#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ০২
ভার্সিটির ক্যাম্পাসে গালে হাত দিয়ে থমথমে মুখে বসে আছে ফারনাজ। তার মাথার ওপর দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে তুলোর মতো মেঘগুলো। নীল আকাশে সাদা মেঘ বড়ই দৃষ্টিনন্দন। তার পাশে বসে রয়েছে তার সব থেকে প্রিয় বন্ধু গুলো। সুমি ও আফিয়া। এই তিন জন স্কুল জীবন থেকেই ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। গলায় গলায় ভাব। তবে এর মধ্যে সুমি বিবাহিত। ফারনাজ ও আফিয়া এখনও কুমারী। হয়তো পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে তাদের বিয়ের ফুল ফুটলেও ফুটতে পারে। এর মধ্যে একটি বিষয় হলো ফারনাজ কোনো ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে না। সে সবাইকে বয়ফ্রেন্ডের দৃষ্টিতে দ্যাখে। ভাই এর চোখে দ্যাখার প্রশ্নই আসে না। ভাই তো জুনিয়র গুলো।
ফারনাজ কে মনম’রা হয়ে বসে থাকতে দেখে সুমি জিজ্ঞেস করে,
“কি ব্যাপার নাজ? সামান্য একটা ব্রেক আপ নিয়ে এতো চিন্তিত কেন তুই?”
ফারনাজ আকাশের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হতাশ শ্বাস ফেলে বলে,
“ব্রেক আপ এর জন্য না রে ফুলি।”
সুমি বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকায়। তার বাহুতে জোরে সোরে আঘা’ত করে বলে,
“আমি সুমি, নাজ!”
ফারনাজ মুখ কুঁচকে আঘা’তকৃত স্থানে হাত ঘষে বলে,
“ওই একই হলো।”
“এবার বল কাহিনী কি?”
“আই ব্যাডলি নিড অ্যা বয়ফ্রেন্ড, টুসি।”
সুমি দাঁতে দাঁত চাপে। শুধরে দিয়ে বলে,
“সুমি!”
“আরে রাখ তোর নাম। আমি আছি আমার জ্বালা’য়। ওই ডালিয়া তুই তো কিছু বল? এখন বয়ফ্রেন্ড কই পাব?”
এবার আফিয়া মুখ কুঁচকে তাকায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“বয়ফ্রেন্ড তো আর বাচ্চার হাতের মোয়া নয় নাজ। যে তুই চায়বি আর আমরা কেড়ে এনে দেব।”
ফারনাজ ঠোঁট উল্টে মুখ কাঁদো কাঁদো করে। যেন সে কোনো খেলনা চায়ছে এবং সেটা তার এই মুহূর্তে চায়। প্রসঙ্গ পাল্টে সুমি বলল,
“কাল আমার ফেভরেট রকস্টারের কনসার্ট আছে। কে কে যাবি বল?”
আফিয়া গদগদ হয়ে তৎক্ষণাৎ সায় দেয়। কারণ সে তারও পছন্দের। বলে,
“ওহ মাই গড! সত্যি বলছিস? সে দেশে ফিরেছে!”
“হ্যাঁ এবং সে এবার থেকে দেশেই গান গায়বে। বিদেশে আর যাবে না।”
উল্লাসে ফেটে পড়ে আফিয়া মৃদু চিৎকার করে। তবে ফারনাজ ভাবলেশহীন। সে এসব কনসার্ট ফনসার্ট খুব কমই দ্যাখে। টিভিতে মাঝে মধ্যে চোখে পড়লেও সামনাসামনি দ্যাখা হয়নি কখনও। আফিয়া তাকে ধাক্কা দিয়ে বলে,
“কি রে! তুই যাবি না? ভেবে দ্যাখ নাজ, ওখানে অনেক ছেলে থাকবে। তুই নিজের মতো একটা বেছে নিতে পারবি।”
ফারনাজের চোখ চকচকে হয়। সে অনবরত মাথা দুলিয়ে বলে,
“অবশ্যই যাব। আর তোরা দেখে নিস আমার সাত নম্বর বয়ফ্রেন্ড আমি ওখান থেকেই ঠিক করব।”
দুই বান্ধবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ক্ষণে ক্ষণে বয়ফ্রেন্ড পাল্টানো ফারনাজের একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। গোল চশমা চোখে ফারনাজকে খুব সুন্দর লাগে। সেই সাথে হলুদ ফর্সা গায়ের রং। কোমর ছুঁই ছুঁই চুল গুলো দেখলে কোনো ছেলে এক কথায় হুমড়ি খেয়ে পড়বে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তারা মনে মনে প্রার্থনা করে খুব শীঘ্রই এমন কেউ আসুক যেন ফারনাজের সাতেই সমাপ্ত হয়।
—
“আই ওয়ার্ন ইউ, দৃষ! আমার কাছে আসবি না। আজ আমি সুইসাইড করেই ছাড়ব। নো ওয়ান ক্যান স্টপ মি।”
দৃষ্টি ক্যাটিনের টেবিলে বসে চোখের সামনে বই ধরে রেখেছে। পায়েল দৃষ্টির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পেরে পুনরায় বলল,
“আ’ম সিরিয়াস দৃষ। এক্ষুনি আমি হাত কে’টে ফেলব।”
দৃষ্টি বই রেখে তার দিকে তাকাল। পায়েল সত্যি সত্যিই হাতে ছুরি চালাতে নিলে ছুরির আগা ধরে টান দিল সে। ফলে হাতের তালু কে’টে গেল। ঝরঝরিয়ে র’ক্ত পড়তে লাগল। আঁতকে উঠল পায়েল। তার হাত ধরতে নিলে সরিয়ে নিল সে। শান্ত কন্ঠে বলল,
“আ’ম ফাইন।”
পায়েল মানল না। চোখ ছলছল করে উঠল। ভো দৌড় দিয়ে ক্যানটিন থেকে বের হয়ে গেল। দৃষ্টি সেদিকে তাকিয়ে টিস্যু দিয়ে ক্ষ’ত স্থান চেপে ধরল। কিছুক্ষণ পরেই পায়েল এলো, তার সাথে এসেছে ডাক্তার এবং নার্স। বিরক্ত হলো দৃষ্টি। এই মেয়ে নিশ্চয় হাসপাতাল মাথায় তুলে এদের এনেছে। নার্স এগিয়ে এসে ফার্স্ট এইড বক্স দৃষ্টির সামনে রাখল। দৃষ্টি জানে এখানে উপস্থিত কেউই তার হাত স্পর্শ প্রর্যন্ত করবে না, ড্রেসিং করা তো দূরে থাক। দৃষ্টিকে বেশিক্ষণ অপেক্ষাও করতে হলো না। হম্বিতম্বি করে প্রবেশ করল এক পুরুষ। দৃষ্টির সামনে ধপ করে বসে শীতল দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে নিল তাকে। পায়েল ভেজা কন্ঠে বলল,
“ড. আফরান ও’র খুব কষ্ট হচ্ছে। আপনি প্লিজ দ্রুত ড্রেসিং করে দিন।”
আফরান চেয়ারে শরীর এলিয়ে বসল। ইশারায় ভীড় কমাতে বলল। শুধু থেকে গেল পায়েল এবং এক জন নার্স। আফরান নার্সটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“মিস শীলা! ইউ আর লুকিং সো বিউটিফুল টুডে।”
শীলা লাজুক হেসে বলে,
“থ্যাঙ্ক ইউ, ডক্টর।”
দৃষ্টি দাঁতে দাঁত চেপে উঠে যেতে নিলেই আফরান তার ক্ষ’ত হাত চেপে ধরে। শীলার দিকে তাকিয়েই বলে,
“বিউটিফুল লেডি! তুমি কি আমাকে তুলোতে করে একটু ডেটল দিতে পারো?”
“অফ কোর্স, ডক্টর।”
সে তুলো এগিয়ে দিল। আফরান সেটা দিয়ে দৃষ্টির ক্ষ’ত ধীরে ধীরে পরিষ্কার করতে লাগল। দৃষ্টি জ্বা’লায় চোখ খিচে নিলে সে ধীরে ধীরে ফুও দিল। অবশেষে গজ পেঁচিয়ে দিতে দিতে বলল,
“আপনার সতর্ক থাকা উচিত, মিস দৃষ্টি।”
দৃষ্টি কিছু বলে না। মুখ ঘুরিয়ে রাখল। আফরান দৃষ্টির শ্যামলা ফর্সা মুখশ্রীতে চোখ বুলিয়ে নিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বলল,
“আমাকে আর কত দৌড় করাবে মেয়ে? আমার হাড় মাংস আলাদা করে তবেই কি দম নেবে?”
দৃষ্টির কানে পৌঁছালেও সে নীরব থাকে। আফরান পুনরায় এক পলক দেখে চলে গেল। তার প্রস্থানের পর পায়েল আলতো করে দৃষ্টির হাত ধরে বলল,
“আমাকে মাফ করে দে জান। আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি তুই এভাবে..”
দৃষ্টি হাত উঁচিয়ে তাকে থামায়। মৃদু স্বরে বলে,
“নিজেকে দোষারোপ করিস না। চল ক্লাসে যাই।”
সে উঠে দাঁড়ায়। পায়েল তার পিছু পিছু যেতে যেতে বলে,
“ড. আফরান খুব দয়ালু মানুষ তাই না? আমি একবার বলাতেই সকল ব্যস্ততা ফেলে ছুটে এলো। এমন মানুষ আর দুটো হয়?”
দৃষ্টি জবাব দেয় না। তাকে নির্বাক দেখে পায়েল আর কিছু বলে না। তবে ক্লাসে প্রবেশ করার আগে দৃষ্টি বলে,
“রোজ রোজ এমন পাগলামী করবি না পায়েল। প্রতিবাদ করতে শেখ। তুই একবার রুখে দাঁড়ালে নিশ্চয়ই তোর সাথে কেউ আর অন্যায় করার সুযোগ পাবে না। আমি জানি তুই আমার সাথে মজা করে হাতে ছু’রি ধরেছিলি। কিন্তু বাড়িতে থাকলে তুই এই কাজ করতে দুবার ভাববি না। তাই তোকে আরও শক্ত হতে হবে। আমি কি বোঝাতে পেরেছি?”
পায়েল মুখ গোমড়া করে ফেলল। পর পর ফেলল দীর্ঘশ্বাস। সে বুঝেছে এবং বোঝে। তবে সাহসে কুলোয় না। লড়তে লড়তেই তো এতদূর এসেছে। আর কত?
—
সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল ভবনটি। বাইরে থেকে দেখলে নজর থমকাতে বাধ্য, না জানি ভেতরে কত সুন্দর হবে! এই ভবনটি আজ যেন নতুন বধুর ন্যায় সেজেছে। সাজবে না’ই বা কেন? সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে তাদের ছোট পুত্রটি দেশে ফিরছে যে! দেশ বিদেশে নাম কামিয়ে সে অবশেষে নিজ দেশে ফিরছে। এই তো ভবনে পা রাখল বলে। বাড়ির মধ্যে হইচই লেগে আছে, কোনো কিছু ভুল হলো না তো? মিসেস অনা ব্যস্ত হাতে ছেলের পছন্দের সব খাবার টেবিলে গুছিয়ে রাখছেন। তিনি ফের একবার দেখে নিলেন কোনো কিছু বাদ পড়ল কিনা। সকল খাবারের মধ্যে একটা খাবার অনুপস্থিত। তিনি গলা উঁচিয়ে হাক ছাড়লেন,
“আপা! চিনি ছাড়া পায়েসটা কই গো? শিগগিরই নিয়ে এসো। ছেলেটা আমার এলো বলে!”
রান্নাঘর থেকে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলেন মিসেস সাইমা। পায়েসের পাত্রটি টেবিলে রেখে বললেন,
“আর কিছু বাদ নেই তো, অনা?”
“না আপা। সব ঠিক আছে।”
স্বস্তির শ্বাস ফেললেন তিনি। ছোট ছেলের আগমনে তারা আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি রাখতে চাননা। ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখে নিলেন একবার। রাত আটটা বাজে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো আগমন ঘটবে তাদের কাঙ্ক্ষিত মানুষটির। তাদের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে বাইরে থেকে গাড়ির আওয়াজ ভেসে এলো। চকচক করে উঠল উভয়ের চোখ।
চলবে,
#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ০৩
“তুই কেমন আছিস বাবা? আমাদেরকে ভুলে গিয়েছিস? একবারও কি মনে পড়ত না আমাদের কথা? এতো পাষা’ণ তুই!”
ছেলের বুকে পড়ে নাক টেনে আহাজারি করে চলেছেন মিসেস অনা। মিসেস সাইমা পাশে দাঁড়িয়ে ক্ষণে ক্ষণে আঁচলে চোখ মুছে নিচ্ছেন। তবে মানুষটি হাত বাড়িয়ে দিল তার দিকেও। তিনি হাসি মুখে তাকে আলিঙ্গন করলেন। নিজেদের স্ত্রীদের এহেন কারবার দেখে বিরক্ত হচ্ছেন তিয়াস ইততেয়াজ ও আমিনুল ইততেয়াজ। তিয়াস ইততেয়াজ ধমকে উঠে বললেন,
“কি হচ্ছে কি অনা? ছেলেটা কতদূর থেকে এতোটা পথ পাড়ি দিয়ে এলো। আর তোমরা দরজায় দাঁড়িয়েই শুরু হয়ে গেলে? ছেলেকে একটু বিশ্রাম নিতে দেবে তো নাকি?”
মিসেস অনা নাক টেনে ছেলে থেকে সরে আসেন। অভিযোগের সুরে বলেন,
“দেখলি? তোর বাবা আমাকে শান্তিতে দুটো কথা বলতেও দেয় না। সব সময় ব্যাগড়া দিতেই হবে তাকে।”
ছেলে হাসে। মৃদু হাসি। যেন সে সব কিছু মেপে মেপে চলে। মিসেস সাইমা বললেন,
“হ্যাঁ রে অনা! ও’কে আগে একটু বিশ্রাম নিতে দে। তারপর যত কথা আছে সব বলিস। কেউ তখন আর বাধা দেবে না।”
মিসেস অনা মেনে নিলেন। ছেলের মুখে হাত বুলিয়ে বললেন,
“যা বাবা ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম করে নে। তারপর তোকে খেতে ডাকব। তোর পছন্দের সব কিছু রান্না করেছি আমরা।”
ছেলে তার মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিয়ে এগোয়। তবে আবার থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“ভাই কোথায়? আমাকে নিতে গেল না কেন এয়ারপোর্টে?”
শুকনো মুখে আমিনুল ইততেয়াজ জবাব দেন,
“তার ইমার্জেন্সি পড়ে গিয়েছিল। তাই যেতে পারেনি। এখনও বাড়িতেও ফেরেনি।”
ছেলে তাদের আর কিছু বলল না। জুতোর খট খট আওয়াজ তুলে প্রস্থান করল। পেছন থেকে সকলে একে অপরের মুখের দিকে চাওয়া চাওয়ি করলেন। আজ হয়তো বড়ো ছেলের কপালে স্বল্প বিস্তর দুঃখ রয়েছে।
–
বাড়ি পৌঁছে হাত ঘড়িতে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিল আফরান। ঘড়ির কাঁটা বারোটায় ঠেকেছে। শান্তি নেই একদমই শান্তি নেই। একে তো দৃষ্টি নামক পাজি মেয়েটা মুখ কালো করে রেখে তার মাথা খারাপ করে, তার ওপর হাসপাতালের যত ঝামেলা। মনে হয় সে ছাড়া আর কোনো ডাক্তারই নেই যেন। ডুবলিকেট চাবি দিয়ে সে লক খুলে বাড়িতে প্রবেশ করে। সবাই নিশ্চয় ঘুমিয়ে? রাতও তো কম হয়নি। সে ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল। শরীরটাও যেন আর চলতে চায়ছে না। রুমে প্রবেশ করে লাইট অন না করেই জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশ রুমে প্রবেশ করল। শাওয়ার না নিলেই নয়। দীর্ঘক্ষণ গা ভিজিয়ে সে বের হলো। ভাবল লাইট জ্বালিয়ে আর কি কাজ? এখন তার একটা দীর্ঘ ঘুম প্রয়োজন। সে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। হাত পা ছড়িয়ে দিতেই কারো গায়ে লাগল। তার রুমে এই সময়ে কে থাকতে পারে? ভেবেই “ওমা গো” বলে লাফিয়ে উঠল। হাত বাড়িয়ে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে দিল। পাশ ফিরে তাকিয়ে হাত পা ছড়ানো অবস্থায় অতি আপনজন কে আবিষ্কার করল। চাপা চিৎকার দিয়ে বলল,
“তূরাগ!”
হা করে চেয়ে রইল। এতো কাজের মধ্যে তার মনেই ছিল না যে আজ তার ভাইটির দেশে পা রাখার কথা। সে ঝাঁপিয়ে পড়ল ভাইয়ের উপর। আহ্লাদে আটখানা হয়ে বলল,
“তূরাগ কেমন আছিস তুই? ওহ মাই গড! আমি ভাবতেও পারিনি বাড়ি এসে তোকে দেখতে পাব।”
তূরাগ মুখ কুঁচকে তাকে ছাড়াল। থমথমে কন্ঠে বলল,
“থাক! আর ন্যাকামো করতে হবে না।”
“কেন রে জানটুস? রাগ করেছিস আমার উপর?”
“না, আমি কারোর উপর রাগ করিনি। সর তুই।”
আফরান ফটাফট তার গালে একটা চুমু দিয়ে বলল,
“রাগ করে থাকিস না ভাই। বিশ্বাস কর! হাসপাতালে এত চাপ ছিল যে আমি তোর আসার কথাই ভুলে গিয়েছি।”
নাক সিঁটকায় তূরাগ। দ্রুত হাতে গাল ঘষে বলে,
“ছিঃ! নিজের বউকে গিয়ে চুমু দে। আমার কাছ থেকে সর। বাসায় কেন এসেছিস? হাসপাতালে রোগীদের সাথেই থাকতি। সাথে সুন্দর সুন্দর নার্স।”
“এমন বলিস না ভাই। তুই খুব ভালো করেই জানিস, তোর ভাই সেই কবেই এক বাচ্চাকে মন, প্রাণ, কলিজা, ফুসফুস, কিডনি, চক্ষু, নাসিকা সব দিয়ে বসে আছে। আমি এতটাও ফোর টুয়েন্টি নই যে সারা মেয়ের সাথে লাইন মে’রে বেড়াব।”
তূরাগ সশব্দে হাসে। ভাইয়ের পেটে গুঁতো দিয়ে বলে,
“নাইস জোক। তুই ফোর টুয়েন্টি নস এটাও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে! তাহলে কলেজের কোনো মেয়ে যে তোর ফ্লার্টের হাত থেকে রক্ষা পায়নি, সে কথা কে বলবে?”
“ভাই বিশ্বাস কর! যেদিন থেকে ওই পিচ্চির মায়ায় আমি পিছলে গেছি, সেদিন থেকে সব বাদ। আমি কোনো মেয়ের দিকে ফিরেও তাকায় না। তুই ভাবতে পারছিস? আমার এই ত্রিশ বছর বয়সে কি ঝড় টাই না তুলেছে ওই মেয়ে! যে আমি অন্য মেয়েদের দিকে তাকানোর সময় পাই না, আমার ইচ্ছেও করে না। জানিস কত সুন্দর সুন্দর নার্স চারপাশে ঘোরে? তোকে একটা সুন্দর নার্স এনে দেব। তোর ভালো সেবা যত্ন করতে পারবে।”
তূরাগ তাকে দুহাতে ঠেলে সরাল। নাকোচ করে বলল,
“দরকার নেই। আমি এমনই ঠিক আছি। সুন্দর নার্স লাগবে না। দ্যাখ ভাই, অনেক টায়ার্ড আমি, তুইও নিশ্চয়? ঘুমা আর আমাকেও ঘুমাতে দে। বাকি কথা সকালে হবে। কাল আবার আমার শো আছে। আই নিড স্লিপ।”
আফরান তাকে আর বিরক্ত করল না। নিজেও ক্লান্ত প্রচুর। তবে ভাইকে ছাড়ল না। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ঘুমে তলিয়ে গেল।
—
আজ ফারনাজ সুন্দর করে সেজেছে। চোখে কাজল দিয়েছে আর ঠোঁটে দিয়েছে লিপস্টিক। হাতে আবার কাঁচের চুড়িও পরেছে। চুলটা ছেড়ে রেখেছে। এতেই তাকে নজর কাড়া সুন্দর লাগছে। সে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে চোখে চশমা এনে ঘর ছেড়ে বের হলো। নিচে দৃষ্টি তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। বোনকে দেখে সে বিরক্ত মাখা কন্ঠে বলে,
“এতো দেরি হয় কেন তোর আপু?”
“আরে দেরি করলাম কোথায়? তোরই তাড়াতাড়ি হয়ে গিয়েছে।”
ফারনাজ কনসার্টে যাচ্ছে। সাথে দৃষ্টিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। দৃষ্টি কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। তবে ফারনাজও ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়। ফারনাজ চেঁচিয়ে বলল,
“মা! আমরা গেলাম।”
পাল্টা কন্ঠস্বর এলো,
“ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি চলে আসবি।”
তারা রওনা দিল। সিএনজি তে চেপে কনসার্টের জন্য নির্ধারিত জায়গার দিকে অগ্রসর হলো।
–
প্রচুর ভীড়! দেখেই বোঝা যাচ্ছে রকস্টার কত বড় মাপের রকস্টার! ফারনাজ এই ভীড়ে বন্ধুদের খোঁজার মত বোকামি করতে গেল না। টিকিট কেটে বহু কষ্টে বোনকে নিয়ে প্রবেশ করল।
চারদিকে হাজার মানুষ হইহই করছে। অপেক্ষা কাঙ্ক্ষিত মানুষটির। এত ভীড়ে দৃষ্টি বোনের সঙ্গে লেগে গেল। ঠেলাঠেলি হচ্ছে ভীষণ। ফারনাজ করুণ কন্ঠে বলল,
“একটু সহ্য কর, দৃষ। কোনো ফাঁকা জায়গা পেলেই আমরা চলে যাব।”
দৃষ্টি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ফারনাজ আশে পাশে দৃষ্টি ঘোরায়। যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এসেছিল, এত ভীড় দেখে তা মাঠে মা’রা গেল। তার এখন বিরক্ত লাগছে। এর মধ্যে থেকে এখন বের হবারও উপায় নেই। আবার গরমও লাগছে প্রচুর। এখন সন্ধ্যা হলেও গরম কম নয়। চুল ছেড়ে আসাটা যে মূর্খতামো হয়েছে, তা এখন টের পাচ্ছে সে।
হঠাৎ হই হুল্লোড় দ্বিগুণ বেড়ে গেল। কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি উপস্থিত হয়েছে। অশান্ত পরিবেশ আবার শান্ত হয়েও গেল। ফারনাজের শ্রবণেন্দ্রিয়ে ভেসে এলো গিটারের শব্দের সাথে অদ্ভুত সুন্দর কন্ঠস্বর,
“তুমি না ডাকলে আসব না
কাছে না এসে ভালোবাসব না
দূরত্ব কি ভালোবাসা বাড়ায়?
নাকি চলে যাবার বাহানা বানায়?
দূরের আকাশ নীল থেকে লাল
গল্পটা পুরোনো,
ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি।
এটা কি ছেলে খেলা আমার এই স্বপ্ন নিয়ে?
চায়লে ভেঙে দেবে গড়ে দেবে ইচ্ছে হলে?
আমি গোপনে ভালোবেসেছি
বাড়ি ফেরা পিছিয়েছি,
তোমায় নিয়ে যাব বলে
এই বার এসে দেখো
হেসে বুকে মাথা রেখো,
বলে দেব চুলে রেখে হাত
দূরের আকাশ নীল থেকে লাল
গল্পটা পুরোনো,
ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি।”
চলবে,