে, ও যেখানে যাবে সেখানে যাবে, আর সবচেয়ে বড় কথা হলো আমার সন্তানকে নিজের হেফাজতে রাখবে একজন আদর্শ মামা হয়ে। করবে এই কাজ?
তাজীবের চোখ মুখে খুশি উতলে পরে। গদগদ করতে করতে বলে,
-অবশ্যই করব স্যার। ম্যামের বডিগার্ড হয়ে থাকবো আমি। কিন্তু স্যার আপনার জন্য আমার চিন্তা হয়।
-দুই কাজ একসাথে করতে পারবে না। তাই তোমার মতোই একজন ছেলে খুঁজে দিও আমাকে।
-জি স্যার।
আনাবিয়া খুশি হয়ে উঠে দাঁড়ায়। কিছু একটা ভেবে বলে,
-এটাই বেস্ট হবে। তাজীব ব্রো মতো একজন ভাই থাকলে আমার আর কিসের প্রয়োজন!
তাজীব আনাবিয়ার দিকে চোখ তুলে তাকায় না। নিচে তাকিয়ে বলে,
-অনেক ধন্যবাদ ম্যাম। আমার মতো একজন মানুষকে এতো বড় মর্যাদা দিয়েছেন আমি ধন্য! আপনাকে কথা দিচ্ছি স্যার কখনই কমপ্লেইন করার সুযোগ দেবো না মন দিয়ে নিজ দায়িত্ব পালন করব।
-তোমার থেকে আমি এটাই আশা করি। আগামীকাল আনাবিয়ার সাথে তুমিও বাগানবাড়িতে চলে যাবে।
-তাহলে সম্মেলনের আয়োজনের কাজ আপনি একা কিভাবে সামলাবেন স্যার?
-আমি একা কোথায় নতুন পিএ থাকবে আমার সাথে।
-কিন্তু স্যার যদি কেউ ষড়যন্ত্র করার প্রয়াস করে? নতুন পিএ সবটা সামলাতে পারবে না।
-এরকম কিছুই হবে না। অনেক সিকিউরিটি থাকবে আর কড়া ব্যবস্থা করা হবে।
এতক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে দুইজনের কথা শুনছিল আনাবিয়া সম্মেলনের কথা শুনে জিজ্ঞেস করে,
-সম্মেলন কী?
-একটা ফাঙ্কশনের মতো। মন্ত্রী, এমপি চেয়ারম্যান সকলে উপস্থিত থাকে সেখানে। অনেক সময় মিছিল হয়। দেশের উন্নয়নের বেপারে আলোচনা হয়। নির্বাচন নিয়ে সমালোচনা আলোচনা হয়।
-ওহ!
___________________🌸
রাতে ডিনার করে কিছু কাজ শেষ করে রুমে আসে ইরান। আনাবিয়া মনোযোগ দিয়ে তার জামাকাপড় প্যাক করছে। হটাৎ করেই ইরানের মনে পরে যায় আনাবিয়া চলে যাচ্ছে অনিদিষ্ট দিনের জন্য। হয়তো এটাই তার শাস্তি! ইরান মাঝে মাঝে যেয়ে দেখা করে আসতে পারবে বাট এখনের মতো সবসময় আনাবিয়ার মুখশ্রী দর্শনের সুযোগ পাবে না। ঘামাক্ত শরীর নিয়ে ক্লান্ত হয়ে বাসায় এসে আনাবিয়াকে দেখবে না! কেউ সেঁধে এসে তার সাথে ঝগড়া করবে না! কেউ রাগ অভিমান করে গাল ফুলিয়ে রাখবে না! মুখ ছোট করে ডিভাইনে বসে পরে। আনাবিয়া ইরানকে দেখে হাসি মিশ্রিত গলায় বলে,
-জানেন আমার কত খুশি খুশি লাগছে। দেখবেন যেভাবেই হোক আমি তাঁদের সুস্থ করে ছাড়বো। রাশিয়ায় ভালো হসপিটাল আছে দরকার পরলে সেখানে নিয়ে যাবো।
-আমিও আছি তোমার সাথে যেখানে নিয়ে যেতে বলবে সেখানেই নিয়ে যাবো। আর হ্যাঁ নিজের খেয়ালও রেখো। আমার বেবির অযত্ন করিও না।
-বেবি এখনও হয়নি।
-হয়নি বলেই নিজের যত্ন করতে হবে। কোনোরকম অসুবিধা হলেই আমাকে কল করে জানাবে।
-হুম।
প্যাকিং করা শেষ হলে ব্যাগ কিনারে রাখে আনাবিয়া। বিছানায় বসে ইরানের পানে তাকায়। ইরানকে মুখ লটকিয়ে বসে থাকতে দেখে আনাবিয়া চমকিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
-আপনি কী সেখানে যাবেন না?
-দেখা করতে যাবো।
আনাবিয়ার মন ক্ষুন্ন হয় ইরানের জবাব শুনে। কপাল কুঁচকে শান্ত কণ্ঠে বলে,
-এখানে থেকে আরেকটা বিয়ে করতে চান আপনি? সব বুঝি আমি।
ইরান আহাম্মক বনে যায় আনাবিয়ার কথা শুনে। মুখে বিস্ময় ভাব এনে বলে,
-এইরকম অদ্ভুত চিন্তা ভাবনা তোমার মাথায় কিভাবে আসে! তুমি থাকতে আমি কেনো আরেকটা বিয়ে করব?
-যদি আমার সেখানে এক কী দুই বছর থাকতে হয় তাহলে এতদিন আপনি আমাকে ছাড়াই থাকবেন?
-থাকতে হলে থাকবো।
-বুঝেছি আরেকটা বিয়ে করবেন। ভালো। বেশ ভালো।
ইরান বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। আনাবিয়ার পাশে বিছানায় বসে শান্ত কণ্ঠে বলে,
-আমি বুঝতেছি না আমি আরেকটা বিয়ে কেনো করব?
-আমার জানা মতে বিবাহিত পুরুষ স্ত্রী ছাড়া এতদিন থাকতে পারে না। তাহলে এটাতেই বুঝা যায় আপনি আরেকটা বিয়ে করবেন।
আনাবিয়ার বাচ্চামো কথায় হেসে দেয় ইরান। হাসতে হাসতেই বলে,
-আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে একটু বেশিই ভালো পারি। হোপ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড? যেখানে ৩৫ বছর বউ ছাড়া থেকেছি সেখানে আরো দুই তিন বছর থাকলাম।
-শাটআপ ইরান। ৩৫ বছর আগে আপনার বিয়ে হয়নি এখন হয়েছে।
-তো কী হয়েছে? যেদিন বউকে দেখতে মন চাইবে সেদিনই তার কাছে দৌড়ে চলে যাবো।
আনাবিয়া মুখ ভেংচি কাটে। ইরান হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে আনাবিয়াকে। না চাওয়ার শর্তেও স্মিত হাসি ফুটে উঠে আনাবিয়ার মুখে। ইরান আনাবিয়ার কাঁধে থুতনি রেখে বলে,
-তখন নিজের কাছে টেনে নেবে তো নাকি দূরে সরিয়ে দেবে?
-মুডের ওপর ডিপেন্ড করে মিস্টার।
-তাই!
ইরান আনাবিয়াকে সুড়সুড়ি দিতে থাকে। আনাবিয়া ইরানের হাত সরিয়ে হাসতে হাসতে বলে,
-বেবি ব্যাথা পাবে আমি হাসলে।
-নির্বোধ! আজ এতদিন পর তোমাকে হাসতে দেখে শান্তি লাগছে আমার।
-আমারও। একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
-একটা কেনো একশোটা করো?
-ইসরাফ কোথায়?
মুখের ভঙ্গিমা পরিবর্তন হয় ইরানের। বিরক্ত হয়ে তাকায় আনাবিয়ার দিকে। কণ্ঠস্বর খাঁদে ফেলে বলে,
-যেখানে থাকার কথা সেখানেই। প্লিজ ভালো মুডে এইরকম ডিসগাস্টিং কথা বলে মুড নষ্ট করো না।
-ওকে করলাম।
আনাবিয়া হামি দিয়ে দূরে সরে বসে। ঘুমানোর ভান করে বলে,
-এখন আমার ঘুম পাচ্ছে। ঘুমাবো আমি।
ইরান বিছানা থেকে নেমে বাতি নিভিয়ে দেয়। আনাবিয়ার দিকে অগ্রসর হয়ে ঘোর লাগা কণ্ঠে বলে,
-আজ রাতে ঘুমানো নিষেধ। বুঝলে ডিয়ার?
>>>>চলবে।