সে প্রেমিক নয় পর্ব-৩২+৩৩

0
694

#সে_প্রেমিক_নয়
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#পর্ব_৩২_৩৩

#পর্ব ৩২

বিছানার মধ্যখানে মাথা নিচু করে বসে আছে আনাবিয়া। ইরান ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে চুল মুছতে মুছতে এগিয়ে যায় আনাবিয়ার দিকে। আনাবিয়া আজ হঠাৎ করে ইরানকে ভীষণ ভয় পাচ্ছে। ইরান আনাবিয়ার স্মুখীন বসে আনাবিয়ার মাথা ওপরে তোলে। সবসময়ের মতো মুগ্ধ হয়ে বলে,

-আমার ওয়াইফ। আমার সহধর্মিনী। মাশাআল্লাহ তোমাকে মেকআপ বিহীন একটু বেশিই সুন্দর লাগে।

-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,।

-সারপ্রাইস অনেক পছন্দ হয়েছে। আর এই ফুটন্ত ফুলকে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।

আনাবিয়া দৃষ্টি নত হয়ে আছে। মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না তার। ইরান ভ্রু কুঁচকে আনাবিয়াকে বলে,

-সিরিয়াসলি তুমি সরম পাচ্ছ কী?

-না।

-তাহলে এভাবে নববধূদের মতো মাথা ঝুঁকে বসে আছো কেনো? তাকাও আমার দিকে।

আনাবিয়া দুই ঠোঁট ভিজিয়ে শক্ত মুখে ইরানের দিকে তাকায়। ইরান আনাবিয়ার গালে হাত দিতেই মৃদু কেঁপে উঠে আনাবিয়া। ইরানের কপালে ভাঁজ পরে।

-কী হয়েছে আনাবিয়া কোনো সমস্যা?

-না তো কোনো সমস্যা নেই।

-তাহলে কাঁপছো কেনো জান?

-আসলে অনেকক্ষন ধরে বসে আছি তাই হয়তো পায়ের সাথে আমিও কাঁপছি।

-সত্যি?

ইরান সন্দীহান দৃষ্টিতে আনাবিয়ার দিকে তাকায়। আনাবিয়া মেকি হেসে বলে,

-হ্যাঁ সত্যি।

ইরান বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। আনাবিয়া ঘোলাটে চোখে মোমের হলুদ আলোয় ইরানের দিকে নিস্পলক তাকিয়ে থাকে। ইরান ফুঁ দিয়ে সব কয়টা মোম নিভিয়ে দিয়ে আনাবিয়ার পাশে এসে বসে। চাঁদের আলোতে রুম মৃদু আলোকিত। আচমকা ইরানের নজর পরে আনাবিয়ার নাকে। ভালোভাবে লক্ষ্য করতেই চমকে যায় সে।

-তুমি নাকফুল পরেছো আনাবিয়া?

-হ্যাঁ।

-তোমার তো নাক ফোটানো ছিল না! তাহলে?

-আজই পার্লরের মেয়েদের হাতে ফোটানো হয়েছে। আপনাকে খুশি ও প্রসন্ন করার জন্য ছোট একটু প্রয়াস।

-আমি খেয়াল করিনি এটা! অনেক জ্বলছে? ব্যাথা করছে?

-না।

-এক কাজ করো নাকফুলটা খুলে ফেলো। ঘা শুকিয়ে গেলে পড়িও।

-না আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না পরেই থাকি।

-তোমার কণ্ঠস্বর কাঁপাকাঁপা কেনো? কোনো কিছু নিয়ে অধিক ভয় পাচ্ছ?

আনাবিয়া প্রতিউত্তরে কিছু বলতে পারল না। ইরান আনাবিয়ার নাকফুলের ওপর নিজের অধর ছুঁয়ে দেয়। দুই হাত বাড়িয়ে আনাবিয়াকে জড়িয়ে ধরতে নেবে তার আগেই একটু দূরে সরে বসে আনাবিয়া। ইরান বুঝতে পারছে না আনাবিয়ার আসলে হলোটা কী!

-বুঝেছি তুমি হয়তো অনেক টায়ার্ড তাই না? ড্রেস চেঞ্জ করে ঘুমিয়ে পরো রোমান্স অন্য একদিন হবে।

-ড্রেস পরিবর্তন করার প্রয়োজন নেই। আই এম সরি ইরান এতো সুন্দর নাইটটা নষ্ট করার জন্য।

-এইরকম অনেক রাত আসবে অনুতপ্ত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ঘুমাও। আমি আছি পাশে।

_________________

সকালে ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে নেয় ইরান। তার অফিসে যেতে হবে। আনাবিয়া যেহেতু একটু অসুস্থ তাই ওকে আর ডাক দিলো না। ইরান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাই বাঁধছিল এমন সময় আনাবিয়া ঘুম থেকে উঠে যায়। বিছানায় বসে ঘুম ঘুম চোখে ইরানকে দেখতে থাকে। ইরান আয়নায় আনাবিয়াকে দেখে তার দিকে ফিরে তাকায়। ইরান আর টাই বাঁধলো না। আনাবিয়ার সামনে যেয়ে বসে পরে। আনাবিয়া ইরানের হাত থেকে টাই নিয়ে নিজেই পরিয়ে দিতে থাকে। ইরান আপাদমস্তক আনাবিয়াকে পরোক্ষ করছে। শাড়ী পরেই ঘুমিয়েছিল রাতে। আঁচল বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। ব্লাউজের গলা বড় হওয়ায় বক্ষের অনেক অংশ-ই দেখা যাচ্ছে।

আনাবিয়া ইরানের দৃষ্টি লক্ষ্য করে মুখ গোমড়া করে বলে,

-আপনার নজর ভালো নয়!

আনাবিয়ার কথায় ইরান মৃদু হাসে। ঠাট্টার স্বরে বলে,

-মানে? আমি কখন কু নজর দিলাম তোমার ওপর?

-হ্যাঁ আপনি তো ভালো মানুষ!

-অবশ্যই। তোমার দিকে ভালো নজরে এবং খারাপ নজরে তাকানোর অধিকার শুধুই আমার।

আনাবিয়া মুখ বাঁকায়। ইরান শব্দ করে হেসে আনাবিয়ার গলায় মুখ ডুবায়। আনাবিয়া হতভম্ব হয়ে বলে,

-কী করছেন কী আপনি! অফিসে যাবেন তো!

-আমার সামনে এইরকম খোলামেলা হয়ে বসে থাকলে আমি কিভাবে নিজেকে কন্ট্রোল করব!

-সরুন আপনি।

ইরান সরলো না। আনাবিয়ার কোমর ধরে টান দিয়ে আনাবিয়াকে নিজের আরো কাছে নিয়ে আসে। গলা থেকে মুখ তুলে ঘোর লাগা দৃষ্টিতে আনাবিয়ার অধরের দিকে তাকিয়ে থাকে। অধরে অধর মিলাতে অগ্রসর হতেই আনাবিয়া বলে উঠে,

-ইরান আমি মুখ ধোতো করিনি। প্লিজ আর সামনে আসবেন না।

-আমার সমস্যা নেই।

-ছি! আমার আছে দূরে সরুন।

না পেরে ইরান দূরে সরে যায়। আনাবিয়া শাড়ী ঠিক করে বিছানা থেকে নেমে যায়। ইরানকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-আপনি ব্রেকফাস্ট করতে যান আমি আসছি।

-ঠিক আছে।

ইরান ব্রেকফাস্ট করছে আর ফোনে কিছু একটা দেখছে। শাড়ী ধরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছে আনাবিয়া। ইউটুব দেখে মোটামুটি ভালোই শাড়ী পরা শিখেছে সে। ইরান আনাবিয়াকে দেখে চোখ ছোট ছোট করে ফেলে।

-সাদা শাড়ী পরেছো কেনো? কেমন অদ্ভুত ভয়ংকর দেখাচ্ছে!

-আজ মন চাইলো এই শাড়ীটা পরতে। দ্রুত ব্রেকফাস্ট করুন আপনার অফিসের সময় হয়ে যাচ্ছে।

-হুম।

খাওয়া শেষ করে ইরান চলে যায়। অন্যদিকে ইরান যেতেই আনাবিয়াও তৈরি হয়ে বেরিয়ে পরে নিজ গন্তব্যে। ড্রাইভার ভীত হয়ে জিজ্ঞেস করে,

-ম্যাম কোথায় যাবেন?

-তনুসফা শেখের অফিসে নিয়ে চলুন।

-কিন্তু ম্যাম স্যার আপনাকে সেখানে যেতে বারণ করেছে।

-আমি বলেছি নিয়ে যেতে চুপচাপ নিয়ে চলুন। আপনার স্যারকে আমি ম্যানেজ করে নেবো।

ড্রাইভার আর কিছু বললো। তনুসফা শেখের অফিসের সামনে আসতেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে পরে আনাবিয়া। আশেপাশের সবাই আড়চোখে দেখছে আনাবিয়াকে। অনেকেই বলাবলি করছে “এটা এমপি ইরান শেখের স্ত্রী না?”। আনাবিয়া সে সব কথায় কান দেয় না। সোজা ভিতরে চলে যায়। ভিতরে ঢুকতেই তার দেখা হয় তনুসফা শেখের অ্যাসিস্ট্যান্টের সাথে। এগিয়ে এসে আনাবিয়াকে সালাম দেয়। আনাবিয়া গম্ভীর মুখে উত্তর দিয়ে বলে,

-আপনার ম্যাম কোথায়? উনাকে বলুন আমি এসেছি।

-ম্যাম তনুসফা ম্যাম নিজ ক্যাবিনে আছে আপনি সেখানে গিয়েই দেখা করতে পারেন।

-কত তালায়?

-পাঁচ।

আনাবিয়া আর কিছু বললো না। লিফটে উঠে হাতে পরিহিত ঘড়িতে সময় দেখে নেয়। আনাবিয়ার চলে যেতেই একজন মেয়ে স্টাফ বলে উঠে,

-উনি ইরান স্যারের ওয়াইফ। ইসসস কত সুন্দর না তিনি!

মেয়েটার কথা শুনে অন্য একজন মুখ ভেংচি দেয়। চাঁপা স্বরে বলে,

-বিদেশী হলে আমাদেরও এমনই সুন্দর লাগতো।

-কিন্তু উনাকে দেখে বুঝার উপায় নেই উনি যে বিদেশী! কত সুন্দর শাড়ী পরে, হাতে চুরি, নাকে নাকফুল, গলায় চেইন, খোঁপা করা চুল বেঁধে একদম বাঙালি সাজে নিজেকে সাজিয়েছে।

-যতই বাঙালি সাজুক তার চেহারায় বিদেশী বিদেশী ভাব ফুটে উঠে। মুখ দেখলেই বুঝা যায় অনেক অহংকারী মেয়ে।

-এমপি ইরান শেখের ওয়াইফ অহংকারী হবে না তো আমরা হবো নাকি!

-ঠিক বলেছো।

-মেয়েটার চোখ অস্বাভাবিক সুন্দর। লেন্স পরে থাকে নাকি সবসময়?

-যাও যেয়ে জিজ্ঞেস করো।

-আজব তো! তুমি রাগ করছো কেনো? অন্যের তারিফ তোমার সয্য হয় না?

-না হয় না। হয়েছে?

_______________________

মনোযোগ দিয়ে কিছু কাজ করছিল তনুসফা শেখ। কাজে ব্যস্ত থাকায় আশেপাশের কোনো দিকে খেয়াল নেই তার। আনাবিয়া ক্যাবিনের ভিতরে প্রবেশ করে বড় একটি হাসি দিয়ে বলে,

-সিস্টার ইন লও বেশি ব্যস্ত নাকি?

অবাক হয়ে তনুসফা সামনে তাকায়। আনাবিয়াকে এখানে আশা করেনি সে। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে,

-তুমি এখানে!

-কেনো আসতে পারি না?

-বসো। কেনো এসেছো?

আনাবিয়া বসলো। চোয়াল শক্ত করে তনুসফার পানে তাকায়।

-আমি কে নিশ্চই জেনেছেন?

-না জানার কী আছে!

-তাহলে কাল রাতের সেই মিথ্যে প্রুভ গুলো পাঠিয়ে নিজেকে ভালো প্রমান করতে চেয়েছিলেন আপনি?

-আমি আবার কাল রাতে কী পাঠালাম?

-ছবি, মেমোরি, চিঠি অবশ্যই আপনিই পার্সেল করেছিলেন?

