সূর্যস্নান পর্ব-০১

0
1606

#সূর্যস্নান
#Nishat_Tasnim_Nishi
পর্ব_১

আঠারো বছরের জন্মদিনে বাবার দেওয়া উপহার দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছি।আমি একবার উপহারের দিকে তাকাচ্ছি আরেকবার বাবার দিকে তাকাচ্ছি। এতক্ষণের হাসিখুশিতে মেতে থাকা মন টা মুহূর্তেই বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেলো।চোখ দুটো বলছে যা দেখছি ভুল,কিন্তুু মষ্তিষ্ক বলছে সঠিক। চোখ জ্বালা করে উঠলো,বুঝলাম চোখ দিয়ে এখন বৃষ্টিপাত হবে। খুব চেষ্টা করে চোখের পানি আটকালাম।হার্টবিটের গতিবেগগুলো দ্রুত হতে লাগলো।

একটু আগে বাবার কাছে গিফ্ট চাইতেই বাবা আমার হাতে একটা কার্ড ধরিয়ে দিলেন।আমি ভ্রু দুটো কুচকে,চোখ এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে বললাম,,”এটাতে কী আছে?”

বাবা হেসে বললেন,,,”খুলে দেখো।”

আমি অনেক আগ্রহ নিয়ে খুলে দেখলাম,, খুব সুন্দর করে একটা কার্ড র্র‍্যাপিং করা। আমি হাসিমুখে খুলে দেখতেই দেখলাম বিয়ের কার্ড।
বিয়ের কার্ড দেখে আমার হাত কাঁপতে লাগলো,কাপা কাপা হাতে পড়তেই দেখলাম খুব সুন্দর করে বড় বড় করে লিখা।

কনে,ফাহমিদা খানম দোলন।বর,আয়ান মেহবুব খান।

বরের নাম দেখেই আমার হাসিখুশি মুখ চুপসে গেলো। আমি টলমল চোখে আয়ান ভাইয়ার দিকে তাকালাম,উনি ভাবলেশহীন ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি উনার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিদ্র ভাইয়ার দিকে তাকালাম। নিদ্র ভাইয়ার চোখে তেমন কোনে পরিবর্তন দেখলাম না। উনি খুশি না বেজার ঠিক বুঝলাম না।উনি এমন কেনো? নিদ্র ভাইয়া আর আয়ান ভাইয়া এক জায়গায় দাড়িয়ে থাকায় কেউ ঠিক বুঝতে পারছে না আমি কার দিকে তাকিয়ে আছি।সবাই ভাবছে আমি আয়ান ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছি কিন্তু না আমি অপলক দৃষ্টিতে নিদ্র ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। কেমন ধম বন্ধকর ফিলিংস হচ্ছে! আচ্ছা,উনি কী আমার ফিলিংস বুঝে না? কেনো বুঝে না,উনার পরিবর্তে আমি হলে তো মুহূর্তেই বুঝতাম।উনি আমাকে বোকা বলে অথচ আমার কাছে উনাকে সবচেয়ে বোকা মনে হয়।উনি কি সব বুঝেও না বুঝার ভান করছেন?

২.

এদিকে নিদ্রভাইয়ার পরিবার আমার আর আয়ান ভাইয়ার পরিবারকে কোলাকুলি করে কংগ্রেস করছে।আমার কাছে তা বিষের মতো লাগছে।নিদ্র ভাইয়ারা আমাদের ফ্লাটের উপরতলায় অর্থাৎ পাঁচতলায় থাকেন আর আয়ান ভাইয়ারা নিচের তলায়।আর আমরা চারতলায় থাকি। এই তিন পরিবার একে অপরের বন্ধু।সরকারী চাকরি হওয়ার পর আব্বু যখন এখানে এসেছিলেন তখনই উনাদের দুই পরিবারের সাথে পরিচয় আর সেই থেকেই বন্ধুত্ব। বিশ বছর থেকে উনাদের বন্ধুত্ব,অর্থাৎ আমার জন্মেরও আগে থেকে। পুরো গ্যাস ফিল্ডে উনাদের বন্ধুত্বের চর্চা করা হয়।অবাক করার বিষয় হলো যে যতবার উনাদের প্রমোশন হয় আর বদলি হয় তখনই উনারা একই ফ্ল্যাটে শিফ্ট হন। এ বিষয় নিয়ে উনাদের কিছু বললে হেসে উড়িয়ে দিতেন। নিদ্র ভাইয়ারা দুই ভাই,উনি আর আদ্র ভাইয়া,,উনাদের কোনো মেয়ে না থাকায় উনার আম্মু আমাকে খুব আদর করতেন আর আমিও উনাদের বাসায় সুযোগ পেলেই দৌড় দিতাম।আদ্র ভাইয়া আমাকে বোনের মতো আদর করে আর উনার বউ অর্থাৎ সিনথিয়া ভাবি তো সারাদিন নূপুর নূপুর ই করে।নূপুর আমার নিকনেইম,যদিও আসল নাম ফাহমিদা খানম দোলন তবুও সবাই নূপুর বলেই ডাকে।শুধুমাত্র নিদ্র ভাইয়া ছাড়া,উনি আমাকে দোলনা বলেন।সবসময় বলতেন এই দোলনা এদিকে আয় একটু দোল খাই, আমি তখন রেগে, লজ্জায় সরে আসতাম।এই লোকটাকে আমি খুব বেশি পছন্দ করি, তবে সেটা উনি আদৌ বুঝেন কি না জানি না।আমাকে দেখলেই উনি রূপকথার কাহিনি শুনানো স্টার্ট করে দেয়।এই তো মাস দুয়েক আগের কথা,ছাদ থেকে কাপড় নিয়ে আসার সময় ভুলবশত সিনথিয়া ভাবির জামা নিয়ে আসি,আমি ওটা ভাবিকে দিয়ে ফিরে আসার সময় নিদ্র ভাইয়া আমাকে ডাক দিলেন।আমি অত্যন্ত খুশি হয়ে গেলাম,পরনের ওড়নার কোনা মুচড়াতে মুচড়াতে একরাশ লজ্জা নিয়ে উনার রুমে গেলাম।উনি আমাকে বসিয়ে বললে আজ একটা কাহিনী বলবো শুন,আমিও অতি মনোযোগ দিয়ে শুনার প্রস্তুতি নিতেই উনি সিনড্রেলার কাহিনী বলা শুরু করলেন।আমি হতভম্ভ হয়ে বললাম,,”এটা সিনড্রেলার গল্প।” উনি তখন একটু কিটকিটে হেসে বললেন,,”হ্যা,সিনড্রেলার গল্পই তো।আরে তোর তো এখন এসব গল্প শুনার বয়স তাই আর কি শুনালাম।বুচ্ছিস তোর বয়সের বাচ্চাদের রাজারানির কাহিনী গুলো অনেক ভালো লাগে,তাই,,” উনার পুরো কথা শেষ হওয়ার আগে আমি দুপদাপ পা ফেলে রুম থেকে বের হয়ে আসলাম।এক প্রকার দৌড়েই রুমে এসে কান্না করতে লাগলাম,,উনি আমাকে এত ছোট ভাবে যে রাজারানির কাহিনী শুনাচ্ছেন!উনি কী বুঝেন না আমার কষ্ট লাগে,খুব খারাপ লাগে। উনি কেনো আমাকে বাচ্চা বলবে,আমি কি এতই ছোট উনার কাছে!সেদিন মনের ভেতরের হাহাকার আর নিশ্বাসেরর শব্দ ছাড়া আর কিছুর আওয়াজ শুনা যায় নি।এরপর থেকে উনি যখনই আমাকে দেখবেন তখনই রুপকথার কাহিনী শুনানোর কথা বলবেন। এ নিয়ে আমি কেঁদে কেঁদে উনার আম্মুকে সব বলে দিয়েছি।তখন আন্টি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,,”কেঁদো না,মামুনি। আসলে ছোট থেকেই ওর শখ ছিলো ওর বোনকে কোলে নিয়ে রুপকথার কাহিনী শুনাবে,ওর তো কোনো বোন নেই তাই তোমাকে শুনায়।ও তো তোমাকে নিজের বোনের মতো ভাবে তাই তো এমন করে।আচ্ছা তুমি কেঁদো না আমি ওকে বারন করে দিবো।” আন্টির কথা শুনে কান্নার বেগ দ্বিগুন হয়ে গেলো,নিদ্র ভাইয়া আমাকে বোন মনে করেন!কেনো যেনো এ বিষয়টা মানতে পারলাম না। উনি কেনো আমাকে বোন মনে করবেন,হোয়াই?আর কেউ কী নেই? আমি নিজেও বুঝতাম না কেনো আমি এমন করতাম,কেনো মানতে পারতাম না। ছোট থেকেই এক ধরনের আলাদা টান অনুভব হয় উনার প্রতি।উনাকে দেখলে হার্টবিট অস্বাভাবিক হতো,বারবার তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে।উনি যখন হাসে তখন গালের নিচে গর্ত হয়ে যায়, আর আমার সেই মুহূর্ত টা খুব বেশি ভালো লাগে।ইচ্ছা করে টুপটুপ করে গালে চুমু দিয়ে দেই।কিন্তু চুমু তো দূর উনার দিকে তিন সেকেন্ডের বেশি তাকালে উনি এমনভাবে তাকান যে দ্বিতীয়বার তাকানোরই সাহস পাই না। উনি না সবার সাথে একদম স্বাভাবিক আর খুব সুন্দর করে কথা বলে।কিন্তুু আমার সাথে কেমন রোবটের মতো আচরন করে। যা আমাকে খুব পুড়ায়। খুব কষ্ট হয় উনি আমার সাথে এমন করে কেনো?একদিন ছাদ থেকে নামার সময় সামনের দিকে না তাকিয়ে হাটতেছিলাম,হঠাৎ উনার সাথে ধাক্কা খেয়ে নিচে পড়ে যাই,উনি তখন আমাকে বাতাসি বলে ক্ষেপিয়ে হাসতে হাসতে চলে যান।আমি লজ্জায় অপমানে সেখানে বসেই কেঁদে দেই।
উনার সাথে আমি আরো অনেক অস্বাভাবিক কান্ড বাঁধিয়েছি, তা অন্যদিন বলবো।

৩.
আয়ান ভাইয়াদের সাথে আমাদের পরিবারের সম্পর্কটা একটু বেশিই আপন।উনাদের সাথে সম্পর্কটা বেশি ভালো হওয়ার কারনে,ছোটবেলায় আমার উনাদের বাসায় বেশি যাওয়াআসা হতো।কিন্তু একটু বয়স হতেই আমি উনাদের বাসায় যাওয়ার কথা শুনলে পায়ে ব্যাথা বলে শুয়ে থাকতাম।এর কারন টাও উনি নিজে,ছোটবেলায় আমার আর আরুশির সাথে অনেক খেলাধুলা করতেন,আমি একটু বড় হতেই উনি কেমন উদ্ভট বিহেভ করতেন।এরপর আমি গেলেই বকে পড়তে পাঠিয়ে দিতেন,আরো কত কাহিনী করতেন। আয়ান ভাইয়ারা তিন ভাইবোন।সবার বড় অনন্যা এরপর আয়ান ভাইয়া আর উনার ছোট আরশি।আরুশি প্রায় আমার সমবয়সী। আমার আব্বু যখন অসুস্থ থাকতেন আরুশির আব্বু প্রায়ই আব্বুর ডিউটি করে দিতেন। অনন্যা আপুর বিয়ে হয়েছে বছর চারেক আগে,উনার একটা ছোট্ট কিউট বপবীও আছে।উনি উনার স্বামীর বাড়ীতেই থাকেন,মাঝে মাঝে এখানে আসেন। আর আয়ান ভাইয়া উনার কথা বলতে গেলে মনের ভেতর তিক্ততা আর কপালে এক রাশ বিরক্তি ফুটে ওঠে। উনাকে আমার একটুও পছন্দ নয়, কারন ছাড়াই পছন্দ নয়।উনার প্রত্যেক টা জিনিসই আমার কাছে দোষের মনে হয়। উনি সবমসময় একদম গম্ভীর থাকেন,উনি দেখতে যে বাজে তা কিন্তুু নয়। বরং গ্যাস ফিল্ডের প্রত্যেক টা মেয়ে উনার উপর ক্রাশড্, কত মেয়ে উনার পিছনে পরে থাকে। গ্যাস ফিল্ডে উনার গুনগান ছাড়া কিছুই শুনা যায় না।সব দিক দিয়ে উনি পারদর্শী, পড়ালেখা তে তো মাশাল্লাহ।কি এক ব্রেইন তার, সব কিছুতেই ফার্স্ট ক্লাস থাকে।উনি ঢাবির বুয়েটে পড়াশুনা করছেন। উনার আরো অনেক গুন আছে যা বলে শেষ করা যাবে না। উনাকে দেখতে না পারার কারন হলো,ছোট বেলা থেকেই উনাকে পছন্দ নয়। আমি যখন নিচে খেলতে যেতাম তখন উনি সবার সামনে আমাকে বকে, ধমকিয়ে পাঠিয়ে দিতেন। আমাকে দেখলেই উনি শুধু বকাবকি করতেন।শীতের সময় রাতের বেলায় যখন প্রত্যেক বিল্ডিং এর মেয়েরা নিচে নামতো ব্যাডমিন্টন খেলতে তখন আমিও নিচে যেতাম।কিন্তুু আয়ান ভাইয়া আমাকে দেখেই বকে উপরে পাঠিয়ে দিতেন। আমার তখন রাগ হতো, ভয়ংকর রাগ হতো।কে না কে আবার আমাকে বকে!ইচ্ছে করতো ঠাটিয়ে দুইটা থাপ্পর দেই। কিন্তু সেটা তো করা সম্ভব নয়,তবে এর পরিবর্তে অন্য কিছু করি যার ফলে কলিজায় অন্যরকম শান্তি পাই। উনি যখন আমাকে কিছু করে বা বকে তখন আমি চুপচাপ ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দেই।এরপর কাগজ বের করে উনার নাম টা অতি যত্নসহকারে লিখি তারপর আগুন জ্বালিয়ে সেটা পুড়িয়ে দেয়।আহ কি শান্তি!কী যে ভালো লাগে,নিজেই নিজের কান্ড দেখে হেসে ফেলতাম।উনাদের পরিবারেরও প্রত্যেকটা মানুষের আলাদা আলাদা কাহিনী রয়েছে পরে সুযোগ পেলে বলবো।

৪.
আমার ভাবনা চিন্তার মাঝে তখন আম্মু এসে আমার হাতে একটা আংটি দিলেন,এরপর আমাকে সবার আড়ালে কানে কানে ফিসফিস করে বললেন,,”জামাইকে পড়িয়ে দিস।”

আমি চোখ বড়বড় করে বললাম,,”মানে কী?”

আম্মু একটু হাসলেন,হাসি মুখেই বললেন,,”আসলে আজকে তোর আর আয়ানের এংগেইজমেন্ট। এই উপলক্ষেই তো এত আয়োজন।”

আম্মুর কথা শুনে আমার মুখ অটোমেটিকলি হা হয়ে গেলো।বিয়ের কার্ডে তো মাস দুয়েক পর বিয়ের পরে বিয়ের তারিখ দেওয়া।তাহলে আজকে কেনো এংগেইজমেন্ট করাবেন? হোয়াট দ্যা হেল,আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো আমি জানি এখন আবার আংটি পরাবেন।এসব কী ধরনের কথা।মনে মনে হাজার কথা বললেও মুখে টু শব্দ করলাম না, কারন হলো বাবা।আমি বাবার বাধ্যগত সন্তান,উনি যা বলেন সেটাই করি।উনাকে অনেক টা ভয় পাই,তাই তো উনার কথার উপর কোনো কথা বলতাম না। কিন্তুু আজ কেনো যেনো মুখ ফুটে বলতে ইচ্ছে করছে।জানি বলতে পারবো না,আর এত গেস্টের সামনে বাবা অপমানিত হোক সেটা আমি চাই না। এদিকে আরশি আপু আয়ান ভাইয়াকে টেনে আমার সামনে দাড় করালেন। আপু উনার হাতে একটা আংটি দিয়ে বললেন পরিয়ে দিতে।আমি সামনের দিকে না তাকিয়ে বুঝতে পারছি যে উনি কেমন হেসিটেইট ফিল করছেন। উনি ইতস্ত করে বললেন,,

—-“নূপুর তোমার হাত টা দেও।”

.

চলবে?
.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে