সূর্যস্নান পর্ব-১০

0
1113

#সূর্যস্নান
#পর্ব_১০
#Nishat_Tasnim_Nishi

চিকিৎসা করার পর,ডাক্তার সবকিছুর টেস্ট করতে বলেন,সব টেস্টের রিপোর্ট,, অনুযায়ী আমি এবং আমার বাবু সুস্থ আছি। এই আপুটিকে যখন ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম তখন উনি বললেন,,

–” যদি তুমি কিছু মনে না করো তাহলে কী আমি জানতে পারি যে তুমি বাচ্চা টা নিয়ে এতটা কনসার্ন কেনো না মানে তুমি বাচ্চা সুস্থ না জানা পর্যন্ত বাড়ীতে ফোন দিয়েও জানাচ্ছো না তাই আর কি! কৌতুহল। ”

আমি মিষ্টি হেসে বলেছি,,” অনেক বড় কাহিনী আমার লাইফের,বলতে সময় লাগবে,!”

উনি তখন বলেছেন,”ব্যাপার না, আমি ফ্রি আছি,!”

আমি কয়েক মুহূর্ত ভেবে ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি দিলাম।তারপর উনি পাশের কফি শপে নিয়ে আসলেন আর এতক্ষণ পর্যন্ত কাহিনী শুনলেন। এতকিছুর মধ্যে হঠাৎ মাথায় এলো এতক্ষণ পর্যন্ত তো উনার নাম টাই জানা হলো না,! ইশশ রে,উনি জানি কী ভাববেন,! একটু ইনিয়ে বিনিয়ে উনাকে সরাসরি বললাম,,

–“ইয়ে মানে আপু,আমি তো এখনও আপনার নামটাই জানলাম না,!”

আমার কথা শুনে আপুটি ভারী অবাক হলেন,সেটা প্রকাশ না করেই বললেন,,

—” মাহমুদা সুলতানা সাথী আমার নাম।তুমি সাথী বলতে পারো,!”

আমি অসম্মতি জানিয়ে বললাম,,”উহু,আমি সাথী আপু বলবো,!”

সাথী আপু ফিক করে হেসে বললেন,,”আচ্ছা,বইলো।এখন, পরে কী হয়েছিলো সেটা বলো প্লিজ,!”

আপুর উত্তেজনা দেখে প্রচুর হাসি পাচ্ছিলো,তবুও কোনোরকম হাসি আটকিয়ে নিলাম।

—“ইয়ে আপু,আমি কী বলতেছিলাম সেটা তো ভুলেই গিয়েছি,!”

–“বিয়ের কথা বলতেছিলা,তোমার বাবা তিনদিনের মধ্যে নাকি ঘরোয়া আয়োজন করেছেন,এরপর থেকে বলো,!”

এদিক-ওদিক তাকিয়ে আমি মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললাম,,”ও,হ্যা আপু,মনে পড়েছে।”

বাবা আমার মতামত শুনার পর তিনদিনের মধ্যেই ঘরোয়া আয়োজন করেন। বলে রাখি এ তিনদিনের মধ্যে আমি ঘর থেকে একবারও বাহির হয় নি,উনার ঠিক করা পরিবারের সামনে এক হাত লম্বা ঘোমটা দিয়ে বসিয়ে দেন আমার আম্মু,!

বড় ঘোমটার কারনে সামনের কাউকে দেখতে পাচ্ছিলাম না আর আমার দেখারও ইচ্ছে ছিলো না।মনের অবস্থার কথা আর না ই বললাম,! সেই মুহূর্ত টা বোধহয় আমার জন্য সবচেয়ে অসহায়ের ছিলো, একদম কষ্টের ছিলো,!প্রথম বিয়ের একবছর না হতেই দ্বিতীয় বিয়ে, বিষয়টা কেমন ছিলো সেটা তো বুঝেনই!

কেঁদে কেঁদে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছিলাম,তাই আর সামনের কারো দিকে তাকাই নি।তাই বলে কী সময় আমার জন্য থেমেছিলো,একদম না, যথাসময়ে যথারীতিতে বিয়েটা সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিলো। বিয়ে হওয়ার সাথে সাথে আম্মু আমাকে রুমে নিয়ে আসে,আর আমাকে বলে দেয় আজকে নাকি আমার ঘরে নাকি থাকবে। আম্মু চলে যেতেই আমি আবারো সাদা জামা-কাপড় গুলো পরে ফেললাম।

খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হতেই আমার রুমে প্রবেশ করলেন আমার সদ্য বিবাহিত স্বামী,যাকে দেখে আমি একটু নয় বরং আকাশ সমান চমকে গিয়েছি।মুখ দিয়ে অস্ফুটসুরে বেরিয়ে এলো,”আয়ান” শব্দ।

তখনই আয়ান মাথা হেলিয়ে হ্যা বলে দরজা টা লাগিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে আমার বুকের ধুকধুকানিও বেড়ে যায়,! হাত-পা কাঁপতে লাগলো,কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগলো। আসলে তখন আমাকে কেমন রিয়েক্ট করতে হবে সেটাই ভুলে গিয়েছিলাম,!

আয়ান একপলক আমার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো,এতক্ষণ মুখে হাসি লেগে থাকলেও এখন মুখটা ফ্যাকাশে লাগছে। উনি কেমন গম্ভীর সুরে বললেন,,

—“সাদা কাপড় পরেছো,কেনো?”

এতক্ষণে আমার সম্মতি ফিরলো,আমি জামা টা আরেকটু টেনে বললাম,,
—“জানেন না,কেনো পরেছি?বিধবা দের তো সাদা জামা ই পরতে হয়,!”

আয়ান থমথমে মুখে আমার দিকে তাকালো,কিছু বলতে যেয়েও বললেন না। উনি বিছানার দিকে আসতেছিলেন তখনই আমি বললাম,,
—“আমাকে কেনো বিয়ে করেছেন?করুণা দেখাচ্ছেন?”

উনি সেখানেই পা থামিয়ে দিলেন,আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন।আমি আবারো বললাম,,

—“কেনো করেছেন আমাকে বিয়ে,বলেন? আমি কারো করুনার পাত্রি হয়ে থাকতে চাই না,!”

উনি এমন ভান করলেন যেনো আমার কথাটা ই শুনেন নি,আমার পাশে ওসে বিছানায় ঠাস করে শুয়ে পড়ে বললো,,

—“ভেবেছিলাম আলাদা ঘুমাবো,তোমাকে কিছু দিন সময় দিবো। কিন্তু তুমি পটরপটর করে সব ভেসতে দিলে,আমি এখানেই ঘুমাবো। তাও তোমাকে জড়িয়ে ধরে কারন হলো তুমি আমার বাসর রাতে সাদা জামা পরেছো তাই।”

এ কথা বলে উনি জোর করে আমাকে ঝাপটে ধরে শুয়ে পড়লেন,!আকস্মিক বিষয়ে আমি হতভম্ভ,!আমি যে নড়চড় করবো সেটার সুযোগও রাখেন নি,রাগে শরীর রি রি করতে লাগলো। দাতে দাত চেঁপে বললাম,,

—“ভালো হচ্ছে না ছেড়ে দেন নাহলে আমি চেঁচিয়ে কিছু একটা করে ফেলবো।”

উনি আমার মুখের সামনে মুখ এনে ফু দিলেন সাথে সাথে আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। মুখ ঘুরিয়ে নিতেই কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন,,

—“তুমি যদি এমন করো তাহলে আমি তোমার মুখ বন্ধ করে দিবো তাও বিদেশি ছবিগুলোর মতো ,বুঝোই তো আমি কিসের কথা বলছি।তাছাড়া এতে আমার ই লাভ বাসর রাতে অন্তত উপস থাকতে হবে না!তাই কিছু করার আগে ভেবো দেখো,ঠিক আছে?”

আমি সাথে সাথে ঠোঁট চেপে ধরলাম,ছিঃ কি লুচ্ছা! উনি ভ্রু নাচিয়ে ঠোঁট চেপে দুষ্ট হাসলেন। আমি নাক-মুখ ছিটকে উল্টো দিকে ফিরে শুয়ে পড়লাম। উনি যে কতটা খারাপ সেটা আগে থেকেই জানা আছে,! আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে উনারর সাথে কীভাবে আমার বিয়ে টা হলো,আর উনি কীভাবে মেনেজ করলো।কিন্তু মুখ ফুটে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না।

কিছুক্ষণ পর খুক খুক করে কাশতে লাগলাম,নাকে যেনো কিসের গন্ধ আসতেছিলো,! ঘাড় ঘুরিয়ে উল্টো দিকে তাকাতেই দেখলাম আয়ান বিছানায় পা দুলিয়ে বসে সিগারেট খাচ্ছে,স্বচক্ষে বিষয়টা দেখতেই চোখ বড় বড় হয়ে আসলো। আমাকে কাশতে শুনে হয়তো উনার সম্মতি ফিরলো,দ্রুত হাতের সিগারেট টা মেঝেতে ফেলে পা দিয়ে পিশে দিলেন। আমারর দিকে তাকিয়ে কেমন অপরাধী কন্ঠ বললেন,,

—“সরি,সরি তোমার কথা ভুলে গিয়েছিলাম,!আসলে আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে তো তাই,বকতে পারবে না অভ্যাস টা কিন্তু তুমি ই করিয়েছো!”

আমি স্থির দৃষ্টিতে তাকালাম,কিছু বলতে গিয়ে বলতে পারলাম না।কেমন যেনো গলায় সব আটকে যাচ্ছিলো,! জোরপূর্বক দুচোখের পাতা এক করলাম,নিঃশব্দে চোখের পানি ছেড়ে দিলাম। নিজেও জানি এ চোখের পানি কিসের,!

সকালের চকচকে এক ফালি রোদ মুখের উপর পড়তেই ঘুম টা ভেঙ্গে গেলো,আদৌ আদৌ আোখ মেলেতেই দেখলাম আমি কারো বুকের সাথে মিশে আছি,!কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো বিষয়টা বুঝতে,!

বিষয়টা বুঝতেই এত রাগ লাগলো যে বলে বোঝাতে পারবো না। রেগে জোরে ধাক্কা দিয়ে উনাকে সরিয়ে দিলাম,উনি ঘুমঘুম চোখে আমার দিকে তাকাতেই যা নয় তা শুনিয়ে দিলাম। উনার ক্যারেক্টার নিয়ে কথা বলে ফেললাম,! মুহূর্তেই রাগে উনার মুখটা লাল বর্ণ ধারন করলো,!আমাকে বিছানার সাথে চেপে ধরে বললেন,,

—“আর একটা কথা বললে তোমার গাল লাল করে ফেলবো,!আই সোয়ার তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলে এতক্ষণে দাত ভেঙ্গে দিতাম,!”

উনার ধমকি শুনে ভয় পেয়ে গেলাম তবুও সেটা বিন্দুমাত্র প্রকাশ করলাম না।
কয়েক সেকেন্ড পার হতেই উনি নিজে নিজে শান্ত হয়ে গেলেন,চোখদুটো বন্ধ করে জোরে শ্বাস নিলেন।চোখ বন্ধ রেখেই বললেন,,

—“মাঝরাতে তোমার কান্না শুনে ঘুম ভেঙ্গে যায়,আমি বারবার তোমাকে ডাকতে লাগলাম কিন্তু তুমি কোনো সাড়া দেও নি।শুধু নিদ্র নিদ্র বলে কান্না করতেছিলে,!এরপর নিজেই আমাকে নিদ্র যেও না বলে জড়িয়ে ধরেছিলে। শেষ রাত অবধি আমার বুক কেঁদে ভাসিয়ে দিয়েছিলে,!”

ব্যাস এটুকু বলেই উনি আমাকে ধাক্কা মেরে উঠে চলে গিয়েছিলেন আর আমি হতভম্ভ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। সেদিন সকালের দিকে উনি আমাকে নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন ঢাকার উদ্দেশ্যে, কারন উনি তো ঢাকাতে থাকবেন তাই আমাকেও ঢাকাতে নিয়ে যাচ্ছেন। এ কথা টা উনি বলেছিলেন,কিন্তু আমি যতটুকু জানি সেটা হলো বিষয়টা মোটেও এমন না। উনার ফ্যামেলির কোনো মেম্বার ই আমাকে মেনে নেয় নি,উনি হয়তো জোরপূর্বক সবাইকে রাজি করিয়ে বিয়ে করেছেন।

চলে আসার সময় বাবা-মা অনেক আদেশ-উপদেশ দিলেন, আমি মাথা নিচু করে সব শুনলাম। ঢাকায় আসার পর আমার শুরু হয়েছিলো আমার জীবনের এক নতুন অধ্যায় যা আমার আগের জীবনকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিলো।একদম ফ্যান্টাসি টাইপ জীবন হয়ে গিয়েছিলো আমার। লাইফের ধূসর রং উড়ে গিয়ে রঙিন রং ঠাই করে নিয়েছিলো। সেখানে যাওয়ার প্রথম,,,

.
.
.
.
.
চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে