#সেদিনও_ছিলে_তুমি ❤
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৮
২২.
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখি আদ্র নেই। বিছানায় একটা শাড়ি রাখা, নতুন বোঝা যাচ্ছে। আমি কিছু না ভেবে পরে নিলাম শাড়িটা। কালকের ওই জঘন্য ঘটনার সাক্ষী শাড়িটাকে বালতিতে ভিজিয়ে রেখে দিলাম।
রুমে একা একাই বসে আছি। এই রুমটা অবশ্য আমার অচেনা। কারণ সেদিন যখন আদ্র আমাকে ওর বাসায় নিয়ে আসে অজ্ঞান অবস্থায়, সেটা নাকি আদ্র’দের অন্য একটা বাড়ি। আর আজকেরটা ওদের নিজেদের, যেখানে ওরা সবসময় থাকে। যাইহোক, ঘুরে ঘুরে রুমটা দেখছি এমন সময় দরজা খুলে কারো আসার আওয়াজ পেলাম। ভাবলাম, আদ্র’ই হবে।
কিন্তু না, সেটা নয়। রুমে ঢুকলেন মাঝবয়েসী একজন মহিলা, দেখতে হুবহু আদ্রে’র মতো। আমি অবাক হয়ে তাকাতেই ওনি মিষ্টি হেসে বললেন, ‘ঘুম ভাঙলো মা?’
আমি অস্বস্তি ভরা গলায় বললাম, ‘হুম!’
ওনি বোধহয় বুঝতে পারলেন আমার অস্বস্তিটা। সেজন্য বললেন, ‘আমাকে চিনতে পারোনি নিশ্চয়ই?’
—“না মানে…!”
—“আমি আরভি ইসলাম। আদ্রে’র আম্মু!”
আমি এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে ওনাকে সালাম করতে গেলাম। ওনি মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘সালাম করতে হবেনা মা। তুমি নিশ্চয়ই অবাক হয়েছো যে নতুন বউ ঘরে রেখে এখনো কেউ আসেনি কেন?’
—“আসলে…!”
—“আসলে কাল রাতে তুমি তো একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে, তাই আমি ভেবেছি তোমার এখনো ঘুম ভাঙেনি। ডিস্টার্ব করা ঠিক হবেনা, সেজন্য। কিন্তু আদ্র’ এসে বললো, তোমার জ্ঞান নাকি ফিরেছে।”
—“ওহহ!”
তারপর আদ্রে’র মা মানে শ্বাশুড়িমা আমাকে বললেন, ‘তোমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছি মা, খেয়ে নাও। রাতে তো কিছুই খাওনি।’
আমি ভদ্রতার খাতিরে জানা জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনারা খেয়েছেন?’
ওনি হেসে বললেন, ‘হুম। আদ্রে’র আব্বু অফিসে গিয়েছেন ব্রেকফাস্ট করে।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘অফিস মানে? স্যার তো রিটায়ার্ড করেছেন।’
—“আমাদের ব্যবসায় দেখশোনা করছেন, রিটায়ার্ড করার পর তো বাসায় বসে বোর হতো, আমিও কলেজে চলে যাই, সেজন্য অফিসে গিয়ে সবকিছু দেখাশোনা করে। ছেলের তো ব্যবসাতে মন নেই, খালি পলিটিক্স নিয়ে যত ভাবনা।”
আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম, ‘ওহহ!’
—“আচ্ছা, আমি খাইয়ে দিই?”
আমার অস্বস্তি ভাবটা কেটে গেলো। ওনাকে বেশ ভালো লাগছিলো, বেশ আপন আপন। আমিও হেসে বললাম, ‘জ্বি, আন্টি!’
ওনি ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘আন্টি? আন্টি বলছো কেন মা? আমি যেমন আদ্রে’র আম্মু, তেমনই তোমারও! আমাকে আম্মু বলেই ডেকো।’
২৩.
আমার চোখ দুটো ভিজে উঠলো। ওনি আমাকে খাইয়ে দিতে লাগলেন। খাওয়া শেষ করে ওনি আমাকে রেস্ট নিতে বলে বেরিয়ে গেলেন। এমনি হুট করে ঘরে ঢুকলো আদ্র। মোবাইল স্ক্রল করতে করতে রুমে ঢুকলেন। কপালে চুল লেপ্টে আছে, ঘামে ভেজা চোখমুখ। সোজাসুজি আসতেই কার্পেটে পা বেঁধে পড়ে যাওয়ার জোগাড়। তবুও ওনি নিজেকে সামলে নিলেন। আমি হেসে উঠলাম। ওনি রেগে তাকালেন আমার দিকে, আমি মুহূর্তেই চুপ। বললেন, ‘এভাবে হেসো না সুইটহার্ট!’
—“কেন? হাসলে কি সমস্যা?”
ওনি বুকে হাত দিয়ে বাঁকা হেসে বললেন, ‘এখানে লাগে, তোমার হাসিটা আমার এখানে লাগে সুইটহার্ট!’
আমি চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইলাম। ওনি আবারও বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে বিছানায় পড়ে যাওয়ার ভঙ্গি করে বললেন, ‘তোমার চাহনিটা আমার এখানে লাগছে, প্লিজ এভাবে তাকিও না সুইটহার্ট!’
আমি কিছু বলতে যাবার আগেই শ্বাশুড়িমা’র গলা শোনা গেলো। ওনি চেঁচিয়ে আদু, আদু বলে ডাকছেন, নিচে যেতে বলছেন।
আমি আদু ডাক শুনে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছি। ওনি চোখ গরম করে আমার দিকে তাকালেন, আমি বললাম, ‘আদু ভাই! আপনি কয়বার ফেইল করেছেন আদুভাই? আদুভাই! প্লিজ… শুনুন..আদু ভা ভা ভাই!’
ওনি মায়ের ডাকের ঠ্যালায় আমাকে আর কিছু বলার সুযোগই পাননি। হনহন করে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় দরজায় একটা লাথি মেরে বেরিয়ে গেলেন।
২৪.
দুপুরের দিকে শেফার ফোন এলো।রিসিভ করতেই বলে উঠলো,
—“হ্যালো, দোস্ত তুই কই?”
—“কেন?”
আমিতো ম্যাসে আসছি, তুই দেখি নাই। দাদী বললো, তুই নাকি কাল বাসায় ফিরস নাই?
—“হুম।”
—“কেন? কোথায় ছিলি তাহলে?”
—“দেখা হলে বলবো।”
—“এখন বললে কি সমস্যা?”
—“এখন বলতে পারবোনা।”
—“তুই এখন আছিস কই?”
—“আদ্র’দের বাসায়।”
শেফা অবাক গলায় বললো, ‘আদ্র মানে? আদ্র ভাই?’
আমি বললাম, ‘হুম।’
শেফা আরও একদফা অবাক হয়ে বললো, ‘তুই আদ্র ভাইয়ের বাসায় কি করোস?’
আমি রেগে বললাম, ‘দেখা হলে সব বলবো।’
শেফা ওপাশ থেকে বললো, ‘এখন আয় তাহলে?’
আমি বললাম, ‘আচ্ছা। আমি আসছি!’
একথা বলতেই কে যেন আমার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিলো। পেছনে ঘুরে তাকালাম। দেখলাম, আদ্র’ মোবাইলটা নিয়ে নিয়েছেন। ওপাশ থেকে শেফার গলা শোনা যাচ্ছে। আদ্র ফোনটা লাউড স্পিকারে দিয়ে কানে লাগিয়ে বললো, ‘শেফা বলছো?’
শেফা বোধহয় অবাক হলো, তাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে কেশে গলা ঝেড়ে ভয়ে ভয়ে বললো, ‘জ্বি!’
—“আমাকে চিনতে পারছো?”
—“জ্বি।”
—“আমাকে ভয় পাচ্ছো?”
—“জ্বি। না মানে…!”
আদ্র হু হা করে হেসে উঠলো। বললো, ‘তুমি ভয় পাও, অথচ তোমার বান্ধবী আমাকে ভয় পায়না। কেন বলতো?’
শেফা বললো, ‘আমি কি করে বলবো ভাইয়া?’
আচ্ছা বাদ দাও। তো তোমার বান্ধবী আমার বিষয়ে কিছু বলেনি তোমাকে?
শেফা বললো, ‘না তো।’
আদ্র রাগী চোখে আমার দিকে তাকালো। তারপর শেফার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আমি বলবো?’
—“জ্বি ভাইয়া বলুন!”
আদ্র বাঁকা হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তোমার বান্ধবী আই মিন আরশির সাথে আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে।’
শেফা প্রথমে একটু অবাক হলেও পরক্ষণে বললো, ‘আপনি ফান করছেন, তাই না ভাইয়া?’
ওনি মুখে একটা ইনোসেন্ট ভাব এনে বললেন, ‘আমাকে কি তোমার ফান বয় মনে হয়?’
—“না ভাইয়া! ঘটনা কি সত্যি?”
—“হুম।”
শেফার গলা দিয়ে বোধহয় আওয়াজ বেরুচ্ছে না।
কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বললো, ‘আরশির কাছে ফোনটা দেওয়া যাবে ভাইয়া?’
আদ্র ঠোঁট উল্টে বললো, ‘অফকোর্স যাবে। নাও কথা বলো!’
বলে বাঁকা হেসে আমার দিকে ফোনটা বাড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আমার রাগে গা জ্বলছে। উষ্ঠা দিয়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে। মুখদর্শন করতেও ইচ্ছা করছে না। আমি ফোন নিয়ে কানে লাগাতেই শেফা বললো, ‘দোস্ত এসব সত্য?’
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘হুম।’
—“তুই এটাই বলতে চেয়েছিলি আমাকে দেখা করে?”
—“হুম, তুই ছাড়া আমার আর কে আছে বল!”
—“কিন্তু এই অঘটন ঘটলো কিভাবে?”
আমি একটা হতাশ নিঃশ্বাস ফেললাম। ঘটনার কথা মনে হতেই আমি দু’হাতে নিজের মাথার চুল টেনে ধরলাম, আর বিরক্তিতে ছেয়ে গেলো মন-মস্তিষ্ক। আমি একে একে পুরো ঘটনা খুলে বললাম শেফাকে, সাথে কাঁদলামও। কেন এমন হলো, কেন এতোটা অপমানিত হলাম স্যারদের সামনে বুঝতে পারলাম না। আমার কপালের দোষ সব। শেফা সব শুনে বললো, ‘যা হওয়ার তা তো হয়েই গিয়েছে! এখন আর কাঁদিস না।’
আমি চুপ করে রইলাম। শেফা বললো, ‘তবে জানিস, আমার একটা কথা মনে হয় সবসময়!’
আমি গলা টেনে বললাম, ‘কি?’
শেফা চিন্তিত গলায় বললো, ‘আমার মনে হয় আদ্র ভাই তোকে ভালোবাসে।’
আমি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম, ‘ভালোবাসে?’ ‘তোর এটা মনে হয়? ওনার সামনে হাজারো সুন্দরী মেয়েরা সবসময় ঘুরাফেরা করে। আর ওনি ওদের না ভালোবেসে আসবে আমার মতো একটা এতিমকে ভালোবাসতে? হাসালি!’
শেফা বললো, ‘হতেই তো পারে। এমন না হওয়ার তো কোনো কারণ নেই!’
আমি বললাম, ‘ওনি আমাকে ভালোবেসে নয়, পানিশমেন্ট দেওয়ার জন্য বিয়ে করেছেন, সেটা কি আর আমি জানিনা।’
শেফা অবাক হয়ে বললো, ‘পানিশমেন্ট মানে? কিসের পানিশমেন্ট?’
আমি চুপ করে গেলাম। এ বিষয়ে এখন কথা বলার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আমি চোখমুখ মুছে বললাম, ‘আচ্ছা, তুই ম্যাসেই আছিস এখন?’
—“হুম।”
আচ্ছা, আমি তাহলে এখন রাখি। আসার চেষ্টা করবো, তবে মনে হয়না আমি আসতে পারবো। যদি না আসি তাহলে তুই তোর বাসায় চলে যাস।
শেফা বললো, ‘বাসায় যাবার কি আছে? তুই তোর শ্বশুরবাড়ি আছিস, তুই না এলে আমি একাই থাকতে পারবো!’
—“আচ্ছা, তাহলে দরজা-জানালা ভালো করে বন্ধ করে ঘুমাবি।”
—“কেন?”
—“ভুলে গেলি? সেদিন বললাম না, কে যেন রাতে আসে? আমি একা থাকাকালীন তো কে যেন আসতো, যদি তোকে একা পেয়ে তোর কোনো ক্ষতি করে দেয়!”
শেফা ভয়ভয় গলায় বললো, ‘আচ্ছা। রাখি তাহলে!’
–“হুম।”
ফোন শেষ করতেই আদ্রে’র হামলা। দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বললো, ‘কথা শেষ?’
আমি মুখ ভেংচি দিলাম। ওনি হেসে বললেন, ‘আহা! কি দৃশ্য। বিয়ে করলে যে এমন সুন্দর দৃশ্য দেখা যাবে সেটা যদি আগেই জানতাম, তাহলে কবে বিয়ে করে নিতাম!’
আমি রেগে বললাম, ‘তো করে নিতেন! আমাকে বিয়ে না করে আপনার ফারিনকে করতেন, তাহলে আরও সুন্দর দৃশ্য দেখতে পারতেন।’
ওনি ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘আর ইউ জেলাস?’
আমি রাগী চোখে তাকালাম। ঘুসি দিয়ে নাক ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে। আমি নাকি জেলাস হবো! হাস্যকর কথা।
👉”হে ঈমানদারগণ,
তোমরা সবর ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে রয়েছে।”
~ [সূরা বাক্বারা : ১৫৩]
সবচেয়ে খুশির সংবাদ হলো, আল্লাহর
রাগের চেয়ে দয়ার পরিমাণ বেশি।
আলহামদুলিল্লাহ।
চলবে….ইনশাআল্লাহ!