-আমি জানি না তুমি এইসব কী বলছো। কিন্তু কাল রাতে আমি তোমাকে কিছু পার্সেল করিনি। আম্মা অসুস্থ হয়ে পরেছিল তাই সবটা সময় তার সাথেই ছিলাম।

-তো আপনি বলতে চান ইসরাফ পাঠিয়েছে? যে নিজেই ঠিক ভাবে দাঁড়াতে পারে না সে পাঠিয়েছে?

-আমি তোমার এই বেহুঁদা কথার মানে বুঝতে পারছি না। প্লিজ বুঝিয়ে বলো?

-আমার পরিবারকে ইসরাফ নয় ইরান মেরেছে এটা লিখে ও সাথে কিছু ওযুক্তির প্রুভ পাঠিয়েছিল কেউ আমাকে। এখন আমি নিঃসন্দেহে বলছি সেটা আপনি ছিলেন।

তনুসফা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। বিরক্ত হয়ে বলে,

-তোমাকে আমার কোনো কিছু বিশ্বাস করানোর ইচ্ছে নেই কিন্তু এইগুলো আমি পাঠাই নি।

-তাহলে কে পাঠিয়েছে? আপনার পাটনার তাহশিয়া?

তনুসফা এবার একটু ভীত হয়ে যায়। কাঁপাকাঁপা কণ্ঠস্বরে বলে,

-তাহশিয়া কেনো পাঠাবে! তাছাড়াও ওর সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই।

-রিয়েলি! ওকে মানলাম যোগাযোগ নেই। এখন সত্যি বলুন আমার পরিবারের হত্যা সত্যিকারে কে করিয়েছিল?

-তুমি তো জানোই আবার জিজ্ঞেস করছো কেনো?

-সত্যিটা জানতে চাই আমি।

-আমি কিছু বলতে পারব না নিজের স্বামীকে যেয়ে জিজ্ঞেস করো।

-সত্যি বলতে ভয় করে?

আনাবিয়া উঠে দাঁড়ায়। আঙুল তুলে রাগী কণ্ঠে বলে,

-আর হ্যাঁ তাহশিয়াকে বলিয়েন যে গুহায়-ই লুকিয়ে থাকুক না কেন ওকে যদি বের করে ওর প্রাপ্য শাস্তি না দিয়েছি তাহলে আমিও তন্নী ফারুকের মেয়ে নই।

#পর্ব ৩৩

রাতে ফুরফুরে মনে বাসায় আসে ইরান। আজ ভীষণ খুশি সে। আর এই খুশির একমাত্র কারণ হলো তাহশিয়া। তাহশিয়া বুঝে গিয়েছিল যে ইরান তার সমন্ধে সব কিছুই জেনে গিয়েছে। তাই সে এখন নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে। আজ ইরান জেনে গিয়েছে তাহশিয়া আসলে কোথায় আছে। এখন তাহশিয়াকে ধরে বড় থেকে বড় শাস্তি দিতে পারলেই তার হলো। ঐ মেয়ের জন্য তার আনাবিয়া কান্না করেছে না! ভয়ংকর থেকেও ভয়ংকর শাস্তি দিবে তাকে।

রুমে এসে কোট খুলে কাবাডে রেখে দেয়। আনাবিয়া গম্ভীর মুখে বিছানায় বসে আছে। আনাবিয়াকে দেখে ইরানের মুখের হাসি বিলীন হয়ে যায়। ইরান কিছু বলবে তার আগেই আনাবিয়া বলে,

-কে আপনি ইরান শেখ? আপনার আসল পরিচয় কী?

-মানে? কেমন প্রশ্ন এগুলো?

আনাবিয়া বসা থেকে দাঁড়ায়। তার হাতেই চিঠি, মেমোরি ও ছবি গুলো ছিল। সেগুলো ছুঁড়ে মারে ইরানের দিকে। ইরান মেঝে থেকে চিঠির চার অংশ কুড়িয়ে নেয়। একসাথে মিলিয়ে পুরোটা পড়তেই তার মুখে অন্ধকার নেমে আসে। আনাবিয়ার চোখে চোখ মিলানোর সাহস হয় না তার। আনাবিয়া চিৎকার করে বলে,

-কী এইসব? কী লুকাচ্ছেন আপনি আমার থেকে?

ইরান নিশ্চুপ। মেঝের দিকে তাকিয়ে মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। আনাবিয়া ইরানের দিকে এগুচ্ছে ধীর পায়ে। বুকে কান্নাগুলো তীব্র রূপ ধারণ করেছে। ইরানের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে করুণ কণ্ঠে বলে,

-আপনার এই চুপ থাকা আমার ভয়কে বাড়িয়ে দিচ্ছে ইরান। কিছু বলুন। কিছু বলুন এমপি ইরান শেখ।

শেষের কথাটা উঁচু স্বরে বলে আনাবিয়ার। চোখ দিয়ে টপ টপ করে অশ্রুর কণা গড়িয়ে পরছে। ইরান আজ তার জীবনে প্রথমবার কিছু জিনিস নিয়ে ভীত হয়েছে। প্রিয় মানুষকে হারানোর ভয়ে কিছু বলতে পারছে না সে। আনাবিয়া পুনরায় বলে,

-আমি আপনাকে বিশ্বাস করি ইরান। অনেক বেশি বিশ্বাস করি। প্লিজ বলে দেন চিঠিতে যা লেখা আছে সব মিথ্যে। প্রমিস তারপর আমি আর একটা প্রশ্নও জিজ্ঞেস করব না আপনাকে।

-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,।

-এভাবে চুপ থেকে আমার কষ্টকে বাড়াতে পারেন না আপনি। কিছু তো বলুন ইরান।

আনাবিয়া ব্যাথাতুর নয়নে ইরানের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষন। আনাবিয়ার এইরকম আতর্নাদ শুনে শরীর শিরশির করছে ইরানের। কিছু বলতে যেয়েও মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের হচ্ছে না তার। আনাবিয়া শেষ বারের মতো চোখ মুছে নিজেকে শক্ত করে। ইরানের বুকে মাথা দিয়ে বলে,

-বলে দিন ইরান এইসব মিথ্যে। আপনি আমার মা, বাবা, বোনকে হত্যা করেননি। বলে দিন?

-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,।

-বলুন ইরান?

আনাবিয়ার চিৎকারে পুরো রুম কেঁপে উঠে। ইরান ঢোক গিলে নত কণ্ঠে বলে,

-এইসব মিথ্যে না আনাবিয়া। আমি তোমার সাথে আর মিথ্যে বলতে পারব।

আনাবিয়া মাথা তুলে ইরানের মুখের দিকে তাকায়। নিঃশাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। বুক অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। শক্ত মুখশ্রী ইরানকে হঠাৎ করেই ভীষণ অচেনা লাগছে আনাবিয়ার কাছে।

-এএএটা বলিয়েন না ইইরান।

-আমিই তাঁদের গাড়ি এক্সিডেন্ট করিয়েছি। কানাডায় ছিলাম ঠিকই কিন্তু সেইসময় এরফান শেখের কাছে ভালো সাজতে আমায় তার কথা শুনতে হতো। তাই কানাডা থেকে এসে কার্য সম্পর্ণ করে পুনরায় কানাডায় চলে যাই। গাড়ি এক্সিডেন্ট আমিই করেছি এবং এক্সিডেন্টে তোমার বাবা মারা যায়নি পরে আমিই তাকে গুলি করেছি।

আনাবিয়ার মনে হলো কেউ তার বুকে ধারালো ছু*রি ঢুকিয়ে দিয়েছে। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয় ইরানকে। পিছাতে থাকে আনাবিয়া। পিছাতে পিছাতে একসময় বেডের সাথে বারি খেয়ে মেঝেতে পরে যায়। ইরান দৌড়ে যেয়ে আনাবিয়াকে ধরতে নেবে তার আগেই আনাবিয়া হাত তুলে ইরানকে আসতে বারণ করে। আনাবিয়ার মুখ শক্ত অথচ চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু বেয়ে বেয়ে পরছে।

-ধোঁকাবাজ, স্বার্থপর, মিথ্যেবাদী। কিভাবে আপনি আমার সাথে এইরকম জঘন্য গেম খেলতে পারেন? কিভাবে? কী ভেবেছিলেন আপনি না বললে আমি জানতে পারব না? আমার ভালোবাসাকে আপনি ধোঁকা দিয়েছেন। নিজ স্বার্থের কথা ভেবেছেন আপনি সবসময়। ছি! একজন খুনিকে আমি কিভাবে ভালোবাসলাম। তাও আবার আমার বাবা মার খুনিকে! প্রেমে অন্ধ হয়ে কত বড় নির্বোধ হয়ে গিয়েছিলাম আমি! কে শত্রু আর কে মিত্র চিনতেও পারিনি। জানেন আপনার এখানে কোনো দোষ নেই। যার রক্তই খারাপ তার অংশ দিয়ে ভালো কিছু আশা করা ভুল। মূর্খ আমি। সব দোষ আমার। আমি মানুষ চিনতে পারিনি। ছি!

এক দমে কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ায় আনাবিয়া। ইরান এতক্ষন মাথা নিচু করে আনাবিয়ার কথা শুনছিল। অনুতপ্ততে পুড়ে যাচ্ছে সে। আনাবিয়া ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে ইরানের দিকে তাকায়। চেঁচিয়ে বলে,

-আই হেট্ ইউ ইরান শেখ। আই হেট্ ইউ।

ইরান মাথা তুলে আনাবিয়ার দিকে তাকায়। ভয়ংকর দেখাচ্ছে আনাবিয়া। চোখ ফুলে টকটকে লাল হয়ে গিয়েছে। এলোমেলো চুল। ইরান বড় বড় পা ফেলে আলমিরা থেকে একটা মাঝারি সাইজের ছু*রি নিয়ে আসে। ছু*রির কিনারে অনেক দিনের আগের কিছুটা রক্ত লেগে শুকিয়ে আছে। ইরান আনাবিয়ার স্মুখীন আসে দাঁড়ায়। ছুরিটা আনাবিয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,

-তোমাকে আমি ভালোবাসি তাই তোমার চাওয়া অপূরণ রাখতে চাই না। এই দেশে কেনো এসেছিলে তুমি? পরিবারের খুনিকে হত্যা করতে তাইতো? আজ তোমার সামনেই তোমার পরিবারের খুনি দাঁড়িয়ে আছে। ছু*রি চালাও। দেহ থেকে মস্তক আলাদা করে দেও আমার। তোমার জীবনও স্বার্থ হয়ে যাবে আমিও অনুতপ্ত থেকে বেঁচে যাবো।

আনাবিয়া ইরানের হাত থেকে ছু*রিটা নিয়ে নেয়। কয়েক পলক ছুরিটা দেখে ইরানের গলায় তাক করে। একটু জোরে যাতা দিয়ে ধরতেই চামড়া ছিলে যায়। রক্ত বের হতে থাকে সেখান থেকে। ইরান এক দৃষ্টিতে আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। এই মুখশ্রী দেখেই সে তার শেষ নিঃশাস ত্যাগ করতে চায়। ইরানের রক্ত দেখে আনাবিয়া দুর্বল হয়ে পরে। অনেক চেষ্টা করেও সে পারে না ইরানকে আঘাত করতে। একসময় অস্থির হয়ে ছু*রি সহ হাত নামিয়ে নেয়। একটু দূরে যেয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে বলে,

-একজন স্ত্রী কখনই নিজ হাতে নিজের স্বামীকে মারতে পারে না। আমিও পারব না। তাই নিজেকে শেষ করে দেওয়াই আমার জন্য উত্তম।

কথা শেষ হতে দেরি আনাবিয়ার ছু*রি চালাতে দেরি নেই। কোনোদিক না তাকিয়ে নিজের পেটে ভিতরে ঢুকিয়ে দেয় ছু*রি। ইরান জ্ঞানশূন্য হয়ে এগিয়ে এসে আনাবিয়ার হাত থেকে ছু*রি নিয়ে ছুঁড়ে নিচে ফেলে দেয়। ছু*রির প্রথম একটু অংশ আনাবিয়ার পেটে ঢুকে গিয়েছিল যার দরুণ এখন সেখান থেকে রক্ত বের হচ্ছে। পিঙ্ক টি-শার্ট রক্তে লাল হয়ে যায়। ইরান কী করবে দিশেহারা হয়ে যায়। আনাবিয়ার গলা থেকে ওড়না নিয়ে আনাবিয়ার পেটে চেপে ধরে। চিৎকার করে ভৃত্যদের ডাকে। তাজীব আসতেই দুইজন মিলে আনাবিয়াকে হসপিটালে নিয়ে যায়। এতক্ষনে রক্তপাতের কারণে জ্ঞান হারায় আনাবিয়া।

__________________🌸

হসপিটালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে তাজীব। ইরান একবার বসছে আরেকবার পায়চারি করছে। নিজেকে শান্ত করতে পারছে না সে। আনাবিয়ার কিছু হয়ে গেলে তার কী হবে! না কিছু হবে না আনাবিয়ার! নিজে নিজেই বিড়বিড় করছে ইরান। তাজীব বলে,

-স্যার শেখ বাড়িতে ফোন করে ম্যামের কথা জানিয়ে দেবো?

-না কোনো প্রয়োজন নেই।

-ঠিক আছে।

ওটি থেকে ডাক্তার বের হতেই ইরান এগিয়ে যায়। অস্থির হয়ে বলে,

-আমার ওয়াইফ কেমন আছে এখন ডাক্তার?

-চিন্তার কোনো বিষয় নেই মিস্টার ইরান। বেশি অংশ কাটেনি। কিছুক্ষন পরই আপনারা তাকে বাসায় নিয়ে যেতে পারবেন। তবে হ্যাঁ এক সপ্তাহে মতো রেস্টে থাকতে হবে তার। বেশি উত্তেজিত হলে দেখা যাবে ঘা পুনরায় তাঁজা হয়ে গিয়েছে তখন কিন্তু অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যাবে।

-জি আমি খেয়াল রাখবো। রক্ত লেগেছে?

-না রক্তের প্রয়োজন হয়নি।

-ঠিক আছে।

-আর শুনুন এক সপ্তাহ পর নিয়ে আসবেন তাকে চেকআপের জন্য। ঔষুধ সময় মতো দিবেন।

-জি ডাক্তার।

ডাক্তার চলে যায়। ইরান মাথায় হাত দিয়ে বসে পরে। তাজীবকে বলে,

-এক এক করে সবাইকে ধ্বংস করে দিবো আমি। সবাইকে।

-স্যার এখন আপনি একটু শান্ত হয়ে ম্যামের সেবা করুন।

ইরান ছোট ছোট চোখে তাজীবের দিকে তাকায়। তাজীব ইরানের চোখের ভাষা বুঝলো না। ইরান শান্ত কণ্ঠে বলে,

-আমি তার সামনে যেতে পারব না কয়দিন। শুনলে না ডাক্তার কী বললো? আমাকে দেখলে ও আবার রেগে যাবে পরে দেখা যাবে জিদে পুনরায় কিছু করে ফেলবে। তাই আমি দুজন ভৃত্যকে আনাবিয়ার দায়িত্বে দেবো। আর তুমিও সবসময় বাসায় থাকবে। বড় ধরণের কোনো সমস্যা হলেই আমাকে বলবে।

-আপনি তাহলে কোথায় যাবেন স্যার?

-দেখি কোথায় যাওয়া যায়।

-কিন্তু স্যার আমরা কী আপনার মতো খেয়াল রাখতে পারব ম্যামের? আর অফিস কিভাবে সামলাবো?

-ঐ ব্যবস্থা আমি করেই যাবো। অফিস নাহয় কিছুদিনের জন্য বন্ধ দিয়ে দেও কিন্তু কারো কোনো টাকা কাঁটা হবে না।

-জি স্যার।

-আর আরেকটা কথা সবাইকে জানিয়ে দেও আমি কিছুদিনের জন্য ব্যবসায়ীক কাজে দেশের বাহিরে গিয়েছি।

-কেনো স্যার?

-এতো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করো না যেটা বলি সেটা করো।




এক সপ্তাহ পর।,,,,,,,,

-আনাবিয়া মা ঘুম হয়েছে?

বিছানায় বসে কিছু একটা ভাবছিল আনাবিয়া। শাশুড়ির কণ্ঠস্বর শুনতেই আটস্যাট হয়ে বসে। শান্ত স্বরে উত্তর দেয়।

-হ্যাঁ মম। দাঁড়িয়ে আছো কেনো? বসো।

-আমি ব্রেকফাস্ট নিয়ে এসেছিলাম তোর জন্য। জলদি মুখ ধুয়ে আয় আমি খাইয়ে দেই।

-বসো তো তুমি আগে।

রাকিয়া আনাবিয়ার পাশেই বসে পরলো। আনাবিয়ার মাথা হাতিয়ে দিয়ে বলে,

-শরীর ভালো লাগছে?

-হুম।

-ব্যাথা করছে?

-না।

-আজ চেকআপ করতে যেতে হবে। তৈরি হয়ে থাকিস।

-হুম। তোমার ধোঁকাবাজ ছেলে মরার ভয়ে কী আর ফিরে আসবে না? কতকাল ও লুকিয়ে থাকবে আমার থেকে?

-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,।

-গতকাল যে তাহশিয়া আলী মারা গেলো এটার পিছনেও তোমার ছেলের হাত। কত মাস্টার মাইন্ডের মানুষ তাই না? কত সহজেই নিজের দোষ, ভুল লুকিয়ে ফেলে! বলি কী এইরকম মানুষদের জাদুঘরে সংগ্রহ করে রাখা উচিত।

রাকিয়ে কিছু বলতে পারল না। ইরান চলে যাওয়ার আগে রাকিয়াকে বলেছিল এখানে আসতে আনাবিয়া অসুস্থ ওর খেয়াল রাখতে। আনাবিয়ার অসুস্থের কথা শুনে দৌড়ে চলে আসে সে। এতদিন ধরে কোনো হদিস নেই ইরানের। কোথায় আছে? কিভাবে আছে? কার সাথে আছে? কিছুই জানে না কেউ।
গতকাল ব্রেকিংনিউজে দেখানো হয়েছিল মন্ত্রী হাসিব আলীর মেয়ে তাহশিয়া আলী অন্যতম ফেমাস ডিজাইনার অসাবধানতার কারণে ফাইভস্টার হোটেলের এগারো তালার ছাদ থেকে নিচে পরে মারা যায়। পুলিশরা তদন্ত করে দেখেছে এটা কী সত্যি এক্সিডেন্ট নাকি মার্ডার। পরিশেষে জানানো হয় তাহশিয়া আলী তার ফ্রেন্ডের সাথে পার্টি এনজয় করতেছিল সেখানে। ড্রাঙ্ক হওয়ায় নিজেকে সামলাতে পারেনি এবং নিচে পরে যায়।
আনাবিয়া এই খবর দেখে শব্দ করে হেসেছিল তখন। রাকিয়া ভয় পেয়ে গিয়েছিল আনাবিয়াকে দেখে। তবুও কোনো প্রশ্ন করেনি।

-মম কোন ভাবনায় ডুবে গেলে?

-না এমনেই।

আনাবিয়া ফ্রেশ হতে চলে যায়। রাকিয়া এখন মুহূর্তে মুহূর্তে আনাবিয়াকে ভয় পায়। আনাবিয়ার ব্যবহার অচেনা লাগে রাকিয়ার। আনাবিয়া ওয়াশরুম থেকে বের হতেই রুমে প্রবেশ করে তাজীব। মাথা নিচু করে বলে,

-ম্যাম ডেকেছিলেন আমায়?

-জি। আপনাকে দিয়ে অনেক ইম্পরট্যান্ট একটি কাজ করাবো তাজীব ব্রো।

-আপনি শুধু বলুন কী কাজ আমি এখনই করে দিচ্ছি।

-আমি ডিভোর্স চাই। বিয়ের যেহেতু তিনমাস হয়ে যাচ্ছে তাই আমাদের এখন ডিভোর্স হবে। আপনি উকিলের সাথে কথা বলুন যত দ্রুত হবে তত ভালো।

-ডিভোর্স!

রাকিয়া অস্পষ্ট স্বরে কথাটা বলে উঠে দাঁড়ায়। আনাবিয়া গম্ভীর মুখে বলে,

-আমার মা বাবার খুনির সাথে আমি থাকতে পারব না মম। উনাকে না নিজের হাতে মারতে পারব আর না উনার সাথে স্বাভাবিক ভাবে সংসার করতে পারব। তাই আমি ডিভোর্স দিয়ে দিতে চাই তাকে। রাশিয়া চলে যাবো। তিনমাসের সবকিছুকে একটা স্বপ্ন ভেবে ভুলে গিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করতে চাই।

>>>চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে