সে এসেছে .পর্ব: ০১
সুহাসিনী মনি
কিছুদিন ধরে প্রতি রাতে একটা রক্তদলার মত নরম শরীর আমার পাশে এসে ঘুমায়।মাঝে মাঝে ওই শরীর টা আমার মত সাইজের হয়ে আমার বালিশের অর্ধেক অংশ দখল করে নেয়। আমি স্পষ্ট অনুভব করি ওটা কোনো একটা মানুষের শরীর।”
~ রাইসার সামনে দাঁড়িয়ে তার নয় বছরের মেয়ে তন্নি কেমন ভয়ার্ত ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে চলেছে। রাইসার চোখের পলক পড়ছে না।মেয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে মেয়ের কথা শুনছে। গতকাল রাতে সে নিজেও এমন একটা স্বপ্ন দেখেছে। যেই স্বপ্নে তন্নির পাশে সে অন্য একটা শরীর শুয়ে থাকতে দেখেছে। ওটা রাইসার কাছে নিছক দু:স্বপ্ন ছিল। কিন্তু,এখন মেয়ের কথা শুনে সেটাকে রাইসা তুচ্ছ মনে করে উড়িয়ে দিতে পারছে না।
মেয়েকে কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে কপালে মৃদু চুমু খেয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। তন্নি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
~জানো মা, শরীর টা মাঝে মাঝে ভীষণ কোমল লাগে,আবার কিছুক্ষণ পর সেটা জেলির মত চপচপে মনে হয়।
~তোমার এই সমস্যা আমাকে এর আগে কেন জানাও নি? কেন তন্নী?
~আমি মনে করেছিলাম ওটা আমি ভুতের গল্প পড়ে স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু এই দুইদিনে অন্ধকারে আমি স্পষ্ট তাকে স্পর্শ করেছি। আমার ডান হাতে জমাট রক্ত লেগেছিল।
রাইসা ভার্সিটি থেকে বিবিএ ও এমবিএ শেষ করে গত সাড়ে ছয় বছর ধরে একটি প্রাইভেট ব্যাংকে চাকুরী করছে। বর্তমানে সে ওই ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার। বিয়ের এগারো মাস পরেই তন্নি জন্ম নেওয়ায় রাইসার এমবিএ কম্পিলিট করতে একটু সময় লেগে যায়। ওর বিবিএ শেষ করে অপেক্ষা করার সময়টুকুতেই রাইসা বিয়ে করতে বাধ্য হয়।ওর স্বামী আসিফ একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। শহরে এখন নিজস্ব বাসা,দুটো প্রাইভেট কার,সমাজের উঁচু শ্রেণীর মানুষের সাথে বেশ খাতির। এক কথায় উচ্চবিত্ত শ্রেণীর নাগরিক। সেই ফ্যামিলিতে মেয়ের এরকম ঘটনা রাইসাদের কাছে মানসিক সমস্যার বাইরে উদ্ভট কিছু মনে হওয়ার সম্ভাবনাও নেই।
আসিফ তখন বাসায় নেই।আজ সারাদিন তন্নির শরীর টা কেমন জানি লাগছে। সেকারণেই রাইসা অফিস থেকে ছুটি নিয়ে মেয়েকে সময় দিচ্ছে। ডাক্তার সামিরকে এরমধ্যে সে কল দিয়ে চেম্বারে যাওয়ার সময় জানিয়ে দিয়েছে।
রাইসা ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলো,মেয়েকে নিয়ে এখন সে কি করবে।
কয়েকবার সে আসিফকে অনবরত কল দিয়েই যাচ্ছে। কিন্তু আসিফ অফিসের কাজে ব্যস্ত।
রাইসার নিজস্ব গাড়িটাও এখন মেকানিক গ্যারেজে। উপায় না পেয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে সে রাস্তায় নেমে এলো। পিচ ঢালা রাস্তায় তপ্ত রোদ। আশপাশে খুজে খুজে পঁচিশ ত্রিশ বছরের কাছাকাছি একটা রিক্সাওয়ালার রিক্সায় চেপে বসলো। ডাক্তার সামিরের চেম্বারে যেতে মাত্র পনেরো মিনিটের মত সময় লাগে।
অথচ রিক্সা যেন চলছেই না। রাইসা বিরক্ত হয়ে রিক্সাওয়ালাকে বলল,
কি ভাই,আমরা কি নেমে যাবো?আপনি তো মনে হয় এ জন্মে আমাদের পৌছে দিতে পারবেন না।
অদ্ভুতভাবে রিক্সাওয়ালা হা হা করে হেসে উঠল।তারপর বলল,
সেদিন তো আস্তে চালাতে বলছিলেন ম্যাডাম।আজ আপনার এত তাড়া কিসের?
রিক্সাওয়ালার বিকট শব্দের হাসিতে রাইসা কিছুটা মুশড়ে গেলো। দীর্ঘ পাঁচ বছর সে রিক্সাতেই ওঠেনি।অথচ, এই লোকটা বলছে রাইসা তাকে একদিন রিক্সা আস্তে চালাতে বলেছে। তন্নী ভয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল। রাইসা কিছু বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু গলাটা কেমন আটকে আসছে। অনেক কষ্টে কাঁপা কাঁপা গলায় রিক্সাওয়ালাকে প্রশ্ন করলো,
কে আপনি?
আরো একবার বিচ্ছিরি রকমের হাসি দিয়ে রিক্সাওয়ালা উত্তর দিলো,
আমাকে চিনতে পারছেন না ম্যাডাম? একদিন আমিই আপনাকে উপকার করেছিলাম। আর তার পরিনতি কি পেয়েছি জানেন.?
প্লিজ আমাদেরকে নামিয়ে দিন, প্লিজ। আমি আপনার রিক্সাতে যাব না।
কিন্তু রিক্সা থামলো না।রাইসা চোখ বন্ধ করে চিৎকার দিলো। কিছুক্ষণ চারপাশ নিরব । তারপর কয়েকজনের উপস্থিতি টের পেয়ে ও চোখ খুলল।সামনে কয়েকজন অপরিচিত মানুষ। রিক্সাওয়লাটাও নেই। আশপাশে খুঁজেও তাকে পাওয়া গেলো না। রাইসার শরীর দিয়ে অঝোরে ঘাম ঝরছে।
একজন এগিয়ে এসে ওকে জিজ্ঞাসা করল,
আপা, আপনি কি ঠিক আছেন? কি হয়েছে আপনার?
এই রিক্সাওয়ালা টা কোথায় গেলো?
এই রিক্সাতে তো আপনি একাই বসে কিসব বিড়বিড় করছিলেন দেখলাম। কোনো রিক্সাওয়ালা তো ছিলো না।
কিন্তু আমি স্পষ্ট তার সাথে কথা বলেছি। ও এই চালকের সিটেই বসে ছিল।
আপনার শরীর খারাপ মনে হয়। আমি নিজে দেখলাম আপনি খালি রিক্সায় বসে কিসব একা একা কথা বলছেন। এই রিক্সার মালিক ওই যে হোটেলে ভাত খেতে গেছে। ওর নাম সালিম। আপনি শান্ত হয়ে বসেন। আমি ওকে বলে দিচ্ছি আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে।
রাইসা তাকিয়ে দেখলো হোটেলের সামনের দিকে প্রায় বিশ বছরের কাছাকাছি একটা ছেলে ভাত খাচ্ছে। ওর সাথে একটু আগে দেখা রিক্সাওয়ালার কোনো মিল নেই। সামনের লোকটাকে বুঝানোর জন্য ও তন্নিকে দেখিয়ে বলল,
আমার মেয়ের কাছেই জিজ্ঞেস করুন, ও নিজেও দেখেছে।
এতক্ষণে তন্নীর দিকে সবার নজর পড়লো। কিন্তু ওর শরীরটা রাইসার কাঁধের পাশে এলোমেলোভাবে পড়ে আছে।ও যে এতক্ষণ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে তা কেউই খেয়াল করেনি।রাইসার কান্নাকাটি দেখে এক ভদ্রলোক ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে এলেন।
আরে, আপনি মিসেস আসিফ না.? আমি তাইজুল হাসান। গত মাসে আপনার ব্যাংকে আমার ছেলের জন্য একটা সেভিংঙ্কস একাউন্ট খুললাম।
লোকটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ও চেনার চেষ্টা করলো। হ্যা, ইনি জনাব তাইজুল। গত মাসেই রাইসার অফিসে এসেছিলেন । সামান্য মাথা দুলিয়ে ও উত্তর দিলো,
জ্বি, চিনতে পারছি কিছুটা।
এতেই হবে। নামুন রিক্সা থেকে। আমি আপনাকে ড্রপ করে দিচ্ছি। যাবেন কোথায় বলুন?
শায়লা মেমোরিয়াল ক্নিনিক।
চলুন। আমার সাথে নির্ভয়ে যেতে পারেন।
এই মুহূর্তে আর কোনো উপায় ও নেই। অনেকটা নিরুপায় হয়েই সে জনাব তাইজুলের গাড়িতে উঠে বসল।
তাইজুল খেয়াল করলো রাইসা কিছুটা কেঁপে কেঁপে উঠছে।
-মিসেস আসিফ..
শায়লা মেমেরিয়াল ক্লিনিক টা কোন দিকে আমার এক্সাক্টলি মনে নেই।
-মেইন রোডের শেষে বাম দিকে একটা মোড় চলে গেছে। একটু ভিতরে গেলেই পেয়ে যাবেন।
-সে তো পৌঁছাতে সামান্য দেরী হবে। আপাতত এখানকার কোনো ক্লিনিকে গেলে হয় না?
-না। আমি ভার্সিটি লাইফ থেকেই সমস্ত চেকাপ ওখানেই করাই। ডাক্তার সামির আমার অনেক পূর্ব পরিচিত।
-ও আচ্ছা।
প্রায় বারো পনেরো মিনিট পর তাইজুল রাইসাকে “শায়লা মেমোরিয়াল ক্লিনিকের” সামনে নামিয়ে দিলো।ডাক্তার সামির ওদের জন্যই অপেক্ষা করছে।এরমধ্যে তন্নির জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু সে একটা কথাও বলছে না।কিছুক্ষণ পরীক্ষা করার পর সামীর তন্নিকে ডাকলো,
মামনি, তুমি কি চকলেট খাবে?
চকলেটের কথা শুনে তন্নীর মুখে সামান্য হাসি ফুটলেও মুহূর্তেই মলিন হয়ে গেলো।
-না আংকেল, আমি কিছু খাব না।আমাকে ও কিছু খেতে দিবে না।
-ও?
এই ও টা কে?
-যে রাতে এসে আমার বিছানায় এসে ঘুমায়। নরম তুলতুলে পুতুলের মত।
রাইসা কপালে চিন্তার ভাঁজ নিয়ে সামিরের দিকে তাকালো। আরো কিছুক্ষণ পরীক্ষা করে সামির রাইসাকে বলল,
মনে হচ্ছে কিছু নিয়ে সাংঘাতিক রকম শক পেয়েছে। সেটা হয়ত ভয় থেকে। চিন্তা কোরো না। ওর এখন কিছুদিন রেস্ট দরকার। আমি কিছু প্রেসক্রাইবও করে দিচ্ছি। নিয়মিত ফলো করলে আশা করি ভাল হয়ে যাবে।
রাইসা কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে বলল,
-ডাক্তার, আপনি আমার সমস্ত বিষয়ই জানেন। এই একটাই সন্তান আমার। আর কোনোদিন বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনাও নেই।
-তার জন্য তো তোমরা নিজেরাই দ্বায়ী রাইসা।
তখন যদি বিয়েটা করে নিতে আজ এই দুর্দিন দেখতে হত না।
রাইসা কানে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল।
-প্লিজ ডাক্তার, আমি মনে করতে চাই না। আপনি প্লিজ আসিফ কে একটা কল দিন। আমি একা বাসায় ফিরতে পারবো না।
রাইসার কথামত সামীর আসিফ কে কল দিলো। প্রায় আধা ঘন্টার মত পর আসিফ গাড়ি নিয়ে ক্লিনিকে ওদেরকে নিতে গেলো। উজ্জল শ্যামলা গায়ের রং,ঘন কালচে চুলের ভাঁজ,সুঠাম দেহ। যেকোনো মেয়েই আকৃষ্ট হবে খুব সহজেই। রাইসাও ভার্সিটিতে এসে ওর প্রেমে পড়ে গেছিলো।প্রকাশ করতে পারেনি কোনোদিন। কিন্তু যখন দেখলো আসিফ নিজে ওকে ভালবাসার প্রস্তাব দিচ্ছে,তখন আর নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি।
ডাক্তার সামীরের কাছ থেকে ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। মেইন দরজা খুলতেই ওদের চোখে পড়লো তন্নির স্কেটিং গাড়িটা ভেঙে পড়ে আছে। পাশে ওর প্রিয় পুতুলটাও মেঝেতে পড়ে আছে।অথচ তন্নীর স্পষ্ট মনে আছে ওটা ও তার মায়ের ঘরেই রেখেছিল। এ বাসায় ওরা ছাড়া আর কেউ থাকে না।পুরো বাসাটা কেমন জানি থমথমে হয়ে আছে।
..চলবে…