সেই মেয়েটি আমি নই
১১ পর্ব
লেখা: জবরুল ইসলাম
বিনোদিনী আর তুষার বিব্রতবোধ করছে৷ এরকম পরিবেশে ঠিক কি করতে হয় তারা বুঝতে পারছে না।
ইশতিয়াক বের হয়ে যাওয়ার পর বিনোদিনী আমতা-আমতা করে বললো,
– ‘আন্টি আপুর সাথে কি একটু কথা বলতে পারি? উনার সঙ্গে কথা বলে আমরা চলে যাব।’
হুস্না বেগমের মেয়েটিকে ভীষণ ভালো লাগছে। কিন্তু এমন একসময় দেখা হয়েছে যখন মন-মেজাজ কিছুই ভালো নেই। তিনি যথাসম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক অবস্থায় এনে বললেন,
– ‘রহিমা যা তো, গিয়ে তোর আপাকে বল আসতে। বলিস ইশতিয়াক চলে গেছে।’
রহিমা তুলির দরজায় গিয়ে আবার নক করে। তুলি দরজা খুলতেই সে অনেকটা ইশতিয়াকের পক্ষ নিয়েই যেন বললো,
– ‘খালাম্মা দুলাভাইকে তাড়িয়ে দিয়েছে আপা। আর কত গালাগালি যে করলো। শেষে ঘর থেকে না গেলে জুতা দিয়েও মারতে বলছিল৷ তাই দুলাভাই চুপচাপ চলে গেছে। আহারে দেইখা আমার কান্না চইলা আসছিল আপা।’
কথাগুলো শুনে তুলি গিয়ে বিছানায় মুখ ঢেকে বসে কান্নায় কেঁপে কেঁপে উঠে। রহিমা এগিয়ে এসে কাঁধে হাত দিয়ে বললো,
– ‘হায় আল্লাহ আপা কাঁদতাছো কেন? আপনেই না বইলা আইলেন বাসা থেকে বাইর কইরা দিতে।’
তুলি কোনো জবাব দিল না৷ রহিমা ছুটে গেল সিটিং রুমে।
– ‘খালাম্মা দুলাভাইকে বাইর কইরা দিছো শুনে তো আপা কাঁদতাছে।’
– ‘কি বলিস।
– ‘হ দেইখা যান নিজের চউক্ষে।’
রহিমা বেগম তুলির রুমে এলেন৷ তুলি সত্যি সত্যি মুখ ঢেকে কাঁদছে।
– ‘কিরে মা, তুই না বললি বাসা থেকে বের করে দিতে?’
তুলি মুখ তুলে বললো,
– ‘তাই বলে এভাবে বের করে দেবে? মানুষের সামনে গালাগালি করবে? তাও জুতোপেটা করতে বলছো।’
– ‘আচ্ছা মা চল। ওরা অপেক্ষা করছে তোর সঙ্গে কথা বলবে। দেখেছিস মেয়েটা একদম তোর মতো দেখতে।’
তুলি চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়ায়। মেয়েটির সঙ্গে ওর নিজেরও কথা বলতে ইচ্ছা করছে। সিটিং রুমে এসে ওদের সামনের সোফায় বসে৷ তুষার আমতা-আমতা করে বললো,
– ‘আসলে আপু আমি খুবই লজ্জিত আমার কারণে এতবড় একটা ঝামেলা হয়ে গেল..।’
তুলি থামিয়ে দিয়ে বললো,
– ‘এসব বাদ দেন আমার কপালে যা ছিল তাই হয়েছে। আপনাদের কথা বলুন। অবশেষে তাকে পেলেন।’
– ‘জি আপু, পার্কে দেখা হওয়ার পরই ওর কল আসে।’
– ‘তাই না-কি? আর আপনি কোথায় লুকাইছিলেন উনাকে রেখে।’
বিনোদিনী মিষ্টি করে হেঁসে বললো,
– ‘আমি লুকাইনি, বন্দী ছিলাম বলা চলে। আজ পালিয়ে এলাম ওর সঙ্গে।’
– ‘ও আচ্ছা তাই? বন্দী কেন?’
– ‘আমাদের দুই পরিবারই মানছে না আপু তাই।’
– ‘তো এখন কি করবেন?’
– ‘এখন আমি আলাদা কোথাও থাকবো। আর সে তার ফুপুর বাসায় আছে। এই মাসে নতুন বাসা দেখবো আর আগামী মাসেই বিয়ে করে নিব।’
– ‘সন্ধ্যা তো হয়েই যাচ্ছে। কোথায় থাকবেন ঠিক হয়নি?’
তুষার ব্যস্ত হয়ে বললো,
– ‘হ্যাঁ, এটাই সে বুঝতে পারছে না। আজই এসেছি, ডায়রেক্ট এদিকে চলে এলো।’
তুলির ইচ্ছা হলো বলে আমাদের এখানেই আপাতত থাকুক। কিন্তু অচেনা কোনো মেয়েকে বলা কি ঠিক হবে? আর অচেনা হলেও তো তারা দু’জন একইরকম দেখতে। কণ্ঠও অবিকল একইরকম। বড়ো আপন আপন লাগছে। হুস্না বেগম এলেন চা-নাশতা নিয়ে। তুলি আমতা-আমতা করে বললেন,
– ‘ও আজ আমাদের সঙ্গেই থাকুক। পালিয়ে ঢাকা এসে কোথায় থাকবে সেটা না ভেবে আমাদের ঝামেলা ঠিক করতে চলে এসেছে।’
হুস্না বেগম যেন খুশিই হলেন। ঝামেলার মাঝে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলা হয়নি। ওর পরিচয় জানা দরকার৷ কত কথা বলতে ইচ্ছা করছে। আজ ওকে নিজের বিছানায়ই রাখবেন। তুলি আবার ওর কাছে নিতে চাইলে রাখতে পারবেন না। তাতেও সমস্যা নেই৷ দরকার হয় ঘুমানোর আগপর্যন্ত ওদের রুমে থাকবেন।
– ‘নাও মা চা নাও। তোমার নাম যেন কি?’
– ‘বিনোদিনী।’
– ‘বাহ সুন্দর নাম।’
নাশতা করার পর তুলি তুষারকে বললো,
– ‘তাহলে আপনি চলে যান। সে আপাতত থাকুক। আপনি ওদিক গুছিয়ে নিন। আর আরেকটা কথা। আমি পার্কে ভ্যানিটিব্যাগ ফেলে চলে এসেছিলাম৷ রহিমাকে পাঠানোর পর গিয়ে পায়নি। দেখেছিলেন কোথাও?’
– ‘আরে ওটা আমার কাছেই আছে। আমি পার্কে অপেক্ষা করছিলাম। তখন ওর কল আসে। তাই বাসায় ভ্যানিটিব্যাগ রেখে চলে গেলাম। যাইহোক কাল সন্ধ্যায় নিয়ে আসবো।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
সে হুস্না বেগমকে সালাম দিয়ে বাইরে গেল। খানিক পর বিনোদিনীর মোবাইলে তুষারের কাছ থেকে মেসেজ আসে,
– ‘ওদেরকে আগ বাড়িয়ে তুমি হিন্দু বলতে যেও না। আপাতত এখানে থাকতে পারলেই ভালো৷’
বিনোদিনী মেসেজ দেখে মুচকি হেঁসে তুলিকে বললো,
– ‘আমি তো হিন্দু, আপনাদের কোনো সমস্যা হবে না?’
তুলি আর হুস্না বেগম মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছেন৷ তুলি বললো,
– ‘আরে না কোনো সমস্যা নেই৷ তবে আপনার সমস্যা থাকলে আলাদা রুম দিয়ে দেবো।’
– ‘না আপু আমার কোনো সমস্যা নেই।’
হিন্দু শুনে হুস্না বেগমের মুখটা মলিন হয়ে গেল। উনার ক্ষীণ আশা ছিল এই মেয়ে কলি না হলেও আত্মীয় কেউ হতে পারে৷ তবুও তিনি বিনোদিনীর পাশে গিয়ে বসলেন।
– ‘তোমার বাড়ি কোথায় মা?’
– ‘সিলেট।’
– ‘সিলেট কোথায়?’
– ‘কোমলগঞ্জ, জগন্নাথপুর।’
হুস্না এবং তুলি একজন আরেকজনের দিকে অবাক চোখ তাকাচ্ছেন। তুলি ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
– ‘আমার নানাবাড়ি রাণীগঞ্জ। কোমলগঞ্জের পাশে।’
হুস্না বেগম তাড়াতাড়ি উঠে গেলেন উনার রুমে। ছুটে এলেন একটা ছবি নিয়ে।
– ‘এই দেখো মা এটা হচ্ছে কলি আর তুলির ছোটবেলার ছবি। দু’জন জমজ ছিল। ১৯৯৮ এ ওদের নিয়ে বাবার বাড়ি থেকে লঞ্চে ফিরছিলাম। তখন লঞ্চ দূর্ঘটনা হয়। তখন আমরা তিনজন বেঁচে যাই। কিন্তু কলিকে পাওয়াই যায়নি। বড়ো হলে অবিকল তোমার মতো হতো আমার কলি।’
বিনোদিনী উনার চোখের দিকে তাকায়। যেন উনি চাচ্ছেন কলি বলুক আমি আপনার হারিয়ে যাওয়া সেই মেয়েটি। বিনোদিনী আমতা-আমতা করে বললো,
– ‘তখন আমরা কোমলগঞ্জ ছিলাম না। আব্বা কোমলগঞ্জ মাস্টারি করতেন। আমরা চাচার সঙ্গে সিলেট থাকতাম।’
তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
– ‘ও আচ্ছা।’
এতো বছর এই ঘরে কলিকে নিয়ে আলাপ-আলোচনা বন্ধ ছিল। কলি একটা আক্ষেপের নাম। হুস্না বেগম বহু বছর প্রায় পাগল ছিলেন। তাই কেউই কলির আলোচনা করতো না। খানিক পর কলিংবেল বেজে উঠলো। হুস্না বেগম গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। মুহিব খান এসেছেন। তিনি ফ্রেশ হওয়ার আগেই টেনে নিয়ে এলেন সিটিং রুমে। তুলি আর বিনোদিনীকে এক সঙ্গে দেখে বিস্মিত হয়ে গেলেন।
– ‘আমার বাবা।’
বিনোদিনী সালাম দিল। হুস্না বেগম চোখের জল মুছে বললেন,
– ‘ও আমার আরেক মেয়ে। কিছুদিন এখানে থাকবে। তুমি ফ্রেশ হও গিয়ে।’
মুহিব খান পরিবেশ বুঝতে পেরে বললেন,
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি।’
বিনোদিনীর সবার সঙ্গে মিলে-মিশে গল্প-গুজব করে সন্ধ্যা কাটিয়ে দেয়৷ রাতে থাকে তুলির সঙ্গেই। ভোরে সবাই নাশতা করছেন। মুহিব খান বাইরে যাবেন। তখনই কলিংবেল বেজে উঠলো৷ রহিমা গিয়ে দরজা খুলতেই সে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলো।
বিনোদিনী একটু সিটিং রুমে আসো। কিছু জরুরি কথা আছে৷ আর এই নিন তুলির আপুর ব্যাগ।
বিনোদিনী চেয়ার থেকে উঠে বললো,
– ‘কি হয়েছে?’
তুলি বললো,
– ‘যান সমস্যা নেই, সিটিং রুমে গিয়ে শুনে আসুন।’
বিনোদিনী বিব্রতবোধ করছে। মুহিব খান নিশ্চয় বিরক্ত হচ্ছেন বাইরের মানুষের আনাগোনা দেখে। তারা সিটিং রুমে গেল৷
– ‘কি হয়েছে?’
– ‘তোমার ফোন বন্ধ পাচ্ছি, স্যার কি কল দিয়েছিলেন আমি যাওয়ার পর?’
– ‘না আমি সন্ধ্যার সময় নিজেই ফোন অফ করে রেখেছি। দিনে মাঝে মাঝে অন করেছিলাম।’
– ‘মনে হয় তোমাকে না পেয়ে স্যার রাতে আমাকে কল দিয়েছিলেন।’
– ‘কি বললেন?’
– ‘তুমি শান্ত হয়ে বসো, বলছি।’
– ‘হ্যাঁ বলো।’
– ‘স্যার প্রথমে বললেন বিনোদিনী নিশ্চয় তোমার কাছেই আছে। তাতে কোনো সমস্যা নেই বাবা। আমার বা বিনোদিনীর মায়ের তোমার সঙ্গে বিয়ে দিতে কখনও বাঁধা ছিল না। সমস্যা হলো গ্রামের হিন্দু এবং মুসলিম সম্প্রদায়। তাছাড়া তোমার পরিবার বিনোদিনীকে মানছে না। এই অবস্থায় আমি কিভাবে মেয়ে বিয়ে দেবো? এভাবে তো সে সুখী হবে না। যাইহোক, তোমরা যখন পালিয়ে চলে গেছো। এখন একটা কথা বলি। তোমার পরিবারকে বলো ও হিন্দু না। আমাদের সন্তানই না বিনোদিনী৷ আমি দরকার হয় ওর পরিবারের সন্ধান বের করে দেবো। তবুও দেখো তোমার পরিবার মেনে নেয় কি-না৷ এরকম বাড়ি-ঘর ছাড়া পালিয়ে পালিয়ে তোমরা সুখী হবে না বাবা। আমি চাই বিনোদিনী সুখে থাকুক। এতদিন যে কথাগুলো গোপন রেখেছি। আজ ওর সুখের জন্য বলছি৷ আর তোমাদের ঠিকানা দাও৷ আমি আর ওর মা আসবো। আমরা নিজেই দাঁড়িয়ে বিয়ে দেবো তোমাদের।’
বিনোদিনী সোফায় দুই হাতে কপাল চেপে ধরে বসে আছে। এগুলো কি শুনছে সে! তাহলে ওর বাবা-মা কোথায়? কোনোভাবে কি তুলি তার আপন বোন? এতো কাকতালীয় ঘটনা ঘটছে কেন? কোনো স্বপ্ন দেখছে না-কি নাট্যমঞ্চে অভিনয় করছে? তুষার তার পিঠে হাত রেখে বললো,
– ‘এখন কি করবো?’
তুলি চোখ তুলে বললো,
– ‘তুমি আব্বুকে কল দাও, দিয়ে জিজ্ঞেস করো আমাকে কিভাবে পেয়েছিল। লঞ্চ ডুবিতে কি-না।’
– ‘তা কেন?’
– ‘তুমি জিজ্ঞেস করো।’
– ‘তুমি কথা বলো।’
– ‘না তুমিই কথা বলো।’
তুষার কল দেয়৷ একবার রিং হয়ে কেটে এলো। আবার কল দিতেই সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ হলো।
– ‘হ্যালো।’
– ‘তুমি কেন কল দিছো?’
তুষার বিনোদিনীকে বললো,
– ‘আন্টি।’
– ‘জিজ্ঞেস করো তাকে।’
– ‘আন্টি বিনোদিনীকে আপনারা কিভাবে পেয়েছিলেন? কোনো লঞ্চডুবিতে না-কি?’
ওপাশে হাউমাউ করে কান্না ভেসে এলো৷
– ‘খুঁজে পাব কেন? ও আমার মেয়ে। তোমরা ওকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চাচ্ছ…।’
কথা শেষ হওয়ার আগেই ফোন যেন কেউ ছিনিয়ে নিল।
– ‘হ্যাঁ বলো তুষার।’
গলা শুনে সে বুঝলো স্যার। সালাম দিয়ে বললো,
– ‘আসলে কল দিয়েছিলাম একটা বিষয় জানতে। কোনো সমস্যা না থাকলে আমাকে কি বলবেন ওকে ঠিক কিভাবে পেয়েছিলেন?’
– ‘কোনো সমস্যা নেই বাবা। আমি নিজেই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেবো ওর বাবা-মায়ের সন্ধানে। ওরা নিশ্চয় এখনও বেঁচে আছেন। কোমলগঞ্জের পাশে একবার লঞ্চ ডুবেছিল। সেখানে আমি ওকে উদ্ধার করে সিলেট নিয়ে চলে এসেছিলাম। কারণ আমাদের কোনো সন্তান হবে না ডাক্তারই বলে দিয়েছিল। এদিকে তোমার আন্টি একটা সন্তানের জন্য পাগল প্রায়। তাই আমি সুযোগ পেয়ে এই কাজটা করেছিলাম। আর ওর বাবা-মা তখন নদীতে জ্বাল ফেলেও ওকে খুঁজে পায়নি৷ যাইহোক সবকিছু আমি নিজেই বলবো এসে বাবা।’
ফোন লাউডস্পিকারে থাকায় বিনোদিনী সবকিছু শুনে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
– ‘বলো বিজ্ঞাপন দেয়া লাগবে না। তারা আগে ঢাকায় আসুক।’
– ‘কি বলো?’
– ‘যা বলছি তা করো।’
তুষার ওর কথা মতো বললো,
– ‘বিজ্ঞাপন দেয়া লাগবে না স্যার। আমি ঠিকানা দিচ্ছি আপনারা চলে আসুন।’
– ‘বাবা বিনোদিনী কথা বলছে না কেন?’
– ‘এমনিতেই স্যার, সেইই বলছে বিজ্ঞাপন না দিয়ে এখানে আসতে।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
অতি উৎসুক রহিমা আগেই দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। তুষার হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে আলাদা রুমে নিয়ে মেয়েটিকে কি বলবে তা না শুনে থাকা রহিমার পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু লাইডস্পিকারে থাকায় সে যা শুনেছে তারজন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। কথাগুলো শুনে ছুটে গেল নাশতার টেবিলে।
– ‘খালাম্মা আমি শুনছি ওরা কলে কথা কইতাছে। মাইয়াটা মনে অয় আমাদের ছোট আপা। ওর আব্বা কলে বইলা দিছে উনাকে তারা লঞ্চ ডুবছিল তখন পাইছে।’
– ‘কি বলিস আবোল-তাবোল কথা।’
– ‘হ্যাঁ খালাম্মা, আপনি গিয়া জিগান।’
তারা ছুটে গেল সিটিং রুমের দিকে। বিনোদিনী দুই হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে।
হুস্না বেগম তুষারের দিকে গিয়ে বললেন,
– ‘বাবা সত্য করে বলো তো ওকে না-কি ওর বাবা লঞ্চডুবিতে পেয়েছিলেন?’
সে আমতা-আমতা করে বললো,
– ‘জি, ওর বাবা একটু আগেই বললেন এই কথা।’
– ‘কখন কোথায় লঞ্চ ডুবি হয়েছিল?’
বিনোদিনী সোফা থেকে উঠে জড়িয়ে ধরলো গিয়ে হুস্না বেগমকে।
– ‘আমিই আপনার কলি মা। ওরা কোমলগঞ্জ লঞ্চডুবিতে পেয়েছে আমায়। তাও ছোট্ট শিশু তখন। তারমানে ১৯৯৮ সালে।’
তুলি মুহিব খান সবাই বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে আছেন। ভাগ্য কলিকে কিভাবে ফিরিয়ে এনে দিয়েছে৷ মুহিব খান চোখের জল আর ধরে রাখতে পারলেন না। কলি আর হুস্না বেগমকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
– ‘হুস্না আজ আমাদের বড়ো আনন্দের দিন। আমাদের এতো বছরের কান্না, আহাজারি আল্লাহ-তায়ালা শুনেছেন। আর এই লঞ্চ ডুবেছিল একেবারে কিনারায়। কারও কোনো ক্ষয় ক্ষতি হয়নি। এমনকি তুমি তুলিকে নিয়ে উঠে গেলে। আমি বাবা হয়ে কলিকে রাখতে পারিনি। আমার হাত থেকে কিভাবে পানিতে হারিয়ে গেল। আমি কখনও নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনি।’
তুষার অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কি হচ্ছে কিছুই যেন বুঝতে পারছে না। বিনোদিনী কি তাহলে তাদের সন্তান? কিভাবে কি হয়েছে? তবে যেরকমই হোক, এখন আর বিনোদিনীকে বিয়ে করতে ওর পরিবারের বাঁধা থাকবে না।
খানিক পরেই রহিমা হুস্না বেগমের মোবাইল নিয়ে এলো।
– ‘খালাম্মা ফোন আইছে আপনার।’
তুলি সোফায় বসে একা একা মুখ ঢেকে কাঁদছে। হারানো বোনকে অপ্রত্যাশিতভাবে খুঁজে পাওয়ার আনন্দাশ্রু। হুস্না বেগম নাম্বার দেখে ফোন রিসিভ করলেন না।
কলি বললো,
– ‘কার কল?’
– ‘তুলির শ্বাশুড়ি।’
কলি শাসানোর ভঙ্গিতে বললো,
– ‘দেখো মা, কাল বাইরের মেয়ে ছিলাম তাই কিছু বলিনি। তুমি দুলাভাইয়ের সঙ্গে কিন্তু বাড়াবাড়ি করেছো। জানো উনি রেস্তোরাঁয় বলেছে, ‘লজ্জা লাগছে তুলির সামনে দাঁড়াতে, আমার মতো নোংরা মানুষের সঙ্গে তুলি আর সংসার করুক আমি তা চাই না, এখন আমার উচিত গাড়ির নিচে পড়ে আ’ত্মহত্যা করা।’ তারপর আমিই টেনে এনেছি। আর তুমি কি-না যাচ্ছে-তাই ব্যবহার করেছো। এখন কল রিসিভ করে সুন্দর করে কথা বলবে। রিসিভ করো।’
হুস্না বেগম কলির মুখে ‘মা’ ডাক শুনে অভিভূত হয়ে গেলেন। ওর কথামতো ফোন রিসিভ করলেন তিনি।
– ‘হ্যালো।’
ওপাশে অস্থির গলা,
– ‘একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেছে৷ ইশতিয়াক গতকাল আমাদের ওখানে এসে কাঁদতে কাঁদতে বললো তুলির কোনো দোষ নেই। সে ভুল বুঝে ওর গায়ে হাত তুলেছে। আমি তাকে বললাম আচ্ছা আমি আর তার বাবা গিয়ে কথা বলে সব ঠিকঠাক করে নিব। কিন্তু আজ সকালে ওর রুমে গিয়ে দেখি রক্ত ফ্লোর ভেসে যাচ্ছে। ওর দুই-হাত ব্লেড দিয়ে ফালিফালি করে ফেলেছে। অজ্ঞান অবস্থায় আমরা হসপিটাল নিয়ে এসেছি। দোয়া করবেন আমার ছেলেটার জন্য। আর পারলে তুলিকে পাঠাবেন বুঝিয়ে। ছেলেটা নিজের ভুল বুঝতে পেরে গতকাল অনেক কেঁদেছে।’
– ‘কোন হসপিটাল?’
তুলি হসপিটাল শুনেই মাথা তুলে তাকায়। হুস্না বেগম হসপিটালের নাম শুনে ফোন রাখেন। মুহিব খান বললেন,
– ‘কি হয়েছে?’
তিনি আমতা-আমতা করে বললেন,
– ‘ইশতিয়াক হসপিটাল।’
___চলবে__