সূর্যস্নান পর্ব-০৯

0
1018

#সূর্যস্নান
#পর্ব_০৯
#Nishat_Tasnim_Nishi

সবচেয়ে অবাক করার বিষয় কী ছিলো জানো?
দাদীশাশুড়ী আমাকে মেনে নিয়েছিলো। উনি নিজেই আমার যত্ন করতেন,আমি তো অবাকের শেষ প্রান্তে ছিলাম। উনি আমাকে উনার সাথে রাখতেন। বাবাকে বারণ করার পর যখন আমি একা একা বসে কান্না করছিলাম তখন উনি আমার ঘরে প্রবেশ করেছিলেন। সেদিন ই উনি বুঝেছিলেন আমি সত্যিই নিদ্রকে ভালোবাসি।

উনি আমাকে উনার রুমে শিফ্ট করিয়ে নেন,সবসময় আমি উনার আশেপাশে থাকতাম। মাঝরাতে যখন কান্না করতাম তখন উনি জেগে যেতেন,আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতেন। উনার এমন বিহেভিয়ার দেখে আমি তো অবাক ছিলাম পরে কাজের মেয়ের থেকে জানতে পারি যে উনি নাকি এমনই,,!!

আমার প্রিয় একজন মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন উনি,প্রথম প্রথম যেমন ব্যবহার করতো তারপর আর তেমন করে নি উল্টো আমার প্রতি সবার থেকে বেশি কনসার্ন ছিলো। ওখানে যাওয়ার চার মাস দশ দিনের দিন উনি আমাকে উনার রুমে ডাকলেন,আমি যেতেই ইশারায় বিছানায় বসতে বললেন।
দাদী পান চিবুতে চিবুতে বললেন,
—“নাতবৌ,,!”
—“জ্বি,দাদী!”
–“কাল সকালবেলা রেডী হইয়া থাইকো!”
আমি ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি দিলাম,বলে রাখি আমি উনাকে ভয় পাই তাই আর কারন জিজ্ঞেস করি নাই। রাত্রেই সব গুছিয়ে রাখার আদেশ দিলেন দাদী,!

সকালবেলা দাদী আমাকে সাথে কইরা রওনা দিলেন,আমি তখনও জানতাম না কোথায় যাচ্ছি।এ কয়েক মাসে কথাটা বলাটাও লিমিটেশনে নিয়ে এসেছিলাম তাই আর কিছু জিজ্ঞেস করি নি। নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে তো আমি অবাক এটা তো গ্যাস ফিল্ড,!

আমি দাদীর দিকে একবার তাকালাম,দাদী এমন রিয়েক্ট করেছেন যেনো উনি জানতেন আমি এমন রিয়েক্টই করতাম! আমাদের বাসার কলিংবেল এ চাপ দিয়ে দিয়েছেন দাদী,পাশেই কাঁচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে আছি আমি। আমার বাসার সিরিয়াল জিজ্ঞেস করতেই আমি অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসলাম!সাথে সাথে উনি চোখ বড় করে তাকালেন,এরপর আমি চুপচাপ বাসা দেখিয়ে দিলাম।

দ্বিতীয়বার কলিংবেল চাপতেই কোমরে শাড়ীর আঁচল গুজে, হাতে খুন্তি নিয়ে এসে দরজা খুলে দিলেন আমার মা। দেখেই বুঝা যাচ্ছে মাত্রই রান্নাঘর থেকে এসেছে,মুখ টা কেমন শুকিয়ে আছে দীর্ঘদিন যাবৎ না খেয়ে থাকলে যেমন দেখায় ঠিক তেমন দেখাচ্ছে মা কে!

আমাদের দেখে উনি অবাক হয়ে গিয়েছেন,অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে অস্ফুটসুরে আমার নাম উচ্চারণ করলেন। আমি দাদীর পিছনে যেতেই দাদী আমার হাত ধরে বললেন,,”সালাম দাও,!”

আমি ক্ষীণ কন্ঠে মা কে সালাম দিলাম,মা সালামের জবাব নিতেই চোখের কোনে অশ্রু কণা ছলছল করে উঠলো,! আমাদের ভেতরে আসার জন্য ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন,দাদী আমার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসলেন। দাদীকে আপ্যায়নের জন্য মা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন!পাশের ঘর থেকে বাবা আওয়াজ করে মা কে ডাক দিয়ে বললেন,,”কে এসেছে?”

মা কাপা কাপা গলায় বললেন,,”এসে দেখে যাও!!” বাবা খবরের কাগজ হাতে নিয়ে চশমা টা ঠিক করতে করতে ড্রয়িংরুমের দিকে আসলেন। দাদীকে দেখে বাবা চমকে গেলেন, বোরকা পরে আপাতমস্তক ঢেকে রাখার কারনে উনি আমাকে চিনতে পারেন নি। আমি মিনিমিন গলায় বাবাকে সালাম দিলাম, উনি একটু চমকে আমার নাম উচ্চারণ করলেন। আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম জ্বি,বাবা তড়িঘড়ি এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।

বাবার চোখে পানি চিকচিক করছে,আর আমার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো। মিনিটখানেক আমাদের মধ্যে অনুভূতির মিশ্রণ বিনিময় হলো। দাদী আর বাবা কথাবার্তা শুরু করতে নিচ্ছিলেন তখনই আম্মু বললেন পরে সব হবে আগে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা খেয়ে নিন। মা-বাবা তো আপ্যায়নের কোনো কমতি রাখেন নি। দুজনে মিলে দাদীর জন্য সবকিছুর ব্যবস্থা করলেন।

ইতোমধ্যে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে এলো,!দাদী সোফায় বসে আছেন,উনার সামনেই বসে আছেন আব্বু-আম্মু আর আমি এক কোনায় দাড়িয়ে আছি। দাদী স্বাভাবিকভাবে বললেন,,”সেদিন তো আপনি আমার কথা রেখেছেন তাই আজ আমি আমার কথা রাখতে এসেছি!”

বাবা মাথা নাড়িয়ে বললো,”জ্বি,!”

উনারা কথোপকথন চালু রাখলেন আর আমি অবাক হয়ে উনাদের কথা শুনছি,কী বলছেন উনারা! অনেক্ষণ পর উনাদের কথাবার্তা শুনে বুঝলাম যে সেদিন দাদী বাবাকে বলেছিলেন যে চারমাস দশদিন পর দাদী নিজে আমাকে বাড়ীতে দিয়ে যাবেন।

সকল-আলাপ আলোচনা শেষে দাদী বললেন,,”আপনারা নাতবৌ এর দ্বিতীয় বিয়ে দিতে পারেন, এতে আমাদের কারো আপত্তি নেই।” বাবা-মা এর মুখে তখন কাঙ্ক্ষিত হাসির রেখা দেখলাম।উনারা যেনো এ কথাই শুনতে চেয়েছিলেন!

(আদ্র বিবাহিত ছিলো,আর সিনথিয়া ওর বউ ছিলো।বিষয়টা আমি ভুলে গিয়েছিলাম, দুঃখিত!যারা বিষয়টা মন্তব্য করে বলেছেন তাদেরকে জানাই অসম্ভব ধন্যবাদ )

রাতে দাদীর পাশে শুয়েছিলাম, দাদী নাকি কাল চলে সকালে চলে যাবেন তাই আমি জোর করে দাদীকে আমাদের ফ্লাটে রেখে দিয়েছি আর ইনার সাথেই ঘুমানোর ব্যবস্থা করেছি। নিদ্রের পুরো পরিবার তো সেদিন আঙ্কেলের সাথে গ্যাস ফিল্ড চলে এসেছিলেন শুধু আমিই সেখানে রয়ে গিয়েছিলাম।

দাদী হুট করে বললেন,,”আমার যখন দশ বছর তখন বিয়ে হয়েছিলো,স্বামী-সংসার কী তা আদৌ বুঝতাম না। আমার ছোট ছেলের বয়স যখন আট তখন ওর বাবা মারা যায়,আমার পুরো পরিবার তখন আমাকে আবারো বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলো।আমি তখন সরাসরি না করে দেই কারন আমার তখন পাঁচটা বাচ্চা রয়েছে।

ওদের দিকে তাকিয়ে বারন করে দিয়েছিলাম। কিন্তুু তোমার বিষয়টা উল্টো,তুমি কীসের জন্য আবার বিয়ে করতে চাইবে না বলো?আজ যদি তোমার কোনো অবলম্বন থাকতো তাহলে মানা যেতো।কিন্তুু তেমার তো এখনও পুরো জীবন পরে আছে,তুমি কেনো বিয়ে করতে চাইছো না।

বিয়ে টা তোমার জন্য ফরজ তাই জিদ করো না। বাবা-মা কখনো খারাপ চায় না,বিয়েতে রাজি হয়ে যেও।আর আমরা তে আছি যোগাযোগ সবসময়ই থাকবে।” আমি মনোযোগ দিয়ে সব শুনলাম,শুধু এ কথাই ভাবলাম দাদী কীভাবে বুঝলেন যে আমি বিয়ের জন্য রাজি হবো না।

দাদী চলে যাওয়ার দুদিনের মধ্যেই বাবা আমার রুমে আসলেন,এসেই গম্ভীর কন্ঠে বললেন,,”আমি তোমার আবার বিয়ে ঠিক করেছি এতে তোমার কী মতামত?” আমি একপলক বাবার দিকে তাকালাম এরপর মাথা নিচু করে বললাম,,”তুমি যা ভালো মনে করো।” বাবা বিনা আওয়াজে চলে গেলেন।

বাবা বের হতেই আয়নার উপর থাকা আমার প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলাম। এ বুঝি নিয়তি, এখনও এক বছর হয় নি আমার বিয়ের আর এরমধ্যেই দ্বিতীয় বিয়ে। কার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে,কবে ঠিক হয়েছে এর কিছুই আমি জানি না। আর না জানতে চেয়েছিলাম,সেদিন আবারো অনেকদিন পর কেঁদে ছিলাম। পুরো রুম ঘাটাঘাটি করে আমার ফোন টা বের করলাম, ফোনের স্ক্রিন অন করতেই নিদ্রের ছবি ভেসে উঠলো।

নিদ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম,,”কী খুশি তো? আমি কিন্তুু বিয়ে করছি।তুমি না বলেছো এত এত বাচ্চা নিতে, তুমি চিন্তা করো না তোমার আশা পূরন করবো। যা যা বলেছো সব পালন করবো,তুমি কিন্তুু ওপারে আমার জন্য অপেক্ষা করো।আমি শীঘ্রই তোমার কাছে চলে আসবো!” সারা রাত পাগলের মতো নিদ্রের ফটোর সাথে কথা বলেছিলাম,কখন যে ফ্লোরে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম টেরই পাই নি। এখানে আসার পর আমি একবারও ঘর থেকে বের হয় নি,আর না কারো সাথে দেখা করেছিলাম। পুরো গ্যাস ফিল্ডে আমার বিষয়টা জানাজানি হয়ে গিয়েছিলো। বাসায় কেউ আসলে আমি দরজা লাগিয়ে বসে থাকতাম।

তিনদিনের মধ্যেই বাবা ঘরোয়া আয়োজন করলেন কারন আমিই বাবাকে বলেছিলাম একদম নরমালভাবে যেনো বিয়ের ব্যবস্থা করে। আয়নার সামনে দাড়িয়ে সাদা কাপড় ছেড়ে যখন লাল কাপড় গায়ে জড়াচ্ছিলাম তখন বুকের ভেতর হাহাকার করছিলো,কষ্ট টা কী পরিমাণ ছিলো সেটা বলেও বুঝাতে পারবো না।

চোখ দিয়ে টপটপ করে সাদা স্বচ্ছ লবণাক্ত পানি মুক্তোর মতো ঝরছিলো। চোখ বন্ধ করতেই মুখের সামনে নিদ্রের চেহারা ভেসে উঠেছিলো,তখন কলিজা টা মনে হচ্ছিলো ছিড়ে যাচ্ছে। এমন কেনো হয়?আমরা সবসময় সবকিছু যেভাবে চাই সেভাবে কেনো হয় না। কেনো সবকিছুতে ট্রায়াঙ্গেল থাকে!

আমার সম্পূর্ণ কথা শেষ করার আগেই শুভাকাঙ্ক্ষী বলে উঠলো,,”বিয়েটা কী হয়েছিলো?কার সাথে হয়েছিলো?”

আমি মৃদু হেসে বললাম,,”হ্যা আপু হয়েছিলো।না হলে আমি এখন প্রেগন্যান্ট কীভাবে হতাম?”

আপুটি হেসে বললো,,”ও,হ্যা তাই তো।সরি,মিস্টেক হয়ে গিয়েছে!”

আমি ঘাড় হেলিয়ে বললাম, সমস্যা নেই। আমি বলি আপুটির কথা,দশটার সমসয় চেকআপ করানোর জন্য হসপিটালে আসতেছিলাম তখনই ভুলবশত রিক্সার সাথে ধাক্কা খেয়ে নিচে পড়ে যাই,সাথে সাথে হাত ছিলে রক্ত বের হতে লাগলো। পায়েও ব্যথা পেয়েছি,বিভিন্ন জায়গা কেটে যায়। তখন এ আপুটি আমাকে হেল্প করেছিলেন আর রিক্সা ওয়ালাকে আচ্ছামতো ধোলাই দিয়েছিলেন। এরপর উনি নিজে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন চিকিৎসার জন্য,আমি আপুটিকে বারবার বলেছি আপু আমার বাচ্চার যাতে কিছু না হয়।
প্রাথমিক চিকিৎসা করার পর,ডাক্তার সবকিছুর টেস্ট করতে বলেন,সব টেস্টের রিপোর্ট,,,

.
.
.
.
.
চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে