#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৪১
“ওয়েলকাম ব্যাক ডক্টর ইততেয়াজ।”
“থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ, ডক্টর আহমেদ। হা হা।”
“তো কেমন আছেন বলুন? হে হে।”
“আমি তো খুব ভালো আছি। তবে বউ রেখে গিয়ে একটু চিন্তায় ছিলাম। হে হে।”
“আরে কীসের চিন্তা? আমরা সবাই ছিলাম। আপনার বউ একদম সুরক্ষিত ছিল। হা হা।”
“হ্যাঁ যেমনটা ছাগলের সামনে ঘাস। হা হা।”
“আপনি কি আমাকে ছাগল বললেন! হে হে।”
“আই ওয়াজ জোকিং। তারপর বলুন বিয়ে করবেন না? হে হে।”
“হ্যাঁ, বিয়ে তো করতেই হবে। হা হা।”
“দৃষ আমাকে বলল ও নাকি ফুপি হতে চায়। আপনি তো ওর আপন ভাই এর মতো। দায়িত্বটা আপনি নিয়ে নিন। হা হা।”
“আমি দৃষ্টির ভাই! হ্যাঁ ভাই’ই তো। হে হে।”
“আপনিও খুব শীঘ্রই মামা হবেন। হে হে।”
দৃষ্টি এসব আর নিতে পারল না। কানে হাত চেপে মৃদু চিৎকার করে বেরিয়ে গেল। সে একটা ফাইলে মৃন্ময়ের সাইন নিতে এসেছিল। মৃন্ময় তাকে সাথে নিয়েই আফরানকে স্বাগত জানাতে এলো। আর তাকেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের কথা গিলতে হলো। হাসতে হাসতে কেমন অদ্ভুত ভাবে কথা বলছিল দুজন। দৃষ্টির দরকার নেই কোনো সাইন। লাগাম ছাড়া কথা বার্তার মধ্যে সে থাকতে চায় না।
দৃষ্টির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আফরান একটু হেসে বলল,
“কি হলো বলুন তো? এভাবে দৌড়ে চলে গেল কেন?”
মৃন্ময় ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলে,
“আপনার কথা ওর কান আর সহ্য করতে পারেনি। তাই কান বাঁচাতে চলে গেল।”
আফরান আবার হেসে ফেলল। বলল,
“একটু বেশি বলে ফেললাম বোধহয়।”
—
বাড়ি ফিরে বিশাল আয়োজন দেখে দৃষ্টি খালামনির নিকট ছুটে গেল। জিজ্ঞেস করল,
“এতো আয়োজন কেন খালামনি? কেউ আসবে নাকি?”
মিসেস সাইমা ভীষণ ব্যস্ত। তিনি ছোটাছুটি করতে করতে জবাব দিলেন,
“আরে দৃষ! অনেক কাজ বুঝলি? ফ্রেশ হয়ে এসে তুইও হাত লাগা।”
“কে আসবে? সেটা তো বলো?”
“তোর আপু আসছে আজ। কতদিন পর আমার মেয়েটা আসবে! আর সাথে আমার নাতনিটাও আসছে।”
দৃষ্টির ভ্রু শিথিল হয়। মিসেস সাইমা কাজে মনোযোগ দিয়ে আবার বললেন,
“আফরান ফিরেছে যেহেতু, সেহেতু তোদের রিসিভশন করা হবে শীঘ্রই। সেই বাহানা দিয়েই আসছে ও।”
দৃষ্টি রুমে চলে গেল। সিনথিয়া আপু আসছে, সাথে তার মেয়ে রিয়া। অনেক দিন আপু আসে না। দেশের বাইরে স্যাটেল হওয়ায় তারা বার বার আসতে পারে না। বছরে একবার নাহয় কয়েক বছর পর একবার আসে। রুমে গিয়ে সে ভাবল বাড়িতে মেহমান আসছে, এখন কি রুম ছেড়ে অন্য রুমে যাওয়া ঠিক হবে? কি মনে করবে সবাই? ওহ! খালামনিকে তো জিজ্ঞেস করাই হলো না যে ওই গায়ে পড়া মেয়েটা কে? আর কি কাজ তার এই বাড়িতে? আফরানের আশে পাশেই বা কি কাজ? সে ফ্রেশ হয়ে নিচে গেল।
ফারনাজকে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করতে দ্যাখা যাচ্ছে। সে তাকে থামায়। টেনে সোফায় বসিয়ে বলে,
“এভাবে ছোটাছুটি করছিস কেন? তুরাগ ভাইয়া দেখলে রাগ করবে। বকলে তখন ভ্যা ভ্যা করতে করতে আমার কাছে নালিশ করতে এলে খবর আছে তোর।”
সে মুখ কালো করে ফ্যালে। ডাগর ডাগর আঁখি জোড়া কুঁচকে বলে,
“এমন ভাব করিস তোরা যেন আমি ন মাসে পড়েছি। আমি বাচ্চা নাকি?”
“তুই বাচ্চার চেয়ে কম নোস, আপু। শুধু দেখতে আর বয়সটাই বেড়েছে তোর। আর এই সময়টা খুব সাবধানে থাকতে হবে। আমি পড়ছি তো, আমি জানি। প্রথম তিন মাস খুব সাবধানে চলতে হবে।”
“বুঝেছি। কিন্তু এতো কাজ পড়ে আছে তার কি হবে?”
সে আশ্বস্ত করে,
“আমি আছি তো। সব সামলে নেব।”
সে চলে যেতে নিয়ে আবার থেমে গেল। ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল,
“ওই মেয়েটা কে রে, আপু?”
ফারনাজ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
“কোন মেয়েটা?”
দৃষ্টি বিরক্ত হয়। মেয়েটার নাম মুখে নিতে কেমন রাগ হচ্ছে তার। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“রূপসী না কুপসী, ওই মেয়েটা।”
“ওহ! রূপসী! ও তো আঙ্কেলের বিজনেস পার্টনারের মেয়ে। ভাইয়ের সাথে নাকি বন্ধুত্বও আছে রূপসীর। বেড়াতে এসেছে। কিছু দিন থাকবে নাকি। জানিস? ভাইয়া যে দেশে গিয়েছিল সেও ওই দেশে গিয়েছিল টুর দিতে। তাই ভাইয়ার সাথেই চলে এসেছে। অতো রাতে কারো বাড়িতে আসা কেমন একটা না, বল?”
দৃষ্টি উঠে দাঁড়ায়। রান্না ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে ভাবে, এ কেমন বন্ধু? শুধু বন্ধু নাকি আরও গভীর কিছু? আফরান দেশে আসার সাথে সাথেই চলে এলো? তাও তার সাথে রাতে! দৃষ্টির ভালো লাগছে না কিছুই। সে খালামনি দের হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দিয়ে রুমে চলে গেল। আকাশ পাতাল চিন্তা ভাবনা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল। বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকার দরুন তার খোঁজ আর কেউ নিল না।
বাইরে থেকে শব্দ ভেসে আসছে। ক্ষণে ক্ষণে উচ্চ স্বরে হাসি এবং কথাবার্তার আওয়াজ শোনা যায়। দৃষ্টি উঠে বসে। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হবে হবে ভাব। বেশ অনেকক্ষণ ঘুমানো হলো। রাতে ঘুম না হওয়ার ফল। সে এতোক্ষণ রুমে অথচ কেউ তার খোঁজ করল না? সে ফ্রেশ হয়ে বের হয়। নিচে চেয়ে দ্যাখে সবাই জড় হয়ে গল্প করছে, হাসি মজা করছে। তার সব থেকে দৃষ্টি কটু বিষয় রূপসী আফরানের গা ঘেঁষে বসে গল্পে মেতে আছে। দৃষ্টির এই মুহূর্তে মনে হলো সে এই বাড়ির কেউ নয়, নিতান্তই বাইরের লোক। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সে পুনরায় রুমে ফিরতে চায়ল, কিন্তু পারল না।
“আরে দৃষ্টি! আয়, নিচে আয়। আমি কখন থেকে তোকে খুঁজে যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি চলে আয়।”
সিনথিয়া আপুর ডাক সে উপেক্ষা করতে পারল না। ঠোঁটের কোণে নকল হাসি ঝুলিয়ে নিচে নেমে এলো। সিনথিয়া আপুর পাশে তুরাগ বসে ছিল। সে তাকে ঠেলে উঠিয়ে বলল,
“এই তুই ওঠ, দৃষ্টিকে বসতে দে।”
তুরাগ উঠে গিয়ে পেছনে দাঁড়াল। সিনথিয়া টেনে দৃষ্টিকে বসিয়ে বলে,
“কখন এসেছি জানিস? খুঁজে যাচ্ছি তোকে, আফরান বলল তুই নাকি ঘুমিয়ে আছিস। তাই তোকে ডাকেনি। ঘুম থেকে ডেকে তুললে যদি মাথা ব্যথা করে? আমার তো মাথা ব্যথা করে আমি বুঝি। তারপর বল কেমন আছিস?”
দৃষ্টির মনে পড়ল সিনথিয়া আপু খুবই চঞ্চল। ঠিক অ’স’ভ্য ডাক্তার টার মতো। কিন্তু খুব ভালো মানুষ। সে মৃদু হেসে বলে,
“ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”
“আর ভালো থাকি কি করে বল? বিয়ে দিয়ে আমাকে কত্ত দূরে পাঠিয়ে দিল! বাপের বাড়ি বেড়াতেও আসতে পারি না। কয়েক বছর পর পর আসতে হয়। রিয়া তো সেই ছোট্ট বেলায় এসেছিল আর এই এলো। ঠিক ঠাক চিনতেও পারছে না সবাইকে। ভিডিও কলে কথা না হলে ভুলেই যেত। তোর দুলাভাই কিছুতেই এলো না। না আসে না আসুক, আমার কি? আমি তো বলে দিয়েছিলাম তুমি না গেলেও এবার আমি যাবই যাব। আমার ভাইয়ের রিসিভশন কিছুতেই মিস করব না।”
দম নিল সে। দৃষ্টি হেসে রিয়াকে আদর করল। রিয়ার বয়স সাত। আগের বার যখন এসেছিল তখন হয়তো চার বা পাঁচ ছিল। মেয়েটা ভীষণ কিউট, একদম ফকফকা সাদা। এরই মধ্যে রূপসী বলল,
“তুমি কি এভাবেই থাকো, দৃষ্টি? ভুতের মতো লাগছে দেখতে। এমনিতেই কালো ঘুম থেকে উঠে এসে আরও কালো লাগছে। তুমি কি মুখে কোনো ক্রিম বা ফেইস ওয়াশ ইউজ করো না? বা কোনো মেকআপ করো না? আমাকে বলতে পারো আমি শিখিয়ে দেব।”
পরিবেশ থমথমে হয়ে গেল। ইতস্তত বোধ করল সকলে। মেহমান হওয়ার খাতিরে রূপসীকে কড়া কথা বলতে পারল না কেউ। এতো লোক জনের মধ্যে যদিও সবাই বাড়ির লোক, তবুও দৃষ্টি অপমান বোধ করল। মৃদু হেসে বলল,
“ধন্যবাদ, আপু। মেকআপ করে সাদা ভুত হয়ে থাকার ইচ্ছে আমার নেই। আমি কালো ভুতই ভালো আছি।”
সে এক পলক আফরানের দিকে চেয়ে দৃষ্টি আবার ফিরিয়ে নিল। বলল,
“আপনার নাম রূপসী এবং আপনি ঠিক তেমনই সুন্দর। কিন্তু মনটা এমন কুপসীর মতো কেন?”
রূপসী রেগে গেল, যা বোঝা গেল তার ক্রুদ্ধ চাহনি দেখে। দৃষ্টি উঠে দাঁড়ালে সিনথিয়াও তার হাত ধরে উঠে দাঁড়াল। বলল,
“সবার গিফট দেওয়া শেষ। তোরটা আর ফারনাজের টা বাকি। চল আমার সাথে। ফারনাজ তুইও চল।”
ফারনাজ লাফিয়ে উঠে তার পিছু নিল। তুরাগ আঁতকে উঠে বলল,
“সাবধানে!”
সে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে ভেংচি কেটে চলে গেল। তূরাগ হতাশ শ্বাস ফেলল। এই বাচ্চা মেয়ে বাচ্চা কীভাবে সামলাবে? ভেবে পায় না সে। তাকেই তার বাচ্চা সামলাতে হবে।
চলবে,
#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৪২
(৫০+ এলার্ট 🥱)
সিনথিয়া দু দুটো শাড়ি তাদের হাতে ধরিয়ে দিল। ভীষণ সুন্দর শাড়ি দুটো। তুলতুলে কোমল কাপড়। ফারনাজেরটা কালো আর দৃষ্টিরটা গোলাপী। সিনথিয়া বলল,
“আজ দুজনে এই শাড়ি পরবি, আমি দেখব। আমার পছন্দ করে আনা জিনিসে তোদেরকে কেমন লাগে?”
দৃষ্টি একটু আমতা আমতা করল। বলল,
“আপু, না মমানে এমন শাড়ি!”
“হ্যাঁ কি হয়েছে শাড়িতে? পছন্দ হয়নি? সব থেকে ভালো ব্রান্ডের শাড়ি, ওদেশে ভীষণ ফেমাস। অন্য কিছু আনতে পারতাম কিন্তু তাতে তোরা কমফর্টেবল ফিল করবি না, তাই আনিনি।”
দৃষ্টি আর কিছু বলল না। আপু ভালোবেসে যখন দিয়েছে তখন তার আপত্তি করা বাজে দ্যাখায়। সিনথিয়া জিজ্ঞেস করে,
“আফরান কিছু আনেনি তোদের জন্য?”
দৃষ্টি এই বিষয়ে কিছুই জানে না। তাই সে জবাব দিতে পারল না। জবাব দিল ফারনাজ,
“দুই মায়ের জন্য দুটো শীতের শাল এনেছে। আর বাবাদের জন্য কোট আর ওর জন্য জুতো এনেছে। আমার জন্য কি এনেছে জানো? চার চারটা চশমা।”
বলে সে মুখ গোমড়া করে ফেলল। আফরান তাকে পরোক্ষভাবে কানা বলতে চেয়েছে। সিনথিয়া হেসে ফেলল। বিদেশ থেকে কেউ এসব আনে? বয়স বেড়েছে কিন্তু তার ভাইয়ের দুষ্টুমি যায়নি। হেসে বলল,
“অদ্ভুত একটা।”
–
ছাদে দাঁড়িয়ে দুই ভাই। দু জনের হাতে দুটো কফির কাপ। তুরাগ এক চুমুক দিয়ে বলল,
“আহা! তোর এই কফিটা ভীষণ মিস করছিলাম। তবে তোকে না।”
আফরান সামনে চেয়ে বলে,
“তোর মিস করা না করা দিয়ে আমার কোনো যায়ই আসল না। সব থেকে বড় একটা অপরাধ করেছিস তুই।”
তুরাগ আফরানের কথায় বিশেষ পাত্তা দেয় না। নিজের মতোই চুমুক দেয় কাপে। হঠাৎ আফরান দানবীয় হাতের থাবা বসায় তার পিঠে। নাকে মুখে কফি উঠে যায় তার। কাশতে কাশতে বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ধাতস্থ হলো। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বলল,
“কি হলো! এমন করলি কেন?”
সে মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,
“তো কেমন করব! তুই শুনেছিস আমার কথা?”
“তোর কোন কথা শুনিনি? তাছাড়া তোর কোন কথাটাই বা আমি শুনি?”
“আসলেই তুই আমার কোনো কথা শুনিস না। তোকে বললাম আগে চাচ্চু হবার অধিকার তোর। কিন্তু তুই শুনলি? উল্টে আমাকে চাচ্চু বানাতে চলেছিস।”
ব্যাপার বুঝে তুরাগ স্বাভাবিক ভাবে আবার কাপে চুমুক দিল। বলল,
“তুই পারিস নি এটা তোর ব্যর্থতা। আমি কি করব? তোর জন্য কি বাবা হবো না, নাকি?”
আফরান বিরক্ত হয়। বউকে এখনো হাতে পায়নি। কপালে আদৌ বাবা হওয়া আছে কিনা কে জানে?
–
রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই সিনথিয়া দৃষ্টিকে টেনে রুমে নিয়ে গেল। বলল,
“ফারনাজ শাড়িটা যখন ইচ্ছে পরুক, ওর শরীর এমনিতেই ভালো নেই। কিন্তু তুই এখন পর। আমার ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে।”
দৃষ্টির না বলতে বাঁধল। আপু এতো উৎসাহের সাথে তাকে বলছে! তার মুখের এই মিষ্টি হাসিটা তার কেড়ে নিতে ইচ্ছে করল না। সিনথিয়া নিজের হাতে তাকে শাড়ি পরাল। টুকটাক সাজিয়ে দিল। কানে ছোট ছোট দুল পরিয়ে সাজ শেষ করল। অতঃপর মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থেকে বলল,
“বাহ্! খুব সুন্দর লাগছে তোকে। তোকে কালো বলেছিল না ওই রূপসী? ইচ্ছে তো করছে ওর মুখে কালি ঘষে দিতে। কি সুন্দর লাগছে তোকে! কারো নজর যেন না লাগে।”
দৃষ্টি হাসে। আপু যা বলছে তা কি সত্যি? নাকি সে এমনি এমনিই বলছে? সে বলল,
“আমি এখন রুমে যাই?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ যা। চল আমি তোকে এগিয়ে দিয়ে আসি।”
সিনথিয়া তাকে রুম পর্যন্ত দিয়ে আবার ফিরে এলো। দৃষ্টি রুমের আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজেকে আবেদনময়ী রূপে আবিষ্কার করে। এই শাড়ির সমস্যা এটাই। ফিনফিনে পাতলা একটা শাড়ি। যা পরা আর না পরা সমান কথা তার কাছে। ভাগ্যিস রুমে আসার সময় কেউ দেখে ফ্যালেনি। রূপ যেমনই হোক সে তো কালো। হ্যাঁ কালোই, আজ সবার নীরবতায় তা প্রমাণ হয়ে গেল। আর কেউ কিছু বললেই বা কি? সে কালো এটা তো আর পাল্টে যাবে না। দৃষ্টি ভাবল শাড়িটা কি পাল্টাবে? নাকি আরেকটু পরে থাকবে? ভীষণ হালকা শাড়ি পরেও আরাম আছে। কিন্তু বাইরে বের হওয়া যাবে না।
“হ্যাঁ? পেশেন্ট সিগারেট খেতে চায়ছে? গোপাল বিড়ি? হাদা রামকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিন। ম’রবে নাকি শা’লা?”
আফরান ফোনে কথা বলতে বলতে রুমে প্রবেশ করে। মাঝে মধ্যে রাগের বশে মুখ ফসকে দু একটা কথা বেরিয়ে যায়। সে বাইরে থেকে নয়, ব্যালকনি থেকে রুমে এলো। তারমানে আফরান এতক্ষণ রুমে ছিল? দৃষ্টি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে তাকে এভাবে দেখলে কি হবে? আফরান ফোন রেখে বলল,
“ব’লদ জুটেছে সব আমার কপালে। সব বলে দেওয়া লাগে।”
দৃষ্টির দিকে চেয়ে বলতে নেয়,
“আরে দৃষ, তুই কখন..”
থেমে যায় সে। আপাদমস্তক দেখে নেয় এই আবেদনময়ী নারীর। র’ক্ত ছলকে ওঠে তার। চশমার কাঁচ ঝাঁপসা হয়ে আসে। চোখ থেকে খুলে তা হাতে নেয়। দৃষ্টি তাকে থমকে যেতে দেখে ঢোক গিলে বলে,
“আআমি গেস্ট ররুমে যাচ্ছি, ননাহলে আপনার ঘঘুমাতে অসুবিধা হবে।”
তার কথা শেষ হতেই আফরানকে লম্বা পা ফেলে দরজার দিকে এগোতে দ্যাখা যায়। দৃষ্টি ভাবে সে হয়তো বাইরে যাচ্ছে। কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে সে দরজা লক করে ফিরে এলো। দৃষ্টির এবার দম বন্ধ হবার জোগাড়। আফরান তার পেছনে এসে দাঁড়ায়। দৃষ্টির কাঁধে উষ্ণ শ্বাস অনুভব করে শিউরে ওঠে। অজানা আতঙ্কে বুক কেঁপে ওঠে। দুহাতে শাড়ি খামচে ধরে সরে যেতে নিলেই বাধা পড়ে। আফরান বলিষ্ঠ হাতে পেঁচিয়ে ধরে পেছন থেকে উদর। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,
“আর কত অভিমান করে থাকবি? এবার তো গলে যা। একটা বছর আমার সাথে কথা বলিসনি। চেহারাও দ্যাখাসনি নিজের। আমার কষ্ট হয় না? আমি ছটফট করি নি? মা’র কা’ট যা খুশি কর কিন্তু অভিমান করে আর থাকিস না।”
সে কিছু বলতে পারে না। আপ্রাণ চেষ্টা চালায় কাঁপুনি থামানোর। আফরান মৃদু হাসে। দুষ্টু হেসে বলে,
“শাড়ি পরে নিশ্চয় আমাকে পটাতে এসেছিস? তুই ভেবেছিস এভাবে শাড়ি পরে সামনে আসবি আর আমি পটে যাব?”
অতঃপর কাঁধে মুখ ঘষে বলে,
“পটে তো পাঁচ বছর আগেই গিয়েছি। ওই ছোট্ট দৃষকে দেখেই।”
দৃষ্টির বুকের মাঝে তুফান হয়। কোনো মতে কণ্ঠে আওয়াজ এনে বলে,
“ছছাড়ুন।”
পরপরই জবাব আসে,
“উঁহু।”
পরপর তার শুষ্ক অধরদ্বয় ছুঁয়ে যায় দৃষ্টির কাঁধ। ভূমিকম্পের ন্যায় কেঁপে ওঠে সে। তার মনে হলো আজ তার সকল শক্তি শেষ হয়ে গিয়েছে। নড়তেও পারছে না যেন। আর আফরানের হাতের বাঁধন? তা নরম হবার নামই নেই। আফরান আরও গভীরে যাবার আগেই হুট করে দরজা নক হয়। চমকে ওঠে তারা। দৃষ্টি ছিটকে সরে যায়। লম্বা শ্বাস নেয়। দরজার ওপাশের ব্যক্তি থেমে নেই, দুরুম দুরুম করে দরজা ধাক্কাতেই আছে। ভেঙে ফেলবে যেন এক্ষুনি দরজা না খুললে। দৃষ্টি এগিয়ে দরজা খুলে দেয়। রূপসীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কি প্রতিক্রিয়া করবে তা ভুলে যায়। রূপসী তার আপাদমস্তক দেখে বলে,
“ভালো লাগছে তোমাকে। আফরান কোথায়?”
আফরান পেছন থেকে বলে,
“এখানে আমি। তুমি কি কোনো দরকারে এসেছ?”
“না মানে, আমার ঘুম আসছিল না। তাই ভাবছিলাম তোমাদের সাথে গল্প করি।”
দৃষ্টির চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই যে, সে ঠিক কি পরিমান রাগে ফুঁসছে ভেতরে ভেতরে। সে হেসে বলল,
“অবশ্যই, আসুন ভেতরে।”
রূপসী প্রবেশ করে। দৃষ্টি আড় চোখে একবার স্বামী নামক ভাইকে দেখে নেয়। তার এখন কেঁদে দেওয়ার মতো অবস্থা। সে সম্পূর্ণ তাকে অবজ্ঞা করে ওয়ারড্রব থেকে কাপড় হাতে নেয়। রুম ছেড়ে বেরিয়ে যেতে নিয়েই রূপসী জিজ্ঞেস করে,
“কোথায় যাচ্ছ তুমি? গল্প করবে না?”
সে মুচকি হেসে বলে,
“আমার খুব ঘুম পাচ্ছে, আপু। আমি ঘুমাতে যাচ্ছি। আপনারা গল্প করুন। দরকার পড়লে সারারাত ধরে গল্প করুন, কেউ বিরক্ত করবে না।”
সে গটগটিয়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল। আফরান কেবল অসহায় চোখে চেয়ে রইল।
বাড়িতে কয়েকটা গেস্ট রুম রয়েছে। একটাতে রূপসীর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দৃষ্টি অন্য একটাতে এসে চেঞ্জ করে নিল। আলো নিভিয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল। পরক্ষনেই বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। রূপসীকে একটা ধন্যবাদ দেওয়া উচিত ছিল। আজ সে না এলে বোধহয় আফরানকে বাঁধা দিতে পারত না। আফরান ঠিকই বুঝে নিত নিজের অধিকার। সত্যিই তো সে কষ্ট কম পায়নি। দৃষ্টি নিজে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে তাকে কষ্ট দিয়েছে। নিজেও তো রাতের পর রাত কেঁদে ভাসিয়েছে। সে ভীষণ দ্বিধায় পড়ে, কি করা উচিত তার?
চলবে,
#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৪৩
আমিনুল ইততেয়াজ আজ বসার ঘরে আসননি। দৃষ্টি তার জন্য চা নিয়ে রুমের দিকে অগ্রসর হলো। দরজার কাছাকাছি আসতেই তার পা জোড়া থেমে গেল।
“আফরানকে আমি সত্যিই কি পাব, আঙ্কেল?”
“কেন পাবে না? দেখছ না, আফরান তোমার কত খেয়াল রাখছে? তোমরা কোনো অবহেলা করছে কি?”
“কিন্তু সে তো দৃষ্টিকে ভালোবাসে। তাকে কি ডিভোর্স দিতে রাজি হবে?”
“হবে হবে, সব হবে। তুমি একটু ধৈর্য করে থাকো মামনি। আমি আছি তো।”
দৃষ্টির পায়ের নীচের জমিন কেঁপে ওঠে। শূন্য দৃষ্টিতে সে কেবল চেয়ে রয়। আঙ্কেল তাকে এতোটাই অপছন্দ করেন যে, তাকে তাড়ানোর পরিকল্পনা করছেন! এতো দিনে কি সে তার মনে একটুও জায়গা বানাতে পারেনি? এতোটাই ব্যর্থ সে!
রূপসী বেরিয়ে যাবার পর দৃষ্টি আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। পা দুটো টেনে প্রবেশ করে। আমিনুল ইততেয়াজ হাতে ফাইল নিয়ে কোনো প্রজেক্ট এর ডিটেইলস্ দেখছিলেন। দৃষ্টি মিহি স্বরে বলে,
“আঙ্কেল, আপনার চা।”
আমিনুল ইততেয়াজ চোখ উঠিয়ে তাকান। পুনরায় কাজে মনোনিবেশ করে বলেন,
“রেখে যাও।”
দৃষ্টি তার সামনের ছোট্ট টেবিলে কাপ রাখে। দাঁড়িয়ে থাকে ঠাঁয়। তিনি তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“কিছু বলবে?”
সে সূক্ষ্ম শ্বাস ফ্যালে। ঢোক গিলে বলে,
“আপনি আমাকে এতোটা অপছন্দ করেন কেন, বাবা?”
দৃষ্টি আজ এই প্রথম তাঁকে বাবা বলল। আমিনুল ইততেয়াজ থমকালেন, পুরোনো মুখে নতুন সম্বোধন শুনে তার ভেতরটা কেমন করে উঠল যেন। সে আবার বলে,
“আমি কি এতোটাই নি’কৃষ্ট মানুষ যে আপনি আমাকে একটুও পছন্দ করেন না, বাবা! এতো দিন আপনার চোখের সামনে থাকলাম, নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করলাম আপনাদের সবার মনের মতো হবার। তবুও, আমি ব্যর্থ। আমার উপর কি একটুও দয়া হয় না আপনার?”
বলতে বলতে তার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কণ্ঠ জড়িয়ে আসছে তার। আমিনুল ইততেয়াজ নিশ্চুপ। দৃষ্টি ঢোক গিলে বলে,
“অপছন্দ করার মাত্রা এতোটা ছাড়িয়েছে যে আপনি আমার সংসার ভাঙার জন্য একটা মেয়েকে নিয়ে এলেন! কেন বাবা? আমি কালো বলে? আমার বাবা কোটিপতি নয় বলে?”
এবার সে চোখে হাত চেপে কেঁদেই ফেলল। এমনটা কেন হয় শুধু তার সাথে? জড়ানো কণ্ঠেই বলল,
“তবে আপনার ছেলে কেন ভালোবাসলো আমাকে? কেন আমাকে সে ভালোবাসতে বাধ্য করল?”
আমিনুল ইততেয়াজ স্তব্ধ হয়ে চেয়ে আছেন। সত্যি কথাগুলো মেয়েটার মুখ থেকে শুনতে ভীষণ খারাপ লাগছে।
“এতো চেষ্টা করেও যখন আমি ব্যর্থ, তখন আমি চলে যাব। আর আমার মুখ দ্যাখাব না আপনাদের। আপনি নিজের পছন্দ মতো মেয়ের সাথে আপনার ছেলের বিয়ে দেবেন। আর ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দেবেন, আমি সই করে দেব। আমার কোনো দাবি নেই আপনাদের কাছে।”
সে ওড়নার আঁচল টেনে চোখ, মুখ মুছে চায়ের কাপ উঠিয়ে নেয়। বলে,
“চা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে। আমি আবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
নিস্তেজ হয়ে সে বেরিয়ে গেল। আমিনুল ইততেয়াজ থম মে’রে বসে রইলেন। পথের কাঁটা নিজে নিজেই সরে যাচ্ছে! তার তো আনন্দ করা উচিত, তবে এমন খারাপ লাগছে কেন?
—
দৃষ্টি কাজের মেয়েটাকে দিয়ে আমিনুল ইততেয়াজের চা পাঠিয়ে দিল। রুমে গিয়ে দেখল আফরান ঘুমিয়ে আছে। ঘড়িতে সকাল আটটা বাজে। এখনও ওঠেনি কেন? সত্যিই সারারাত জেগে গল্প করেছে দু’জনে? সে তাচ্ছিল্য হাসে। সে তো চলেই যাচ্ছে, এখন আর তাদের পথে কোনো বাঁধা থাকবে না। নিজেদের ইচ্ছেমতো চলতে পারবে। সে ফোন নিয়ে ব্যালকনিতে যায়। বাবার নম্বর বের করে ফোন দেয়। কিছুক্ষণ বাদেই কল রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো,
“কেমন আছ, মা?”
দৃষ্টি ঠোঁট চেপে কেঁদে ফ্যালে, নিঃশব্দে। বলে,
“ভালো আছি, বাবা। তোমাদের সবার কথা খুব মনে পড়ছে। তোমরা কেমন আছ?”
“ভালো আছি তো। তোমার মা একটু আগেই তোমার কথা বলে গেল। আমি কল দিতেই যাচ্ছিলাম, তার আগেই তুমি কল দিলে।”
দৃষ্টি হু হু করে কেঁদে ওঠে। ফাহাদ আবরার চমকে উঠলেন। যেদিন এই বাড়ি ছেড়েছিল সেদিন ছাড়া মেয়েকে তিনি আর কাঁদতে দ্যাখেননি। তবে আজ কেন কাঁদছে? তিনি ব্যস্ত কণ্ঠে বললেন,
“কাঁদছ কেন? কি হয়েছে? বলো আমাকে।”
সে কাঁদতে কাঁদতেই বলে,
“আমি তোমার কাছে যাব, বাবা। আমি মায়ের কাছে যাব। আমাকে নিয়ে যাও। এক্ষুনি এসে আমাকে নিয়ে যাও। আর এক মুহূর্তও আমি এখানে থাকতে পারব না। আমার.. আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। প্লিজ তুমি আমাকে নিয়ে যাও।”
ফাহাদ আবরার শান্ত কণ্ঠে বললেন,
“আমি আসছি।”
কল বিচ্ছিন্ন করলেন তিনি। দৃষ্টি দেওয়াল ঘেঁষে বসে পড়ে। হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদে বেশ কিছুক্ষণ। আফরানের ঘুম এতোই গাঢ় যে, সে টের পায় না কিছুই। দৃষ্টি চোখ মুখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। রুমে এসে লাগেজ বের করে। যা সাথে করে এনেছিল সেগুলোই ভরতে শুরু করে। এখান থেকে যা পেয়েছে তার কিছুই নেবে না। এ বাড়ির লোকের দেওয়া জিনিস এ বাড়িতেই থাক। আফরানের দিকে তাকায় ফের। চুপচাপ বিছানার এক কোণে বসে পড়ে। নিষ্পলক চেয়ে থাকে স্বামীর মুখশ্রীতে। সে নড়েচড়ে উঠতেই দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।
আফরান পিটপিট করে চোখ মেলে সময় দ্যাখে। তড়িৎ গতিতে লাফিয়ে ওঠে। দৃষ্টির পানে চেয়ে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলে,
“ডাকিসনি কেন আমাকে? কত দেরি হয়ে গেল।”
সে জবাব দেয় না। আফরান দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আসে। ওয়ারড্রবের দিকে এগোতে গিয়ে বেখেয়ালে দৃষ্টির লাগেজের সাথে পা আটকে পড়তে নেয়। কোনো মতে নিজেকে সামলে সে নিচে তাকায়। কৌতূহল মিশ্রিত কণ্ঠে বলে,
“লাগেজ এখানে ফেলে রেখেছিস কেন? আরেকটু হলে তো পড়েই যেতাম। লটকে পড়ে থাকলে তখন আসতিস সেবা করতে?”
টেনে সরাতে গিয়ে অনুভব করে অতিরিক্ত ওজন। সে ভ্রু কুঁচকে ফ্যালে,
“কি ব্যাপার, দৃষ? লাগেজে কি আছে?”
“যা থাকার কথা তাই।”
তার নির্লিপ্ত জবাব। আফরান লাগেজ খুলে চমকে ওঠে। সে চোখে পলকে দৃষ্টির সামনে গিয়ে দুহাতে তার বাহু চেপে ধরে। ব্যাকুল হয়ে বলে,
“লাগেজে তোর জামা কাপড় কেন? কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
“যেখানে যাওয়ার কথা সেখানে।”
“কি হয়েছে তোর? এভাবে কথা বলছিস কেন? কেউ কিছু বলেছে তোকে? বাবা কিছু বলেছে? রূপসী?”
সে জোর পূর্বক হাত ছাড়িয়ে নেয়। রুষ্ট কণ্ঠে বলে,
“এভাবে যখন তখন ছোঁবেন না আমাকে।”
গটগটিয়ে সে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যায়। আফরান বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। হঠাৎ কি হলো ওর?
ডাইনিং টেবিলে সবাই একে একে বসে পড়ছে। নাস্তা করে যে যার কাজে বেরিয়ে পড়বে। দৃষ্টি চুপচাপ সোফায় বসে। অন্য দিনের মতো হাত লাগায় না নাস্তা পরিবেশনের কাজে। মিসেস সাইমা এবং মিসেস অনা কিঞ্চিত অবাক হলেন। তাদের ওঠার আগেই যে মেয়ের অর্ধেক কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়, সে মেয়ে আজ শান্ত।
আমিনুল ইততেয়াজের গলা দিয়ে যেন খাবার নামতে চায়ছে না। কেমন যেন অস্বস্তি ঘিরে ধরেছে তাকে। এই বাড়িতে আসার পর থেকে কখনো মেয়েটাকে ওভাবে কাঁদতে দ্যাখেননি। তিনি মাঝে মাঝে শক্ত দু এক কথা বললেও শান্ত থাকত। যেন তার উপর কোনো প্রভাবই পড়ত না। তবে আজ! মেয়েটা বোধহয় বড্ড কষ্ট পেয়েছে। তাছাড়া সংসার ভাঙার আভাস পেয়ে যেকোনো মেয়েই এমন আচরণ করবে।
ফারনাজকে নিজের পাশে বসিয়ে নিজ দায়িত্বে গেলাচ্ছে তুরাগ। মেয়েটা খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে এক প্রকার। জোর না করলে তার গলা দিয়ে কিছুই নামে না। ফারনাজ মুখ কুঁচকে ধীরে ধীরে গিলছে। প্রচন্ড ক্ষুধা লাগলেও খেতে পারে না। সে পানি খেয়ে ডাকে,
“দৃষ, আজ কলেজ যাবি না? সাড়ে আটটা বেজে গিয়েছে। খেয়ে নে।”
দৃষ্টি নড়ে না। দৃষ্টি নত করে বসে রয়। আফরান হতদন্ত হয়ে নিচে নেমে আসে। গায়ে তার বাড়ির পোশাক। হাসপাতালে যাওয়ার কোনো তাড়াহুড়ো নেই তার মধ্যে। মিসেস সাইমা বলেন,
“নাস্তা করে নে। হাসপাতালে যাবি না? ন’টা বাজতে চলল।”
আফরানের সেদিকে খেয়াল নেই। উতলা হয়ে আছে সে। লম্বা পা ফেলে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“দৃষের কি কিছু হয়েছে, মা?”
তার কপালে ভাঁজ পড়ে। সত্যিই তো! মেয়েটার কি কিছু হয়েছে? নাহলে এমন শান্ত হয়ে তো কোনো দিন থাকে না। তিনি মাথা নেড়ে বোঝালেন যে, তিনি কিছু্ই জানেন না। আমিনুল ইততেয়াজের হাত থেমে যায়। মেয়েটা কি বলে দিয়েছে তার পরিকল্পনার ব্যাপারে?
রূপসী ঘুম থেকে উঠেই ডাইনিং টেবিলে বসেছে। গদগদ কণ্ঠে আফরানকে ডাকে,
“আফরান, এসো একসাথে ব্রেকফাস্ট করি।”
আফরানের এখন আদিখ্যেতা করার মুড নেই। চিন্তায় মাথা খারাপ হবার অবস্থা। কোনো জবাব দিল না সে। চুপচাপ অপেক্ষা করল, দৃষ্টির এমন আচরণের কারণ আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে। এভাবে অতিক্রম হলো প্রায় এক ঘন্টা। তিয়াস ইততেয়াজ এবং তুরাগ অফিসে চলে গেলেও কোনো এক কারণে থেকে গেলেন আমিনুল ইততেয়াজ। আফরানও গেল না হাসপাতালে। রূপসী সাধাসাধি করেও তাকে খাওয়াতে পারল না। আর মিসেস সাইমা এবং মিসেস অনা খাওয়াতে পারলেন না দৃষ্টিকে।
হঠাৎ কলিং বেল বেজে ওঠায় দৃষ্টি দাঁড়িয়ে পড়ে। এগিয়ে গিয়ে খুলে দেয় দরজা। সকলে দরজার দিকে চেয়ে। কৌতূহল, এখন কে এলো? ফাহাদ আবরার কে চমকালেন সবাই। তিনি ফারনাজের বিয়ের পর আবার আজ এ বাড়িতে পা রাখলেন।
চলবে,