সে জানে পর্ব-০৬

0
911

#সে_জানে
#Part_6
#Writer_Tahsina_Islam_Orsha

গগনের গায়ে এলোমেলো হয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে তারারা । এতো তারা আকাশে আজ ভালো লাগছে না নুপুরের। যেন অযথা ভিড় জমিয়েছে আকাশে। শুক্লপক্ষের তিথিতে পূর্ণ চাঁদের ঝলমলে আলো বিরাণ করছে নুপুরের অবিচ্ছিন্ন হৃদয়, যেন তিরস্কার করছে নুপুরকে। নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। একগুঁয়ে লাগছে আজ চাঁদটাকে। চুম্বকের ন্যায় চোখ যেন আটকে গেছে তবুও চাঁদের গায়ে। অনিচ্ছাকৃতভাবেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে দায়িত্ব নিয়ে বাতাসে বয়ে চলেছে অযথা।

নুপুর বেল্কুনি থেকে অনিচ্ছুক পা বাড়িয়ে দিলো রুমের ভিতরে প্রবেশ করার জন্য। দৃঢ় সংকল্প সঞ্চারিত করছে সে, আজ সব বলবে দিবসকে।

নুপুর রুমে প্রবেশ করে দেখে দিবস চলে এসেছে। বসে বসে ফোনে গেম খেলছে। এতো বড় ছেলে গেম খেলছে, তাও আবার বাবল শুটার। নুপুরকে দেখেও না দেখার ভান করছে দিবস, নুপুরকে কিছু বলছে না সে। নুপুর মলিন মুখে
‘ কখন এলেন?

দিবস নুপুরের দিকে তাকিয়ে
‘ এইতো একটু আগেই। তুমি এক ধ্যানে আকাশ দেখছিলে তাই ডাকিনি।

নুপুর কোথায় থেকে কিভাবে কথা শুরু করবে বুঝতে পারছে না তাই পায়চারি করতে শুরু করে রুমের ভেতরে। দিবস গেম খেলছে আর আড়চোখে দেখছে নুপুরকে সে কি করছে। কিছুক্ষণ যাবার পর নুপুরের ঘুরঘুর দেখে দিবসের মাথা ঘুরাচ্ছে তাই ফোনের দিকে তাকিয়েই
‘ আর কত ঘুরবে! আমার মাথা ঘুরাচ্ছে। কিছু বলতে হলে বসে বলতে হয় এইভাবে পায়তারা করে কি কিছু বলা যায়? আর মানুষ নিখুঁত নয়। সবার জীবনেই সবাই কম বেশি ভুল করে থাকে। বিচলিত হবার কিছু নয়। আর দুপুরের ঘটনার দোষ এনে নিজের ঘারে চাপিয়ে লাভ নেই।

নুপুর দিবসের কথা শুনে বিচক্ষণ চোখে তাকালো দিবসের দিকে। ভ্রু জোড়া কুঁচকে
‘ আপনি কিভাবে বুঝলেন আমি কিছু বলবো?

দিবস উঠে দাঁড়িয়ে আস্তে করে নুপুরের কাছে এগিয়ে আসতে শুরু করে। নুপুর হতভম্ব হয়ে গেছে। সে কি প্রশ্ন করেছে আর দিবস করছেটা কি! আর উনি কেনই বা এইভাবে নুপুরের কাছে আসছে বুঝতে পারছে না। নুপুর দিবসের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে পেছাতে শুরু করে। দিবস আস্তে আস্তে নুপুরের কাছে আসতেই নুপুর বুঝতে পারলো তার পিঠ দরজায় ঠেকেছে। পেছানোর আর কোন সুযোগ নেই। নুপুর চোখ মুখ খিচে বন্ধ করেছে। সে কি বললো আর কি করছে! ভুল কিছু আবার বলে ফেলেনি তো!

দিবস নিজের মুখটা ধীরে ধীরে নুপুরের গলা বেয়ে কানের কাছে নিয়ে
‘ ওই যে রাতে এসে বুকে শুয়ে ছিলে তখন সব কপি করে নিয়েছি, তোমার ভিতরে কি চলে, বা চলবে সব। বুঝলে!

কথাগুলো বলতেই নুপুর বড় বড় করে তাকায়। দিবস একটু পিছিয়ে গিয়ে হো হো করে হাসতে শুরু করে। দিবসের হাসি দেখে নুপুর লজ্জাও পাচ্ছে আবার রাগও হচ্ছে সাথে বিরক্ত। অদ্ভুত একটা লোক। রাতে কি নুপুর ইচ্ছে করে ওই পাশে গিয়েছিলো নাকি! নাকি ইচ্ছে করে বুকে শুয়ে ছিলো।

নুপুর মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দিবস বেডে গিয়ে শরীর এলিয়ে দেয়। নুপুর দিবসের পাশে গিয়ে চুপ করে বসে। তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে
‘ আপনাকে কিছু কথা বলার ছিলো।

দিবস শুয়ে থেকেই মাথা ঘুরিয়ে তাকায় নুপুরের দিকে। বাম হাতের কনুইয়ের উপর ভর করে হাতে মাথা রেখে,
‘ শুনতেই তো বসে আছি। বলো। আর প্লিজ দুপুরের বিষয়ে কিছু বলবে না।

নুপুর নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে এক হাতের নখ দিয়ে আরেক হাতের নখ ঘষতে ঘষতে
‘ আসলে আমার অতীত নিয়ে কিছু বলতে চাই। রাদিল আর আমার বিষয়ে।

দিবস রাদিলের কথা শুনে উঠে বসে। সামনে তাকিয়ে নুপুরকে উদ্দেশ্য করে
‘ তোমার অতীত নিয়ে আমার কোন মাথাব‍্যাথা নেই। তুমি কার ছিলে, কি হয়েছিলো তা নিয়েও আমার কোন আক্ষেপ নেই। তুমি এখন আমার। আর এখন তোমায় ভালো রাখার দায়িত্বও আমার। আর এখন যদি তোমায় আমি ভালো রাখতে না পারি, সম্মান দিতে না পারি তাহলে হ‍্যাঁ অবশ্যই আক্ষেপ থাকবে আমার। অতীত নিয়ে মানুষ বাঁচতে পারেনা নুপুর। না ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হতে পারে। অতীত মানুষকে পেছনে টেনে ধরে। ভুলে যাও ওই কালো অধ্যায়।

নুপুর মাথা নুইয়ে চোখের পানি মোছার চেষ্টা করে
‘ কিন্তু আমার অতীত তো আমার পিছু ছাড়ছে না দিবস। বরং ভবিষ্যতে আরো বড় আকার ধারণ করে তা আমার সামনে এসে দাঁড়াবে। আর তখন আমি তার সামনাসামনি দাঁড়াতে পারবো না। আজ ভালোবাসা কথাটি আমার কাছে শুধুমাত্র একটা শব্দ ছাড়া আর কিছুই না।
তাই আজ জানাতে চাই। আপনি সবটুকু জানেন না। শুনবেন?

দিবস কিছুক্ষণ চুপ থেকে দুহাত দিয়ে নিজের মুখে হাত বুলিয়ে নিয়ে
‘ আচ্ছা বলো।

দিবসের কথা শেষ হবার আগেই নুপুর বলা শুরু করে
‘ স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে যখন ভর্তি হই আমার কাছে সবকিছু ছিলো কেমন স্বপ্নের মতো। নতুন সব বন্ধু, নতুন পরিবেশ সবকিছু ছিলো নতুন আর সুন্দর অনুভুতি। এর মাঝে আমার যেইসব বান্ধবীদের সাথে পরিচয় হয় তাদের মধ্যে প্রায় সবাই-ই প্রেম করতো। আর আমাকেও উৎসাহ দিতে থাকতো। আমারো তখন উড়ন্ত বয়স। ওদের কথা শুনেই রাদিলের প্রেমের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাই। ভালোলাগাকে ভালোবাসা নাম দিয়ে চালিয়ে দিতে থাকি৷ এইভাবে প্রায় দেড়বছর ছিলো আমাদের প্রেম। আমি এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কিছুদিন আগে রাদিল আমার ফ্যামিলিতে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। ও নাকি দেশের বাহিরে চলে যাবে তাই বিয়ে করে যেতে চায়। আমার ফ্যামিলিতে আমার এক মা, মামা, মামি আর মামাতো পিচ্চি ছোট বোন ছাড়া আর কেউ নেই। আমার আব্বু আমার নানু বাড়িতেই থেকে চাকরি করতেন। ফলে আমার চাচারা আমাদের সব সম্পত্তি দখল করে নেয়। এইসব নিয়ে ঝামেলায় আব্বু অসুস্থ হয়ে যায়। এর কিছুদিন পরই মারা যায়।

মা, মামা, মামি প্রথমে রাজি ছিলেন না বিয়েতে। রাদিলের সম্পর্কে নাকি ভালো তথ্য পাননি। সেই প্রসঙ্গে নিয়ে ওনারা রাজি নন। কিন্তু আমার জেদের কাছে হার মেনে অবশেষে রাজি হয়, আর আমাদের বিয়ে হয়ে যায়।

প্রথমে ক’দিন ভালোই চলছিলো আমাদের সংসার। রাদিলের আব্বু, আম্মু, ছোট ভাই সবাই আমাকে খুব আদর করতো। কিন্তু কিছুদিন যেতেই রাদিলের মা নাতির জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। ছেলে বাহিরে গেলে নাকি নাতি নিয়ে থাকবে। আর সন্তান হলে নাকি ছেলের বউও ঠিক থাকবে। সামনেই আমার এইচএসসি পরীক্ষা ছিলো। তাই আমি রাজি ছিলাম না। রাদিল প্রথমে না করলেও পরে মায়ের কথায় আমার সাথে জোরাজুরি শুরু করে। কয়েকদিন শরীরে হাতও তুলেছে। আমি বাধ্য হয়ে রাজি হই। কিন্তু আল্লাহ না চাইলে কি মানুষ কিছু পারে!! আমাদের বাচ্চা হয়না। এর জন্য ও তাড়াহুড়ো করে ডাক্তার দেখায়….

এইটুকু বলেই নুপুর কেঁদে দেয়। নুপুরকে কাঁদতে দেখে দিবস এগিয়ে যায় নুপুরের কাছে। নুপুরের মাথা তার কাঁধে রেখে।
‘ বলতে হবে না আর। যা বলে কান্না আসবে তা কেন বলতে চাও? এসব নিয়ে কেনই বা ভাবছো?

নুপুর দিবসের কাঁধ থেকে মাথা উঠিয়ে
‘ ভাবতে হবে কারণ সেদিন ডাক্তারের রিপোর্টে আসে আমি কখনো মা হতে পারবো না। বাবা মানে আপনার আব্বুও সে কথা জানে না।

নুপুরের কথাটা শুনে দিবসের মাথায় যেন বাজ পড়েছে। বসা থেকে চমকে উঠে দাঁড়িয়ে………

চলবে……….

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কেমন হয়েছে জানাবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে