সে আমারই পর্ব-৪+৫

0
555

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ০৪

ফারনাজ আগে অনেক গান শুনেছে। তবে সামনাসামনি এভাবে শোনা হয়নি। এমন মুগ্ধ সে আগে কখনও হয়নি। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, স্টেজে অবস্থান রত রকস্টারের দিকে। এদিকে চেঁচামেচি বেড়েই চলেছে, সিটি বাজছে আশে পাশে। আবার অতিরিক্ত গরমে এবং এতো ভীড়ের চাপে দম বন্ধ হয়ে আসছে দৃষ্টির। সে ঢোক গিলে দুর্বল কন্ঠে বলল,

“আমার খারাপ লাগছে আপু।”

ফারনাজ ঘোর থেকে বের হলো। বোনের বেহাল অবস্থা দেখে ভড়কে গেল। ব্যস্ত কন্ঠে বলল,

“চল, ওদিকটায় যাই।”

তাকে টেনে নিয়ে ভীড় ঠেলে বের হয়ে এক গাছের নিচে দাঁড়াল। আশে পাশে চোখ বুলিয়ে বলল,

“তুই এখানে একটু কষ্ট করে দাঁড়া, দৃষ। আমি তোর জন্য পানি নিয়ে আসছি।”

সে দ্রুত পায়ে চলে গেল। দৃষ্টি বারণ করতে যেয়েও পারল না। তার শরীর সাঁই দিচ্ছে না। মাথা ভনভন করছে। মনে হচ্ছে এখনই শরীর ছেড়ে দেবে। হলোও তাই, মাথা ঘুরে উঠল তার। শরীর ছেড়ে পড়ল কারো বাহুডোরে। তবে ব্যক্তিটিকে দেখার পূর্ব মুহূর্তে চোখে আঁধার নেমে এলো।

হতভম্ব আফরান বার কয়েক পলক ফেলল। আদৌ তার ভ্রম কিনা! কিন্তু না এটা দৃষ্টিই। সে তার গালে মৃদু চাপড়ে ডাকে,

“দৃষ! এই মেয়ে!”

তার সাড়া নেই। আফরান চিন্তিত হয়। প্রেশার ফল করেছে নিশ্চয়। সে আজ না এলে কি হতো? নিশ্চয় এখানে পড়ে থাকত। মাথা ফাটাত। সে দৃষ্টিকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর হম্বিতম্বি করে ফারনাজ পানির বোতল নিয়ে এলো। দৃষ্টি কে জ্ঞানহীন অবস্থায় দেখে তার চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। চিল্লিয়ে বলল,

“দৃষ! হায় আল্লাহ্! কি হলো তোর?”

আফরান বিরক্ত চোখে তাকায়। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে,

“অসুস্থ অবস্থায় ও’কে রেখে কোথায় গিয়েছিলি তুই? আমি এসে না ধরলে কি হতো?”

ফারনাজ মুখ কালো করে বলল,

“আমি তো ওর জন্য পানি আনতে গিয়েছিলাম। এর মধ্যে!”

আফরান দৃষ্টি কে কোলে তুলে নিল। এগোতে এগোতে বলল,

“এত ভীড়ের মধ্যে কেন এসেছিস? জানিস না দৃষ এতো ভীড় আর গরম সহ্য করতে পারে না? আর এসেছিস ভালো কথা ফারদিন কে নিয়ে আসিস নি কেন? গ’র্দ’ভ কোথাকার! আমার পিছু পিছু আয়।”

ফারনাজ মুখ বাঁকিয়ে তার পেছনে গেল। আফরান যে কোথায় যাচ্ছে তা সে বুঝতে পারছে না। আশ্চর্য জনক ব্যাপার কেউ তাকে বাঁধা দিচ্ছে না। এতো এতো গার্ড চারপাশে, তার দিকে তাকাচ্ছে প্রর্যন্ত না।
আফরান একটা রুমের মধ্যে এনে দৃষ্টিকে বিছানায় আলতো হাতে শুইয়ে দিল। ফুল স্পীডে ফ্যান চালু করে দিল। ফারনাজ চারপাশে তাকাল। এটা সম্ভবত কোনো রেস্ট রুম। ফারনাজ জিজ্ঞেস করল,

“এটা কার রুম?”

“তোর শশুরের।”

“ভাই!”

আফরান চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বলে,

“আলতু ফালতু কথা না বলে পানির বোতল দে।”

ফারনাজ এগিয়ে দিল। আফরান হাত পানি নিয়ে দৃষ্টির মুখে আলতো ছিটিয়ে দিল। মাথায়ও অল্প পানি দিল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। ফারনাজের এদিকে নজর নেই সে ঘুর ঘুর করতে ব্যস্ত। সে রুম ছেড়ে বেরিয়েই গেল। আশে পাশে উঁকি ঝুঁকি মে’রে দেখতে লাগল সে। পাশে তাকিয়ে সামনে এগোতেই কোনো পিলারের সঙ্গে ধাক্কা লেগে তার চোখ থেকে চশমা ছিটকে পড়ে গেল। ফারনাজের সামনে অধিকাংশ সব ঝাপসা হয়ে এলো। সে বেশি কিছু চশমা ছাড়া দেখতে পায় না। একেবারেই অচল বলা চলে। সে মুখ বিকৃত করে বলল,

“ধুর! এই পিলার টাও সামনে আসার সময় পেল না। এখন চশমা খুঁজব কীভাবে?”

কোনো উপায় নেই। হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে ফিরে যেতে পারবে কি? ফারনাজের পিলার উপাধি দেওয়া মানুষটি আশে পাশে তাকিয়ে চশমাটি তুলে নিল। ফারনাজ তখন ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। মানুষটি শক্ত করে তার হাত চেপে ধরে নিজের দিকে ফেরাল। ফারনাজ হকচকাল। পরপরই চোখে চশমার উপস্থিতি টের পেয়ে সামনে তাকাল। বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল। হা করে চেয়ে রইল সে। মানুষটি গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“চোখে চশমা থাকা সত্ত্বেও জল জ্যান্ত মানুষকে পিলারের উপাধি দেওয়ার চেয়ে চশমা না থাকাই ভালো।”

ফারনাজ স্বাভাবিক হলো। কোণা চোখে রকস্টারের আগা গোড়া পর্যবেক্ষণ করল। হঠাৎ একটা বোকা কাজ করে বসল, রকস্টারের শক্ত পোক্ত বুকে এক হাত ঠেকিয়ে বলল,

“এই যে দেখুন! এমন শক্ত কিছুর সাথে ধাক্কা খেলে পিলার বলব না তো আর কি? পাথরও বলা যায়।”

তূরাগ থতমত খেয়ে দু পা পিছিয়ে যায়। এমন ঘটনা তার সাথে প্রথম। বলা নেই কওয়া নেই তার বুকে হাত ঠেকাল এই মেয়ে! আশ্চর্য! চোয়াল শক্ত করে ধমকে ওঠে,

“এই ফা’জিল মেয়ে! ম্যানারস্ জানা নেই কোনো? এভাবে এই অজ্ঞাত পুরুষের গায়ে হাত দেওয়া কোন ধরনের ভদ্রতা?”

ফারনাজ চুপসে গেল। সত্যিই তার কাজটা করা ঠিক হয়নি। কি মনে করে সে কাজ টা করল কে জানে? তাছাড়া এই লোকের কন্ঠে সে যতটা মুগ্ধ হয়েছিল, এই লোকের ব্যবহার ঠিক ততটা খারাপ। মিনমিন করে বলল,

“আপনিও তো আমার হাত ধরেছিলেন।”

তূরাগ বিস্মিত! সামান্য হাত ধরা আর এই কাজ কি এক হলো? সে থমথমে কন্ঠে বলল,

“কে তুমি? এখানে প্রবেশ করলে কীভাবে?”

ফারনাজের আর এই লোকের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। এতো সুন্দর লোকের কথা এমন তেতো! তবুও সে বলে,

“ওই রুমে আমার বোন আছে।”

তূরাগ রুমের দিকে তাকিয়ে আরেক দফা বিস্মিত হয়। খড়খড়ে কন্ঠে বলে,

“আমার রুমের মধ্যে তোমার বোন কীভাবে ঢুকল!”

সে লম্বা পা ফেলে এগোয়। ফারনাজ মুখ ভেংচি কেটে তার পিছু যায়। রুমে প্রবেশ করে ভাইকে অজ্ঞাত রমনীর পাশে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়। ডাকে,

“ভাই!”

ফারনাজ চোখ পিটপিট করে। এই লোক আফরান ভাইকে ভাই ডাকছে কেন? দৃষ্টি আর আফরানও তাকায়। দৃষ্টির জ্ঞান ফিরেছে কিছু মুহূর্ত পূর্বে। ফারনাজ কোনো দিকে পাত্তা না দিয়ে তড়িঘড়ি করে বলে,

“তোর জ্ঞান ফিরেছে, দৃষ! ঠিক আছিস তুই? চল বাড়ি যাই।”

দৃষ্টির কোনো নড়চড় না দেখে সে পুনরায় বলে,

“কি হলো? চল!”

আফরান গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,

“দৃষ, আমার সাথে যেতে চায়ছে। আমি পৌঁছে দেব তোদের।”

আফরানের অকপট মিথ্যে কথায় দৃষ্টি কঠোর দৃষ্টিতে তাকাল। যেন পারলে এখনই ভ’ষ্ম করে দেবে। হাত মোচড়ালো, তবে আফরানের শক্ত বাঁধন থেকে ছাড়াতে পারল না। তার ওড়নার নিচেই খুব কৌশলে তার হাত চেপে ধরে বসে আছে এই লোক। কারো চোখেই পড়ছে না তা। তূরাগ জিজ্ঞেস করল,

“এরা কারা ভাই? তুই চিনিস এদের?”

“হ্যাঁ, যে তোর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সে আমার খালামনির বড় মেয়ে, ফারনাজ। আর এই যে মহিলা আমার পাশে বসে আছে সে হলো খালামনির ছোট মেয়ে, দৃষ্টি। আর নাজ! এই রকস্টার হলো আমার ভাই তূরাগ ইততেয়াজ। তোদের সাথে হয়তো ছোট বেলায় দ্যাখা হয়েছিল। তাই তোরা চিনিস না। আমি তো জানতামই না তোরা তূরাগের এতো বড় ফ্যান। নাহলে আমিই নিয়ে আসতাম। টিকিটও কাটা লাগত না। আমি একদম ফ্রিতে এসেছি। কি সুবিধা দেখেছিস? রকস্টারের ভাই হওয়ার?”

ফারনাজ চোখ উল্টায়। ফ্যান না ছাই! এই পাথর মানবের ফ্যান কে হবে? এই পাথর মানবের গানটা যে এতো ভালো লেগেছিল! ভাবতেই ফারনাজ মনে মনে কয়েকবার তওবা করে। দৃষ্টিকে মহিলা বলায় সে ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে। ইচ্ছে তো করে এই লু’চু ডাক্তারের ভবলীলা সাঙ্গ করতে! আফরান আবার বলে,

“ভাই! তোর কি কাজ শেষ সব? বাড়ি ফিরবি?”

“হ্যাঁ।”

“ঠিক আছে। চল তাহলে। এদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আমরা যাব।”

আফরান আলগোছে দৃষ্টির হাত মুক্ত করে দিতেই সে ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। বোনের কাছে গিয়ে বলল,

“চল আপু। আমরা একাই চলে যাব। ওনাদের এত কষ্ট করতে হবে না।”

ফারনাজ তাকে বুঝিয়ে বলল,

“দৃষ! একে তো তোর শরীর ভালো নেই। তার উপর এখন রাত হয়ে গিয়েছে। আমরা কি একা যেতে পারব, বল? তার থেকে ভালো আফরান ভাই দিয়ে আসবে।”

ফারনাজের যুক্তির সামনে দৃষ্টি আর কিছু বলতে পারল না। তবে এটা বুঝল আফরান আবারও কিছু না কিছু করবে, লু’চু ডাক্তারের কোনো বিশ্বাস নেই।

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ০৫

“শোন নাজ! তুই তূরাগের সাথে সামনে বোস, আমি পেছনে বসছি। বলা তো যায় না, দৃষ আবার কখন অসুস্থ হয়ে পড়ে।”

এই পাথর মানবের সাথে বসার একদমই ইচ্ছে নেই ফারনাজের। তবুও বোনের কথা ভেবে এক প্রকার বসতে বাধ্য হলো সে। তারা দু’জনে উঠে বসতেই তূরাগ শা করে গাড়ি টান দেয়। দৃষ্টি কটমটিয়ে আফরানের দিকে তাকাতেই সে দাঁত কেলিয়ে একটা হাসি দেয়। মুখ কুঁচকে ঘুরিয়ে নেয় দৃষ্টি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। আফরান সুযোগ বুঝে একটু চেপে বসে তার দিকে। তার হেলদোল না দেখে, সে আরও চেপে বসে। আলগোছে পিঠের নিচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে কোমর চেপে ধরে। শিউরে উঠে, অ’গ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে। তবে আফরান এমন একটা ভাব করল যেন সে ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না। দৃষ্টি সা’পের ন্যায় মুচড়ে উঠে তার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল। হিতে বিপরীত হলো, আফরান হাতের বাঁধন আরও দৃঢ় করল। দৃষ্টি হাল ছেড়ে দিয়ে বসে রইল। আফরান একটু ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলল,

“কি রে মহিলা! মুখটা এমন পেঁচার মতো করে রেখেছিস কেন? কেউ নিম পাতা খাইয়ে দিয়েছে?”

দৃষ্টি তেজী কিন্তু চাপা কন্ঠে বলল,

“আমাকে কোন দিক দিয়ে মহিলা মনে হয়? আর ছাড়ুন আমাকে।”

আফরান গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,

“উহু! তুই মহিলা নস। তুই হলি কচি নাদুসনুদুস একটা বাচ্চা। দেখলেই শুধু আদর করতে ইচ্ছে করে। ওলে লে লে।”

বলেই তার গাল টেনে দেয়। তার গাল দুটো একটু ফোলা বলে আফরান তাকে নাদুসনুদুস বাচ্চা উপাধি দিল। দৃষ্টি ভয়’ঙ্কর রেগে যাচ্ছে দেখে আফরান একটু নড়েচড়ে বসল। বলল,

“এমন করে তাকিয়ে আছিস কেন? খেয়ে ফেলবি নাকি? দ্যাখ আমি কিন্তু খুবই ভদ্র একটা ছেলে। তোর এই নজর দিয়ে আমাকে কাবু করতে পারবি না।”

দৃষ্টি দাঁত কিড়মিড় করে বলে,

“দেখুন!”

“দ্যাখা।”

আফরান চোখ বড় বড় তাকাল। যেন সে কিছু দ্যাখারই অপেক্ষা করছে। দৃষ্টি হতাশ শ্বাস ফেলে পুনরায় জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। বিড়বিড় করে বলল,

“লু’চু ডাক্তার কোথাকার!”

আফরান ঠোঁট কামড়ে হাসে। ছোট্ট এই মেয়েটার নাকের ডগায় রাগ দেখতে তার বেশ লাগে।

ফারনাজ একটানা চুপ করে বসে থাকতে পারে না। সে এখন কথা বলার জন্য উসখুস করছে। পেটে কথা চেপে না রাখতে পেরে বলেই ফেলল,

“আচ্ছা রকস্টার মশাই? আপনি কি দেশের বাইরে হাডুডু খেলতে গিয়েছিলেন? নাকি কাবাডি? নাকি কুস্তি?”

ফারনাজের এমন অকেজো কথা শুনে তূরাগ বিরক্ত হলো। সে একজন রকস্টার। একজন রকস্টার দেশের বাইরে কি করতে যায়? এই মেয়ে কি তা জানে না? সে সামনের দিকে তাকিয়ে বলল,

“আর একটা ইউজলেস কথা বলেছ তো ধাক্কা মেরে গাড়ি থেকে আউট করে দেব। স্টু’পিড মেয়ে!”

ফারনাজ আড়ালে ভেংচি কেটে চশমা ঠিক করে ফোন বের করল। ‘অ্যাহ! ওনার সাথে কথা বলতে বয়েই গেছে আমার। রকস্টার হয়ে যেন মাথা কিনে নিয়েছে।’ সে ফোন লাগাল সুমির ফোনে। রিসিভ করতেই বলল,

“এই জুসি! তোরা গিয়েছিলি কনসার্টে?”

“আরে হ্যাঁ হ্যাঁ। আমিও গিয়েছিলাম। কি আর বলব! এমন বাজে কনসার্ট আমি আমার জীবনে দেখিনি।”

“কি বললি? ডুবে ডুবে ভালোবাসি গান? আরে ওইটা সব থেকে বি’শ্রী লেগেছে আমার কাছে। এমন বাজে কেউ কীভাবে গায়তে পারে? আমিও এর থেকে ভালো গাই।”

“কি! চেহারা সুন্দর ছিল! ছিঃ ছিঃ! তুই ওটাকে চেহারা বলিস! আমার তো মনে হলো কোনো শি’ম্পাঞ্জি গিটার নিয়ে নাচানাচি করছে।”

এক পর্যায়ে গাড়ির ব্রেক কষলো তূরাগ। মেজাজ তার আগে থেকেই বিগড়ে ছিল। তা বিগড়েছে স্বয়ং ফারনাজ। হঠাৎ ব্রেক কষায় হকচকাল সবাই। ফারনাজের হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে জানালা দিয়ে ছুড়ে মারে সে। ফারনাজ চেঁচায়,

“আরে! আমার ফোন!”

“চুপ! একদম চুপ! তোমাকে আমি চুপ থাকতে বলেছি না? অভ’দ্র মেয়ে!”

তূরাগের ধমকে কেঁপে উঠল ফারনাজ। আফরান উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

“কি হয়েছে?”

আফরানের কন্ঠস্বর পেয়ে ফারনাজ ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে উঠল। নাকের পানি চোখের পানি এক করে ফেলল। তূরাগ অতিষ্ট ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। “আমার ফোন, আমার ফোন” করে কিছুক্ষণ আহাজারি করল সে। অতঃপর নাক টেনে বলল,

“দৃষ! আমাকে নিয়ে যা। এই লোক আমাকে বকেছে। এমন পাষা’ণ মানুষ আমি কোনো দিন দেখিনি। এই দৃষ! আমি তোর কাছে যাব।”

আফরান মুখ কুঁচকাল। কি সুন্দর দৃষ্টির পাশে বসে তাকে বিরক্ত করতে পারছিল। দৃষ্টির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিও খুব ভালো লাগছিল। তার ভাইটাও না! ধৈর্য্য নেই একদম। এখন এখান থেকে না উঠলে ফারনাজ কেঁদে কুটে সমুদ্র বানিয়ে ফেলবে। আর ভালো লাগে না! সে দৃষ্টিকে ছেড়ে দিয়ে গাড়ি থেকে নামল। বলল,

“নাম। যা পেছনে গিয়ে বোস।”

ফারনাজ দ্রুত ভঙ্গিতে নেমে গেল। চশমা উঁচু করে চোখ মুছে দৃষ্টির পাশে গিয়ে বসল। ফোনটা তুলে নিয়ে যেতে ভুলেনি। দৃষ্টি বোনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“কি করেছিস তুই, আপু? তূরাগ ভাই চেঁচালেন কেন?”

ছলছল চোখে তাকিয়ে ফারনাজ বলে,

“আমি কিছু করিনি। ওই লোক এমনি এমনিই বকেছে।”

“আমার বিশ্বাস হয় না।”

“বিশ্বাস করতে হবে না। তোরা সবাই আমার ঘাড়েই দোষ দিবি। দ্যাখ আমার ফোনটার কি অবস্থা করেছে! কতদিনই বা বয়স হয়েছে এর?”

সে আবারও নাকে কাঁদল। তূরাগ ভ্রু কুঁচকে ফ্রন্ট মিররে তা দেখল। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকাল।
বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই ফারনাজ হম্বিতম্বি করে নেমে পড়ল। দৃষ্টি নেমে শান্ত কন্ঠে বলল,

“তূরাগ ভাইয়া! আসুন আমাদের বাড়ি। এক কাপ চা খেয়ে যাবেন।”

তূরাগ মৃদু হেসে বলল,

“আজ নয়। অন্য কোনো দিন।”

আফরান সবে হা করেছে কিছু বলার জন্য। তাকে সে সুযোগ না দিয়েই তূরাগ গাড়ি স্টার্ট করল। তারা চলে যেতেই ফারনাজ মুখ বাঁকিয়ে বলল,

“ওই পাথর মানবকে আবার ডাকতে গেলি কেন? আমি জানতাম যে আসবে না। পাথর মানবরা এমনই হয়। দেখলি না? আমার ফোনটা ভেঙে কি করেছে? সময় আমারও আসবে।”

“হ্যাঁ আসবে। চল।”

দৃষ্টি বাড়ির দিকে এগোলো। শিহরণে শরীর কাঁপছে এখনও তার। আফরান কাছে এলে দম বন্ধ হয়ে আসে তার। বুকের ধুকপুক হাজার গুণ বেড়ে যায়। চারপাশে শতশত প্রজাতি উড়ে যায়। তবে সে আফরানকে পূর্ব থেকেই চেনে। আফরান কলেজে থাকাকালীন অনেক মেয়ের সাথে ঘুরতেও দেখেছে সে। তবে চার বছর ধরে সে মেয়ে নামক প্রাণী থেকে দূরে আছে, শুধু সে ছাড়া। তবে তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে নার্সদের সাথে কথা বলে। আর ভাবে সে কিছুই বোঝে না।

“আচ্ছা ভাই? দৃষ্টিই কি তোর সেই পিচ্চি?”

আফরান সিটে গা এলিয়ে দিয়ে বলে,

“হু আমার পিচ্চি। শুধু আমার।”

মুচকি হাসে তূরাগ। পরক্ষণে আফরান লাফিয়ে উঠে তার দিকে তাকিয়ে বলে,

“দেখলি! তুই দেখলি! তোকে ভেতরে যেতে বলল, চা ও খেতে বলল। কিন্তু আমাকে যেতে বলল না। কি অপমানটাই না করল আমাকে। এই বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে আমি আর পারি না।”

“তুইও কম যাস না, ভাই। আমি কিন্তু দেখেছি সব, পেছনে মেয়েটাকে কেমন বিরক্ত করছিলি।”

আফরান মুখ কালো করে। হতাশ শ্বাস ফেলে বলে,

“বিরক্ত না করে আর উপায় কি? মহারানী তো আমাকে পাত্তাই দেয় না। তাকায়ও না। একই মেডিকেলে সব সময় চোখের সামনে ঘুরঘুর করি। তাও!”

“কিন্তু কেন? আমার এমন হ্যান্ডসাম, ডক্টর ভাইকে পাত্তা দেয় না এমন কোনো মেয়ে পৃথিবীতে আছে নাকি!”

“দুঃখের কথা আর বলিস না ভাই। সেই চার বছর ধরে আমি ঝুঁলে আছি। খুব বাজে ভাবে ফাঁসিয়েছে এই মেয়ে আমাকে। সর্বনা’শ টা আমার চার বছর আগেই হয়েছে। যখন এই মেয়ে ভালোবাসার ‘ভ’ ও বুঝত না। আর আমি দিব্যি মেয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম! চার বছর আগেই আমি মেয়ে সঙ্গ ত্যাগ করেছি। কাউকেই আর ভালো লাগে না। এই মেয়ে নিজেও জানে না, নিজের অজান্তেই তীর ছুড়েছে এবং তা ঠিক আমার বুকে এসে লেগেছে।”

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে