সেই রজনী দর্শনে পর্ব-০১

0
695

#সেই_রজনী_দর্শনে |১|
#সূচনা_পর্ব
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন

নিজের দ্বিগুণ বয়সী একজন লোকের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হচ্ছে রজনীর, অথচ এ বিষয়ে কানাকড়ি খবরও তার কান অবধি পৌঁছায়নি। সদর দরজার সামনে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো সে, সম্মুখে থাকা ব্যক্তি পুনরায় গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
_”বললাম না ভিতরে যা, স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
দর্শনের কথায় খুব একটা ভ্রুক্ষেপ করলোনা রজনী। ড্রইংরুমে দাঁড়িয়ে থাকা সবার দিকে তাকিয়ে খানিক শান্ত গলায় বললো,
_”কার বিয়ের কথা বলছো তোমরা?”

দু আঙুল দিয়ে কপালে স্লাইড করলো দর্শন, রজনীর দিকে দৃষ্টি এনে আবারো বললো,
_”বড়দের কথা এতো শুনতে হয়না। রাফিনকে নিয়ে ঘরে যা।”

_”তুমি কখন এলে?”

পাল্টা প্রশ্ন করে বসলো রজনী। দর্শন তার স্বাভাবিক উত্তরে বললো,
_”এসেছি, একটু আগে।”

ড্রইংরুম এ উপস্থিত আফিয়া আক্তার পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার উদ্দেশ্যে মেয়ের কাছে এসে কড়া গলায় বললেন,
_”এক কথা কতবার বলতে হবে তোমায়? বড়রা কথা বলছে তো এখানে, তুমি ঘরে যাবে এক্ষুনি। আর কোনো কথা শুনতে চাইছি না।”

একনজর চোখ সরিয়ে বাবা জাহিদ হাসানের এর দিকে তাকালো রজনী, তার দৃষ্টি অন্যদিকে। আর কথা বললোনা রজনী,ছোট ভাই রাফিনের হাত ধরে ঘরে চলে গেলো সে। রজনী স্থান ত্যাগ করতেই আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলোনা দর্শন, রজনী আড়ি পেতে কথা শুনবেনা সে জানে। তাই সরাসরি জাহিদের সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো,
_”তো বলো মামা, তোমার মেয়ের বয়স কত?”

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দর্শনের দিকে তাকালো জাহিদ,এই ছেলে তার সব পরিকল্পনা নষ্ট করে দিচ্ছে। এমন কিছু হতে পারে আন্দাজ করেই এবার মা হালিমা খাতুন এর সঙ্গে আলোচনা করে গোপনেই কথাবার্তা এগিয়েছিলেন জাহিদ। ছেলে রজনীকে একবার দেখাতেই পছন্দ করেছে, আরও তার কম বয়সী মেয়েই পছন্দ। ফলে সঙ্গে সঙ্গে জাহিদের নিকট রজনীকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় সে, জাহিদ সেই ছেলের বাবার অফিসেই চাকরি করে। বিয়েটা একবার দিতে পারলে, সর্বোচ্চ স্তরে যাওয়া থেকে জাহিদকে আর কেউ আটকাতে পারবে না। এমন সব পরিকল্পনা করেই পাত্রপক্ষকে প্রায় সায় জানিয়েই দিয়েছিলেন জাহিদ। দর্শন বাড়িতে নেই, এক সপ্তাহের জন্য ট্যুরে গিয়েছে, এই ফাকেই শুভকাজ সেড়ে ফেলতে চেয়েছিলেন তিনি।

তবে তা আর হলো কই? স্ত্রী আফিয়া আর বিধবা বোন মাহমুদাকে ডেকে যেই না বিয়ের কথাবার্তা বলতে যাবে তখনি বাড়িতে এসে হাজির হয় দর্শন। অবাক হয় সকলে, তার তো আরো চারদিন পরে আসার কথা ছিলো।

_”কি হলো এটাও কি জানোনা নাকি? তো মনে করিয়ে দেই, তোমার মেয়ে সবে ষোলো পেরিয়েছে। আগামী বছর সে মাধ্যমিক তথা এস এস সি পরিক্ষা দেবে। আইনত সে এখনো নাবালিকা.. বুঝতে পারছো তো?”

মাহমুদা বিরক্ত হয়ে দর্শনের উদ্দেশ্যে বললেন,
_”এতো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে না বলে সরাসরি বল তো হয়েছে টা কি? আর তুই ই বা এত তাড়াতাড়ি কি করে চলে এলি?”

নিজের কাধে থাকা ব্যাগটা সোফার উপর ছুড়ে মারে দর্শন। তার ঘাড়ে,কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়েছে। ছোট চেক এর শার্টটার এক হাতা কনুই অবধি গোটানো, অন্যটা স্বাভাবিক। জাহিদের দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
_”আর দুদিন পরে এলে তো সঙ্গে করে পুলিশ আনতে হতো। নিজের মেয়েকে বাল্যবিবাহ দেওয়ার চেষ্টা করায় তোমার ভাইকে পুলিশ ধরে নিয়ে যেতো,সেটা খুব ভালো হতো নাকি?”

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হালিমা খাতুন তেতে উঠলেন খানিকটা। কপাল কুঁচকে বললেন,
_”এত কথা বলার কি আছে? আগেকার দিনে কি কমবয়সী মেয়েদের বিয়া হয়নাই? আর ঐ মেয়ে এত কচি খুকিও না,যথেষ্ট বিয়ার বয়স হইছে ওর।”

দর্শন মুখে বিরক্তির ছাপ এনে হাতের ইশারায় হালিমাকে থামার উদ্দেশ্য করে বলে,
_”আর তুমিতো চুপই থাকো নানু। নিজেই তো ছেলের কান ভাঙিয়েছো, আমি কি কিছুই জানিনা ভাবছো?”

_”আহ দর্শন, নানুর সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয় ভুলে গেছিস?”

মাহমুদার কথায় তাচ্ছিল্যের সুরে হাসে দর্শন। প্রতিত্তরে বলে,
_”যার যেমন ব্যাবহার পাওয়া উচিৎ তেমনটা করলে তো। থাক.. মুখ খুলতে চাইছিনা এখন।”

মাহমুদা কড়া চোখে তাকায় দর্শনের দিকে,সেদিকে খেয়াল করেনা দর্শন। আফিয়া এতক্ষনে ঘটনা অনেকটাই আন্দাজ করতে পেরেছে। এগিয়ে এসে জাহিদের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
_”তুমি আবার রজনীর বিয়ের চিন্তা করছো?”

স্ত্রীর দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন জাহিদ। শক্ত গলায় উত্তর দেয়,
_”আমার মেয়ে ও, তাই ওর ব্যপারে সিদ্ধান্ত ও আমিই নেবো।”

দর্শন বুকে হাত গুঁজে বলে,
_”মানতে কষ্ট হচ্ছে নাকি মামু? কিছুই করার নেই,তোমারই মেয়ে। কিন্তু তাই বলে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে যার তার সঙ্গে বিয়ে দিতে চাইবে তা তো হতে পারেনা।”

_”যার তার সঙ্গে কে বললো? এমন বড়লোক বাড়ির প্রস্তাব ভবিষ্যৎ এ পাবো কিনা সন্দেহ।”

কঠিন হলেন আফিয়া,শক্ত গলায় উত্তরে বললেন,
_”বড়লোক হোক আর যাই হোক, মেয়েকে আমি এই বয়সে কোনো ভাবেই বিয়ে দিতে দেবোনা।”

আঙুল উঁচিয়েও তা নামিয়ে নেন জাহিদ,তিনি জানতেন আফিয়া রাজি হবেনা। তাকে জোর করে রাজি করানোও কোনো ব্যাপার না, তবে দর্শনের সামনে তিনি কিছুই করতে পারছেন না। যত যাই হোক, এই ছেলে শুধু মুখে কথা বলবে তেমন নয়, কাজেও করে দেখাতে পারে। তাই এই মুহূর্তে কথা বাড়াতে চাইলেন না তিনি, নিঃশব্দে চলে গেলেন সিঁড়ির দিকে। দর্শন পিছন থেকে বলে উঠলো,
_”যাচ্ছো যাও, কিন্তু নেক্সট টাইম এমন কথা শুনলে কিন্তু আমি বলতে আসবোনা..”

জাহিদের সঙ্গে তার মা হালিমাও চলে গেলেন। মাহমুদা সব কথার মাঝে নিরব দর্শক হিসেবেই রইলেন। ভাইয়ের সংসার, সেখানে তার কথা বলার কোনো ইচ্ছেও নেই।
আফিয়া মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে সোফায় বসে পরলেন, দর্শন না এলে জাহিদ ঠিকই কোনোভাবে তাকে রাজি হতে বাধ্য করতো। দর্শনের কথা মাথায় আসতেই আফিয়া তার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন,
_”কিন্তু দর্শন, তুমি কি করে জানলে এসব?”

দর্শন নিজের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ঘরের দিকে যেতে যেতে বললো,
_”সেটা জানতে হবেনা। যেকোনো ভাবেই হোক, জানতে যে পেরেছি এটাই বড় ব্যাপার।”

আর পিছনে ফিরে তাকালো না দর্শন। অনেক তাড়াহুড়ো করে কুয়াকাটা থেকে ফিরেছে, বর্তমানে সাওয়ার নেওয়া অতিমাত্রায় প্রয়োজন তার জন্য।

____
_”সারাদিন বইয়ের মধ্যেই ঢুকে থাকবি?”

ঘড়িতে দুপুর ৩ টের কাছাকাছি সময়। বিছানায় হেলান দিয়ে বসেছিলো রজনী,হাতে তার গল্পের বই। দর্শনের কণ্ঠ শুনে বইটা নামিয়ে নিলো সে, ততক্ষণে দর্শন বিছানার অন্যপাশে এসে বসেছে।
রজনী বইটা বন্ধ করে সোজা হয়ে বসে বললো,
_”তো, কি করবো?”

_”কাজের অভাব আছে দুনিয়ায়?”
সোজাসাপ্টা উত্তর দিলো দর্শন। রজনীও তেমনভাবেই বললো,
_”বই পড়ার চেয়ে ভালো কাজ দুটো নেই।”

দর্শন কিছু বলার আগেই রজনী পুনরায় প্রশ্ন করলো,
_”তুমি এত তাড়াতাড়ি চলে এলে কেনো?”

ফোনে কিছু টাইপ করতে করতে দর্শন উত্তর দিলো,
_”টপ সিক্রেট..”

উঠে দাঁড়ালো দর্শন। মেসেজটা পাঠিয়ে দিয়ে ফোন পকেটে রেখে বললো,
_”পাঁচটায় পড়াবো,গ্রুপ এও জানিয়ে দিয়েছি। চলে আসিস।”

_”আজই পড়াবে?”

_”হুম, এসেই যখন পরেছি তখন আর বন্ধ দেবো কেনো। প্যারা নাই, পড়া নেবোনা আজ।”

_”তার জন্য না, পড়া তো আগেই শেষ হয়ে গেছে। এমনি জিজ্ঞেস করলাম।”

_”আচ্ছা।”

দর্শন দরজার দিকে পা বাড়াতেই রজনী বলে ওঠে,
_”দর্শন ভাই, একটা কথা বলি?”

ঘাড় ঘুরিয়ে রজনীর দিকে তাকালো দর্শন। হাতে থাকা ঘড়ির দিকে নজর দিয়ে বললো,
_”পরে বলিস? বেরোবো এখন..”

রজনী বিরক্তির ভাব নিয়ে বুকে হাত গুঁজে বলে,
_”এমন বুক ফুলিয়ে চললে, যেন কতো মহান কাজ করতে যাচ্ছো তুমি! ভাবো একটু,এগুলো খাওয়া ভালো না।”

_”আরেহ.. কতো কিছুই তো ভালো না। যেমন প্রেমে পরাও তো ভালো না,তবুও মানুষ প্রেমে পরবেই। তাহলে তোরা এই একটা জিনিস এর দিকেই নজর দিস কেন?”

_”কিসের সাথে কিসের তুলনা!”

হাসলো দর্শন,বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। ড্রইং রুমের দিকে যেতেই জাহিদের সঙ্গে দেখা হয় তার। জাহিদকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই পিছন থেকে তিনি বলে ওঠেন,
_”দাড়াও,আমার কথা আছে তোমার সঙ্গে..”

#চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে