#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১৪
ফারনাজের বিরক্তির যেন শেষ নেই। তাদের ভার্সিটিতে কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছে নবীন বরণ অনুষ্ঠান উপলক্ষে। আর ডাকা হয়েছে ওই পাথর মানব সহ তার দলবল কে। তখন থেকেই ফারনাজের মেজাজ চটে আছে। কেন ভাই? আর কোনো রকস্টার কি এরা পায়নি? ওই পাথর মানব কে কেন ডাকতে হবে? আবার ফারনাজ রা যেহেতু সিনিয়র তাই তাদের ঘাড়ের উপর সব দায়িত্ব পড়েছে। তার কেটে পড়ারও কোনো পথ নেই।
সে বিরস মুখে বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জিনিস গুলোর দিকে তাকাল। এখানে একটা কালো শাড়ি এবং প্রয়োজনীয় সকল জিনিসপত্র আছে। ড্রেস কোড শাড়ি এবং তারা সকল বান্ধবী মিলে কালো শাড়ি পরবে বলে ঠিক করেছে। ফারনাজ উৎসাহিত ছিল যতক্ষণ না রকস্টারের নাম শুনল। এখন তার বাড়ি থেকে বের হতেই ইচ্ছে করছে না।
মিসেস সীমা মেয়ের রুমে এসে এমন অবস্থা দেখে মাথায় হাত দিলেন। বললেন,
“তুই এখনও রেডি হোস নি, নাজ? অনুষ্ঠানে যাবি না, নাকি? আয় তোকে তাড়াতাড়ি করে শাড়িটা পরিয়ে দেই।”
ফারনাজ “যাব না” বলতে নিলেই ফোন বেজে উঠল। সে রিসিভ করে কানে ধরতেই আফিয়া গড়গড় করে বলে,
“তুই কই রে নাজ? আমরা সেই কখন চলে এসেছি, আর তোরই কোনো খোঁজ নেই। জলদি চলে আয়। এটা তো আমাদের শেষ নবীন বরণ তাই না? এরপর তো আমাদের বিদায় হয়ে যাবে, আর ভার্সিটির কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারব না। তাড়াতাড়ি চলে আয়। এবার খুব মজা করতে হবে।”
ফারনাজ ফোন কে’টে দিল। ইমোশনাল হয়ে পড়েছে সে। সত্যিই তো আর একটা বছর পরই তাদের ভার্সিটি ছাড়তে হবে। অসহায় চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“শাড়ি পরিয়ে দাও মা।”
মিসেস সীমা খুব সুন্দর করে তাকে শাড়ি পরিয়ে দিলেন। হালকার মধ্যে সাজিয়েও দিলেন। চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক আর একটু মেকআপ। এক হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি এবং অন্য হাতে ঘড়ি। খোঁপা করে গুঁজে দিলেন আর্টিফিশিয়াল গাজরা। ব্যস, এতেই যেন চোখ ধাঁধানো সুন্দর লাগছে তাকে। মানতেই হবে গুণের দিক দিয়ে ছোট জন এগিয়ে থাকলেও রূপের দিক দিয়ে বড় জন এগিয়ে। তবে ছোট জনেরও রূপ কম নয়। তবুও দুটো মেয়েই তার সোনার টুকরো। তিনি তার থুতনি ছুঁয়ে আঙুলে চুমু খেলেন,
“মাশাআল্লাহ! আমার মেয়েটার দিকে যেন কারো নজর না লাগে।”
সে মুখ গোমড়া করে বলে,
“দৃষ কেন কলেজ গেল মা? ও তো আমার সাথে যেতে পারত। দু বোন একসাথে যেতাম, ভালো হতো না?”
“ভালো তো হতো। কিন্তু দৃষের নাকি ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস আছে। তাই তো চলে গেল।”
ফারনাজ তড়িঘড়ি করে পার্স হাতে ছোটে। বলে,
“তোমার ছোট মেয়ের রোজ রোজ ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস থাকে। আমার কথার কোনো মূল্যই নেই কারো কাছে। আমি আসি আম্মু। সন্ধ্যার আগে চলে আসব।”
চলে গেল সে। মিসেস সীমা হাসলেন, মেয়েটা বড্ড সহজ সরল।
–
রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে শাড়ির কুচি চেপে ধরে দৌড় দিল ফারনাজ। ওই রকস্টার কে নিয়ে এতো না ভাবলে এমন দেরি হতো না। সে আফিয়া ও সুমির মাঝে গিয়ে দাঁড়াল। শ্বাস নিল ঘন ঘন। সুমি খোঁচা দিয়ে বলল,
“এতো দেরি করলি কেন? আর একটু দেরি করলেই ফুল টুল দেওয়া হয়ে যেত।”
ফারনাজ কিছু বলে না। শ্বাস নেয় কেবল। কিছুক্ষণ পর তাদের হাতে গোলাপ ফুল দেওয়া হলো নবীনদের দেওয়ার জন্য। তারা এগিয়ে সবাইকে ফুল দিল। ফুল দেওয়া শেষে স্যাররা নিজের মূল্যবান বক্তব্য রাখলেন। যা তারা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিল।
তারা তিনজন জায়গা বের করে বসে পড়ল। গরমে ফারনাজ লালবতী হয়ে আছে। হাঁসফাঁস করছে শুধু। ওই রকস্টার আসবে শুনে ক্যামপাস গম গম করছে মানুষের ভিড়ে।
“তোরা শাড়ি পরিস কীভাবে? আমার গরমে জানই চলে যাচ্ছে। বাবারে বাবা!”
“গরম লাগলেও শাড়িতে একটা আলাদা ব্যাপার আছে। শাড়িতেই তো নারী সুন্দর, তাই না?”
আফিয়ার কথা শুনে সে মুখ কুঁচকে তাকায়। অসহ্য লাগছে।
স্যারদের বক্তব্য শেষ হতে হতে দুপুর গড়িয়ে গেল। এমনিতেই অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল দেরিতে। এবার সবাইকে কিছু নাস্তা দেওয়া হলো। জানানো হলো যে খুব শীঘ্রই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হবে।
ফারনাজ আর থাকতে চায়ল না। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আজ আমি যাই রে। এসব অনুষ্ঠান আর ভালো লাগছে না। গরমও লাগছে খুব।”
আফিয়ার শুরু হয়ে গেল ইমোশনাল ভাষণ। ফারনাজ আবার ধপ করে বসে পড়ল। বলল,
“তুই দয়া করে থাম। এই অনুষ্ঠানের শেষ না দেখে আমি এক পাও নড়ব না। কিন্তু তুই থাম।”
আফিয়া দাঁত কেলিয়ে হাসে। তার ভাষণ কাজে দিয়েছে ভেবেই ভীষণ গর্ববোধ করে।
অনুষ্ঠানের শুরু গান দিয়েই হবে। সুতরাং রকস্টার তূরাগ ইততেয়াজ এখন স্টেজে উঠবে। সকলে হই হই শুরু করে দিয়েছে। ফারনাজ আশেপাশে দ্যাখে। বাব্বাহ! এই পাথর মানবের এতো ফ্যান ফলোয়ার!
তূরাগকে স্টেজে উঠতে দ্যাখা যায়। হাতে গিটার সামনে মাইক। একটা ড্যাসিং রকস্টার লুকে প্রত্যেকটা মেয়ে বোধহয় হার্টবিট মিস করেছে। বাদ যায়নি ফারনাজও। তবে সে দ্রুত নিজেকে গা’লাগা’ল করে ফোন বের করে হাতে নিল। আর একটা বারও সে তাকাবে না স্টেজের দিকে। আর কানও দেবে না।
তূরাগ গান শুরু করার পূর্বে সামনে তাকাল এক পলক। এই এক পলক তাকানোতেই যে তার সর্ব’না’শ নিশ্চিত ছিল, তা জানলে সে কি তাকাত? না, তাকাত না। হৃদপিণ্ড অত্যাধিক হারে লাফাচ্ছে। চোখ দুটো যেন ঝলসে যাচ্ছে। বুকের মধ্যে অনুভব হচ্ছে নতুন চিনচিনে ব্যথা। তূরাগ ভাবল আজ আর গান গাওয়া হবে না। তার গলা দিয়ে আওয়াজ বের হবে না। কিন্তু এখন নেমে গেলে ভীষণ বদনাম হবে। সে আশেপাশে তাকিয়ে ইশারা করে মিউজিশিয়ান দের বুঝিয়ে দিল কিছু। তারা ইশারা বুঝে সাঁই জানাল। তূরাগ আবারও চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের দিকে তাকাল। গিটারে টুং টাং আওয়াজ তুলল। মুহূর্তে শান্ত হয়ে গেল পরিবেশ।
“ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে
আমি হয়ে গেছি তারা
ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে
আমি হয়ে গেছি তারা
এই জীবন ছিল নদীর মতো গতি হারা
এই জীবন ছিল নদীর মতো গতি হারা, দিশা হারা।
ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে
আমি হয়ে গেছি তারা।”
ফারনাজ যতোই ফোনে চোখ রেখে বসে থাকুক, কানে তার গান পৌঁছাচ্ছে এবং সে মুগ্ধ হতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু তাকাচ্ছেও না আর মুগ্ধতা প্রকাশ করছেও না।
গান শেষ হবার সাথে সাথে তূরাগ নেমে গেল। তালির বর্ষণে মঞ্চ কেঁপে উঠল যেন। পুরোটা গান সে একাই গেয়েছে, গিটার বাজিয়ে। তূরাগ নেমে যাবার পরই ফারনাজ মুখ তুলল। এবার সে শান্তিতে বাকি অনুষ্ঠান দেখবে। হঠাৎ সুমি বলে,
“নাজ, তুই কি কিছু দেখেছিস?”
“কি দেখব?”
“আমার মনে হলো গান গাওয়ার সময় রকস্টার তোর দিকে তাকিয়ে ছিল।”
ফারনাজ হেসে উড়িয়ে দেয়। বলে,
“তোর রকস্টার আমার দিকে কেন তাকাতে যাবে? হয় তার চোখ ট্যারা নাহয় তোর মনের ভুল।”
সুমি ভাবে। অতঃপর বলে,
“রকস্টারের চোখ ট্যারা হতেই পারে না। নিশ্চয় আমার মনের ভুল ছিল।
“হ্যাঁ, তাই। এখন চুপ করে বোস, আমাকে অনুষ্ঠান দেখতে দে।”
তারা হা করে তাকায়। এতো ভালো একটা গান হয়ে গেল ফারনাজ মুখ তুলেই তাকায়নি। আর এখন বলে অনুষ্ঠান দেখবে! আসল জিনিস শেষ হয়ে গেল এখন কি ঘোড়ার ডিম দেখবে?
অনুষ্ঠান চলাকালীন ফারনাজের অস্বস্তি হয়। কেন যেন মনে হয় কেউ ও’কে দেখছে। ভীষণ সূক্ষ্ম ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। সে আশেপাশে চশমা ভেদ করে সতর্ক দৃষ্টি বুলায়। কিন্তু তেমন কাউকেই চোখে পড়ে না। হতাশ হয়ে আবার অনুষ্ঠানে মন দেওয়ার চেষ্টা করে।
চলবে,
#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১৫
উচ্চ শব্দে মিউজিক এবং গায়ক গায়িকা দের বিরক্তিকর আওয়াজে ফারনাজের অসহ্য লাগছে সব কিছু। তূরাগের সফট গানের পর এসব তার ভালো লাগছে না। কানের মধ্যে দুমদাম বাজছে শুধু। কানে তালা লেগে যাবার উপক্রম। এসব কোনো গানের পর্যায়ে পড়ে? ছ্যাহ্!
সে উঠে দাঁড়াল। অনেক হয়েছে, এখানে আর কিছুক্ষণ বসে থাকলে সে বয়রা হয়ে যাবে। সুমি তাকে দাঁড়াতে দেখে জিজ্ঞেস করে,
“উঠে দাঁড়ালি কেন? ওয়াশ রুমে যাবি?”
