সে পর্ব-৪+৫

0
1999

#সে
#পর্ব_৪_৫
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
পাশে পড়ে থাকা ছেলেটিকে দেখে না চমকে পারলাম না। এই হতচ্ছাড়াটা কে! আমি দ্রুত উঠে জামা,হাতের ময়লা ঝাড়তে লাগলাম। বেচারা এখনো ফ্লোরেই পড়ে রয়েছে। বেশ বুঝতে পারছি আমার চেয়েও অনেক গুণ বেশি ব্যথা এই লোক পেয়েছে।

‘আপা আপনি ব্যাথা পাইছেন?’ জিজ্ঞেস করল রাজ্জাক। এটা কোনো কথা হলো বলেন তো? পড়ে গেলে ব্যথা পাব না তো কী আরাম পাব? রাজ্জাকের ওপর মেজাজ চটে গেলেও নিজেকে স্বাভাবিক রাখলাম। হাত বাড়িয়ে দিলাম সেই ছেলেটির দিকে। ব্যথাতুর দৃষ্টিতে ছেলেটি একবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল। আমি তাকে টেনে তুললাম। নিচে একটা চশমাও পড়ে থাকতে দেখলাম। সম্ভবত এই লোকেরই হবে। চশমাটি তুলে দিয়ে বললাম,’এটা কি আপনার?’
‘জি।’ মৃদু স্বরে বলল ছেলেটি।

চশমা পরার পর তাকে কেন জানি আমার কাছে খুব ইনোসেন্ট, ভদ্র আর সহজ-সরল মনে হলো। একটু বোকা বোকা’ও অবশ্য লাগছে। এই ছেলেকে দেখে মেয়েরা ক্রাশ খেতে পারে কিন্তু সবাই ভয় পাবে কেন? একে নিয়ে তো পারলে মেয়েরা আরও মজা লুটবে। রিশান যে আমায় ঢপ মেরেছে আমি নিশ্চিত। মনে সংশয় রাখতে চাইলাম না বিধায় রিশানকে প্রশ্ন করলাম,’এটাই তোমার ভাই?’
‘না। ভাইয়ার বন্ধু। অন্তু ভাইয়া।’

আমি অন্তুর দিকে তাকিয়ে বললাম,’আ’ম সরি। আসলে কীভাবে যেন পড়ে গেলাম বুঝতেই পারিনি। তার মধ্যে আবার আপনি এসে উদয় হয়েছিলেন।’
‘না, না সমস্যা নেই। ইট’স ওকে।’ চশমাটি ঠিক করে বলল অন্তু। আমি আর কথা না বাড়িয়ে রাজ্জাককে নিয়ে ফ্ল্যাটে চলে আসি। কোমরে বেশ খানিকটা ব্যথা পেয়েছি। আসার পথে রাজ্জাককে ভালো করে বুঝিয়ে বলেছি এই কথা যেন ভুলেও মায়ের কানে না যায়। নিজের ঘরে ফিরে চট করে জামা-কাপড় পাল্টে নিলাম আগে। নয়তো মায়ের চোখে ফাঁকি দেওয়া মুশকিল।

সন্ধ্যার দিক দিয়ে পরিবেশটা অনেকবেশি মোহনীয় লাগছিল। এই পরিবেশে হাঁটতে পারলে মন রিফ্রেশ হতে বাধ্য। রাজ্জাককে নিলাম না সাথে। একাই হাঁটতে বের হয়েছি। বেশিদূর যাব না। বাড়ির ভেতরেই ফাঁকা জায়গায় হাঁটব। গাছের পাতায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে হাঁটছিলাম তখন সামনে একটি মেয়ে এসে দাঁড়ায়। তার মুখটা ভীষণ হাসি হাসি। মিষ্টি করে হেসে আমায় বলল,’তুমি এই অ্যাপার্টমেন্টেে নতুন এসেছ তাই না?’

প্রত্যুত্তরে আমিও হেসে বললাম,’হ্যাঁ।’
‘জানি। তোমরা যেদিন এসেছ সেদিন ব্যলকোনি থেকে তোমাদের দেখেছিলাম। তোমার সাথে কথা বলার অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল আমার। কিন্তু তোমার দেখাই তো পাওয়া যায় না।’
‘আসলে ক্লাশ, প্রাইভেট, কোচিং করে সময় তেমন পাওয়া যায় না।’
‘ও। কীসে পড়ো?’
‘টেনে। আপনি?’
‘আমি ইন্টার প্রথম বর্ষে পড়ি। তোমার থেকে খুব একটা তো বড়ো নই। আমায় তুমি করে বলো।’
আমি হেসে ফেললাম। বললাম,’আচ্ছা।’

‘এই তোমার নামটাই তো জানা হলো না।’
‘নবনী। তোমার?’
‘রোজ।’
‘নামটা অনেক সুন্দর।’
‘তোমার নামও সুন্দর।’
দুজনে হেঁটে হেঁটে গল্প করছিলাম। মেয়েটা আমার চেয়েও বেশি মিশুক। কয়েক মিনিটের পরিচয়েই গড়গড় করে সব গল্প বলছে আমায়।
‘জানো আমার না তেমন কোনো ফ্রেন্ডও নেই। বেষ্টফ্রেন্ড আছে শুধু। কিন্তু ও সবসময় ব্যস্ত থাকে। সময় দেয় না একদম।’
‘বেষ্টফ্রেন্ড কেন সময় দেবে না?’
‘জানিনা গো।’
‘থাক মন খারাপ কোরো না আপু। এখন থেকে তোমার জন্য আমি আছি।’
‘সব ঠিক আছে। আপু বলে তো মাঝখানে একটা দেয়াল টেনে দিলে।’
‘তাহলে?’
‘আপু বলবে না।’
‘আচ্ছা বলব না।’

দুজনে খেলার মাঠের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আর সামনে যেতে চাইল না রোজ। তাই জিজ্ঞেস করলাম,’ওদিকে যাবে না কেন?’
রোজ আমায় হাত দিয়ে একটা ছেলেকে দেখিয়ে বলল,’ঐযে সাদা শার্ট পরা একটা ছেলেকে দেখতে পাচ্ছ? ফুটবল খেলছে বাচ্চাদের সাথে। দেখেছ?’

আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছেলেটিকে দেখলাম। এটা সেই ছেলে যার সাথে আমি ধাক্কা খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। যদিও আমি তার নাম জানতাম। কিন্তু রোজ তার পরিচয় দিয়ে বলল,’ঐ ছেলেটা আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকে। আমার রুম থেকে সরাসরি তার রুমের জানালা দিয়ে দেখা যায়।’
‘তোমায় পছন্দ করে?’
‘হ্যাঁ। অনেক বেশি।’
‘তুমি করো না?’
‘না।’
‘কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তুমি তাকে পছন্দ করো। এমনকি ভালোও বাসো।’
‘এমন মনে হলো কেন?’
‘জানিনা। কিন্তু সত্যিটাই বলেছি তাই না?’

রোজ কিছু বলল না। কিন্তু ওর মুখ দেখেই আমি যা বোঝার বুঝে ফেলেছি। ওকে দাঁড় করিয়ে রেখে আমি মাঠে গিয়ে বললাম,’এই চাশমিস ভাইয়া আমায় খেলায় নিবেন?’
অন্তু দাঁড়িয়ে জোরে বলল,’আপনি পারবেন না।’
কত বড়ো সাহস! আমি নাকি পারব না। আমি জোর নিয়ে বললাম,’পারব আমি।’

এরপর পিচ্চিটার থেকে বল নিয়ে এমন জোরে কিক দিলাম যে উড়ে গিয়ে লাগল রুদ্রর গায়ে। কিন্তু আমি টার্গেট করে মেরেছিলাম অন্তুকে। কে জানত এই সময়ে সে এসে হাজির হবে! ভয়ে এদিকে আমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। অন্তু দৌঁড়ে যায় রুদ্রর কাছে। মাথা ডলতে ডলতে রুদ্র এগিয়ে এসে বলে,’কে মারল বল?’

কেউ বলার আগেই আমি একটা গুলুমুলু মোটাসোটা বাচ্চা ছেলেকে দেখিয়ে বললাম,’এই পটলা মেরেছে।’
‘না, না রুদ্র দাদা। আমি মারিনি। মা কালীর দিব্যি করে বলছি।’ ভয়ে জড়সড় হয়ে রুদ্রকে কথাগুলি বলল বাচ্চাটি। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত-মুখ খিঁচে বলল,’এই দিদিভাই তুমি এত মিথ্যে বলো কেন? তুমি আমায় পটলাই বা বললে কেন? আমার নাম গণেশ।’
‘বাবা গণেশ! কে তোরে মুখ খুলতে বলেছে রে? দোষটা নিজের ঘাড়ে নিলে কী এমন ক্ষতি হতো? তুই ছোটো মানুষ। তোরে দুইটা থাপ্পড় দিলেও মানুষ কিছু বলবে না। কিন্তু আমি তো বড়ো। আমায় একটা থাপ্পড় দিলে মান-সম্মান কিছু থাকবে? কিচ্ছু থাকবে না। সব একদম ধুলোয় মিশে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।’ বিড়বিড় করে বললাম আমি।

রুদ্র এবার আমার কাছে এগিয়ে আসে। এখনই বোধ হয় দেবে গালে পাঁচ ইঞ্চির একটা থাপ্পড় বসিয়ে। কিন্তু সে আমায় এবং উপস্থিত সকলকে অবাক করে দিয়ে বলল,’পিচ্চি হলে কী হবে; পায়ে তো বিশাল জোর! ফুটবল কি নিয়মিত খেলো? না খেললে এটাকে সিরিয়াসভাবে নেওয়া উচিৎ। তাহলে অনেকদূর আগাতে পারবে।’
রুদ্র চলে যাওয়ার পরেও আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময় রয়েছে সকলের চোখেমুখে। কারণ ওর সম্পর্কে যা যা শুনেছি তার সারমর্ম হচ্ছে, সে খুব রাগী। বদমেজাজি স্বভাবের। অবশ্যই স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড। ভুল পেলে কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। সে যেই হোক না কেন! মুরুব্বি হলেও নয়। এজন্য অনেকেই রুদ্রকে অপছন্দ করে, বেয়াদব বলে তাতেও রুদ্রর কিছু যায় আসে না। সে তার নিজের জায়গায় স্থির এবং অটল। কিন্তু আজকের ঘটনার পর সে আমায় না মারলে একটা ঝাড়ি যে অন্তত দেবে এটা সবারই প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু না, সে তা করেনি। বরং কেয়ারিং দেখিয়েছে। আর এই সামান্য কথাটাই এবার ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। মনে মনে কিন্তু আমিও পুলকিত ছিলাম। আনন্দ লাগত আমার। অনেক মেয়েই আমায় হিংসা করা শুরু করে। যাদের প্রায় অধিকাংশকে আমি চিনিই না। যখনই রুদ্রর সাথে আমার দেখা হতো মিষ্টি করে হেসে বলত,’কী খবর পিচ্চি?’

