#সেই_রজনী_দর্শনে🌙 |১৩| [অন্তিম পর্ব]
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
_”আপনি আমায় না জানিয়েই চলে গেলেন মিস্টার নুডুলস? কষ্ট পেলাম ভীষণ।”
ইনাম অনলাইন এই ছিলো, মেসেজটা তাই সঙ্গে সঙ্গেই দেখতে পেলো। রিপ্লাই করলো,
_”বলে আসার কি আছে?”
_”তা নেই, তবে থাকলে থাকতেও পারতো। আপনি চাচ্ছেন না তাই কারণ থাকছেনা।”
_”খাপছাড়া কথাবার্তা কি জন্ম থেকেই বলো?”
_”তা একটু আকটু।”
হাসলো ইনাম। সারা পুনরায় লিখলো,
_”আবার আসবেন কবে?”
_”তুমি জেনে কি করবে?”
_”যখনই আসুন, চুলগুলো নুডুলস বানিয়েই আসবেন। ভালোলাগে দেখতে।”
_”এতদিকে না তাকিয়ে পড়তে বসো পিচ্চি।”
_”এতদিকে কোথায়? তাকালাম তো শুধু আপনার দিকে, আমি আবার ভীষণ লয়াল।”
_”লয়ালিটির কি বোঝো তুমি?”
_”না বুঝলে,আপনি বোঝাবেন। আমার কোনো সমস্যা নেই।”
সারা এবার হুট করেই ইনামের নিকনেইম দিয়ে দিলো, “মিস্টার নুডুলস”। ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো ইনাম, নিজেও কি বুঝে নিকনেইম সেট করলো, “খাপছাড়া “।
_”বাহ, আই লাইক দিস নেইম।”
রিপ্লাই না দিয়েই অফলাইন গেলো ইনাম। মুচকি হাসছে সে, কেন হাসছে? জীবনে প্রথম কোনো মেয়ে তার সঙ্গে এভাবে কথা বলছে তাই? মেয়েরা তাকে পছন্দ করেনা তেমনটা নয়, তবে সবাই তাকে মজার নজরে দেখে বেশি, এটাও তার চুলের জন্য। আবারো অনলাইন এ এসে ইনাম টাইপ করলো,
_”আস..”
নিজেই অবাক হলো ইনাম, প্রশ্রয় দিচ্ছে সে মেয়েটাকে? দিলে দিক, মাঝেমধ্যে প্রশ্রয় দেওয়াটা খারাপ নয়।
____
_”র…জ…নী…” (বেশ টান দিয়ে ডাকলো)
ডাইনিং টেবিলে বসে গল্পের বই পড়ছিল রজনী। দর্শন বাহিরে থেকে এলো মাত্র,হাতে ফাইল। এক্সাম দিয়ে এলো বোধ হয়, সোফায় হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে, মাথা পিছন দিকে এলিয়ে রাখা।
রজনী বইটা রেখে উঠে দাড়ালো, ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল বের করে এক গ্লাস পানি ঢেলে নিলো। এরপর সেটা নিয়ে গেলো দর্শনের কাছে। দর্শন হাত বারিয়ে পানিটা নিলো। পুরো গ্লাস শেষ করে সেটা টি টেবিলের উপর রেখে ডান হাত ঝাড়া দিলো কয়েকবার। রজনী এগিয়ে এসে বললো,
_”মানে তুমি কষ্ট পাবে ভাইয়া,তাও ডাক্তারের কাছে যাবেনা? বাচ্চাদের মতো করো আসলেই।”
দর্শন সোফায় হেলান দিয়ে ক্লান্ত সুরে বলে,
_”হাতের কথা ছাড় তুই। মাথাটা প্রচণ্ড ব্যাথা করছে, একটু টিপে দে না।”
দেরি করলোনা রজনী। পিছন দিকে এসে হাত রাখলো দর্শনের মাথায়,সোফায় মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করলো সে। ফাহমিদা রান্নাঘর থেকে বেরিয়েই দর্শনের উদ্দেশ্যে বললেন,
_”মেয়েটাকে দিয়ে এতো কাজ করাস কেনো বল তো? ও কি তোর চাকর নাকি?”
দর্শন চোখ খুললো না, রজনীর নরম হাতের স্পর্ষে আরাম লাগছে বেশ। চোখ বন্ধ রেখেই বললো,
_”কি যে বলোনা আম্মু! ও চাকর হতে যাবে কেনো? ও তো আমার..”
রজনী খানিক জোরে মাথায় চাপ দিতেই চুপ করে যায় দর্শন, নাহয় কি থেকে কি বলে ফেলবে! চোখ খুলে ভ্রু কুঁচকে নেয় দর্শন, রজনী ফাহমিদার দিকে তাকিয়ে বলে,
_”কোনো সমস্যা নেই ফুপ্পি, তুমি ভেবোনা অতো। প্রি টেস্ট শেষ হলো মাত্র,এখন এমনিতেও পড়ার চাপ কম।”
ফাহমিদা চলে যান নিজের কাজে। দর্শন ভ্রু নাচিয়ে তাকায় রজনীর দিকে। রজনী পুনরায় মাথা টিপতে শুরু করলে সে চোখ বন্ধ করে বলে,
_”কথা শেষ করতে দিলিনা কেন?”
_”তোমার না মাথা ব্যাথা করছে? চুপ করে থাকোনা বাবা তাহলে,এত কথা বলতে যাও কেনো?”
হাসলো দর্শন,কিছুক্ষন বাদে বললো,
_”তোর হাতে জাদু আছে পাখি, মাথা ব্যাথা অর্ধেকটাই গায়েব হয়ে গেলো, স্ট্রেঞ্জ!..”
_”তেল এর দাম বুঝি কমে গেছে ভাইয়া?”
চোখ খুললো দর্শন, রজনী নিজেও হেসে দিলো এবার। দর্শন ওর হাতটা সরিয়ে দিয়ে বললো,
_”হয়েছে, আর লাগবেনা। আবার হাতে ব্যাথা করবে তোর। ”
সোফা থেকে উঠে দাড়ালো দর্শন,রজনী অবাক মুখে বললো,
_”এই, রাগ করলে?”
দর্শন মুচকি হেসে এগিয়ে এলো রজনীর দিকে। দু’হাতে তার গাল টেনে দিয়ে বললো,
_”তোর উপর? ইম্পসিবল..”
_”উফ,গাল টানবেনা আমার।”
বিরক্ত হয়ে বলে রজনী। দর্শন আবারো হেসে তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,
_”তাহলে? কিস করবো?”
রজনী হা করে তাকালো দর্শনের দিকে। দর্শন চোখ টিপ মে’রে চলে গেলো নিজের ঘরে। রজনীর বিস্ময় এখনো কাটছে না, এটা কি বলে গেলো দর্শন?
_”হা করে দাড়িয়ে আছো কেন?”
আফিয়া টেবিল গোছাতে এসে বলেন এই কথা। রজনী মুখ বন্ধ করে মাথা নাড়িয়ে নিজের ঘরে চলে আসে এবার। ইদানিং আবার তার অদ্ভুত লাগে, অতিমাত্রায় খুশি হয়ে যায় কখনো কখনো। মনের মাঝে রঙিন প্রজাপতিরা উড়ে বেরায় বোধ হয়, তার কিশোরী মনে প্রথমবারের মতো প্রেমের হাওয়া লাগছে বলে কথা!
এই খুশির সূত্র ধরেই আবার নতুন সাধ জাগলো রজনীর মনে, শাড়ি পরার ইচ্ছে হলো খুব। তবে ছবি তুলে দেওয়ার জন্য প্রয়োজন দর্শনকে। গুটিগুটি পায়ে দুপুরের পরপর তার ঘরে হাজির হলো রজনী। দর্শন ঘুমোচ্ছে উপুড় হয়ে, তবে তাকে ঘুমোতে দেখতে ইচ্ছে হলোনা। ধীরেধীরে গিয়ে বিছানার পাশে বসলো সে। দর্শনকে ডাকতে যাবে তার আগেই দর্শন বলে ওঠে,
_”কি চাই পাখি? এইসময় আমার ঘরে?”
অবাক হয় রজনী। দর্শন লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে সোজা হয়ে শোয় এবার, তার মানে সে ঘুমায়নি। রজনী হেঁয়ালি না করেই বললো,
_”বাসায় থাকবে বিকেলে? ক’টা ছবি তুলে দিতে পারবে?”
_”সে থাকবো। কিন্তু,হঠাৎ ছবি?”
_”শাড়ি পরতে ইচ্ছে করছে খুব।”
এক ঝটকায় উঠে বসে দর্শন। চোখ দুটো ডলে বলে,
_”আমি জেগে আছি তো? লাইক, তোর শাড়ি পরতে ইচ্ছে করছে?”
_”এত অবাক হওয়ার কি আছে?”
দর্শন বিছানায় হেলান দিয়ে বলে,
_”আম্মু,মামি তো গেলো কোন আন্টির বাসায়। নানুর কাছে শাড়ি পরবি?”
_”দাদুর কাছে কেন পরতে হবে? আমি নিজে পরতে পারিনা বুঝি?”
_”রাতপাখি, তুই শাড়ি পরা কবে শিখলি?”
অবাক হয়ে প্রশ্ন করে দর্শন, রজনী হেসে উত্তর দেয়,
_”অনেক আগে,পরিনি শুধু এই যা।”
_”কেন শিখতে গেলি বল তো? বিয়ের পর নাহয় হাজবেন্ড পরিয়ে দিতো।”
সামান্য হেসে বলে দর্শন, রজনী ভাবান্তর ছাড়াই বলে দেয়,
_”থাক, তোমায় আর অতো কষ্ট করতে হবেনা।”
চোখ বড়বড় করে নেয় দর্শন। ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,
_”আমি কেন কষ্ট করবো? কেন, আমায় বিয়ে করবি বুঝি?”
বিব্রতকর পরিস্থিতি তে পরে যায় রজনী, মুখ ফসকে এটা কি বলে ফেললো? পরিস্থিতি সামাল দিতে উঠে দাড়িয়ে বলে,
_”তুমি বাহিরে যাবেনা কিন্তু। আমি রেডি হয়ে বলবো, তখন ছাঁদে গিয়ে ছবি তুলে দেবে।”
ঘর থেকে বেরোবার আগ মুহূর্তে দর্শনের হাসির শব্দ ঠিকই শুনতে পেলো রজনী, নিজেও হাসলো সামান্য। এত বেশি হাসছে আজকাল,না জানি এত বিপরীতে কত কান্না অপেক্ষা করছে।
গোলাপি রঙের শাড়ি পরে হালকা সাজলো রজনী। হিজাবটা বের করতেই দরজার বাইরে থেকে দর্শনের কণ্ঠ শোনা গেলো,
_”তৈরি তুই?”
রজনী চুপ করে রইলো দু সেকেন্ড, দর্শনকে দেখতে পাচ্ছেনা দরজার পাশে। তারমানে সে কিছুটা দূরে থেকেই বলছে কথাটা। মাথা নিচু করে হাসলো রজনী। সে কখনো দরজা খোলা রেখে চেঞ্জ করবেনা, তবুও দর্শন না বলে ভিতরে আসেনি।
_”হ্যা তৈরি, এসো ভিতরে।”
দর্শন এবার প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে ভিতরে এলো। রজনী আয়নার সামনে গিয়ে হিজাব বাধতে লাগলো এবার, দু মিনিটেই সুন্দর করে হিজাব বেধে নিলো সে। দর্শনের নজর লক্ষ্য করেছে সে,তবে বলেনি কিছু। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে চুড়িগুলো বের করতেই দর্শন এগিয়ে আসে তার দিকে। চুড়িগুলো যত্ন করে পরিয়ে দেয় রজনীর হাতে। সেই হাতের দিকে তাকিয়েই বলে,
_”সাবধানে কি আর সাধে থাকতে বলি তোকে রাতপাখি? এবার সিরিয়াসলি আমার নজর লেগে যাবে।”
মুচকি হেসে রজনীর গালে হাত রেখে দর্শন বলে,
_”মাই নাইট বার্ড, মিষ্টি লাগছে খুব, জাস্ট লাইক আ ডল।”
_”পুতুল শাড়ি পরে?”
_”আমার পুতুল পরে।”
হাসলো দুজনেই। ছাঁদে গেলো একসঙ্গে, বিকেল গরিয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেছে প্রায়। তড়িঘড়ি করে বেশ কয়েকটা ছবি তুলে দিলো দর্শন।
সন্ধ্যা নামতেই রজনী নিচে যেতে চাইলো, সেখানেও বাঁধা দিলো দর্শন। আবদারের সূরে বললো,
_”রাতপাখি, এখনই যাসনা।”
রজনী ভ্রুযুগল কুঁচকে বলে,
_”তো কি করবো? অন্ধকারে ছবি তুলবো? চেঞ্জ করবো আমি, অস্বস্তি লাগছে এখন।”
_”থাকনা আর কিছুক্ষন। চাঁদের আলোয় একটু দেখি তোকে।”
দর্শনের কথা ফেলতে পারলো না রজনী। এগিয়ে গিয়ে বসে পরলো সেই বেঞ্চটাতে, দর্শন এসে কিছুটা দূরত্ব রেখেই বসলো, ছাঁদের রেলিং এ কনুই ঠেকিয়ে গালে হাত রেখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রজনীর দিকে।
তার অজান্তেই অতিবাহিত হলো অনেকটা সময়। নিরবতা ভাঙলো দর্শন নিজেই। প্রশ্ন করে বসলো,
_”এভাবে যে তোর দিকে তাকিয়ে আছি, খারাপ লাগছেনা রাতপাখি?”
_”ভালো আর খারাপ নজরের মধ্যে পার্থক্য বোঝার মতো ম্যাচিউরিটি অন্তত আমার মধ্যে আছে।”
সরাসরি উত্তর দিলো রজনী। দর্শন মুচকি হেসে বললো,
_”বুঝে গেলি, আমার নজর খারাপ নয়? কি করে?… রাতপাখি, ভালোবেসে ফেলেছিস আমায়?”
_”একই প্রশ্নটা যদি আমি করি?”
_”আমি? সে তো কতো আগে থেকেই বেসেছি।”
_”কবে থেকে?”
অধির আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলো রজনী। দর্শন এবার কিছটা এগোলো তার দিকে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
_”নাটক সিনেমার মতো পিচ্চিকালে প্রথমবার দেখেই ভালোবেসে ফেলিনি,এটুকু সিওর। আমি মুগ্ধ হয়েছি অনেক দেরিতে, এই ধর বছর পাঁচেক আগে। কোনো এক পূর্নিমা কিংবা অমাবস্যা রাতে, তুই ঠিক এভাবেই ছাঁদে বসেছিলি, হয়তো মন খারাপটাই তার কারণ ছিলো। কি হলো আমার জানিনা, তবে আটকে গেলাম যেন। বাঁধা পরলাম সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া এই বালিকার প্রেমে। সেই রাতের কথা সহজ শব্দে এভাবেও বলা যায়,
‘হৃদকোঠরে আঁকড়ে তোকে
চাহিলাম তোর পানে
মনপাখি রূপে চাইলাম তোকে
সেই রজনী দর্শনে’
মুগ্ধ নয়নে কিছুক্ষন দর্শনের দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ সরালো রজনী। আপনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো এবার। আর দর্শন? সে’ও আকাশ দেখলো। তার নিজস্ব আকাশ, যার মাঝে চাঁদের পরিবর্তে নিজের ভালোবাসা দেখতে পায় সে।
#সমাপ্ত