ফারনাজের মাথা যেন ভনভন করে ঘুরছে। সে দ্রুত ভঙ্গিতে বলে,
“হ্যাঁ ওয়াশ রুমে যাব।”
এখন এখান থেকে না গেলেই নয়। ওয়াশ রুমে যেয়ে চোখে মুখে একটু পানি দিয়ে আসবে নাহয়। তারপর তাদের বলে বিদায় নেবে। এই অসহ্য পরিবেশে আর থাকা সম্ভব নয়। আফিয়া উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“চল আমিও তোর সাথে যাই।”
“আরে না। তোকে যেতে হবে না। শেষ নবীন বরণ এনজয় কর। আমি যাব আর আসব। বেশি সময় লাগবে না।”
সে লম্বা পা ফেলে প্রস্থান করল। ভবনের শেষ প্রান্তে ওয়াশ রুম। এদিকটা ফাঁকা। সবাই ওই বিরক্তিকর কনসার্ট নিয়ে ব্যস্ত। ফারনাজ শাড়ির কুচি সামলে হেঁটে চলে। ওয়াশ রুমে প্রবেশ করে চশমা খুলে রাখে। ট্যাব ছেড়ে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দেয়। টিস্যু নিয়ে মুখ মোছে। হাতড়িয়ে চশমা নেওয়ার আগের অকস্মাৎ হাত চেপে ধরে কেউ। চোখের পলকে দুহাত সামনে নিয়ে বেঁধে ফেলে। ফারনাজ হকচকাল, ভয় পেল। চিৎকার করতে নিলেই তার মুখটাও বাঁধা পড়ল। ফারনাজ প্রতিবিম্বে দ্যাখার চেষ্টা করল অপহরণকারীর মুখ, তবে মাস্ক ও সানগ্লাসে আবৃত মুখমণ্ডল দেখা হলো না। চোখটাও বাঁধা পড়ল। পরপরই অনুভব করল হাওয়াতে ভাসছে সে। ছোটাছুটি করল ছাড়া পাবার জন্য, ব্যর্থ হলো। মুখ থেকে শব্দ বের করার চেষ্টা করল। কিন্তু ‘উম উম’ ছাড়া আর কোনো শব্দ বের হলো না। কাঁদতেও পারছে না চোখ বাঁধা। তাকে কি ধরে নিয়ে বাবার কাছে টাকা দাবি করবে? টাকা দেওয়ার পরও যদি তাকে না ছাড়ে, তাহলে?
ফারনাজের হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এই কিডন্যাপার কোনো পথ খোলা রাখেনি।
কোনো এক গাড়ির মধ্যে বসিয়ে দেওয়া হলো তাকে। অনুভব করল পাশে উঠে বসেছে কেউ। তারপরই গাড়ি চলতে শুরু করল। পাশে অবস্থান করা লোকটি তার মুখের বাঁধন খুলে দিল। তবে চোখ এবং হাত খুলল না। ফারনাজ এবার চেঁচিয়ে উঠল,
“কে কে? কে আপনি? আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? ছেড়ে দিন আমাকে। আমি আপনার কি ক্ষতি করেছি?”
ফারনাজের গলায় উষ্ণ নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ল। শিউরে উঠল সে, বুঝল লোকটি তার অতি নিকটে অবস্থান করছে। কানে বাজল ভারি গম্ভীর কন্ঠস্বর,
“সর্বনা’শ করেছ তুমি আমার। আর জিজ্ঞেস করছ কি ক্ষতি করেছি?”
ফারনাজ থরথরিয়ে কাঁপে। সে আবার কার কি করল? কাঁপা কন্ঠে বলে,
“দ দেখুন, আ আমি কারো কিছু করিনি। আমি একটা ভালো মেয়ে।”
“জেনে বুঝে করোনি। তবে মনের অজান্তেই করেছ।”
তার ভীষণ কান্না আসে। মনের অজান্তেই কিছু হয়ে গেলে তার কি দোষ? ফারনাজ ভেজা কন্ঠে বলে,
“আপনার কন্ঠ চেনা চেনা লাগছে। কে আপনি?”
মৃদু হাসির শব্দ আসে। দুটো আঙুল ফারনাজের নাক টেনে দেয়। আবার কন্ঠস্বর আসে,
“মাথামোটা।”
সে ঢোক গেলে। বলে,
“আপনি কিন্তু মোটেও ঠিক করছেন না জানেন আমি কে?”
“কে তুমি? কোন দেশের রানী?”
কন্ঠে তার দুষ্টুমি, রসিকতা ঝরে পড়ে।
“ডক্টর আফরান ইততেয়াজের বোন হই আমি।”
“ওহ আচ্ছা।”
কিডন্যাপারের ভাবলেশহীন কন্ঠস্বর। ফারনাজ ঢোক গিলে আবার বলে,
“তাছাড়া রকস্টার তূরাগ ইততেয়াজও আমার ভাই হন। তাকে নিশ্চয় চেনেন।”
লোকটি উচ্চ শব্দে হাসে। খুব মজা পেয়েছে যেন। বলে,
“তাই নাকি! তাকে তো তুমি পছন্দই করো না। গানও না। তাকাও ও না। আর বিপদে পড়ে তাকে ভাই বানিয়ে দিলে! ভারি ধড়িবাজ মেয়ে তো তুমি।”
ফারনাজ ঘোর বিরোধিতা করে বলে,
“কে বলেছে তাকে আমার পছন্দ নয়? জানেন? প্রথম দ্যাখাতেই ক্রাশ খেয়েছিলাম। তার গান যে আমার এতো ভালো লাগে, তা বলে বোঝানো যাবে না। আজ এতো সুন্দর একটা গান গাইলেন! আমি তো রেকর্ডও করে নিয়েছি।”
তার সহজ সরল স্বীকারোক্তি। লোকটি তার চঞ্চল ঠোঁট বুড়ো আঙুলে ছুঁয়ে দেয়। কেঁপে ওঠে সে। এমন বিপদে সে জীবনে পড়েনি। লোকটি বলে,
“তবে সে তোমার ভাই নয় আর না তুমি তার বোন।”
“আশ্চর্য! আমার খালাতো ভাইয়ের ভাই তো আমারও ভাই হবে তাই না? যদিও তিনি আমাকে একদমই সহ্য করতে পারেন না। তবুও আমি অস্বীকার করতে পারি না।”
“উফ্! শুধু তোতা পাখির মতো বকবকানি! চুপ থাকো।”
“আমাকে ছেড়ে দিন। তাহলে চুপ থাকব।”
“তোমার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি! তোমাকে কিডন্যাপ করেছি, এখন যদি মে’রে গুম করে দেই? ভয় লাগে না?”
ফারনাজ চুপ হয়ে গেল। টু শব্দটি করল না আর। জানের ভয় আছে তার। লোকটিও আর কোনো কথা বলে না। চোখ বাঁধা থাকলেও ফারনাজ অনুভব করে খুব কাছ থেকে তাকে দেখা হচ্ছে। বারংবার তপ্ত শ্বাস আছড়ে পড়ছে তার মুখশ্রীতে। যা তার আত্মা সহ কাঁপিয়ে দিচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর, তবে কতক্ষণ সে জানে না, গাড়ি থামানো হলো। লোকটি চেপে বসল তার গা ঘেঁষে। ফারনাজ অদ্ভুত সুন্দর একটা পুরুষালী পারফিউমের সুবাস পেল। কিডন্যাপার কি কোনো বিদেশী ব্রান্ডের পারফিউম ইউস করে? শুনতে পেল লোকটির কন্ঠস্বর,
“আজ এই পর্যন্তই। তবে ভেবো না যে শেষ। আবারও দ্যাখা হবে।”
পরপরই তাকে টেনে গাড়ি থেকে নামানো হলো। অনুভব করল হাতের বাঁধন ঢিলে হয়ে এসেছে। সে থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে দ্রুত চোখের বাঁধন খুলল। তবে তার আগেই গাড়িটি ধুলো উড়িয়ে চলে গিয়েছে। ফারনাজ হাতে থাকা চশমা চোখে দিল। লোকটি যাবার আগে তার হাতে চশমা গুঁজে দিয়েছিল। মনে হলো বহু জনম পর সে ধরিত্রী দেখছে। আশে পাশে তাকিয়ে আকাশ থেকে টুপ করে পড়ল যেন। সে তার বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। সে বিড়বিড় করে,
“আশ্চর্য তো! লোকটা কিডন্যাপ করে আবার বাড়ির সামনে নামিয়ে দিল কেন? আর আমার বাড়িই বা চিনল কীভাবে? আবার দ্যাখা হবে মানে!”
সে আকাশ পাতাল ভাবছে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে। ফারদিন বাড়ি থেকে বের হচ্ছিল। তাকে হা করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“চলে এসেছিস! বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা, ভেতরে যা।”
বলা বাহুল্য তারা এক ক্লাসে হলেও এক ভার্সিটিতে পড়ে না। তাদের ভার্সিটি আলাদা। ফারনাজ ঘোর থেকে বেরিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ির মধ্যে চলে গেল।
অনেকক্ষণ ধরে সে ভাবল, এ কেমন অদ্ভুত কিডন্যাপার? ধরল আবার ছেড়ে দিল! আবার দ্যাখা হবে মানে কি আবার ধরবে নাকি! সে শুকনো ঢোক গিলল। খুব সাবধানে থাকতে হবে।
–
দৃষ্টির বাহু পেঁচিয়ে বসে আছে সে। দৃষ্টি বিরক্ত মাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে। অতিষ্ট কন্ঠে বলে,
“সে এসে থেকে আমার হাত জড়িয়ে বসে আছিস! কি সমস্যা তোর আপু? আমি তো পড়তেও পারছি না ভালো করে।”
ফারনাজ কোণা চোখে তাকায়। কন্ঠে অভিমান ঢেলে বলে,
“আমার থেকে তোর কাছে এই পড়াশোনা বড় হয়ে গেল, দৃষ? আমি তোর কেউ না? এই পড়াশোনায় সব?”
“দ্যাখ আপু! আজে বাজে কথা বাদ দিয়ে মূল টপিকে আয়। কি হয়েছে তোর? রুমে যাচ্ছিস না কেন?”
ফারনাজ চুপসে যায়। বিকেলের ঘটে যাওয়া ঘটনা তাকে বলবে কিনা ভাবে। অবশেষে সে আর না ভেবে বলেই দেয় তার সাথে ঘটে যাওয়া করুণ কাহিনী। দৃষ্টি বিচলিত হলো না মোটেও। নির্লিপ্ত কন্ঠে বইয়ের দিকে চোখ রেখে বলল,
“নিশ্চয় তোর কোনো এক্স হবে। তোকে ভয় দ্যাখাতে চেয়েছে।”
“তা কি করে হয়? আমার এক্স গুলোর একটাও বিদেশ চোখে দ্যাখেনি। বিদেশী ব্রান্ডের নামই বা জানবে কি করে আর কিনবেই বা কি করে? এতো কিপ্টার কিপ্টা সব গুলো!”
“তাহলে দ্যাখ বিদেশী কেউ। তোকে দেখে আ’ছাড় খেয়েছে। এবার পিছু ছাড়াতে পারিস কিনা দ্যাখ।”
ফারনাজ চিন্তিত হয়। বিদেশী কেউ! তার মতো মেয়ের পেছনে শুধু শুধু কেন লাগতে যাবে? আচ্ছা? বিদেশী হলে ফড়ফড় করে বাংলা কীভাবে বলল? তার মাথা কাজ করে না। ধপ করে শুয়ে পড়ে বোনের পাশে। হাত পা ছড়িয়ে বলে,
“আমি আর ভাবতে পারছি না। অনেক ভেবেছি, যা হয় হোক। ব্রেইনের রেস্ট দরকার এখন। ঘুমাচ্ছি, আজ তোর রুমেই থাকব। ঘুমের মধ্যে নিশ্চিত জ্বর আসবে আমার। মা’কে বলে দিস রাতে খাব না।”
চলবে,