আহা! তার ঠোঁটের হাসি আর মুখনিঃসৃত ডাক ‘পিচ্চি’ যতবারই শুনতাম আবেগে ভাসতাম। ভীষণ আপন আপন লাগত তাকে। একদিন তাকে আমি বললাম,’অ্যাপার্টমেন্টে যে একটা গুজব ছড়িয়েছে আপনি জানেন?’
তার হাতে কিছু বিয়ের কার্ড ছিল। বাইরে বসে বসে কার্ডে নাম লিখছিল। ওপর তলার এক আপুর বিয়ের কার্ড। তাদের সঙ্গে রুদ্র এবং ওর পরিবারের খুব ভাব। তাই বিয়ের অধিকাংশ কাজের দায়িত্বই রুদ্রর ওপর পড়েছে। কার্ড বিলি করতে যাওয়ার সময়েই তার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায়। কার্ডগুলোতে চোখ বুলিয়ে আমায় বলল,’কোন গুজব?’
‘আপনি কি সত্যিই জানেন না?’
‘শুনি তো কত কথাই। তুমি কোনটার কথা বলছ?’
‘কীভাবে বলব বুঝতেছি না।’
‘তবে থাক। আমি অনেক ব্যস্ত পিচ্চি। পরে কথা হবে।’

মন খারাপ হয়ে গেল আমার। তবুও তার ব্যস্ততাকে তো আর উপেক্ষা করার জো নেই। জোরপূর্বক হেসে বললাম,’আচ্ছা।’
সে দু’কদম এগিয়ে আবার ফিরে তাকিয়ে বলল,’প্রাইভেটে যাচ্ছ নাকি কোচিং-এ? তোমার স্কুলের সামনে দিয়েই যাব। গেলে সাথে আসতে পারো।’
আজ প্রাইভেট নেই আমার। কোচিং করে মাত্রই ফিরেছি। কাঁধে ব্যাগ দেখেই রুদ্র প্রশ্নটি করেছে। রুদ্রর সাথে যাওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। তাই বললাম,’হ্যাঁ চলুন।’

মেইন গেটের কাছে গিয়ে রুদ্র একটা রিকশা নেয়। আমায় আগে উঠতে বলে তারপর সে ওঠে। এই প্রথম আমরা একসাথে রিকশায় পাশাপাশি বসেছি। আমার যে কতটা খুশি লাগছে তা আমি আপনাদের বলে বুঝাতে পারব না। ওর পারফিউমের ঘ্রাণ আমায় মাতাল করে তুলছে। ওহ, আর একটা কথা তো বলতেই ভুলে গেছি। রুদ্র নীল কালারের একটা পাঞ্জাবি পরেছে। যেটা রুদ্রর গায়ে অনেকবেশি মানিয়েছে।
‘ওড়না সামলিয়ে নিও নবনী। রিকশার চাকায় যেন না লাগে!’

রুদ্রর কথায় আমার ঘোর কাটে। ওড়নাটা কোলের ওপর গুছিয়ে রেখে আড়চোখে আরেকবার তাকে দেখে নিলাম। ওর এই ছোট্ট কেয়ারিং’টাই ওর প্রতি ভালোবাসা, ভালোলাগার টান আমায় বাড়িয়ে দিয়েছে। রুদ্র তখন বলল,’হ্যাঁ তখন যেন কোন গুজবের কথা বলছিলে?’
‘ঐতো অ্যাপার্টমেন্টের সবাই ভাবছে আপনার সাথে আমার সম্পর্ক আছে। এজন্য অনেক মেয়ে আমায় হিংসা’ও করে।’

রুদ্র শব্দ করে হেসে বলে,’পাগলের সুখ মনে মনে।’
‘একথা বললেন কেন?’
‘ওদের কথা বললাম। আচ্ছা একটা কথা বলো তো, সত্যটা তো আমরা জানি? আমরা তো জানি যে আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই।’
‘হুম।’
‘তুমি ওদের কথায় মন খারাপ কোরো না। ওদের কথা গায়েও মাখবে না। মানুষের কথায় তো আর সত্যিটা বদলে যাবে না।’

এই ছেলেকে আমি কী করে বোঝাই; ওদের কথায় আমার মন খারাপ হয় না। বরং আমি খুশি হই। আর সম্পর্ক নেই তো কী হয়েছে? হতে কতক্ষণ? স্কুলের সামনের প্রায় এসে পড়েছি। সত্যিটা না বললে এখন রিকশা থেকে নামিয়ে দেবে বিধায় ভয় নিয়ে বললাম,’একটা সত্যি কথা বলি?’
‘বলো।’
‘আমার না মন ভীষণ খারাপ! তাই মিথ্যে বলে আপনার সাথে এসেছি। আপনার সঙ্গে কথা বললে আমার মন ভালো হয়ে যায়। আমার প্রাইভেট, কোচিং কোনোটাই এখন নেই।’

রুদ্র কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে কী যেন ভাবল। তারপর বলল,’আচ্ছা সমস্যা নেই।’
রুদ্রর সম্পর্কে যা শুনেছিলাম তার সবকিছুই এখন আমার মিথ্যে মনে হচ্ছে এই মানুষটা তো কখনো আমার সাথে রুড বিহেভ করে না। বাকিদের সাথেও করতে দেখিনি। তবে সেদিন ডেয়ার পূরণ করতে গিয়ে ঐ ছেলেটাকে মারতে দেখে বুঝেছি যে সে ভীষণ রাগী। এছাড়া আর কিছু নয়। আমি তার সঙ্গে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ইনভাইটেশন কার্ড বিলি করলাম। একবিন্দু পরিমাণ বিরক্তও আমার লাগেনি। তার সাথে সময় কাটাতে পেরে ভীষণ ভালো লাগছিল। বাড়িতে মায়ের ফোনে ম্যাসেজ করে জানিয়ে দিয়েছি আসতে একটু লেট হবে। তিথিকেও ম্যাসেজ করে বলে দিয়েছি মা ফোন করলে যেন সেভাবেই কথা বলে। কার্ড বিলি করা শেষ হলে রুদ্র জিজ্ঞেস করে,’চা খাবে নাকি আইসক্রিম?’
‘গরমের মধ্যে চা খাব না এখন। আইসক্রিম খাওয়া যেতে পারে।’

রুদ্র দোকান থেকে একটা আইসক্রিম আর পানির বোতল নিয়ে আসে। আইসক্রিমটা আমার হাতে দিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে একটা রিকশা ডাকে। আমরা দুজন রিকশায় উঠে বসি। রিকশা চলছে মন্থর গতিতে। বিন্দু বিন্দু বাতাসে রুদ্রর ঘামে লেপ্টে থাকা চুল কপালে এসে পড়ছে। সেই মুহূর্তে আমার ভীষণ ইচ্ছে করছিল ওর চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিতে। পানির বোতলটা আমার হাতে দিয়ে সিগারেট ধরাল। আশ্চর্য! সে যে সিগারেট এনেছে আমি দেখিইনি। আমি নাকমুখ কুঁচকে ফেললাম। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম। কারণ সিগারেটের গন্ধ আমি একদম সহ্য করতে পারি না। বিরক্ত লাগে। বাবা’ও খায়। কত চেষ্টা করেছি সিগারেট ছাড়ানোর জন্য! কিন্তু পারিনি। আর এখন কী-না রুদ্রও!

রুদ্র সিগারেটে টান দিয়ে অন্যপাশে রাখল। ধোঁয়াও উড়াল অন্যপাশে। যথাসম্ভব চেষ্টা করছে যেন আমার দিকে সিগারেটের ধোঁয়া না আসে। আমি আইসক্রিম হাতে বসে রয়েছি। গলে গলে জামার ওপর পড়ছে। তখন রুদ্র বলে,’খাচ্ছ না কেন? গলে যাচ্ছে তো।’
‘আপনি সিগারেট ফেলেন। আমার বমি পাচ্ছে।’
সঙ্গে সঙ্গে সিগারেট ফেলে দিল রুদ্র। পানি দিয়ে কুলকুচি করে বলল,’এখন ঠিক আছো?’
‘হুম।’ ছোটো করেই বললাম আমি।

এরপর নিরবতা কাটিয়ে বললাম,’সিগারেট কেন খান?’
‘সবসময় খাই না। মাঝে মাঝে খাই। এখন একটু খেতে ইচ্ছে হলো।’
‘আমার সামনেই ইচ্ছে হলো?’
‘তুমি কি আমার ওপর রেগে গেছ? রাগ করলে বলতে পারো। সমস্যা মিটিয়ে নেওয়া ভালো।’
‘এমন কিছু না। সিগারেট আমার পছন্দ না।’
‘স্বাভাবিক। অধিকাংশ মেয়েই সিগারেট পছন্দ করে না।’
‘তাহলে আপনি আমার সামনে কেন খেলেন?’
‘আমার সম্পর্কে তো প্রায় অনেক কিছুই শুনেছ। স্বচক্ষেও দেখা উচিৎ আমি কেমন!’

একথার পিঠে আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। চুপ করে রইলাম। সূর্যে ডুবে গিয়ে অন্ধকার এখন রাজত্ব করছে। মাঝে মাঝে চাঁদটাও বড়াই করে চলেছে দখল নেওয়ার জন্য। কিন্তু দুষ্টু মেঘের জন্য পেরে উঠছে না। মেঘ চাঁদকে আড়াল করে রেখেছে। আমি সেদিকেই তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ করে রুদ্র বিষণ্ণ গলায় বলল,’জানো নবনী কেন জানি আমি কখনোই কারো প্রিয় হয়ে উঠতে পারিনি। একান্ত প্রিয় মানুষ হতে পারিনি কারো। সবাই আমায় অপশন হিসেবেই ব্যবহার করে এসেছে। কেন জানি সবার জীবনে আমি অপশোনাল হিসেবেই থেকে যাই!’

রুদ্রর কথাগুলো আকাশে থাকা মেঘের আড়ালে চাঁদটির বিষণ্ণের চেয়েও আরও বেশি বিষণ্ণ শোনাল। আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না কথাগুলো যে রুদ্রই বলেছে। এই মানুষটারও কি কোনো দুঃখ থাকতে পারে?

চলবে….
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ। কিছু সমস্যাজনিত কারণে কয়েকদিন গল্প দিতে পারিনি এজন্য দুঃখিত।]

#সে
#পর্ব_৫
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
রুদ্র নিরব এবং নির্জীব হয়ে রয়েছে। কথা নেই আমার মুখেও। চারপাশ থেকে বারবার রিকশার টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে। কতক কতক জায়গায়, চায়ের দোকানের সামনে লোকজনের কোলাহল এবং সমাগম। ফিরতি কোনো প্রশ্ন করব সেই সাহসও কেন জানি পাচ্ছি না। আচমকা পুরো প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে রুদ্র বলল,’এখান থেকে বাড়ি খুব কাছেই এখন। হেঁটে যাবে? হাঁটতে খুব ইচ্ছে করছে।’

তার এই প্রস্তাবে আমি খুশিই হলাম। কারণ রাতেরবেলায় রাস্তায় হাঁটার অন্যরকম আনন্দ রয়েছে। সাথে পাশে যদি থাকে প্রিয় মানুষ, তাহলে সেই সময়ের বর্ণনা করা কষ্টসাধ্য বটে। তাই বারণ করার প্রশ্নই আসলো না। আমি বিনাবাক্যেই রাজি হয়ে যাই। রিকশা থেকে নেমে দুজনে ফুটপাত দিয়ে হাঁটছি। মনের ভেতর লুকিয়ে রাখা প্রশ্নটিও করে ফেললাম।

‘কেন সবাই আপনাকে অপশোনাল হিসেবে ব্যবহার করে?’
‘অপশোনালের চেয়েও সেকেন্ড চয়েজ বেশি হয়েছি। কেন হয়েছি সেসব না হয় আরেকদিন বলব। একদিনে সব জেনে ফেললে পরে আর কোনো আগ্রহ থাকবে না।’
আমি হেসে ফেললাম। সে তো আর এটা জানে না যে, তার প্রতি আমার আগ্রহ কোনোদিনই কমবে না। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে।

বাড়ির গেইটের কাছে আসার পর রুদ্রর কিছু মেয়ে কাজিনের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। এদেরকে আমি ফেসবুকে দেখেছি রুদ্রর আইডিতে। যদিও তারা কাজিন কিন্তু আমার ভীষণ হিংসা হয়। কাঁধে হাত রেখে, হাসি হাসি মুখ করে তোলা যতগুলো ছবি আছে সবকয়টা আমার পুড়িয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। আমি সহ্য করতে পারি না একদম। রুদ্রকে পেয়ে ওরা একদম জেঁকে ধরেছে। একজন বলছে,’তোর কাছেই যাচ্ছিলাম। ভালোই হলো দেখা হয়ে গেছে। চল আড্ডা দেবো।’
‘আজ থাক। রিমির বিয়ের অনেক কাজের দায়িত্ব আমার ওপর।’ বলল রুদ্র।

আরেকটা মেয়ে তখন রুদ্রর গাল চেপে ধরে বলল,’তোর নাটক বন্ধ কর। বিয়ে তো আর আজই হচ্ছে না। কয়েক ঘণ্টা আমাদের সাথে আড্ডা দিলে কিচ্ছু হবে না। প্রয়োজনে পরে এসে আমরা সবাই তোকে কাজে হেল্প করব।’
রুদ্র তখন হেসে বলল,’তাহলে ঠিকাছে। চল।’

ওরা একদিকে খুনশুটিময় ঝগড়া করছে। আর আমি অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে ওদের কাণ্ড দেখছি। আপনাদের হয়তো আমার এমন কথা শুনে হাসি পাচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। খারাপ লাগছে। আমি বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছি সুখ ও দুঃখ একে অপরের পরিপূরক। একটু আগেও যেই আমি সুখের সাগরে ভাসছিলাম সেই আমিই এখন তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। আমি বুঝতে পারি না কিছুতেই মেয়েগুলো এমন ছেচ্রা হয় কী করে? ছেচ্রা হবে ছেলেরা। মেয়েদের পেছনে ঘুরে ঘুরে ছেচ্রামি করবে। মানায় ওদের। কিন্তু মেয়েরা কেন এমন করে? আমি কিন্তু সব মেয়ের কথা বলছি না। এই টাইপ কিছু মেয়ের কথাই বলছি। ছেলে কাজিন আমারও আছে। কিন্তু আমরা ঘন ঘন আড্ডা দিই না। কোনো অনুষ্ঠানে একসঙ্গে হলেও সবাই মিলে গল্পগুজব করি না। এভাবে কেউ মিশতে পারি না। ছেলেরা ছেলেরা একসাথে এবং মেয়েরা মেয়েরা একসাথে আড্ডা দিই। তাহলে কি আমরাই ইমম্যাচিউর?

ওদের গল্পগুজব এবং কোথায় আড্ডা দেবে সব প্ল্যান শেষ হলে রুদ্রর নজর আমার দিকে পড়ে। আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছিল। উচিৎ ছিল অনেক আগেই বাড়িতে ফিরে আসা। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে আমার পা সেখানেই স্থির ছিল। রুদ্র আমার কাছে এসে বলল,’নবনী তুমি বাসায় যাও। রাত না হলে তোমায়ও সঙ্গে করে নিয়ে যেতাম।’
‘সমস্যা নেই। আপনি ওদের সঙ্গে যান। ইনজয় করুন।’
এইটুকু বলেই আমি ভেতরে চলে আসি। একবারও পেছনে তাকাইনি। ভেতর থেকে আসা দীর্ঘশ্বাস সঙ্গে সঙ্গে চোখের কোণে পানিও নিয়ে এসেছে। বড্ড জেলাসি তো আমি!
.
.
বাড়িতে এসে কী করব বুঝতে পারছিলাম না। আমার সময় কাটছে না কিছুতেই। আমায় গম্ভীর থাকতে দেখে মা জিজ্ঞেস করলেন,’কী হয়েছে তোর?’
‘কই? কিছু না তো!’ আনমনেই বললাম আমি।
‘বললেই হলো? কিছু না হলে তুই তো এত চুপচাপ থাকার মেয়ে না।’
‘এগুলো কোনো কথা হলো মা? চুপচাপ আছি এমনিই। কোনো স্পেসিফিক রিজন নেই।’
‘তুই চুপ কর। মিথ্যা কার সঙ্গে বলিস তুই? তুই আমার পেটে হইছিস নাকি আমি তোর পেটে হইছি?’
‘তোমরা মায়েরা কি কমন ডায়লগগুলা দেওয়া এবার অফ করতে পারো না? ছোটোবেলা থেকে শুনে আসা সব ডায়লগই এখন আমার মুখস্থ।’
‘তুই অনেক বেয়াদব হয়ে গেছিস নবনী।’
‘সরি মা। তুমি এখন যাও। আমি একটু একা থাকব।’
‘আমার পেটের মেয়ে হয়েও তুই এমন করিস। তোর থেকে তো রাজ্জাকই ভালো।’
‘বেশ তো! ওর কাছেই যাও।’

মা কিছুক্ষণ আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে রুম থেকে চলে গেলেন। আমি ঠায়ভাবে সেখানেই কিছু্ক্ষণ বসে থেকে বারান্দায় চলে আসি। মেইন গেটের দিকে তাকিয়ে দেখি রুদ্র আসছে কী-না! নাহ্। অনেকেই আসে। কিন্তু রুদ্র আসে না। ফেসবুকে লগিন দিয়ে রুদ্রর আইডিতে গেলাম। তাকে একটিভ দেখাচ্ছে। ডে’ও দিয়েছে দেখলাম। একঘণ্টা আগে দেওয়া। ছবিটা ওর মেয়ে কাজিনের সাথে। তার মানে যাওয়ার পর ছবি তুলে সাথে সাথেই ডে তে দিয়েছে। কী যে অসহ্য রকমেই পেইন হচ্ছে তা বলে বুঝাতে পারব না। বড়ো বড়ো শ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে ওর পুরনো পোষ্ট, ছবিগুলো দেখছিলাম। হাত শুধু নিশপিশ করছিল নক দেওয়ার জন্য। মনের কথায় সায় দিলাম। নক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,’বাড়ি ফিরেছেন?’

রিপ্লাই এলো ঠিক দু’মিনিট পর। লিখেছে,’না। আজ বাড়ি ফিরতে দেরি হবে।’
‘ওহ। আড্ডা দিন। ভালো লাগবে।’
এই ম্যাসেজটা আর সীন হলো না। অনেকক্ষণ যাবৎ ফোনের স্ক্রিনে চাতকপাখির মতো তাকিয়েই রইলাম। ডাটা অফ করতে যাব তখন টুং করে ম্যাসেঞ্জারে একটা শব্দ হয়। রুদ্রর ম্যাসেজ। দ্রুত আমি ওর ইনবক্সে গেলাম। আসলে ম্যাসেজ নয় ছবি পাঠিয়েছে আর একটা ভিডিও। সবগুলো ছবি ওর ঐ কাজিনগুলোর সাথে। ভিডিওটা মনে হচ্ছে ছবি তুলতে গিয়ে ভুল করে করে ফেলছে। বুঝতে পারার পর রুদ্র হেসে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়েছে। ইশ! হাসিটা যেন সোজা বুকে এসে বিঁধেছে। শুধু চোখের কাঁটা লাগছিল ঐ আপুগুলোকেই। আমি ম্যাসেজ লিখলাম,’শুধু মেয়ে কাজিনরাই এসেছে? ছেলেরা আসেনি?’
রুদ্র যদিও লেট করে উত্তর দিচ্ছিল তবুও যে রিপ্লাই করছিল আমি এতেই খুশি ছিলাম। রুদ্র লিখল,’হ্যাঁ, ছেলেও আছে চারজন।’
‘তাহলে ওদের ছবি দেন।’
‘ওদের ছবি ওদের ফোনে।’
‘আশ্চর্য! একটা ছবিও আপনি ছেলেদের সাথে তোলেননি? একটা হলেও নিশ্চয়ই তুলেছেন। দিন দেখি।’

রুদ্র চোখ উল্টানো ইমুজি দিয়ে বলে,’ওদের ছবি দিয়ে কী করবে?’
‘কী আজব! আমি মেয়ে হয়ে মেয়েদের ছবি দেখে কী করব? ছেলেদের ছবি দিন। চয়েজ করি। দেখি কাকে ভালো লাগে।’
মূলত রুদ্রকে একটু খোঁচা মারতেই আমি এই ম্যাসেজ লিখেছি। রুদ্র এবার সেন্টি ইমুজি পাঠালো। আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছিল। আমিও তো নাছোড়বান্দা। তাই আবার বললাম,’কী হলো? দিন?’

রুদ্র বলল,’পরে ওদের থেকে নিয়ে দিবনি।’
‘শিওর?’
‘হুম।’
ব্যস কনভারসেশনের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে ‘হুম’ বলে। এরপর তো আর নতুন করে কিছু বলা যায় না। আমি আর কিছু বললামও না। রাতে ডিনার করে আবার গেলাম ফেসবুকে। ওর আইডি ঘেটে দেখলাম মেয়ে কাজিনদের সাথে ছবি পোষ্ট করেছে। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে এখানেও রুদ্র বাদে কোনো ছেলের ছবি নেই। একটা কথা আপনারাই বলুন তো, সবাই একসাথে আড্ডা দিতে গিয়েছে সেখানে সব মেয়েদের ছবি আছে অথচ ছেলেদের কারো ছবি নেই! এটা হতে পারে? আমার কেন জানি এবার মনে হচ্ছে রুদ্র আমায় মিথ্যে বলেছে।

এর পরের কয়েকদিন রুদ্রর বেশ ব্যস্ত সময় কাটল। মোটামুটিভাবে পড়াশোনা নিয়ে আমি নিজেও ব্যস্ত ছিলাম। কিন্তু এতটা ব্যস্তও থাকতে পারিনি যে রুদ্রর কথা মনে পড়বে না। সেদিনের পর থেকে আমি আবারও রুদ্রর সামনে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। লুকিয়ে লুকিয়ে শুধু দূর থেকেই দেখি। কারণ আমি ৯৯% শিওর রুদ্র আমায় মিথ্যে বলেছিল। তার ছেলে কাজিনরা কেউ ছিল না। ছবিও দেয়নি আমায়। আমার কথা হচ্ছে, মিথ্যে বলার কী দরকার? কোনো ফায়দা তো নেই। এই মিথ্যেটাই মূলত রুদ্রর প্রতি চাপা অভিমান তৈরি করেছে।

রিমি আপুর বিয়ে আজ। গতকাল গায়ে হলুদ গিয়েছে। হলুদে আমি যাইনি। রোজ অনেকবার জোর করেছিল আসার জন্য। কিন্তু মিথ্যে বাহানা দিয়ে যাইনি। সত্যি বলতে রুদ্রর মুখোমুখি হতে ইচ্ছে করছে না। মায়ার টান আমি বাড়াতে চাচ্ছিলাম না কাছ থেকে। সে আমায় দেখে কিছু আন্দাজ করুক এটাও আমি চাইনি। হলুদে না গেলেও বিয়েতে না এসে পারলাম না। রিমি আপু সকালে ফোন করে বলেছে বিয়েতে না গেলে কান ধরে নিয়ে যাবে। বিয়ের কিছুদিন আগে থেকেই আমি রিমি আপুর সাথে পরিচিত হই। রোজ পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। আপু ভীষণ মিশুক। অল্প দিনের ব্যবধানেই আমায় একদম নিজের বোন বানিয়ে ফেলেছে। যে কারণে এত অধিকারবোধ তার কথায়। আমিও ভাবলাম, একটা মানুষের জন্য শুধু শুধু আরেকটা মানুষকে কষ্ট দেওয়ার তো কোনো মানে হয় না। রুদ্রর সামনে না গেলেই তো হয়। তাই রেডি হয়ে রোজের সঙ্গে আগে চলে আসলাম। আব্বু,আম্মু পরে আসবে। ওহ আপনাদের তো এতদিন একটা কথা বলাই হয়নি। রিশানের আপন ভাই হচ্ছে রুদ্র। রিশান সেদিন রুদ্রর কথাই বলেছিল। রাজ্জাকের সাথে রিশানের ভাব জমে গেছে বহু আগেই। ওরা ওদের বন্ধুত্বের নাম দিয়েছে আর টু(R2). এদিকে আমি তো আমার চারপাশে সবই আর(R) দেখি। এই যেমন, রুদ্র, রিশান, রাজ্জাক, রোজ, রিমি। শুধু আমার নামটাই বোধ হয় এন(N) দিয়ে হয়ে গেল। যাক সেসব। আমি ভাবছি এখন যদি রুদ্র সামনে পড়ে যায় তাহলে কী করব?

আমার ভাবনা তার জায়গামতো সীমাবদ্ধ থাকতে পারল না। রুদ্রর সাথে দেখা হয়ে গেল। রুদ্র এক গাল হেসে বলল,’কেমন আছো পিচ্চি?’
আমি দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম,’আলহামদুলিল্লাহ্‌। আপনি?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌। কালকে নাকি তুমি হলুদে আসোনি?’

আমি এবার অবাক হয়ে তাকালাম তার দিকে। সে আমায় জিজ্ঞেস করছে শিওর হওয়ার জন্য আমি এসেছিলাম নাকি! তার মানে সে জানেই না। খেয়ালও করেনি। এমনকি একবার আমার কথা মনেও হয়নি। অবশ্য আগ বাড়িয়ে এতকিছু ভাবা, এত এক্সপেকটেশন রাখা আমার উচিৎ হয়নি। তার সাথে আমার পরিচয়ই বা কয়দিনের? সে কেন আমায় নিয়ে এত মাথা ঘামাবে? শুধু শুধু আমি নিজেই এতসব ভেবে চলেছি। আমায় চুপ থাকতে দেখে রুদ্র বলল,’চুপ হয়ে গেলে যে?’
আমি মৃদু মেকি হেসে বললাম,’হুম আসিনি। আজ সকালে একটা পরীক্ষা ছিল তাই।’
‘এখন আবার কীসের পরীক্ষা? যাই হোক, আজকে কিন্তু তোমায় অনেক সুন্দর লাগছে। মাশ আল্লাহ্! মনে হচ্ছে আজ রাতের বুকে সুন্দর একটা চাঁদ জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছে।’
‘আপনি অনেক সুন্দর করে কথা বলতে পারেন।’

রুদ্র হাসলো। তারপর চলে গেল অন্যদিকে। আমি রিমি আপুর কাছে গিয়ে কয়েকটা ছবি তুললাম। আমার ভীষণ অস্থির অস্থির লাগছিল। অস্থিরতা আরও বেশি বেড়ে যায় যখন দেখলাম রুদ্রর সেই মেয়ে কাজিনগুলা এসেছে। ওর বন্ধু-বান্ধবরাও এসেছে। একটা জিনিস আমায় খুব ভাবায়। মেয়ে বান্ধবীদের গায়ে পড়া স্বভাব রুদ্র পছন্দ করে না অথচ মেয়ে কাজিনগুলোকে কিছু বলে না। যদিও রুদ্র বলেছিল কাজিনগুলো ম্যারিড। কিন্তু আমি ওদের আইডি ঘেঁটে দেখেছি রিলেশনশিপ সিঙ্গেল দেওয়া। একের পর এক রুদ্রর এসব মিথ্যা আমার মাথায় চাড়া দিয়ে ওঠে। আমার মনে হচ্ছে আমি আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে পারব না। তাই রোজকে বললাম,’আমার ক্ষুধা লেগেছে। চলো খেয়ে আসি।’

রোজ রাজি হলো। খাওয়ার সময় তখন হাজির হলো অন্তু। এমনিতেই খাবার গলা দিয়ে নামছিল না। ভেবেছিলাম রোজের সঙ্গে গল্প করতে করতে খেতে পারব। প্রয়োজনে রুদ্রর বিষয়টাও ওকে শেয়ার করব। এতে লাভ কী হবে জানিনা তবে মন হালকা হবে। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব নয়। অন্তু খেজুরে আলাপ জুড়ে দিয়েছে। রোজ-ও লজ্জায় লাল, নীল বর্ণ ধারণ করছে। এই মু্হূর্তে আমার গ্যাং-টাকে খুব মিস করছি। ওরা থাকলে কখনোই আমার এমন একা একা ফিলিংস হতো না। যতই জ্বালাক না কেন, দিনশেষে বিপদে-আপদে খারাপ সময়ে ওরা পাশে থাকলে তখন আর কিছু লাগে না। ভেতর থেকে আমার তখন দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। এই খাবার আর আমার গলা দিয়ে নামবে না। আপনারা বিশ্বাস করবেন কীনা আমি জানিনা, তবে আমার খুব খুব একাবোধ হচ্ছে। আমি টেবিল ছেড়ে উঠে বললাম,’আমার খাওয়া শেষ। আপনারা খান।’
রোজ বলল,’বসো। আমারও প্রায় শেষ।’
‘আমি রিমি আপুর কাছে যাই। অন্তু ভাইয়া তো এখানে আছেই। খাওয়া শেষ করে চলে এসো।’

মিথ্যে বলেই আসলাম। রিমি আপুর কাছেও যাব না। কারণ সেখানে রুদ্র ও তার গ্যাং রয়েছে। ওদেরকে আমার সহ্য হচ্ছে না। ইচ্ছে করছে সবার মাঝখান থেকে রুদ্রর পাঞ্জাবির কলার ধরে টেনে বাইরে নিয়ে আসি। এরপর সামনে বসিয়ে গান শুনি। রুদ্রর গানের গলা অসম্ভব রকমের সুন্দর! না, সে আমায় গান শোনায়নি। তার নিজের ডে ও টাইমলাইনে পোষ্ট করা গানগুলো শুনেই বলছি। কমিউনিটি সেন্টার থেকে বেরিয়ে কিছুটা দূরে এসে দাঁড়ালাম। এখান থেকে গান-বাজনার আওয়াজ তেমন তীব্রভাবে শোনা যাচ্ছে না। ফোনে কথা বলার জন্য খুব একটা ডিস্টার্ব করবে না এই সাউন্ড। তিথিকে কল লাগালাম। রিং হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই তিথি কল রিসিভ করে বলল,’কীরে বিয়ে বাড়িতে কেমন ইনজয় করতেছিস? আমি তো ভাবছি দুই দিন তোর খোঁজই পাব না।’

‘ধুর! ফাউল কথা বলিস না তো। ভালো লাগছে না।’
‘কী হয়েছে? মুড অফ নাকি তোর?’
‘লাইনে থাক। বাকিদের কলে আনি।’
‘শোন তোর গলা শুনে মনে হচ্ছে সমস্যা বিশাল। সবাই একসঙ্গে লাইনে আসলে টাকা শেষ হয়ে যাবে কিন্তু কথা শেষ হবে না। তার চেয়ে ভালো আমাদের ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে আয়। সবাই একসঙ্গে কলে আসি। একটিভই আছে সবাই।’
‘আচ্ছা। আমি তাহলে এম্বি কিনে আসতেছি।’
‘আয়।’

কল কেটে দিয়ে ফোনে এম্বির অফার দেখছিলাম। বাড়িতে ওয়াইফাই থাকায় এম্বি নেওয়ার তেমন প্রয়োজন হয় না বলে নিইও না। কিন্তু এখন আমার মন সাংঘাতিক লেভেলের খারাপ। ওদের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। এম্বি কিনে ডাটা অন করব তখন মনে হলো পেছনে কেউ আছে। আমি সাথে সাথে পেছনে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি একটা ছেলে। ছেলেটি ভয় পেয়ে দু’হাত ওপরে তুলে বলে,’রিল্যাক্স! রিল্যাক্স ভয় পাবেন না।’

ভয় পাবেন না বললেই কি আর হয়? ভয় তো অলরেডি পেয়ে বসে আছি আমি। বুকে থুথু দিয়ে তার দিকে তাকালাম। সাদা শার্টের ওপর কালো স্যুট পরা ছেলেটি।
‘কে আপনি?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।
‘আমি রুদ্রর বন্ধু। আমি যদি ভুল না হই তাহলে আপনি নবনী।’
‘জি আপনি সঠিক।’
‘যাক! যেটা বলতে এসেছিলাম। রুদ্র আপনাকে ডাকছে। পেছনের গেইটের দিকে আছে।’
আমি সেদিকে তাকিয়ে বললাম,’আমি তো চিনি না। তাকে আসতে বলুন।’
‘ও আপনাকেই যেতে বলল।’

বললাম,’ঠিকাছে।’
যাওয়ার পথে সে বলল,’সরি। আমি কিন্তু আপনাকে ভয় দেখাতে চাইনি।’
‘ইট’স ওকে। সমস্যা নেই।’
এখান থেকে গান-বাজনার শব্দ অনেক জোড়ে জোড়ে আসছে। রুদ্র যে কেন আমায় ঐদিকে ডাকল আমি সেটাই বুঝতে পারছি না। ক্রমে ক্রমে পথ নির্জনতার দিকে যাচ্ছিল। এবার আমার ভয় হতে লাগল। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আমি তাকে বিশ্বাস করে ভুল করেছি। এখান থেকে গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার করলেও কেউ আমার গলার আওয়াজ শুনতে পাবে না। ভয়ে হাত-পা কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যায়। কিন্তু ছেলেটির সরলভাবে বলে যাওয়া কথাগুলো শুনে সন্দেহ করাও কষ্টকর। কিন্তু এবার আমি সন্দেহ নয় বরং শিওর হয়ে গেলাম যে রুদ্র আমায় ডাকেনি বরং এটা এই ছেলের একটা ফাঁদ। আর আমিও বিশ্বাস করে সেই ফাঁদেই পা দিয়ে ফেলেছি। কারণ বক্স থেকে রুদ্রর গান শুনতে পাচ্ছিলাম। হ্যাঁ, এটা রুদ্ররই গলা। রুদ্র যদি ভেতরে গান গেয়ে থাকে তাহলে একই সময়ে সে অন্য জায়গায় আমায় ডাকবে এটা অসম্ভব। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার সঙ্গে এবার ছেলেটিও দাঁড়িয়ে পড়ে। মাটির সাথে আমার পা আঁকড়ে আছে মনে হচ্ছে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমায় পালাতে হবে। আমি যদি নিজে নিজেকে না বাঁচাতে পারি তাহলে অন্য কেউ পারবে না। অন্য কেউ তো জানতেই পারবে না! আমি দৌঁড় দেওয়ার আগেই ছেলেটি আমার হাত চেপে ধরে বলে,’কী হলো? চলেন।’

আমরা দুজন দুজনের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বললাম,’আপনি আমার হাত ধরেছেন কেন? হাত ছাড়েন।আপনি আমায় মিথ্যেও বলেছেন। রুদ্র আমায় ডাকেনি।’
ভয়ে আমার কণ্ঠস্বর থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছিল না। এই কথাগুলো বলতেই আমার নিজের সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছে। এবার ছেলেটির চোখে-মুখে লোভ-লালসার কুৎসিত হাসি দেখতে পাই আমি। মনের সাহস আমি হারিয়ে ফেলছিলাম। আমার বোধ হয় আর কিছু করার নেই। ছেলেটি আমার হাত ছাড়ল না বরং আরও শক্ত করে ধরল। ছেলেটির হাতে সাহস করে কামড় বসিয়ে দেওয়ার পর তার হাত আলগা হয়। সঙ্গে সঙ্গে দৌঁড় দেই আমি। কিন্তু হায়! দৌঁড়ানোর মতো শক্তি আমার একেবারেই ক্ষীণ। ছেলেটি ধরে ফেলে আমায়। আমি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলি। আমায় টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে নির্জনতা থেকে আরও নির্জনতার দিকে। দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসছিল আমার। বারবার বাবা-মায়ের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আমার পরিণতির সমাপ্তি আজ এখানেই। এরপর আর এই সুন্দর ধরণী হয়তো দেখার সৌভাগ্য আমার হবে না। আমার আর্তচিৎকার রুদ্রর গাওয়া গানের আড়ালে তলিয়ে যাচ্ছে। কারো কর্ণকুহরে পৌঁছাচ্ছে না। পৌঁছাবে না!

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে